Ajker Patrika

ভেঙে ফেলা হচ্ছে ২০০ বছরের পুরোনো স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
স্মৃতিবিজড়িত একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্মৃতিবিজড়িত একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

ময়মনসিংহ শহরের হরিকিশোর রায়ের ২০০ বছরের পুরোনো স্মৃতিবিজড়িত একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। তাঁর নামানুসারেই রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল হরিকিশোর রায় রোড। বাড়িটি ভেঙে নতুন ভবন করার উদ্যোগ নেয় শিশু একাডেমি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা।

বাড়িটি ভেঙে ফেলায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় তুলছেন নেটিজেনরা।

ময়মনসিংহ সিটি নামক ফেসবুক গ্রুপে মুসরিন আক্তার মিম নামের একজন মন্তব্য করেন, ‘কেন ভাঙল? এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তো প্রিজার্ভ করা উচিত।’ ফাল্গুনি চক্রবর্তী নামের আরেকজন লেখেন, ‘শিশু একাডেমির ক্লাস করতাম এখানে।’ আশিক উজ্জামান নামের আরেকজন মন্তব্য করেন, ‘কী আর বলব, পুরোনো স্থাপনা ময়মনসিংহে আর তেমন কিছুই রইল না। অথচ জমিদারবাড়ির আধিক্যের কারণে ময়মনসিংহ শহরকে বলা হতো জমিদারদের শহর। পুরোনো বিল্ডিংয়ের শহর। আজ সেটা অস্তিত্বের সংকটে। অথচ এই ময়মনসিংহ শহরকে কলকাতার মতো রাজকীয় শহর হিসেবে সাজানো যেত।’

মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, শিশু একাডেমি হিসেবে ব্যবহৃত বাড়িটির সামনের অংশের অর্ধেক ভাঙা। ইটগুলো পড়ে আছে এলোপাতাড়িভাবে। আপাতত ভাঙার কাজ বন্ধ রয়েছে। ভেতরের অংশও বেশির ভাগ ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে কোনো শ্রমিক পাওয়া যায়নি।

লেখকসমাজের মতে, এই বাড়ি শুধু একটি পুরোনো স্থাপনা নয়, এটি বাংলা শিশুসাহিত্যের পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর দত্তক পিতা হরিকিশোর রায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, যা সুকুমার রায় ও অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল।

জানা যায়, ১৯৮৯ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি এই একতলা বাড়িটি ব্যবহার শুরু করে। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় বাড়িটি আগাছায় ছেয়ে যায় এবং মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। বাড়িটি ময়মনসিংহের বিএনপির রাজনৈতিক কার্যালয়ের পাশে অবস্থিত।

বাড়িটি ভাঙার বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন জানান, এ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে গতকাল জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। তিনি জানান, এটি রায় পরিবারের ঐতিহাসিক বাড়ি এবং সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল। যদিও এটি এখনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত নয়, তবে এ বছর নতুন জরিপে এটি তালিকাভুক্ত হতে পারে।

সাবিনা ইয়াসমিন আরও জানান, ‘এ বিষয়ে আজ ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি শিশু একাডেমির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে শতবর্ষী প্রাচীন বাড়িটি ভাঙা মোটেও ঠিক হয়নি তাদের। এই ভবন ঠিক রেখেও নতুন ভবন তৈরি করা যেত।’

ময়মনসিংহ শিশু একাডেমির জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মেহেদী জামান জানান, ২০১০ সালের পর থেকে বাড়িটি ব্যবহার করা যাচ্ছিল না এবং একাডেমির কার্যক্রম ভাড়া বাড়িতে চালানো হচ্ছিল। ঝুঁকি বিবেচনায় একবার মেরামতের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।

মো. মেহেদী জামান আরও বলেন, ‘বর্তমানে যে ভাড়া বাড়িতে আছি, সেখানে প্রতি মাসে ৪৭ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এতে সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তা ছাড়া ভাড়া বাড়িতে শিশুদের কার্যক্রম চালানো কঠিন।’

স্মৃতিবিজড়িত একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা
স্মৃতিবিজড়িত একটি বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছে। ছবি: আজকের পত্রিকা

মো. মেহেদী জামানের মতে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে সব প্রক্রিয়া মেনে স্থাপনাটি ভাঙা হচ্ছে। স্থাপনা ভাঙার কাজটি করছে মেসার্স ময়ূর বিল্ডার্স। ভাঙার কাজ শেষ হলে আপাতত একটি আধা পাকা স্থাপনা হবে এবং পরে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হবে।

ভবনটি রেখে কাজ করা সম্ভব ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মো. মেহেদী জানান, ভবনটি অনেক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। গণপূর্ত অধিদপ্তর এটি নিয়ে আগেই কাজ করে রিপোর্ট দিয়েছে।

লেখক ও কবি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ২০০ বছরের পুরোনো এই স্থাপনার ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষা করে ভবন নির্মাণ করতে পারত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এবং স্থানীয় ইতিহাসবিদেরা যেখানে এর সংরক্ষণ চাইছেন, সেখানে শিশু একাডেমি এটি ভেঙে ফেলছে। সিদ্ধান্তটি মোটেও ঠিক হয়নি। ইতিহাস-ঐতিহ্য এভাবে ধ্বংস করে দিলে এ নগরীর সন্তানেরা কী ধারণা পাবে?

জানা যায়, হরিকিশোর রায় ছিলেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া জমিদারবাড়ির জমিদার। এই জমিদার বংশের আদি কৌলিক পদবি ছিল ‘দেব’, যা পরে ‘রায়’ বা ‘রায়চৌধুরী’ উপাধিতে পরিবর্তিত হয়। হরিকিশোর রায় নিজেই ছিলেন একজন সুপণ্ডিত ও পৃষ্ঠপোষক।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ৫ বছরেরও কম বয়সে তাঁর পিতা কালীনাথ রায়ের জ্ঞাতিভাই হরিকিশোর রায়চৌধুরীর কাছে দত্তক হিসেবে আসেন। হরিকিশোরের আদর-যত্নেই উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। হরিকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন রায় পরিবারের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি এই পরিবারের ইতিহাসে এবং উপেন্দ্রকিশোরের বেড়ে ওঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

ময়মনসিংহরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, শিশু একাডেমি কীভাবে ভবনটি ভেঙে নতুন ভবনের কাজ করবে, তা জানতে তাদের ডেকেছি। কাজপত্র দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বদলির আদেশ ছিঁড়ে বরখাস্ত হলেন এনবিআরের ১৪ কর্মকর্তা

দরপত্র ছাড়াই জুলাই স্মৃতি জাদুঘরের কাজ পেল দুই প্রতিষ্ঠান, এরা কারা

ট্রাকে করে ৪৩ হাজার পৃষ্ঠার নথি ইসিতে জমা দিয়েও নিবন্ধন পেল না এনসিপি

বিধি লঙ্ঘন করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হলেন এনসিপি নেতা

বিমানবন্দর থেকেই ৯৬ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত