স্লাভয় জিজেকের নিবন্ধ
অনলাইন ডেস্ক
গত বছরের নভেম্বর থেকে সার্বিয়াজুড়ে যে ব্যাপক শিক্ষার্থী আন্দোলন চলছে, তা স্পষ্টতই ‘অরাজনৈতিক’। কারণ এই আন্দোলনের লক্ষ্য বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার আরেকটি নতুন সংস্করণ মেনে নেওয়া নয়, বরং নতুন এক রাজনীতির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। তরুণ সার্বীয়রা গভীরভাবে উপলব্ধি করছে যে, যতক্ষণ না পুরো ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র—দুটোর একটিও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
চীনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে চলেছে। এই বিষয়টি নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। তরুণ চীনারা ক্রমবর্ধমান হারে এক ধরনের নির্লিপ্ত মনোভাব প্রদর্শন করছে। চীনের এই অবস্থাকে নতুন জনপ্রিয় শব্দবন্ধ ‘বাই লান’ অর্থাৎ ‘এটাকে পচতে দাও’—এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।
এই প্রবণতার উৎস অর্থনৈতিক হতাশা ও দমবন্ধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহের প্রতি গভীর অসন্তোষ। চীনাদের মাঝে জেগে ওঠা এই ‘বাই লান’ মূলত প্রতিযোগিতামূলক জীবন থেকে সরে আসার মনোভাব। এই মানসিকতায় ক্যারিয়ারে উন্নতির পরিবর্তে ব্যক্তির সুস্থতা ও মানসিক শান্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই মনোভাব কর্মক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির কেবল ন্যূনতম প্রচেষ্টা জারি রাখার পক্ষে যুক্তি দেয় এবং প্রচলিত ‘ইঁদুর দৌড়’ পরিহারের আহ্বান জানায়।
চীনাদের মাঝে এই একই মনোভাব প্রকাশে আরেকটি শব্দবন্ধ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে— ‘তাং পিং’ অর্থাৎ ‘শুয়ে থাকো’। প্রবাদে পরিণত হওয়া এই নতুন শব্দবন্ধটি চীনা সমাজে ক্রমাগত সামাজিক ও পেশাগত প্রতিযোগিতার মুখে এক প্রকার নীরব আত্মসমর্পণের অনুভূতি প্রকাশ করে। উভয় শব্দবন্ধই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সামাজিক চাপকে প্রত্যাখ্যান করার নিশানা। সেই সঙ্গে সামাজিক সম্পৃক্ততাকে এমন এক বৃথা প্রয়াস হিসেবে চিত্রিত করে এবং যে কোনো মূল্যে বস্তুগত কিছু অর্জন করতেই হবে— এই প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করে।
গত বছরের জুলাইয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খুব চাপ নিয়ে কাজ করতে হয় এমন চাকরি ছেড়ে কায়িক শ্রমের দিকে ঝুঁকছেন অনেক চীনা। এই বিষয়ে চীনের উহানের ২৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তাঁর উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে কম বেতনের কায়িক শ্রমের কাজ নেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করি। দেশে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়ির পরিচ্ছন্নতা ও গৃহস্থালি সেবার চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে...এতে যে পরিবর্তন এসেছে তা হলো, কাজের চাপে আমার মাথা আর চক্কর দেয় না! মানসিক চাপ অনেক কমে গেছে। আর প্রতিদিনই আমি উদ্যমে ভরপুর থাকি।’
এ ধরনের মনোভাবকে অরাজনৈতিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এই মনোভাব ক্ষমতার বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধ এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যেকোনো সংলাপ—উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে।
কিন্তু ক্ষমতাহীন ও বিচ্ছিন্ন মানুষের জন্য কি কেবল এই দুটি পথই খোলা আছে?
সার্বিয়ায় চলমান গণবিক্ষোভ ভিন্ন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা শুধু এটি স্বীকার করেই থেমে থাকছে না যে, সার্বিয়ার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গভীর পচন ধরেছে, বরং তারা এটাও দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তারা এই পচনকে আর বাড়তে দিতে রাজি নয়।
গত নভেম্বরে সার্বিয়ার নোভি সাদ শহরে সম্প্রতি সংস্কার করা একটি রেলস্টেশনের ছাদ ধসে ১৫ জন নিহত এবং দুজন গুরুতর আহত হওয়ার পর এই বিক্ষোভের সূত্রপাত। এরপর থেকেই এই আন্দোলন সার্বিয়ার ২০০টি শহর ও জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে লাখো মানুষ অংশ নিচ্ছে। ১৯৬৮ সালের পর ইউরোপের বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন এটি।
নিঃসন্দেহে ছাদ ধসে পড়ার ঘটনাটি কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ ছিল। আর এই স্ফুলিঙ্গ সার্বদের মনে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। প্রতিবাদকারীদের উদ্বেগ শুধু এই একটি ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা বহু বিষয়ে বিস্তৃত। ব্যাপক দুর্নীতি ও পরিবেশগত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে শুরু করে (সরকার সম্পূর্ণ মাত্রায় লিথিয়াম খনিতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে) সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দর ভুসিচের জনগণের প্রতি যে অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব, সবই তাদের ক্ষোভের উৎস। খনিতে বিনিয়োগকে সরকার বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করলেও তরুণ সার্বদের কাছে এটি মূলত দুর্নীতিকে আড়াল করার, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে জাতীয় সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার এবং ধীরে ধীরে বিরোধী গণমাধ্যম নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
কিন্তু কী কারণে সার্বিয়ার শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ অনন্য? বিক্ষোভকারীদের প্রধান বক্তব্য হলো: ‘আমাদের কোনো রাজনৈতিক দাবি নেই এবং আমরা বিরোধী দলগুলোর থেকে দূরত্ব বজায় রাখছি। আমরা শুধু চাই, সার্বিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের স্বার্থে কাজ করুক।’
এই লক্ষ্যে তারা খুব স্পষ্টভাবে চারটি বিষয়ে জোর দিচ্ছে, নোভি সাদ রেলস্টেশনের সংস্কারকাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সব নথিতে সবার পূর্ণাঙ্গ প্রবেশাধিকার, গত নভেম্বরের প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থাকা সব অভিযোগ প্রত্যাহার এবং বেলগ্রেডে শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা।
আর এসব দাবির মাধ্যমে বিক্ষোভকারীরা সেই প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ করতে চায়, যা ক্ষমতাসীন দলকে সব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জিম্মি করার সুযোগ দিয়েছে। বিপরীতে ভুসিচের সরকার সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং একই সঙ্গে একটি কৌশলও প্রয়োগ করছে। বক্সিংয়ে এই কৌশলটি ‘ক্লিনচিং’ নামে পরিচিত। যেখানে একজন প্রতিযোগী প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ধরে স্বাধীনভাবে ঘুষি মারতে বাধা দেয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে ভুসিচ যত বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন, ততই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কোনো না কোনো সমঝোতা করার মরিয়া চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা যে কোনো ধরনের সংলাপ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা তাদের দাবি স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছে এবং শর্তহীনভাবে সেগুলোর বাস্তবায়ন চেয়ে অনড় অবস্থান নিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে, গণবিক্ষোভ থেকে কমবেশি সহিংসতার হুমকি দেওয়া হয় এবং এর ওপরই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করে। তবে এ ধরনের হুমকির সঙ্গে সাধারণত বিক্ষোভকারীরা আলোচনারও একধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। কিন্তু সার্বিয়ার ক্ষেত্রে আমরা ঠিক উল্টো একটি চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিক্ষোভকারীরা সহিংসতার কোনো হুমকি দিচ্ছে না, আবার তারা সংলাপের পথও পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই সরলতা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, যেমনটি করছে স্পষ্ট নেতৃত্বের অনুপস্থিতি। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিলে, এই বিক্ষোভের মধ্যে চীনের ‘বাই লান’ ধারণার কিছুটা সাদৃশ্য দেখা যায়।
তবে একপর্যায়ে এই আন্দোলনকে এক ধরনের সংগঠিত রাজনীতিতে অবশ্যই প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু আপাতত, বিক্ষোভকারীদের ‘অরাজনৈতিক’ অবস্থান এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্র তৈরি করছে এবং এই বাস্তবতা নতুন বোতলে পুরোনো মদ টাইপ কিছু নয়, বরং একেবারেই ভিন্ন কিছু। আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, মাঠ পুরোপুরি পরিষ্কার করতে হবে।
সার্বিয়ার বিক্ষোভকারীদের এই মনোভাব বিশ্বের বাকি অংশে যারা নতুন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে, তাদের প্রতিবাদকে শর্তহীন (নৈতিক) সমর্থন দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই মনোভাবের ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সহজ–সরল আহ্বানও নৈরাজ্যের চেয়ে বেশি বিধ্বংসী হতে পারে। সার্বরা আইনের শাসন চায়, তবে এমন সব অলিখিত নিয়ম ছাড়া যা দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্রের জন্য দরজা খুলে দেয়।
সার্বিয়ার আন্দোলনকারীরা সেই পুরোনো অরাজক বামপন্থী আন্দোলন থেকে অনেক দূরে। নোভি সাদে দানিয়ুব নদীর ওপরের একটি সেতু ২৪ ঘণ্টা অবরোধ করার পর, তরুণ প্রতিবাদকারীরা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রতিবাদ আরও তিন ঘণ্টা বাড়াবে, যাতে করে ওই এলাকা পরিষ্কার করা যেতে পারে।
যদিও কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, সার্বিয়ার আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যহীনতা চালাকি হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে তারা বিদ্যমান (অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রকাশিত) নিয়ম অনুসারে, রাজনীতি করতে অস্বীকার করছে। তারা মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ করার পদ্ধতিতে গভীর পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে।
সার্বিয়ার আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখজনক দ্বিচারিতা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা ভুসিচের ওপর বল প্রয়োগ থেকে বিরত আছে এই আশঙ্কায় যে, তিনি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকবেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়ন ‘গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা’ জর্জিয়ার জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনিই সার্বিয়ায় বিদ্রোহ সম্পর্কে অত্যন্ত নীরব। অথচ সার্বিয়া ২০১২ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য প্রার্থীর তালিকায় আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুসিচকে তাঁর পথে চলতে দিয়েছে কারণ তিনি স্থিতিশীলতা এবং লিথিয়ামের রপ্তানি—যা বৈদ্যুতিক যানবাহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সার্বিয়ার নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিন্দুমাত্র সমালোচনা করেনি। এই বিষয়টি সার্বিয়ার নাগরিক সমাজকে অন্ধকারে রেখে দিয়েছে। এখন আমাদের কি অবাক হওয়া উচিত যে, প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তেমন কোনো পতাকা দেখা যাচ্ছে না? ২০ বছর আগে ইউক্রেনে ‘গণতান্ত্রিক পশ্চিমে যোগদানের’ উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল কালার রেভ্যুলিউশন, কিন্তু সার্ব তরুণদের কাছ এখন তা আর কোনো গুরুত্ব রাখে না। এর অর্থ হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাজনৈতিক দীনতার অনেক নিম্নস্তরে নেমে গেছে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
গত বছরের নভেম্বর থেকে সার্বিয়াজুড়ে যে ব্যাপক শিক্ষার্থী আন্দোলন চলছে, তা স্পষ্টতই ‘অরাজনৈতিক’। কারণ এই আন্দোলনের লক্ষ্য বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার আরেকটি নতুন সংস্করণ মেনে নেওয়া নয়, বরং নতুন এক রাজনীতির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। তরুণ সার্বীয়রা গভীরভাবে উপলব্ধি করছে যে, যতক্ষণ না পুরো ব্যবস্থার খোলনলচে বদলে দেওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র—দুটোর একটিও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়।
চীনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে চলেছে। এই বিষয়টি নিয়ে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। তরুণ চীনারা ক্রমবর্ধমান হারে এক ধরনের নির্লিপ্ত মনোভাব প্রদর্শন করছে। চীনের এই অবস্থাকে নতুন জনপ্রিয় শব্দবন্ধ ‘বাই লান’ অর্থাৎ ‘এটাকে পচতে দাও’—এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে।
এই প্রবণতার উৎস অর্থনৈতিক হতাশা ও দমবন্ধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহের প্রতি গভীর অসন্তোষ। চীনাদের মাঝে জেগে ওঠা এই ‘বাই লান’ মূলত প্রতিযোগিতামূলক জীবন থেকে সরে আসার মনোভাব। এই মানসিকতায় ক্যারিয়ারে উন্নতির পরিবর্তে ব্যক্তির সুস্থতা ও মানসিক শান্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই মনোভাব কর্মক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির কেবল ন্যূনতম প্রচেষ্টা জারি রাখার পক্ষে যুক্তি দেয় এবং প্রচলিত ‘ইঁদুর দৌড়’ পরিহারের আহ্বান জানায়।
চীনাদের মাঝে এই একই মনোভাব প্রকাশে আরেকটি শব্দবন্ধ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে— ‘তাং পিং’ অর্থাৎ ‘শুয়ে থাকো’। প্রবাদে পরিণত হওয়া এই নতুন শব্দবন্ধটি চীনা সমাজে ক্রমাগত সামাজিক ও পেশাগত প্রতিযোগিতার মুখে এক প্রকার নীরব আত্মসমর্পণের অনুভূতি প্রকাশ করে। উভয় শব্দবন্ধই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সামাজিক চাপকে প্রত্যাখ্যান করার নিশানা। সেই সঙ্গে সামাজিক সম্পৃক্ততাকে এমন এক বৃথা প্রয়াস হিসেবে চিত্রিত করে এবং যে কোনো মূল্যে বস্তুগত কিছু অর্জন করতেই হবে— এই প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করে।
গত বছরের জুলাইয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খুব চাপ নিয়ে কাজ করতে হয় এমন চাকরি ছেড়ে কায়িক শ্রমের দিকে ঝুঁকছেন অনেক চীনা। এই বিষয়ে চীনের উহানের ২৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তাঁর উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে কম বেতনের কায়িক শ্রমের কাজ নেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করি। দেশে জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরবাড়ির পরিচ্ছন্নতা ও গৃহস্থালি সেবার চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে...এতে যে পরিবর্তন এসেছে তা হলো, কাজের চাপে আমার মাথা আর চক্কর দেয় না! মানসিক চাপ অনেক কমে গেছে। আর প্রতিদিনই আমি উদ্যমে ভরপুর থাকি।’
এ ধরনের মনোভাবকে অরাজনৈতিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এই মনোভাব ক্ষমতার বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধ এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যেকোনো সংলাপ—উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে।
কিন্তু ক্ষমতাহীন ও বিচ্ছিন্ন মানুষের জন্য কি কেবল এই দুটি পথই খোলা আছে?
সার্বিয়ায় চলমান গণবিক্ষোভ ভিন্ন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা শুধু এটি স্বীকার করেই থেমে থাকছে না যে, সার্বিয়ার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গভীর পচন ধরেছে, বরং তারা এটাও দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তারা এই পচনকে আর বাড়তে দিতে রাজি নয়।
গত নভেম্বরে সার্বিয়ার নোভি সাদ শহরে সম্প্রতি সংস্কার করা একটি রেলস্টেশনের ছাদ ধসে ১৫ জন নিহত এবং দুজন গুরুতর আহত হওয়ার পর এই বিক্ষোভের সূত্রপাত। এরপর থেকেই এই আন্দোলন সার্বিয়ার ২০০টি শহর ও জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে লাখো মানুষ অংশ নিচ্ছে। ১৯৬৮ সালের পর ইউরোপের বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন এটি।
নিঃসন্দেহে ছাদ ধসে পড়ার ঘটনাটি কেবল একটি স্ফুলিঙ্গ ছিল। আর এই স্ফুলিঙ্গ সার্বদের মনে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। প্রতিবাদকারীদের উদ্বেগ শুধু এই একটি ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা বহু বিষয়ে বিস্তৃত। ব্যাপক দুর্নীতি ও পরিবেশগত ধ্বংসযজ্ঞ থেকে শুরু করে (সরকার সম্পূর্ণ মাত্রায় লিথিয়াম খনিতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে) সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দর ভুসিচের জনগণের প্রতি যে অবজ্ঞাপূর্ণ মনোভাব, সবই তাদের ক্ষোভের উৎস। খনিতে বিনিয়োগকে সরকার বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করলেও তরুণ সার্বদের কাছে এটি মূলত দুর্নীতিকে আড়াল করার, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে জাতীয় সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার এবং ধীরে ধীরে বিরোধী গণমাধ্যম নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
কিন্তু কী কারণে সার্বিয়ার শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ অনন্য? বিক্ষোভকারীদের প্রধান বক্তব্য হলো: ‘আমাদের কোনো রাজনৈতিক দাবি নেই এবং আমরা বিরোধী দলগুলোর থেকে দূরত্ব বজায় রাখছি। আমরা শুধু চাই, সার্বিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের স্বার্থে কাজ করুক।’
এই লক্ষ্যে তারা খুব স্পষ্টভাবে চারটি বিষয়ে জোর দিচ্ছে, নোভি সাদ রেলস্টেশনের সংস্কারকাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সব নথিতে সবার পূর্ণাঙ্গ প্রবেশাধিকার, গত নভেম্বরের প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থাকা সব অভিযোগ প্রত্যাহার এবং বেলগ্রেডে শিক্ষার্থী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা।
আর এসব দাবির মাধ্যমে বিক্ষোভকারীরা সেই প্রক্রিয়াটিকে বন্ধ করতে চায়, যা ক্ষমতাসীন দলকে সব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জিম্মি করার সুযোগ দিয়েছে। বিপরীতে ভুসিচের সরকার সহিংস প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং একই সঙ্গে একটি কৌশলও প্রয়োগ করছে। বক্সিংয়ে এই কৌশলটি ‘ক্লিনচিং’ নামে পরিচিত। যেখানে একজন প্রতিযোগী প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে ধরে স্বাধীনভাবে ঘুষি মারতে বাধা দেয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে ভুসিচ যত বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হচ্ছেন, ততই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কোনো না কোনো সমঝোতা করার মরিয়া চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা যে কোনো ধরনের সংলাপ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা তাদের দাবি স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছে এবং শর্তহীনভাবে সেগুলোর বাস্তবায়ন চেয়ে অনড় অবস্থান নিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে, গণবিক্ষোভ থেকে কমবেশি সহিংসতার হুমকি দেওয়া হয় এবং এর ওপরই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করে। তবে এ ধরনের হুমকির সঙ্গে সাধারণত বিক্ষোভকারীরা আলোচনারও একধরনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। কিন্তু সার্বিয়ার ক্ষেত্রে আমরা ঠিক উল্টো একটি চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিক্ষোভকারীরা সহিংসতার কোনো হুমকি দিচ্ছে না, আবার তারা সংলাপের পথও পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। এই সরলতা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে, যেমনটি করছে স্পষ্ট নেতৃত্বের অনুপস্থিতি। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিলে, এই বিক্ষোভের মধ্যে চীনের ‘বাই লান’ ধারণার কিছুটা সাদৃশ্য দেখা যায়।
তবে একপর্যায়ে এই আন্দোলনকে এক ধরনের সংগঠিত রাজনীতিতে অবশ্যই প্রবেশ করতে হবে। কিন্তু আপাতত, বিক্ষোভকারীদের ‘অরাজনৈতিক’ অবস্থান এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ক্ষেত্র তৈরি করছে এবং এই বাস্তবতা নতুন বোতলে পুরোনো মদ টাইপ কিছু নয়, বরং একেবারেই ভিন্ন কিছু। আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে হলে, মাঠ পুরোপুরি পরিষ্কার করতে হবে।
সার্বিয়ার বিক্ষোভকারীদের এই মনোভাব বিশ্বের বাকি অংশে যারা নতুন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে, তাদের প্রতিবাদকে শর্তহীন (নৈতিক) সমর্থন দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এই মনোভাবের ক্ষেত্রে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সহজ–সরল আহ্বানও নৈরাজ্যের চেয়ে বেশি বিধ্বংসী হতে পারে। সার্বরা আইনের শাসন চায়, তবে এমন সব অলিখিত নিয়ম ছাড়া যা দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্রের জন্য দরজা খুলে দেয়।
সার্বিয়ার আন্দোলনকারীরা সেই পুরোনো অরাজক বামপন্থী আন্দোলন থেকে অনেক দূরে। নোভি সাদে দানিয়ুব নদীর ওপরের একটি সেতু ২৪ ঘণ্টা অবরোধ করার পর, তরুণ প্রতিবাদকারীরা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্রতিবাদ আরও তিন ঘণ্টা বাড়াবে, যাতে করে ওই এলাকা পরিষ্কার করা যেতে পারে।
যদিও কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, সার্বিয়ার আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যহীনতা চালাকি হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে তারা বিদ্যমান (অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপ্রকাশিত) নিয়ম অনুসারে, রাজনীতি করতে অস্বীকার করছে। তারা মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ করার পদ্ধতিতে গভীর পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে।
সার্বিয়ার আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখজনক দ্বিচারিতা করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তারা ভুসিচের ওপর বল প্রয়োগ থেকে বিরত আছে এই আশঙ্কায় যে, তিনি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকবেন। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়ন ‘গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা’ জর্জিয়ার জনগণের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তিনিই সার্বিয়ায় বিদ্রোহ সম্পর্কে অত্যন্ত নীরব। অথচ সার্বিয়া ২০১২ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য প্রার্থীর তালিকায় আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুসিচকে তাঁর পথে চলতে দিয়েছে কারণ তিনি স্থিতিশীলতা এবং লিথিয়ামের রপ্তানি—যা বৈদ্যুতিক যানবাহনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সার্বিয়ার নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ থাকলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিন্দুমাত্র সমালোচনা করেনি। এই বিষয়টি সার্বিয়ার নাগরিক সমাজকে অন্ধকারে রেখে দিয়েছে। এখন আমাদের কি অবাক হওয়া উচিত যে, প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তেমন কোনো পতাকা দেখা যাচ্ছে না? ২০ বছর আগে ইউক্রেনে ‘গণতান্ত্রিক পশ্চিমে যোগদানের’ উদ্দেশ্যে শুরু হয়েছিল কালার রেভ্যুলিউশন, কিন্তু সার্ব তরুণদের কাছ এখন তা আর কোনো গুরুত্ব রাখে না। এর অর্থ হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাজনৈতিক দীনতার অনেক নিম্নস্তরে নেমে গেছে।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান
ভারতের বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির পরিকল্পনায় আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলেন টেক মোগল ইলন মাস্ক। রাজধানী নয়াদিল্লি ও মুম্বাইয়ে শোরুম স্থাপনের জন্য স্থান নির্ধারণ করেছে টেসলা। পাশাপাশি কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াও জোরদার করছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মাস্কের
৪ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি এবং উচ্চ বৈদেশিক ঋণের চাপে রয়েছে, সামগ্রিক পরিস্থিতি এসব দেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার সক্ষমতাকে সীমিত করছে।
১০ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের ২২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বেইজিং সফর শুরু করেছেন। এই দলে রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজের সদস্য, শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিকেরা রয়েছেন। এই দলটি গতকাল সোমবার ১০ দিনের সফরে চীন গেছে। প্রতিনিধি দলের এক নেতা বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন, তাঁরা চীন সরকার ও ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতাদ
৩ দিন আগেবিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে একটি নতুন প্রশাসন ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় বসেছে। এই প্রশাসন সরকারি আমলাতন্ত্রকে আরও কার্যকর করতে কর্পোরেট দক্ষতা ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। তারা লাখ লাখ সরকারি কর্মচারীকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে এবং বাজেটে ভারসাম্য
৪ দিন আগে