Ajker Patrika

আমি কী খাব বলাতে ছেলেরা মারে: শতবর্ষী মায়ের আর্তনাদ

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ২৩: ৫১
আমি কী খাব বলাতে ছেলেরা মারে: শতবর্ষী মায়ের আর্তনাদ

হাপিরুন নেছার বয়স ১০৪ বছর। চলতে-ফিরতে না পারায় সব সময় বিছানায় শুয়ে থাকতে হয় তাঁকে। ১৫ দিন করে ছেলেদের বাসায় থাকেন তিনি। গত বুধবার দুপুরে খাবার খেয়ে উঠে মায়ের খোঁজ না নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন ছেলেরা। এ সময় হাপিরুন তাঁদের বলেন, ‘তোরা খেয়ে নিলি, আমি কি এখন ছাই খাব?’ এ কথা বলতেই হাপিরুনকে মারধর করে রক্তাক্ত করার অভিযোগ উঠেছে দুই ছেলের বিরুদ্ধে। 

ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে হাপিরুন নেছাকে মারধরের ঘটনা ঘটে। তিনি ওই গ্রামের মৃত মঙ্গল মণ্ডলের স্ত্রী। তবে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন হাপিরুনের বড় ছেলে। 

আজ শুক্রবার সকালে হরিশপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, হাপিরুন বর্তমানে ছোট ছেলের বাড়িতে রয়েছেন। ঘরের এক কোণে একটি খাটের ওপর ঘুমিয়ে আছেন তিনি। বাড়ির অন্য সদস্যরা বাইরে বিভিন্ন কাজ করছেন। কথা বলতে চাইলে বাড়ির সদস্যরা বলেন, ‘এখন তাঁর সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তিনি অসুস্থ। ঘুমাচ্ছেন।’ কিছুক্ষণ পর হাপিরুন যন্ত্রণায় কাতরে উঠে অপলক তাকিয়ে থাকেন। তাঁর চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। 

স্থানীয় লোকজন জানান, বিধবা হাপিরুন নেছার তিন ছেলে। ছোট ছেলে ছানোয়ার হোসেন (সেন্টু মন্ডল) ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এক বছর আগে মারা গেছেন। বড় ছেলে ফজলুর রহমান (ঠান্ডু মন্ডল) অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। মেজ ছেলে মানোয়ার হোসেন কৃষিকাজ করেন। ছেলেদের সংসারে পালাক্রমে ১৫ দিন করে থাকেন হাপিরুন। 

বছরখানেক আগে বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে ডান পা ভেঙে যায় হাপিরুনের। হাঁটুর নিচের হাড় ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঝুলে আছে তাঁর। শরীরে বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন রোগ। চলতে-ফিরতেও পারেন না শতবর্ষী এই নারী। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ২৩ বছর আগে। সেই থেকেই হাপিরুন অসহায় জীবনযাপন করছেন বলে জানান স্থানীয় লোকজন। 

হাপিরুন নেছা বলেন, ‘বুধবার দুপুরে আমার বড় ছেলের বাড়িতে মেজ ছেলেসহ পরিবারের সবাই ভাত খাচ্ছে। তাঁরা খেয়ে সবাই চলে যাচ্ছে। আমি খাইনি তখন, আমি বলি, তোরা খেয়ে নিলি। আমি কি এখন ছাই খাব? এ কথা বলায় গালিগালাজ করে তারা। এরপর বড় ছেলে মেজ ছেলেকে বলে, মারিশ না ক্যা মার, তখন তারা ও তাদের বউয়েরা আমাকে আখ দিয়ে মারতে থাকে। এতে আমার হাত-পা কেটে গেছে।’ 

হাপিরুন নেছার বয়স বেশি হওয়ায় চলাফেরা করতে পারেন না বলে জানান প্রতিবেশী জাহানারা। তিনি বলেন, ‘সন্তান হয়ে মাকে মারা—এটা খুবই অপরাধ। মাকে মেরে তাঁরা রক্তাক্ত করেছেন। এটা ঠিক না।’ 

হাপিরুনের ছোট ছেলের বউ বুলবুলি বলেন, ‘ঘটনার দিন বাড়ির পাশে মেম্বারের স্ত্রী দেখেন, আমার শাশুড়ি হামাগুড়ি দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে আসছেন, তাঁর শরীরে রক্ত। এ দেখে আমাকে ডাক দেন। আমার শাশুড়িকে কেউ মেরেছে নাকি সে পড়ে গেছে, এটা আমি বলতে পারছি না।’ 

মারধরের বিষয়ে বড় ছেলে ফজলুর রহমান (ঠান্ডু মন্ডল) বলেন, ‘আমার মাকে আমরা মারিনি। তিনি বিছানা থেকে নিচে পড়ে গিয়ে তাঁর হাত-পা কেটে গেছে। যাঁরা বলছেন, মাকে আমরা মেরেছি, তাঁরা মিথ্যা বলছেন। আর মায়ের বয়স হয়েছে, তাঁর মাথা ঠিক নেই।’ 

আরেক প্রতিবেশী নায়েব আলী বলেন, ‘হাপিরুনের বড় ছেলের বাড়িতে মেজ ছেলেসহ দুপুরের খাবার খাওয়া হচ্ছিল। তখন তিনি ছেলেদেরকে বলেন, “তোরা ভাত খাচ্ছিস, আমাকে একটু ভাত দে। তখন বড় ছেলে বলেছে, আমার ভাত খাওয়া দেখলেই তোর ভাত খাওয়া লাগে? ” এ কথা বলে মাকে বকাঝকা করতে করতে আখ দিয়ে মেরেছেন বড় ছেলে। এতে তাঁর নাক মুখ ও হাত দিয়ে রক্ত বের হয়েছে। ছেলেরা হাপিরুনকে মাঝেমধ্যে বকাঝকা ও মারধর করেন।’ 

মেজ ছেলে মানোয়ার হোসেন বলেন, ‘সংসারে পাঁচজন থাকলে একটু হইচই হলে একজন ধাম করে চড় মারতেই পারে। সংসারে অনেক রকম ঝামেলা হতেই পারে।’ 

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য বসির উদ্দিন বলেন, ‘রক্তাক্ত মাকে দেখতেও আসেননি ছেলেরা। তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেননি তাঁরা। পরে আমি খবর দিয়ে পল্লিচিকিৎসক ডেকে এনে চিকিৎসা করাই।’ মারধরের বিষয়ে কথা বলতে গেলে হাপিরুনের দুই ছেলে দুর্ব্যবহার করেন বলে জানান ইউপি সদস্য। 

জোড়াদহ ইউপির চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম বাবু মিয়া বলেন, ‘খবর পেয়ে আমি সেখানে যাই। চিকিৎসক ডেকে ওই মায়ের চিকিৎসা করাই। অত্যন্ত অমানবিক ঘটনা। ভাত খেতে চাওয়ায় শতবর্ষী মাকে এভাবে মারধর করা খুবই খারাপ কাজ।’ 

এ বিষয়ে হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুস্মিতা সাহা বলেন, ‘সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে বৃদ্ধা বলেন, “আমার সন্তানদের কিছু করবেন না।” এমনকি তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে দিতে চাইলেও তিনি থাকতে রাজি হননি।’ তিনি হাপিরুনের ছেলেদের ডেকে সতর্ক করে দেবেন বলেন জানান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত