Ajker Patrika

বাবা-ছেলের দখল-বাণিজ্য, দলীয় নেতারাও আক্রান্ত

শাহীন রহমান, পাবনা 
Thumbnail image

ক্ষমতায় থাকার সময় জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার ও পাবনা-১ (বেড়া-সাঁথিয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) শামসুল হক টুকু এবং তাঁর ছেলে বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আসিফ শামস রঞ্জন দখলদারত্বের রাজত্ব চালিয়েছেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নৌবন্দর দখল, হুরাসাগর নদ ও আশপাশে শতাধিক বিঘা জমি দখল, নদ থেকে কয়েক কোটি টাকার বালু-বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন বাবা-ছেলে। এমনকি মামলা দিয়ে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করেছেন বলে এখন মুখ খুলছেন আওয়ামী লীগের একসময়ের নেতারাই।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শামসুল হক টুকু গ্রেপ্তার হন। আর তাঁর ছেলে রঞ্জন আত্মগোপনে আছেন। টুকুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।

দলীয় নেতা-কর্মী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেড়া পৌর সদরের বৃশালিখা মহল্লায় ১০ বছর আগেও আধা পাকা বাড়ি ছিল টুকুর। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। এর কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি করেন টুকু। তবে ৫ আগস্টের পর পোড়া বাড়িতে পরিণত হয়েছে সেই অট্টালিকা।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নথি সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রী হওয়ার পর টুকুর নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানদের নামেও সম্পদ বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করে ১৬১ কোটি টাকা অবৈধ আয়ের প্রমাণ পেয়েছিল দুদক। তবে পরে রহস্যজনক কারণে দুদকের সেই মামলা আর এগোয়নি।

দলের নেতা-কর্মীরাই বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টুকু তাঁর বড় ছেলে আসিফ সামস রঞ্জনকে বানিয়েছিলেন বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বেড়া পৌরসভার মেয়র। রঞ্জনের ছিল ভিওআইপি ব্যবসা।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, ভিওআইপি ব্যবসায় প্রায় ১৯২ কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগে রঞ্জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সেই মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও তা গোপন ছিল ৩৩ মাস। পরে সেটি প্রকাশ পেলে গত জুলাইয়ে তিনি আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেন।

সম্প্রতি টুকুর এলাকায় গেলে দেখা যায়, সুইমিংপুল বানানোর জন্য টুকুর বাড়ির সামনে ইছামতী নদী ভরাট করা হয়েছে। স্থানীয়রা জানান, ক্ষমতার শেষ দিকে সুইমিংপুলের জন্য কাজ চলছিল। ৫ আগস্টের পর কাজ বন্ধ রয়েছে।

স্থানীয়রা আরও জানান, হুরাসাগর নদ ও তার আশপাশের প্রায় ১০০ একর জমি দখল করেছেন টুকু ও রঞ্জন। সেখানে গড়ে তোলা হয় টুকুর প্রয়াত স্ত্রীর নামে লুৎফর নেসা ট্রাস্ট। এ ছাড়া নদ থেকে কয়েক কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে বিক্রি করতেন রঞ্জন। সরেজমিনে বালুর স্তূপ রাখার চিহ্নও দেখা গেছে।

বেড়া বৃশালিখা কোল ঘাটের (নৌবন্দর) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স বেড়া ট্রান্সপোর্টের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নামে ইজারা বৃশালিখা কোল ঘাটের (নৌবন্দর)। অথচ জোর করে দখল নিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন শামসুল হক টুকু। ক্ষমতার দাপটে বৃশালিখা নৌবন্দরে আমার অফিস ভাঙচুর, লুটপাট করেছিল টুকু ও তাঁর ছেলে রঞ্জনের সন্ত্রাসী বাহিনী।’ তবে সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট এই ঘাট আবার ফেরত পান বলে জানান নজরুল ইসলাম।

বেড়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এনামুল হক শামীম বলেন, ‘হুরাসাগর নদের পাড়ে আমার প্রায় ২০ লাখ টাকার বালুর খামাল (স্তূপ) ছিল। সেটা জোর করে দখলে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে টুকু ও তার ছেলে। প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলা দেয় এবং পুলিশ দিয়ে হয়রানি করে বাড়িছাড়া করেছিল আমাকে।’

বেড়া পৌর এলাকার বাসিন্দা ও বেড়া পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল মান্নান মানু বলেন, ‘নির্বাচন এলেই টুকুর পছন্দের লোক দাঁড়াবে, তাকে জেতাতে হবে, এটাই ছিল নিয়ম। নিজ দলের নেতা-কর্মীরাও তার হাত থেকে রেহাই পাননি। যেমন গত জাতীয় নির্বাচনে আমি টুকুর বিরুদ্ধে অন্য প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর চালিয়েছে। বোমা হামলার মতো মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাকে হয়রানি করেছে।’

বেড়া উপজেলার পায়না গ্রামের বাসিন্দা বিএনপির নেতা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলের একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের বাড়িতে হামলা করে টুকু ও রঞ্জনের সন্ত্রাসী বাহিনী। তারা আমার বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করে। অপরাধ হলো আমি বিএনপি করি। পরে মামলা করতে গেলে তাদের দাপটে পুলিশ আমাদের এজাহার নেয়নি। তাদের ইচ্ছেমতো সাজানো এজাহার তৈরি করেছে। আবার আদালতেও তাদের পছন্দমতো চার্জশিট দিয়েছে। ওই ঘটনায় কোনো আসামি আজও গ্রেপ্তার হয়নি।’

সাঁথিয়া উপজেলার নন্দনপুর গ্রামের বাসিন্দা কালিপদ হালদার বলেন, ‘এখানে একটি সরকারি মৎস্য খামার রয়েছে; যেটি আমি সরকারিভাবে লিজ নিয়ে মাছ চাষ করতাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৫-১৬ বছর আগে টুকুর ছেলে রঞ্জন হুমকি-ধমকি দিয়ে খামারটি দখল করে নেয়। রঞ্জন সেখানে গরুর খামার বানিয়েছিল।’

শামসুল হক টুকু কারাগারে এবং তাঁর ছেলে আসিফ শামস রঞ্জন পলাতক থাকায় তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রঞ্জনের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত