Ajker Patrika

তপ্ত প্রিজন ভ্যানে ঘামে ভেজা কষ্ট

রাসেল মাহমুদ, ঢাকা
আপডেট : ৩১ মে ২০২৪, ১১: ৩৬
তপ্ত প্রিজন ভ্যানে ঘামে ভেজা কষ্ট

প্রিজন ভ্যান থেকে একজন একজন করে নামছেন। শরীর ও পোশাক ঘেমে জবজবে। কষ্টের ছাপ স্পষ্ট সবার চোখমুখে। নেমেই যেন পরশ চাইছিলেন বাতাসের। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁদের একটি ফটকের ভেতরে ঢোকানো হলো।

এই দৃশ্য পুরান ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণের একটি হাজতখানার বাইরের। রাজধানীর বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে আসামিদের প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হচ্ছিল। কোনোটি এসেছে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে, কোনোটি কেরানীগঞ্জের কারাগার থেকে। কোনোটি এসেছে ধামরাই, সাভার থেকে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) থানাগুলো থেকেও এসেছে প্রিজন ভ্যান। কোনোটিতে ২০ জন, কোনোটিতে আনা হয় ৩৬ জনকে। তাঁদের অনেকের শরীরই ঘর্মাক্ত।

ধাতবের (ইস্পাত) তৈরি ১০ ফুট উঁচু প্রিজন ভ্যানে কোনো ফ্যান নেই। ওপরের দিকে এক ফুট প্রস্থের লম্বালম্বি লোহার জাল রয়েছে। ভ্যানের ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের এটাই একমাত্র পথ। তবে ওই পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে যায় ভারসাম্য রক্ষার জন্য জাল ধরে আসামিদের দাঁড়ানোর কারণে। ওই জালের ফাঁক দিয়ে তাঁরা বাইরের মুক্ত পৃথিবীও দেখেন। ফলে ভ্যানে গরম থাকে বাইরের চেয়ে বেশি। গরমে পানির পিপাসা পেলেও মেটানোর ব্যবস্থা নেই। পুরোনো ভ্যানগুলোতে বসার স্থানও নেই।

জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের কারা উপমহাপরিদর্শক মনির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই প্রিজন ভ্যানগুলো করা হয়।

সেখানে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। নতুন প্রিজন ভ্যানগুলোতে আরও ভালো ব্যবস্থা কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা চলছে।

ঢাকার নিম্ন আদালত প্রাঙ্গণে ১৯ মে সকালে গিয়ে দেখা যায়, একাধিক প্রিজন ভ্যান আসামি নিয়ে এসেছে। তাঁরা ভ্যানের জাল ধরে দাঁড়িয়ে বাতাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসা প্রিজন ভ্যান থেকে সাব্বির নামের একজন বলেন, এই ভ্যানে ৩০-৪০ জন আছেন। গরমে ঘেমে গোসল হয়ে গেছে। তাঁকে আনা হয়েছে ছিনতাই মামলায় হাজিরার জন্য। 
জিহাদ নামের আরেকজন বলেন, ভেতরে অনেক গরম। পানির পিপাসা পায়। পানি ও খাবার দেয় নামানোর পর।

গাড়ি ছিনতাই মামলার সন্দেহভাজন আলী হোসেন বললেন, প্রচণ্ড গরমে গাদাগাদি করে ৪০-৪২ জনকে আনা হয়েছে।

২০ মে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে আদালত প্রাঙ্গণে একটি প্রিজন ভ্যান আসে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে। নামানোর সময় দেখা যায়, একজন হাতে থাকা শার্ট পরছেন। পুরো শরীর ঘেমে গেছে। অনেকের গায়ে ঢিলেঢালা পোশাক। এর ঠিক আগেই কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আসা একটি প্রিজন ভ্যান থেকে নেমেছেন ৩৬ জন। সবার শরীর ছিল ঘর্মাক্ত। 
কারাগার থেকে আসা প্রিজন ভ্যানের দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য বলেন, ভ্যানে গরম একটু বেশি লাগে। তবে এ নিয়ে আসামিরা কিছু বলেন না।

ঢাকার নিম্ন আদালতের চারটি হাজতখানার সূত্র জানায়, কেরানীগঞ্জ, কাশিমপুর কারাগারসহ ঢাকা জেলা ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানা থেকে প্রিজন ভ্যান, ডিবি পুলিশ ও র‍্যাবের গাড়িতে দিনে গড়ে ৭০০ আসামিকে আদালতে আনা-নেওয়া করা হয়। এর মধ্যে কারাগারগুলো থেকে প্রায় ২০টি প্রিজন ভ্যানে গড়ে ৪০০ জনকে আনা-নেওয়া করা হয়। কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দিনে সাত-আটটি প্রিজন ভ্যানে ২৫০-৩০০ জন, কাশিমপুরের তিনটি কারাগার থেকে সাতটি প্রিজন ভ্যানে দিনে গড়ে ১২০ জনকে আনা-নেওয়া করা হয়। এর মধ্যে একটি ভ্যানে থাকেন গড়ে ১০-১২ জন নারী আসামি।

পুরোনো প্রিজন ভ্যানে বসার ব্যবস্থা না থাকলেও নতুন ভ্যানগুলোতে বসার জন্য দুই পাশে লোহার বেঞ্চের মতো রয়েছে।

প্রচণ্ড গরমে যাতায়াতে আসামিদের ঘর্মাক্ত অবস্থার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এর সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ বলেন, এই কারাগার থেকে সকাল ৬টার দিকেই আসামি পাঠানো হয়। তখন তেমন গরম থাকে না। ফেরার সময় গরম পড়ে। তবে এ নিয়ে কেউ তেমন অভিযোগ করেন না।

জানা গেছে, দেশে মানবদেহের জন্য সহনশীল তাপমাত্রা প্রায় ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাইরে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলেও প্রিজন ভ্যানের ভেতর তা আরও বেশি অনুভূত হয়। চলতি বছর ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও উঠেছিল, যা প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। সেদিনও আসামিদের একইভাবে আনা-নেওয়া করা হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. অলক কুমার মজুমদার বলেন, গাড়ির ধাতব বডি থাকলে তাপমাত্রা বেশ বেড়ে যায়। এক জায়গায় বেশি মানুষ থাকলে তাপমাত্রার সঙ্গে আর্দ্রতাও বাড়ে। ভালো ভেন্টিলেশন ও ফ্যান না থাকলে তা অসহ্যকর হয়। তবে আসামি পরিবহনে নিরাপত্তার বিষয়টিও রয়েছে। গরমে একটু বেশি বাতাস চলাচল ও বাতাসের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি এক ভ্যানে কমসংখ্যক আসামি বহন করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, অপরাধী বা অভিযুক্ত যে-ই হোক, তাঁদের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দিতে হয়। একজন অপরাধীরও মানবাধিকার রয়েছে। তাই তাঁর মর্যাদা যেন ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে নজর রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তিনি বলেন, ‘গরমের সময় আসামিদের প্রিজন ভ্যানে বহনের জন্য ন্যূনতম সুবিধা থাকা প্রয়োজন। তবে আমাদের সক্ষমতা নিতান্তই কম, অবশ্য আমরা তা নিয়ে চিন্তাও করি না। রাষ্ট্রকে আরও সচেতন হতে হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লুটপাটে শেষ ৫ কোটির প্রকল্প

‘ওরা সোনার তৈরি, আমরা মাটির’, কারখানার ভেতর আত্মহত্যার আগে শ্রমিকের ফেসবুক পোস্ট

দিনাজপুরে হিন্দু নেতাকে অপহরণ করে হত্যা: ভারত সরকার ও বিরোধী দল কংগ্রেসের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল, বেশির ভাগই ভারতীয়, আছে বাংলাদেশিও

আজ থেকে ৫০০ টাকায় মিলবে ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত