Ajker Patrika

বছরের অধিকাংশ সময়ই হাওরের পানিতে ডুবে থাকে বিদ্যালয়টি

তাহিরপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২১, ১৪: ১৬
বছরের অধিকাংশ সময়ই হাওরের পানিতে ডুবে থাকে বিদ্যালয়টি

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার হাওরবেষ্টিত দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘ এক যুগ ধরে যে বিদ্যালয়টি শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে, সেটি হলো তাহিরপুর উপজেলার দ্বিজেন্দ্র বর্মন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের পৈন্ডুপ গ্রামের সম্মুখের এই বিদ্যালয় বছরের অধিকাংশ সময় হাওরের পানিতে ডুবে থাকে। বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হাওরপাড়ের প্রায় আড়াই শ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। 

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র দীপক তালুকদারের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি বর্তমানে উপজেলার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরই শনি হাওর ও হালির হাওরের উত্তাল ঢেউ এবং অকাল বন্যায় বিদ্যালয়ের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে চারপাশ ভেঙে পড়ে। পুনরায় আবার সেগুলো মেরামত করা হয়। এভাবেই ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৩ মে প্রধানমন্ত্রীর উপহারস্বরূপ বিদ্যালয়টিতে তৃতীয় তলার একটি ভবন নির্মাণ করে বিদ্যালয়টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে শুভ উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। 

তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের হাওরপাড়ের গ্রাম পৈন্ডুপ, রামজীবনপুর, রাজধরপুর, সাহেবনগর, উজ্জ্বলপুর, কামদেবপুর, নয়া কামদেবপুর, গোপালপুর মাড়ালা, নয়ানগর, নয়াগাঁও, ইকরামপুর, জগদিশপুর ও পার্শ্ববর্তী জামালগঞ্জ উপজেলার হরিনাকান্দি, আলীপুর, আহসানপুর, উমেদপুর, হরিপুর, হিজলা, নয়াপাড়া, দুর্গাপুর, মদনাকান্দিসহ যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ও পিছিয়ে থাকা প্রায় ২০টি গ্রামের শিক্ষার্থীদের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় এটি। 

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত দীনেশ চন্দ্র তালুকদার ব্যক্তি উদ্যোগে নিজ ভূমিতে বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন। দীনেশ তালুকদারের মৃত্যুর পর ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্র দীপক তালুকদারের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়টি পরিচালিত হয়ে আসছে। 

বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের অনুমোদন থাকলেও নবম ও দশম শ্রেণির কার্যক্রম না থাকায় অন্য বিদ্যালয়ের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হয়। বর্তমানে এটি একটি বড় সমস্যা। বিগত কয়েক বছরে বিদ্যালয়টি শিক্ষার মান ও ভালো ফলাফলের দিক থেকে উপজেলার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এগিয়ে রয়েছে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে দুর্গম হাওরপাড়ে বাল্যবিবাহ, মাদক নির্মূলসহ সামাজিক অবক্ষয় অনেকটাই কমেছে। 

ওই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোনিয়া জান্নাত বলে, `হাওরপাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে আমাদের বসবাস, যেখানে থেকে প্রাইমারি পড়ার পর আর কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। দ্বিজেন্দ্র বর্মন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আমার মতো শত শত শিক্ষার্থী পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে।' 

বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সৌরভ হাসান বলে, `আমরা কৃষক পরিবারের সন্তান। শহরে গিয়ে পড়াশোনা করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। দ্বিজেন্দ্র বর্মন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়েই আমাদের পড়াশোনার একমাত্র ভরসা।' 

স্থানীয় ইউপি সদস্য মিয়া হোসেন বলেন, তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন সর্বোপরি একটি যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত ইউনিয়ন। এখানে শিক্ষার হার একেবারেই শূন্যের কোটায় ছিল। তবে দ্বিজেন্দ্র বর্মন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই এ ইউনিয়নের শিক্ষার হার এখন অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। 

দ্বিজেন্দ্র বর্মন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র দীপক তালুকদার বলেন, `প্রতিবছরই হাওরের উত্তাল ঢেউয়ে বিদ্যালয়ের চারপাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এগুলো আমি নিজ উদ্যোগে মাটি ভরাট, ব্লক লাগানো, গৃহনির্মাণ, বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র, ছাত্রছাত্রী আসা-যাওয়ার ব্যবস্থাসহ শিক্ষকের বেতন আমি বহন করে যাচ্ছি। ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বেতন ফ্রি ছিল। এখনো অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বেতন ফ্রি। বিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত চারবার হাওরের ঢেউ ও বন্যায় সবকিছু তছনছ হওয়ার পরও নতুন করে আবারও স্থাপন করেছি। আমার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল বিদ্যালয়টিতে স্থায়ী ভবন নির্মাণ করার। অবহেলিত হাওরবাসী ও আমার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূর্ণ হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।' 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত