Ajker Patrika

নিজের তৈরি ‘উড়োজাহাজে’ উড়লেন কৃষকের ছেলে জুলহাস

ঘিওর (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি  
আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৫, ২১: ৩৫
নিজের তৈরি উড়োজাহাজে জুলহাস। ছবি: আজকের পত্রিকা
নিজের তৈরি উড়োজাহাজে জুলহাস। ছবি: আজকের পত্রিকা

মানিকগঞ্জের শিবালয়ে নিজের তৈরি ‘উড়োজাহাজ’ উড়িয়েছেন জুলহাস মোল্লা (২৮) নামের এক বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি। আজ মঙ্গলবার (৪ মার্চ) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার জাফরগঞ্জ এলাকায় যমুনার চরে উড়োজাহাজটি আকাশে ওড়ান। এ সময় মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শত শত মানুষ যমুনাপাড়ে উপস্থিত ছিলেন।

এদিন জুলহাস চার মিনিট উড়োজাহাজটি আকাশে উড্ডয়ন করে আবার নেমে আসেন। বাতাসের গতি বেশি থাকায় ঝুঁকি এড়াতে আর বেশিক্ষণ উড়োজাহাজটি আকাশে উড্ডয়ন করা সম্ভব হয়নি। জুলহাস তাঁর এ উড়োজাহাজের নাম দিয়েছেন ‘স্কাই বাইক থ্রি’।

জেলার দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া এলাকায় বাড়ি হলেও নদীভাঙনের কারণে বর্তমানে শিবালয় উপজেলার ষাইটঘর তেওতা (বিলপাড়া) গ্রামে বাড়ি করে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন জুলহাস। পিতা কৃষক জলিল মোল্লা। ছয় ভাই, দুই বোনের মধ্যে জুলহাস পঞ্চম। জিয়নপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করেন তিনি। অর্থাভাবে আর পড়া হয়নি। বর্তমানে ঢাকায় বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন।

জানা গেছে, শৈশব থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক ছিল জুলহাসের। পড়াশোনার ইতি টানলেও উদ্ভাবনী চিন্তা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত। ২০২১ সালে যখন প্রথমবারের মতো আরসি (রিমোট কন্ট্রোল) প্লেন দেখেন, তখন ঠিক করেন, নিজে একটা প্লেন বানাবেন। এরপর শুরু হয় নিরলস গবেষণা। ইউটিউব, বইপত্র ঘেঁটে ধাপে ধাপে শিখতে থাকেন প্লেন তৈরির খুঁটিনাটি। যন্ত্রাংশ জোগাড় করা থেকে শুরু করে নকশা তৈরি, কাঠামো সাজানো—সবকিছু করেছেন নিজেই। দীর্ঘ সময়ের প্রচেষ্টার পর অবশেষে সফলতা এল। নিজের হাতে তৈরি সেই প্লেনে চড়ে আকাশে ওড়েন তিনি।

জুলহাস মোল্লা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এসএসসির পর আর লেখাপড়া করা হয়নি। পেশায় ইলেকট্রনিক মিস্ত্রি হিসেবে ঢাকায় কাজ করি। চার বছর আগে হঠাৎ মাথায় আসে ছোট ছোট রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে বিমান তৈরি করার। এর কিছুদিন পরে আল্ট্রালাইট বিমান তৈরির কথা মাথায় আসে। কিন্তু তাতে তেমন সফলতা আসেনি। পরে গত এক বছর চেষ্টা করে এই বিমানি তৈরি করতে সক্ষম হই।’

জুলহাস আরও বলেন, ‘মূলত টাকার জোগান না থাকায় পাম্প ইঞ্জিন আর অ্যালুমিনিয়াম, এসএস দিয়ে মূলত এটি তৈরি করা হয়। ওজন হয়েছে ১০০ কেজি। গতি পরিমাপের জন্য লাগানো হয়েছে একটি ডিজিটাল মিটার, অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে পাখা তৈরি করা হয়েছে। ইঞ্জিন চলবে অকটেন অথবা পেট্রল দিয়ে। ঘণ্টায় গতি হবে সর্বোচ্চ ৭০ কিলোমিটার।’

কয়েক দিন আগে উড়োজাহাজটি পরীক্ষামূলক সফলভাবে আকাশে উড্ডয়ন করতে সক্ষম হন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কোনো দিন বিমানের উঠিনি। বিমানটি তৈরি করে আকাশে উড্ডয়ন করতে পেরে নিজের স্বপ্নও পূরণ করেছি।’

আকাশে উড়ছে জুলহাসের তৈরি উড়োজাহাজ। ছবি: আজকের পত্রিকা
আকাশে উড়ছে জুলহাসের তৈরি উড়োজাহাজ। ছবি: আজকের পত্রিকা

উদ্ভাবক জুলহাস আরও বলেন, ‘প্রথম দিকে পরিবার ও এলাকাবাসী আমাকে পাগল মনে করেছে। তবে এখন সবাই উৎসাহ আর বাহবা দিচ্ছে। সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পেলে এ নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আছে।’

ছেচনা মডেলের বিমানটি গত ডিসেম্বর থেকে তৈরির কাজ শুরু হয়। শেষ হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এরপর বাড়ির পাশে নমুনা নদীর চরে পরীক্ষামূলকভাবে বিমানটি উড্ডয়ন করার একটি ভিডিও তাঁর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় ভিডিওটি এবং এলাকাজুড়ে হইচই পড়ে যায়।

জুলহাস জানান, ফায়ার অ্যালার্মের চাকরির পাশাপাশি চার বছর ধরে তিনি উড়োজাহাজ তৈরি করে আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা করছেন। শখের বশে তিনি প্রায় তিন বছর আগে একটি খেলনা বিমান তৈরি করে আকাশে উড়িয়েছিলেন। তিনি কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজেই ড্রাইভ করে আকাশে উড়িয়েছেন উড়োজাহাজটি। এই উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ তৈরিতে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করেছেন জুলহাস। তবে গত চার বছরে তাঁর এই কাজের পেছনে ৮-১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে একটি আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন।

জুলহাস মোল্লার বাবা জলিল মোল্লা বলেন, ‘জুলহাস ছোটবেলা থেকে প্লাস্টিকের জিনিস কাটাকাটি করে কিছু বানাতে চায়। জিজ্ঞেস করলে বলত, একদিন দেখবে আমি কী বানাইছি। সারা দেশের মানুষ দেখবে। চার বছর ধরে চেষ্টা করছে প্লেন ওড়ানোর। প্রতিবছরই যমুনার চরে ওড়ানোর চেষ্টা করে। এবার সফল হয়েছে। গতকাল ৫০ ফুট ওপরে উড়ছে।’

জুলহাসের ছোট ভাই নয়ন মোল্লা বলেন, ‘শুরু থেকে আমি ভাইয়ার সঙ্গে ছিলাম। সব কাজ আমি সঙ্গে থেকে করেছি। আমরা কোনো সময় দমে যাইনি। গত এক বছর দিনে আমরা পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা প্লেন তৈরি করতে গবেষণা ও কাজ চালিয়ে গেছি।’

তেওতা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, ‘জুলহাস এলাকার কৃতী সন্তান। তাঁর কাজ প্রশংসনীয়। স্বল্পশিক্ষিত একজন ছেলে টেকনিক্যালি কোনো প্রশিক্ষণ নেই এবং কখনো প্লেনে না উঠেও নিজে প্লেন তৈরি করে নিজেই অবতরণ করল। বর্তমান সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি জুলহাসকে সহযোগিতা করে, ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে, তাহলে দেশীয় প্রযুক্তিতে এমন প্লেন তৈরি করে দেশ ও জাতিকে সম্মানের সাথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।’

উদ্ভাবনী এই কাজের প্রশংসা করে মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, ‘এমন উদ্ভাবনী কার্যক্রমে আমি অভিভূত। প্লেনটি অবতরণের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষার্থী কাছ থেকে মুঠোফোন মাধ্যমে জানতে পারি, মানিকগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার একজন ছেলের তৈরি এই প্লেন। তার সাথে যোগাযোগের পর আজ তার এলাকায় এসে তাকে প্রণোদনা এবং সরকারি সহায়তা দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে চেষ্টা এবং এই প্রযুক্তি বিকাশে প্রশাসন তার পাশে থাকবে। প্রাথমিকভাবে কিছু আর্থিক সহযোগিতা করে তাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সংখ্যালঘু ইস্যুতে বাংলাদেশের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাল দিল্লি

‘শেখ হাসিনা আসবে, বাংলাদেশ হাসবে’ ব্যানারে বিমানবন্দর এলাকায় আ.লীগের মিছিল

ইটনায় এবার ডিলার নিয়োগে ঘুষ চাওয়ার কল রেকর্ড ফাঁস

কুষ্টিয়ায় গভীর রাতে বিএনপি নেতার বাড়িতে গুলি, দেখে নেওয়ার হুমকি

‘ওরা সোনার তৈরি, আমরা মাটির’, কারখানার ভেতর আত্মহত্যার আগে শ্রমিকের ফেসবুক পোস্ট

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত