Ajker Patrika

পরীমণির রিমান্ড: ব্যাখ্যায় হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন করেছেন দুই বিচারক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪: ৪৭
পরীমণির রিমান্ড: ব্যাখ্যায় হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন করেছেন দুই বিচারক

চিত্রনায়িকা পরীমণিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানো নিম্ন আদালতের দুই মহানগর হাকিমের ব্যাখ্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, লিখিত ব্যাখ্যায় তাঁরা হাইকোর্টকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নই। বিচারকদের ব্যাখ্যায় হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন (হেয়) করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আদালত। আজ বুধবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। 

আদালত এই মামলার পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন। ওই দিন পরীমণির মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে আবারও আদালতে হাজির হতে হবে। আদালতে পরীমণির পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান। 

আজ সকাল সোয়া ১১টার দিকে ক্রম অনুসারে বিষয়টি উঠলে হাইকোর্ট বলেন, ‘দুজন ম্যাজিস্ট্রেটকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছিল। তাঁরা উত্তর দিয়েছেন। অংশবিশেষ পড়ে শোনাতে চাই।’ এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাকে আসতে বলা হয়েছিল। আদালত বলেন, ‘তিনি এসেছেন, দেখেছি। তিনি আছেন।’ 

আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্নার উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘লার্নেড ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টকে শিক্ষা দিয়েছেন কিছু। এই অংশটুকু পড়ছি। রাষ্ট্র মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। এই মামলার আসামি পরীমণি বিদেশি মদ, এলএসডি, আইসসহ গ্রেপ্তার হন। প্রশ্ন হচ্ছে, এলএসডি ও বিদেশি মদ পেলে শাস্তি কী?’ 
তখন জেড আই খান পান্না বলেন, ‘পাঁচ বছর হতে পারে।’ 

আদালত বলেন, ‘এটি পরিষ্কার করতে হবে, যে পরিমাণ এলএসডি ও আইস পাওয়া গেছে তাতে শাস্তির পরিমাণ কত?’ । তখন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মিজানুর রহমান বলেন, ‘ইয়াবা বড়ির ক্ষেত্রে যে সাজা, এলএসডির ক্ষেত্রেও তা–ই হবে।’ 

আদালত বলেন, ‘তাহলে দুই থেকে পাঁচ বছর হতে পারে।’ জেড আই খান পান্না বলেন, ‘পাঁচ বছর হবে, মাই লর্ড।’ 

বিচারকের লিখিত ব্যাখ্যা তুলে ধরে আদালত বলেন, ‘এলএসডি মাদক যে কত ভয়ানক, তা পুরো দেশবাসী অবগত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। এলএসডিকে ভ্রম উৎপাদক মাদক হিসেবেও বলা হয়। ওই ছাত্র এলএসডি গ্রহণের পর একজন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে নিজের গলায় পোঁচ মেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন।’ 

আদালত বলেন, ‘আমরা তাঁদের (বিচারক) কারণ দর্শাতে বলেছি, কেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে? এখানে তাঁরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এলএসডি গ্রহণের পর একজন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে নিজের গলায় পোঁচ মেরেছেন। এখানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশনা ও প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে তিনি (বিচারক)। এ কারণে তাঁদের জবাবে আমরা সন্তুষ্ট নই। এ জন্য ২৯ সেপ্টেম্বর পরবর্তী আদেশের জন্য রাখছি।’ 

আদালত বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা সিডি (মামলার নথিপত্র) উপস্থাপন করেছেন। ২৯ সেপ্টেম্বর পরবর্তী আদেশের জন্য রাখা হচ্ছে। ওই দিন তদন্ত কর্মকর্তাকে আসতে হবে। এ সময় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘বিচারকদের ব্যাখ্যার কপি পেতে পারি?’ 

আদালত বলেন, ‘বিষয়টি বিচারাধীন। তাই অংশবিশেষ পড়ে শোনানো হলো। আরেকটু পড়ছি।’ 

আদালত বলেন, ‘উপযুক্ত বিষয়ে সার্বিক বিবেচনায় আমি (মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস) দুই দিন রিমান্ড মঞ্জুর করার আদেশ প্রদান করি। ওই আদেশ প্রদানে কোনোরূপ ত্রুটি-বিচ্যুতি নিতান্তই আমার অনিচ্ছাকৃত এবং সরল বিশ্বাসে করা ভুল।’ 

ত্রুটি হয়েছে যে তা তাঁরা (বিচারক) বিশ্বাস করেন না উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন করা হয়েছে।’ 

তখন জেড আই খান পান্না বলেন, ‘একদম ঠিক, যদি ভুল হয়ে থাকে।’ 

সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘২৯ সেপ্টেম্বর তারিখ রাখা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় কি না?’ 

আদালত বলেন, ‘ওই দিন তদন্ত কর্মকর্তাকে আসতে হবে। তাঁর ব্যাখ্যার দরকার আছে। তাঁকে ব্যাখ্যা দিতে হবে। যেকোনো আইনজীবীর মাধ্যমে বা তিনি নিজেও ব্যাখ্যা দিতে পারেন।’ 

গত ২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের হাইকোর্ট বেঞ্চ ১০ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দাখিল করতে সংশ্লিষ্ট দুই বিচারকের প্রতি নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ১৫ সেপ্টেম্বর মামলার নথিসহ (সিডি) সশরীরে হাইকোর্টে হাজির থাকার নির্দেশ দেন। পরীমণিকে রিমান্ডে নেওয়ার বৈধতা প্রশ্নে হস্তক্ষেপ চেয়ে আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) করা এক আবেদনে এ আদেশ দেন হাইকোর্ট। 

হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুরের সময় কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে রিমান্ড মঞ্জুর করা প্রয়োজন? প্রথম চার দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে এমনকি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল যে তাঁকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে নিতে হবে? আদালত বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা চাইল আর তাতেই কীভাবে সংবিধান ও দেশের অন্যান্য আইন লঙ্ঘন করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করে দিলেন মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট এটা বুঝে আসে না। 

এর আগে গত ২৬ আগস্ট একই হাইকোর্ট বেঞ্চ পরীমণির জামিন প্রশ্নে রুল জারি করে আদেশ দেন। পয়লা সেপ্টেম্বর রুলের ওপর শুনানির দিন ধার্য করা হয়। এই রুল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ৩১ আগস্ট পরীমণির জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এরপর পয়লা সেপ্টেম্বর কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান পরীমণি। 

গত ৪ আগস্ট রাতে বনানীর বাসা থেকে পরীমণি ও তার সহযোগী দীপুকে আটক করে র‍্যাব। এ সময় পরীমণির বাসা থেকে বিভিন্ন মাদক জব্দ করা হয়। পরদিন ৫ আগস্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পরীমণি ও তাঁর সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দিপুর বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে। এ মামলায় তিন দফা রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ড শেষে গত ২১ আগস্ট পরীমণিকে কারাগারে পাঠানো হয়। 

এদিকে আজ সকালে পরীমণি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির হন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য আগামী ১০ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদার এই তারিখ ধার্য করেন। 

পরীমণিকে তাঁর বনানীর বাসা থেকে যেদিন গ্রেপ্তার করা হয় সেদিন জব্দকৃত আইপ্যাড ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং তার ব্যবহৃত গাড়ি জিম্মায় দেওয়ার আবেদন করেন। আদালত পরীমণির মালামাল সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সিআইডির পরিদর্শক কাজী গোলাম মোস্তফা এই প্রতিবেদন দেবেন। 

পরীমণি আদালতকে জানান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তাঁকে আটকের দিন ছয় ঘণ্টা ধরে তাঁর বাসা তছনছ করে। অনেক মালামাল তাঁর বাসা থেকে নিয়ে যায়। তাঁর গাড়ি নিয়ে যায়। তিনি অসুস্থ। প্রতিদিন তাঁর ওষুধ খেতে হয়। এমনকি তিনি মুক্তি পাওয়ার পরে ওই ওষুধগুলো খুঁজে পাননি। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত