Ajker Patrika

পানি সংকটে কুষ্টিয়ায় খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা

দেবাশীষ দত্ত, কুষ্টিয়া
আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৭: ৫৭
পানি সংকটে কুষ্টিয়ায় খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা

কুষ্টিয়ায় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পানির অভাবে জমি ফেটে চৌচির। পুড়ে যাচ্ছে ফসল। কয়েক মাস অনাবাদি পড়ে আছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। জেলাজুড়ে কৃষকদের মধ্যে চলছে পানির জন্য হাহাকার। তীব্র তাপপ্রবাহে ঝরে যাচ্ছে আম ও লিচুর গুটি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে কৃষি বিভাগ। পানি সংকটের সমাধান করা না গেলে আগামী আউশ মৌসুমে ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা নেই।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমি। কিন্তু পানি সংকটের কারণে আবাদ হয়নি প্রায় ৬ হাজার বিঘা জমি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মিরপুর উপজেলায়। সেখানে বোরো মৌসুমে অনাবাদি ছিল ৩ হাজার ৩২২ বিঘা জমি। এ ছাড়া কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ১ হাজার ১২৫ বিঘা ও কুমারখালী উপজেলায় ৭৬৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়নি।

এদিকে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি। কিন্তু পানি সংকটের কারণে আউশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে তাদের হাতে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও জেলার তিন উপজেলায় কয়েক হাজার বিঘা আউশের জমি ফাঁকা পড়ে আছে। দ্রুত পানি সমস্যার সমাধান না হলে এসব জমিতে চাষাবাদ সম্ভব নয়।

সদর উপজেলার জগতি এলাকার কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘২০ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে ধান ও ভুট্টা লাগিয়েছি। জমি চাষাবাদ ও সেচে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন আর টাকা দিলেও পানি যাওয়া যাচ্ছে না। তীব্র তাপপ্রবাহে ভুট্টার গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। ধানের শিষ আসা অবস্থায় গাছ নুয়ে পড়ছে। কিছু গাছে শিষ বের হলে সব চিটা হয়ে যাচ্ছে। ফসল ঘরে তুলতে না পারলে নিঃস্ব হয়ে যাব।’

একদিকে জিকে ক্যানালে পানি নেই, অন্যদিকে পানির স্তর ক্রমশই নিচে নামছে। স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ পাম্প দিয়ে উঠছে না পানি। মাঠের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে আছে অধিকাংশ পাম্প। দীর্ঘদিন নষ্ট হয়ে বন্ধ রয়েছে জিকে প্রকল্পের তিনটি পাম্পই। এ কারণে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে জিকে ক্যানেল। তীব্র তাপপ্রবাহে কোথাও পানির অভাবে মাঠেই পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসল।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ী এলাকার কৃষক ইজাবুল হক বলেন, ‘জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছি। দুই বিঘা জমিতে সবজি ও কলা গাছ রয়েছে। জমির পাশে জিকে ক্যানাল থাকলেও পানি নেই। জমির সঙ্গে বরিং বসিয়েও কাজ হচ্ছে না। স্তর নেমে যাওয়ায় সেখান থেকেও পানি উঠছে না। পানির অভাবে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর কয়েক দিন গেলে সব শুকিয়ে যাবে।’

সদর উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠ ধান শুকিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছু গাছে শিষ বের হলেও চিটা হয়ে যাচ্ছে। বিঘার পর বিঘা ভুট্টা খেত পুড়ে শুকিয়ে গেছে। পানির অভাবে শত শত বিঘার ঢ্যাঁড়স, বেগুন, করলা, ঝিঙে লাল শাক, ডাটা শাকসহ সব সবজি নুয়ে পড়েছে। ফলন্ত এসব ফসলে পানি দিতে না পেরে কৃষকদের মধ্যে চলছে হাহাকার।

তাঁরা বলছেন, টাকা দিয়েও মিলছে না পানি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে ফসল ফলিয়ে তা ঘরে তুলতে পারছেন না। এমন সংকটের তারা আগে কখনো পড়েননি।

পানি সংকটে মাঠ ফেটে চৌচির। ছবি: আজকের পত্রিকাকৃষি বিভাগের তথ্য মতে, বর্তমানে মাঠে সবজিসহ ধান, পাট, ভুট্টা, কলা, আখসহ বিভিন্ন ফসল রয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহে এসব ফসল জমিতেই পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কুষ্টিয়ার কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল বলেন, পানি সংকটের কারণে বোরো আবাদ ব্যাহত হয়েছে। দ্রুত সমস্যার সমাধান করা না গেলে আউশ উৎপাদনেও প্রভাব পড়বে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৃষ্টি না হওয়া এবং তীব্র তাপপ্রবাহে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্তর আশঙ্কাজনক পর্যায়ে নেমে যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। এ বছর পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিন ধরে কুষ্টিয়া অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত রোববার জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তপ্ত এলাকার মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়া অঞ্চল।

শহরেও পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। শহরের হাউজিং এলাকার বাসিন্দা মাহবুব রহমান বলেন, ‘অনেক মানুষে নিজের পয়সায় সাবমারসিবল বসিয়ে পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। একটা সাবমারসিবল বসাতে অর্ধলাখ টাকা খরচ হয়। আমরা পারি না। পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও তীব্র পানি সংকট বিরাজ করছে।’

মিরপুর উপজেলার ধুবইল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সামাদ বলেন, এলাকার মানুষের বড় চিন্তা হয়ে উঠেছে খাওয়ার পানি। পানির অভাবে এলাকাবাসী গরু-ছাগল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

এদিকে কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের কোনো টিউবওয়েলে পানি উঠছে না বলে জানিয়েছেন থানাপাড়া এলাকার বাসিন্দা সেলিম হোসেন। তিনি বলেন, ‘এলাকার টিউবওয়েলে পানি নেই। এক ঘণ্টা চেষ্টা করেও এক বালতি পানি তোলা যাচ্ছে না। এখন প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে পানি এনে খেতে হচ্ছে।’

পানি সংকটে ও তীব্র খরায় পুড়ে গেছে খেতের সবজি। ছবি: আজকের পত্রিকামোল্লাতেঘরিয়া গ্রামের নাসির উদ্দীন বলেন, ‘বাড়ির টিউবওয়েলে ১৭০ ফুট পাইপ বসিয়েছি। এরপরও পানি উঠছে না। মোটর বসানো আছে, সেখানেও পানি উঠছে না। সংকট ভয়াবহ।’

কুষ্টিয়া জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহীম মো. তৈমুর বলেন, ‘জিকে সেচ প্রকল্প বন্ধ এবং আবহাওয়া এখন বেশ উত্তপ্ত। কয়েক সপ্তাহ ধরে খরা চলছে। শুধু পৌর এলাকায় নয়, গ্রামাঞ্চলেও পানির সংকট চলছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। প্রতি বছরই এ সময় পানির স্তর নেমে যায়। বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। তবে প্রতিবছর এক–দুই সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলেও এবার সময়টা বেশি লাগছে।’

চলমান তাপপ্রবাহ ও তীব্র খরার মধ্যে ভূ–গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে অবস্থান করছে। জিকের সব পাম্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি সংকটের মধ্যে পড়েছেন কৃষকেরা। কবেনাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে নিশ্চিত নয়।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় গঙ্গা–কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের পাম্প ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে তিনটি পাম্প বন্ধ রয়েছে। পাম্পগুলো সচল করার চেষ্টা চলছে। কবে নাগাদ সেচ কার্যক্রম চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান বলেন, পানি সংকটের কারণে উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে এ সমস্যা থাকবে না। দু–একদিনের মধ্যে বৃষ্টি হলেই সংকট কেটে যাবে। অন্যদিকে জিকে সেচ প্রকল্প চালু করতেও কাজ চলছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত