Ajker Patrika

ঢাবি শিক্ষকের স্ত্রীর মৃত্যু: ময়নাতদন্তে শ্বাসরোধে হত্যা, পিবিআইয়ের তদন্তে আত্মহত্যা

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
আপডেট : ১৮ মে ২০২৪, ২৩: ৩০
ঢাবি শিক্ষকের স্ত্রীর মৃত্যু: ময়নাতদন্তে শ্বাসরোধে হত্যা, পিবিআইয়ের তদন্তে আত্মহত্যা

দাম্পত্য জীবনের ১৪ বছর নিঃসন্তান ছিলেন ফার্মাসিস্ট কোহিনূর বেগম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক কে বি এম মামুন রশীদ চৌধুরী। সন্তানের শূন্যতা পূরণে তাঁরা এক কন্যা নবজাতক দত্তক নেন। পরম স্নেহে সেই মেয়েকে লালন পালন করেন। দুই বছর পর কোহিনূর বেগম অন্তঃসত্ত্বা হন। তাঁর কোল জুড়ে আসে পুত্র সন্তান। দুই সন্তানকেই তাঁরা সমান স্নেহে বড় করেন। এটি ৩০ বছর আগের কথা। দুই সন্তানই এখন প্রাপ্তবয়স্ক। গত বছর এক দিন তাঁদের ধানমন্ডির বাসা থেকে কোহিনূর বেগমের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

প্রথমে এটি আত্মহত্যা মনে করে পুলিশ। তবে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্বাসরোধে হত্যা। এতে কোহিনূর বেগমের বড়ভাইয়ের সন্দেহ হয়। এরপর তিনি একটি হত্যা মামলা করেন। সেই মামলায় আসামি করা হয় কোহিনূর বেগমের স্বামী মামুন রশীদ চৌধুরী ও তাঁদের পালিত মেয়ে ফাইজা নুর রশীদ চৌধুরীকে। তাঁদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়। রিমান্ড শেষে পাঠানো হয় কারাগারে।

তবে এই ঘটনার নয় মাস পর জানা গেল, কোহিনূর বেগম খুন হননি। তিনি আত্মহত্যাই করেছেন। মাকে হত্যার মতো অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে ফাইজা বলেন, ‘এমন ঘটনা ঘটলে পৃথিবীর সব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে!’

গত বছরের ১০ এপ্রিল ধানমন্ডির ৩০ নম্বর সড়কের বাসায় ঢুকে কোহিনূর বেগমকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান তাঁর স্বামী কে বি এম মামুন রশীদ চৌধুরী। হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

এই ঘটনায় ধানমন্ডি মডেল থানায় আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু বলে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। তবে ঘটনার তিন মাস পর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসার পর ওই বছরের ১৫ জুলাই কোহিনূর বেগমের বড়ভাই সালাহউদ্দীন মো. রহমতুল্লাহ ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘শ্বাসরোধে হত্যা’ উল্লেখ থাকায় সালাহউদ্দীন কোহিনূর বেগমের স্বামী রশীদ চৌধুরী ও তাঁদের পালিত মেয়ে ফাইজা নূর–ই–রশীদকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। 

তিনি মামলায় অভিযোগ করেন, কোহিনূর বেগমকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর তাঁর স্বামী রশীদ ও তাঁদের পালিত মেয়ে ফাইজা আত্মহত্যা বলে প্রচার করেছেন। 

এ মামলায় রশীদ ও ফাইজাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত শুরু করে পিবিআই। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের অর্গানাইজড ক্রাইমের এসআই শাহীন মিয়া তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এরপর আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠান। তিন মাস কারাবাসের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান ফাইজা নূর। রশীদ এখনো কারাগারে। 

হত্যা মামলাটি প্রায় আট মাস তদন্ত করে পিবিআই। তদন্তে উঠে এসেছে, কোহিনূর বেগমকে হত্যা করা হয়নি। তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। গত ২৮ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে বাবা ও মেয়েকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। 

তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাহীন মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, এটি একটি আত্মহত্যার ঘটনা। তাই নিহতের স্বামী কে বি এম রশীদ ও তাঁদের পালিত মেয়ে ফাইজা নূর–ই–রশীদকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। 

ময়নাতদন্তে হত্যা বলা হলেও পুলিশ তদন্তে হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ পায়নি। আত্মহত্যার ক্ষেত্রে গলার সামনের দিকে গোলাকার চিহ্ন থাকে। তবে কোহিনূরের ঘাড়ের পেছনের অংশে লালচে দাগ ছিল। পুলিশ বলছে, ঝুলন্ত অবস্থা থেকে নামানোর সময় এই দাগ হয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া ঘটনার দিন সকাল ৬টা ৪৬ মিনিটে মেয়ে ফাইজা এবং ৭টা ৪৯ মিনিটে রশীদ চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হন। সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে তাঁদের ছেলে সাবিক আন নূর রশীদ বের হন। মাকে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে বেরিয়ে যান তিনি। মাও জবাব দেন। সাবিক ফ্ল্যাটের সামনের দরজায় তালা দিয়ে চলে যান। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে সেটি ধরা পড়েছে। 

রশীদ চৌধুরী একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় সকাল ১০টা ৫৮ মিনিটে কোহিনূর হোয়াটসঅ্যাপে রশীদ চৌধুরীকে কল দিয়ে জানতে চান, ভার্সিটি থেকে কী তিনি অন্য কোথাও যাবেন কিনা? জবাবে রশীদ চৌধুরী বলেন, তিনি সরাসরি বাসায় আসবেন। ৩৫ সেকেন্ড কথা বলে কোহিনূর ফোন রেখে দেন। এরপর রশীদ ক্লাসে চলে যান। 

ক্লাস শেষ করে ১২টা ২২ মিনিটে রশীদ চৌধুরী ভার্সিটি থেকে ধানমন্ডির বাসার উদ্দেশে রওনা দেন। গাড়িতে উঠে তিনি সাড়ে ১২টার দিকে স্ত্রীকে তিন বার হোয়াটসঅ্যাপে কল করেন। কিন্তু রিসিভ হয়নি। এরপর তিনি ছেলে সাবিক নূর রশীদকে ফোনকল করেন। ছেলেও রিসিভ করেননি। ছেলেকে তিনি মেসেজ পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি দ্রুত বাসায় যেতে পারবেন কিনা? ছেলে তারও জবাব দেননি। এরপর ধানমন্ডির বাসায় এসে তিনি ফ্ল্যাটের দরজার তালা খুলে দেখেন স্ত্রী ডাইনিং রুমের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছেন। নিজেই টেবিলের ওপর চেয়ার ও প্লাস্টিকের টুল দিয়ে কাঁচি দিয়ে ওড়না কেটে স্ত্রীকে নিচে নামান। আত্মীয়স্বজন ও জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ কল দেন। স্ত্রীকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান তিনি মারা গেছেন। 

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কোহিনূর বেগম বাইপোলার রোগে ভুগছিলেন। ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত পান্থপথের ব্রেন অ্যান্ড লাইফ হসপিটালে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামালের অধীনে ভর্তি ছিলেন। মানসিক অসুস্থতার কারণে গলায় ফাঁস দিয়ে কোহিনূর বেগম আত্মহত্যা করেন। 

তবে মামলার বাদী সালাহউদ্দিন মো. রহমতুল্লাহ এখনো মনে করেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তদন্ত প্রতিবেদনে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। তদন্ত কর্মকর্তা পক্ষপাতিত্ব করে আসামিদের অব্যাহতি দিয়েছেন। এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেবেন বলেও জানান তিনি। 

কোহিনূর বেগম নামকরা একাধিক ওষুধ কোম্পানিতে উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। তাঁর স্বামী মামুন রশীদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ান। মেয়ে ফাইজা নূর রশীদ আইসিডিডিআর,বি–এর গবেষণা বিভাগে কাজ করেন। ফাইজা নূর ও তাঁর ভাই সাবিক নূর রশীদ ধানমন্ডির ওই বাসায় ভাড়া থাকেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত