সেলিম জাহান
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার শিরোনাম আমার খুব পছন্দের, ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ শেষ যখন কথা হয় হেলালের সঙ্গে, তখন সে বলেছিল, ‘যেতে চাই, কেন আছি?’ ইদানীং এমনটাই বোধ হয় ভাবত হেলাল। আমার পঞ্চাশ বছরের বন্ধু কবি হেলাল হাফিজ। আমাকে শুধু নয়, শামীমকেও (কবি শামীম আজাদ) এমনটাই বলেছিল সে। বেশ কিছু সময় ধরে রোগ, ব্যাধি, নিঃসঙ্গতা ওঁকে এমন একা আর একলা করে দিয়েছিল যে, বেঁচে থাকাটাই হয়তো ওঁর কাছে কষ্টকর গুরুভার মনে হতো।
শামীম এবং আমার সখ্য ছিল হেলালের—কবি বলে শামীমের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে? স্রেফ শরীফ মিয়ায় আড্ডা মারার জন্য। শরীফ মিয়ায় হেলালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হাসান ভাই—কবি আবুল হাসান। তারপর সে পরিচয় উপচে পড়ল অন্যদের সঙ্গে—কবি রফিক নওশাদ, শাহনূর খান, সাজ্জাদ কাদিরদের মধ্যে। প্রথম দর্শনেই হেলালের চেহারাটা আমার কাছে ভিন্ন মনে হয়েছিল—বেশ পরিপাটি করে মাঝখানে সিঁথি করা একটু বাবরি হয়ে যাওয়া চুল, কচি ঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফ, বড় বড় চোখ—সব মিলিয়ে তরুণ যিশু যেন।
বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না হেলালের সঙ্গে। সকাল-দুপুর-বিকেল—আড্ডা দিই শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে। কবিতা পড়া হয়, সাহিত্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলে, চুটকি, রটনা এবং সেই সঙ্গে পরচর্চাও বাদ যায় না। আমাদের তর্ক-বিতর্ক আর চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। রমজান ভাইয়ের নিয়ে আসা চা কাপের পর কাপ উড়ে যায়। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে যায় ঘর।
মাঝে মাঝে দুপুরবেলা শরীফ মিয়ায় এক টাকার বিরিয়ানি খেতে খেতে হেলাল তার সদ্য সমাপ্ত কোনো কোনো কবিতার লাইন আওড়ায়। আমি মুগ্ধ হই। শুনি, ‘যদি কোনদিন আসে আবার দুর্দিন,/ যেদিন ফুরাবে প্রেম, অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে,/ ভেঙে সেই কালো কারাগার,/ আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার’। কেমন যেন লাগে যখন হেলাল পড়ে, ‘ইচ্ছে ছিল রাজা হবো,/ তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে রাজ্য বাড়াবো,/ আজ দেখি রাজ্য আছে,/ রাজা আছে,/ ইচ্ছে আছে,/ শুধু তুমি অন্যঘরে’। হেলালের মোট বইয়ের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু যে কয়টাই আছে, প্রতিটিই হীরকখণ্ড। আমার নিজের মতে, হেলাল হচ্ছে সেই মুষ্টিমেয় কবির একজন, যে কখনো কোনো খারাপ কবিতা লেখেনি। কারণ, হেলালের শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু হচ্ছে কবির অণু-পরমাণু।
মনে আছে, কোনো এক সময়ে হেলালের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘কষ্ট’ সবে বেরিয়েছে। রঙের কারবার সব—লাল কষ্ট, নীল কষ্ট, কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট—‘মালটি-কালার কষ্ট...’। শরীফ মিয়ায় দেখা হতেই বললাম, ‘কী সব লিখেছ হে? কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট, মালটি-কালার কষ্ট! ব্যাখ্যা করতে পারবে?’ একমুহূর্ত! হেলাল চোখ বন্ধ করল; তারপর একনিঃশ্বাসে বলে গেল কষ্টের নানান রং। আমি হতবাক! ভাবতেই পারিনি, কষ্টেরও কাঁচা হলুদের রং আছে, আছে বিবিধ বর্ণ।
ইদানীং ফোন করলে মাঝে মাঝে হেলাল শামীম ও আমার—দুজনের সঙ্গেই কথা বলত। সেসব কথায় ও প্রায়ই ‘গো’ শব্দটি ব্যবহার করত—এই যেমন ‘কেমন আছো গো?’ আমরা দুজনে মজা পেতাম। মাঝে মাঝে ও দুঃখ করত, সংসার করল না বলে, নিজের কোনো থিতু নেই বলে, কাছের মানুষ নেই বলে। ওর গলার সেই কষ্ট আমাদের ছুঁয়ে যেত। কখনো কখনো বলত, ‘একা থাকার বড় কষ্ট গো’। সব সময় কথা শেষ করত এই বলে, ‘তোমরা দুজন ভালো থেকো গো’।
আমি হেলালের কবিতার বড় ভক্ত। ওঁর বেশির ভাগ কবিতাই আমি পড়েছি। কিন্তু কবি হিসেবে হেলালের মূল্যায়ন করা আমার অসাধ্য। আমি হেলালের কবিতার পাঠক ও ভোক্তা। মধ্য-আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের কালে তাঁর বিরুদ্ধে আমার নানান লেখায় হেলাল হাফিজের কবিতা উঠে এসেছে স্বাভাবিকভাবে। ‘নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না’ কিংবা ‘আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন, মোটামুটি সুখেই আছেন। প্রিয় দেশবাসী, আপনারা কেমন আছেন?’ এসব পঙ্ক্তির নামাবলি চাপিয়ে আমার বহু লেখা বেরিয়েছে।
তখন প্রতি বৃহস্পতিবার সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে আমার পাক্ষিক কলাম ‘কড়ি-কড়চা’ বেরোচ্ছে। একবার আমার এক লেখায় হেলালের কবিতা ‘যার যেখানে জায়গা’ পুরোটা ব্যবহার করেছিলাম। কথ্য ভাষায় লেখা কবিতাটির শেষ লাইনে একটি মারাত্মক গালি ছিল। সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক হাসনাত ভাই (প্রয়াত আবুল হাসনাত) একটু ইতস্তত করছিলেন। জনান্তিকে শোনা, পরে সন্তোষদার (প্রয়াত সন্তোষ গুপ্ত) সুপারিশ ও বজলু ভাইয়ের (সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান) অনুমোদনে তা ছাপা হয়েছিল।
আজ মনে পড়ল, শেষ যখন হেলালের সঙ্গে কথা বলি, তখন গত বছর হেলাল বলেছিল, ‘আমাদেরও তো যাওয়ার সময় হয়ে এলো গে’। সবকিছু ছাপিয়ে হেলালের ওই ‘গো’ ডাকটিই হৃদয়ে বাজবে নিরন্তর।
বিদায় বন্ধু, হেলাল হাফিজ।
কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতার শিরোনাম আমার খুব পছন্দের, ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ শেষ যখন কথা হয় হেলালের সঙ্গে, তখন সে বলেছিল, ‘যেতে চাই, কেন আছি?’ ইদানীং এমনটাই বোধ হয় ভাবত হেলাল। আমার পঞ্চাশ বছরের বন্ধু কবি হেলাল হাফিজ। আমাকে শুধু নয়, শামীমকেও (কবি শামীম আজাদ) এমনটাই বলেছিল সে। বেশ কিছু সময় ধরে রোগ, ব্যাধি, নিঃসঙ্গতা ওঁকে এমন একা আর একলা করে দিয়েছিল যে, বেঁচে থাকাটাই হয়তো ওঁর কাছে কষ্টকর গুরুভার মনে হতো।
শামীম এবং আমার সখ্য ছিল হেলালের—কবি বলে শামীমের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে? স্রেফ শরীফ মিয়ায় আড্ডা মারার জন্য। শরীফ মিয়ায় হেলালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন হাসান ভাই—কবি আবুল হাসান। তারপর সে পরিচয় উপচে পড়ল অন্যদের সঙ্গে—কবি রফিক নওশাদ, শাহনূর খান, সাজ্জাদ কাদিরদের মধ্যে। প্রথম দর্শনেই হেলালের চেহারাটা আমার কাছে ভিন্ন মনে হয়েছিল—বেশ পরিপাটি করে মাঝখানে সিঁথি করা একটু বাবরি হয়ে যাওয়া চুল, কচি ঘাসের মতো দাড়ি-গোঁফ, বড় বড় চোখ—সব মিলিয়ে তরুণ যিশু যেন।
বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না হেলালের সঙ্গে। সকাল-দুপুর-বিকেল—আড্ডা দিই শরীফ মিয়ার ক্যানটিনে। কবিতা পড়া হয়, সাহিত্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলে, চুটকি, রটনা এবং সেই সঙ্গে পরচর্চাও বাদ যায় না। আমাদের তর্ক-বিতর্ক আর চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। রমজান ভাইয়ের নিয়ে আসা চা কাপের পর কাপ উড়ে যায়। সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে যায় ঘর।
মাঝে মাঝে দুপুরবেলা শরীফ মিয়ায় এক টাকার বিরিয়ানি খেতে খেতে হেলাল তার সদ্য সমাপ্ত কোনো কোনো কবিতার লাইন আওড়ায়। আমি মুগ্ধ হই। শুনি, ‘যদি কোনদিন আসে আবার দুর্দিন,/ যেদিন ফুরাবে প্রেম, অথবা হবে না প্রেম মানুষে মানুষে,/ ভেঙে সেই কালো কারাগার,/ আবার প্রণয় হবে মারণাস্ত্র তোমার আমার’। কেমন যেন লাগে যখন হেলাল পড়ে, ‘ইচ্ছে ছিল রাজা হবো,/ তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে রাজ্য বাড়াবো,/ আজ দেখি রাজ্য আছে,/ রাজা আছে,/ ইচ্ছে আছে,/ শুধু তুমি অন্যঘরে’। হেলালের মোট বইয়ের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু যে কয়টাই আছে, প্রতিটিই হীরকখণ্ড। আমার নিজের মতে, হেলাল হচ্ছে সেই মুষ্টিমেয় কবির একজন, যে কখনো কোনো খারাপ কবিতা লেখেনি। কারণ, হেলালের শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণু হচ্ছে কবির অণু-পরমাণু।
মনে আছে, কোনো এক সময়ে হেলালের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘কষ্ট’ সবে বেরিয়েছে। রঙের কারবার সব—লাল কষ্ট, নীল কষ্ট, কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট—‘মালটি-কালার কষ্ট...’। শরীফ মিয়ায় দেখা হতেই বললাম, ‘কী সব লিখেছ হে? কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট, মালটি-কালার কষ্ট! ব্যাখ্যা করতে পারবে?’ একমুহূর্ত! হেলাল চোখ বন্ধ করল; তারপর একনিঃশ্বাসে বলে গেল কষ্টের নানান রং। আমি হতবাক! ভাবতেই পারিনি, কষ্টেরও কাঁচা হলুদের রং আছে, আছে বিবিধ বর্ণ।
ইদানীং ফোন করলে মাঝে মাঝে হেলাল শামীম ও আমার—দুজনের সঙ্গেই কথা বলত। সেসব কথায় ও প্রায়ই ‘গো’ শব্দটি ব্যবহার করত—এই যেমন ‘কেমন আছো গো?’ আমরা দুজনে মজা পেতাম। মাঝে মাঝে ও দুঃখ করত, সংসার করল না বলে, নিজের কোনো থিতু নেই বলে, কাছের মানুষ নেই বলে। ওর গলার সেই কষ্ট আমাদের ছুঁয়ে যেত। কখনো কখনো বলত, ‘একা থাকার বড় কষ্ট গো’। সব সময় কথা শেষ করত এই বলে, ‘তোমরা দুজন ভালো থেকো গো’।
আমি হেলালের কবিতার বড় ভক্ত। ওঁর বেশির ভাগ কবিতাই আমি পড়েছি। কিন্তু কবি হিসেবে হেলালের মূল্যায়ন করা আমার অসাধ্য। আমি হেলালের কবিতার পাঠক ও ভোক্তা। মধ্য-আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের কালে তাঁর বিরুদ্ধে আমার নানান লেখায় হেলাল হাফিজের কবিতা উঠে এসেছে স্বাভাবিকভাবে। ‘নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না’ কিংবা ‘আমার কষ্টেরা বেশ ভালোই আছেন, মোটামুটি সুখেই আছেন। প্রিয় দেশবাসী, আপনারা কেমন আছেন?’ এসব পঙ্ক্তির নামাবলি চাপিয়ে আমার বহু লেখা বেরিয়েছে।
তখন প্রতি বৃহস্পতিবার সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে আমার পাক্ষিক কলাম ‘কড়ি-কড়চা’ বেরোচ্ছে। একবার আমার এক লেখায় হেলালের কবিতা ‘যার যেখানে জায়গা’ পুরোটা ব্যবহার করেছিলাম। কথ্য ভাষায় লেখা কবিতাটির শেষ লাইনে একটি মারাত্মক গালি ছিল। সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক হাসনাত ভাই (প্রয়াত আবুল হাসনাত) একটু ইতস্তত করছিলেন। জনান্তিকে শোনা, পরে সন্তোষদার (প্রয়াত সন্তোষ গুপ্ত) সুপারিশ ও বজলু ভাইয়ের (সংবাদ সম্পাদক প্রয়াত বজলুর রহমান) অনুমোদনে তা ছাপা হয়েছিল।
আজ মনে পড়ল, শেষ যখন হেলালের সঙ্গে কথা বলি, তখন গত বছর হেলাল বলেছিল, ‘আমাদেরও তো যাওয়ার সময় হয়ে এলো গে’। সবকিছু ছাপিয়ে হেলালের ওই ‘গো’ ডাকটিই হৃদয়ে বাজবে নিরন্তর।
বিদায় বন্ধু, হেলাল হাফিজ।
নোবেলজয়ী পেরুভিয়ান সাহিত্যিক মারিও বার্গাস যোসা শুধু কথাসাহিত্যের জন্যই নন, মানবিকতা ও বিশ্ব রাজনীতির প্রতি গভীর মনোযোগের জন্যও পরিচিত। বাংলাদেশে এসিড হামলার শিকার নারীদের নিয়ে তাঁর লেখা হৃদয়বিদারক প্রবন্ধ ‘Weaker sex’ প্রমাণ করে, কীভাবে যোসার কলম ছুঁয়ে গিয়েছিল বাংলার পীড়িত নারীদের কান্না ও সংগ্রাম।
৫ দিন আগেনোবেলজয়ী পেরুভিয়ান সাহিত্যিক মারিও বার্গাস যোসা মারা গেছেন। স্থানীয় সময় গতকাল রোববার পেরুর রাজধানী লিমায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তাঁর ছেলে আলভারো বার্গাস যোসা মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
৫ দিন আগেমৃত্তিকাবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলমগীর হাইয়ের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়েছে। শনিবার (১২ এপ্রিল) বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা, ৫ নম্বর গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়।
৬ দিন আগেজর্জ দুহামেল ১৮৮৪ সালের ৩০ জুন প্যারিসের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার আর্থিকভাবে খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। সব মিলিয়ে তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি খুব একটা সুখকর নয়; যা তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস লে নতেয়্যাখ দু হ্যাভখ (Le Notaire du Havre) এ ফুটে ওঠে।
৬ দিন আগে