Ajker Patrika

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের নিবন্ধ /ইসরায়েল নয়, যুদ্ধের পর ইরানের পাশেই থাকছে সৌদি আরব

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১৮: ৪৬
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সৌদি আরব বরং তেহরানের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের পর সৌদি আরব বরং তেহরানের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত

ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যকে নতুনভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি বারবার সামনে আনছেন।

কিছুদিন আগেই নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘সৌদি আরব ও অন্যদের সঙ্গে কীভাবে শান্তিচুক্তি করব, সেটা আমাকেই দেখতে দিন।’ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলা এবং গাজায় যুদ্ধের আগে রিয়াদের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল ইসরায়েল। গত সপ্তাহে স্থানীয় গণমাধ্যমে নেতানিয়াহু বলেন, ‘বিশ্বাস করুন, শুধু ভাবিনি, এখনো ভাবছি।’

কিন্তু অন্তত সৌদি আরবের ক্ষেত্রে এখন এটা আর স্পষ্ট নয়। ৭ অক্টোবরের পর থেকে সৌদি আরবের হিসাব-নিকাশ নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এবং ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের তৎপরতা এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপ সৌদি আরবকে আরও বেশি সতর্ক করে তুলেছে। দেশটি এখন ইসরায়েলকে ক্রমবর্ধমানভাবে যুদ্ধবাজ ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী শক্তি হিসেবে দেখছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সৌদি আরব প্রকাশ্যে তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করার পদক্ষেপ নিয়েছে।

সৌদি সরকারের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে অবগত এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘পারস্য উপসাগরের দেশগুলো ইরানের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নয়নের পথ ধরে রাখবে। এটা সবচেয়ে বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এর ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে এবং সৌদি আরব ফিলিস্তিনি ইস্যুতে তাদের দাবির ব্যাপারে আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

বাহরাইনের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য নীতির জ্যেষ্ঠ গবেষক হাসান আল-হাসান বলেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কারণে সৌদি আরবের যে ভাব-মর্যাদাগত ক্ষতি হবে, তা এখন অনেক বেশি। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিক থেকে এবং তাদের আঞ্চলিক ও ইসলামি নেতৃত্বের অবস্থানের জন্যও।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যে পরিকল্পনা করেছিলেন, তাতে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার কথা ছিল। এটা বাস্তবায়িত হলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিন্যাসে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আসত।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্ট থাকার সময়, ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, যা ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত। কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে এমন চুক্তি হলে সেটা হতো ইসরায়েলের জন্য আরও বড় কূটনৈতিক সাফল্য। কারণ, সৌদি আরব শুধু ইসলামি বিশ্বের শীর্ষ নেতৃত্বের দেশ নয়, বরং বহুদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে আসছে।

কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর সবকিছু বদলে যায়। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বারবার গাজায় ইসরায়েলের ক্ষুব্ধ আক্রমণকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। উপসাগরীয় অঞ্চলের কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এই ধ্বংসযজ্ঞের ছবি নতুন প্রজন্মকে আরও বেশি উগ্রপন্থার দিকে ঠেলে দেবে। এই যুদ্ধ সৌদি আরবের যুবসমাজের মধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি অত্যন্ত অজনপ্রিয় করে তুলেছে। অথচ যুবসমাজকে কেন্দ্র করেই ক্রাউন প্রিন্স তার অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তাই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে যুদ্ধবিরতি এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে দৃশ্যমান অগ্রগতি থাকতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ায় সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে। সুন্নি-অধ্যুষিত সৌদি আরব ও শিয়া-অধ্যুষিত ইরানের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে বৈরিতা বজায় ছিল। ইয়েমেন ও লেবাননের মতো দেশে ইরানের মদদপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতিকে সৌদি আরব বরাবরই বড় নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখে এসেছে।

কিন্তু ২০১৯ সালে পারস্য উপসাগরের জ্বালানি স্থাপনার ওপর হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিশ্র প্রতিক্রিয়া’ দেখে সৌদি আরব কৌশল বদলানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওই হামলার জন্য তেহরানকে দায়ী করেছিল রিয়াদ। এরপর ২০২৩ সালের মার্চে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়।

এরপর থেকে মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান নিয়মিত ফোনে কথা বলছেন। অন্য উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারাও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। কারণ, সৌদি আরব আশঙ্কা করছে, বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতে তারা জড়িয়ে পড়বে।

ইসরায়েলের আক্রমণের নিন্দা জানিয়েছে সৌদি আরব। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রিন্স খালিদ বিন সালমান গত রোববার নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান আব্দুলরহিম মুসাভির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তাঁরা ‘নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রচেষ্টা’ নিয়ে আলোচনা করেন। সৌদি আরবের জন্য ইসরায়েলের হাতে ইরান এবং তাদের আঞ্চলিক প্রক্সি গোষ্ঠী; যেমন হিজবুল্লাহ, দুর্বল হলে তেহরান থেকে আসা হুমকি কিছুটা কমে যায়। তবে এ নিয়ে শঙ্কাও আছে। কারণ, এতে ইরান আগের চেয়ে আরও বেশি পরমাণু অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করতে পারে।

ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের গবেষক গ্রেগরি গাউস বলেন, ‘২০২২ সালের ইরান আর ২০২৫ সালের ইরান এক নয়। ২০২৫ সালের “বিজয়ী ইসরায়েল” এখন আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য আরও বেশি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।’

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সৌদি আরবের জন্য ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক আনুকূল্য অর্জনের পথ খুলে দেবে। আর ট্রাম্প আগেই পরিষ্কার করেছেন; তিনি চান, সৌদি আরব আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দিক। মে মাসে রিয়াদ সফরে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা হবে একটা বিশেষ ব্যাপার।’

যুদ্ধের পর ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট (ট্রাম্প) বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন, আরও দেশ আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দিতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা এটা নিয়ে এগিয়ে যাব। কারণ, আসল সমস্যা ছিল ইরান।’

তবে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চেয়ে অপেক্ষাকৃত সহজ এবং দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপ হতে পারে একটি সীমিত ‘অসহযোগিতা পরিহার’ বা নিরাপত্তা চুক্তি। এমন চুক্তির লক্ষ্য হতে পারে ইসরায়েলের প্রতিবেশী সিরিয়া, যেখানে আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ট্রাম্পকে খুশি রাখতে সৌদি আরব ও অন্য উপসাগরীয় দেশগুলো আরেকটি পথ বেছে নিয়েছে—অর্থ। মে মাসে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় উপসাগরীয় দেশগুলো বহু ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের আশা, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি এবং উন্নত অস্ত্রের প্রবেশাধিকার পাওয়া যাবে।

আল-হাসান বলেন, ‘ট্রাম্পের মতো সৌদি আরবের ওপর এতটা সময়ের চাপ নেই চুক্তি করতে। তাদের কিছু উদ্বেগ থাকলেও তারা এতটাই আরামদায়ক ভূরাজনৈতিক অবস্থানে আছে যে, যা তারা করতে চায় না, সেটা করার জন্য তাদের কোনো চাপ নেই।’

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত