এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জিততে যাচ্ছে—এই বিষয়টি জনমনে গেঁথে দিতে যে রাজনৈতিক কূটকৌশল ও শক্তিশালী মিথ্যা বয়ান দলটি হাজির করেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কারণ, এর মধ্য দিয়েই ভারতের গণতন্ত্রের ক্ষয় প্রায় নিশ্চিতভাবেই ত্বরান্বিত হয়েছে।
ছয় সপ্তাহ ধরে চলা ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সাত ধাপে প্রায় একশ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছেন। বিষয়টি গণতন্ত্রের একটি দারুণ নজির স্থাপন করেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বাস্তবতা হলো—এর মধ্য দিয়ে ভারতের দশকব্যাপী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ক্ষয়কেই সুনিশ্চিত করা হয়েছে। যার মধ্যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নাই করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরও যে নেতা এই ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই নরেন্দ্র মোদি এখনো ভারতে বিপুল জনপ্রিয়।
বিজেপির মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের লাখো কোটি স্বেচ্ছাসেবীর শ্রমসাধ্য প্রয়াস মোদিকে এই জনপ্রিয়তা দিয়েছে। এর বাইরে, একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেছেন কিছু কট্টরপন্থী পণ্ডিতও। যদিও এই দুই শ্রেণির কার্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে। তবুও সেগুলো মোদির জনপ্রিয়তা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
২০২২ সালে প্রকাশিত আমার বই ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড অব ইনসিকিউরিটি: ডেমোক্রেটিক ডিজএনচ্যান্টমেন্ট ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিজ’— এ আমি দেখিয়েছিলাম যে, এ ধরনের শক্তিগুলো (আরএসএস, বিজেপি এবং কট্টরপন্থী পণ্ডিত) সাধারণত অল্পশিক্ষিত, গ্রামীণ ও বৃদ্ধদের নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করে। তবে শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির মাঝেও মোদির প্রতি সমর্থন আছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মতো লোকরঞ্জনবাদী নেতারা ভোটে শহরে জয় পেতে হাঁসফাঁস করেছেন। সেখানে নরেন্দ্র মোদি দিল্লি, মুম্বাই ও বেঙ্গালুরুর মতো মেগাসিটিগুলোতে ব্যাপক জয় পেয়েছেন।
এমনটা হওয়ার মূল কারণ হলো—রাজনৈতিক উদারতাবাদ বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে আস্থা, সরকারের ক্ষমতায় ভারসাম্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ ইত্যাদি পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ভারতের অভিজাত শ্রেণির বাইরে কখনোই দেখা যায়নি। ২০২৩ সালে পিউ রিসার্চের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ ভারতীয় মনে করেন, আদালত বা সংসদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই যে শক্তিশালী নেতা নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাঁকেই তাঁদের পছন্দ। এই অনুপাত জরিপের অধীন দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
লোকরঞ্জনবাদী পণ্ডিতেরা সব সময়ই গণতন্ত্রের অংশগ্রহণমূলক দিকগুলোর ওপর জোর দেন। কিন্তু ভারতে এই বিষয়ের যে পদ্ধতিগত দুর্বলতাগুলো আছে সে বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি যে ভয়ংকর রূপ নিয়ে ভিন্নমতাবলম্বী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালাতে পারে সেসব বিষয়ে কোনো কথা বলেন না।
বামপন্থীদের মধ্যেও অ–উদারতাবাদের বিকাশ লাভ করেছে। তাদের কাছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী। এমনকি মহাত্মা গান্ধী—যিনি তাঁর সহনশীলতা ও সহানুভূতির মূল্যবোধের জন্য বিখ্যাত— তাঁর অনুসারীদের মাঝেও গণতন্ত্র হলো পুরুষতন্ত্র ও বংশ পরম্পরায় চলে আসা মূল্যবোধের বিকাশের হাতিয়ার। ফলে এটি জানা কথাই যে, বিজেপি–আরএসএসের মতো যারা হিন্দুত্ববাদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করেন, তাঁরা উদারতাবাদের দিকে ঝুঁকবেন না এটাই স্বাভাবিক।
গরিব ভারতীয়দের মধ্যে যারা আগে মধ্য–বাম ঘেঁষা জাতীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ঝুঁকে ছিলেন তারাও আজকাল বিজেপির প্রতি নিবেদিত। এর মূল কারণ হলো—বিজেপির হিন্দুদের সংহত করার কৌশল কৌশল। যার মাধ্যমে, দলটি ঐতিহাসিক নেতাদের এমনকি দেবতা চরিত্রগুলোকে হিন্দুকরণ করে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে দলটি বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ভারতীয়দের একটি বড় অংশকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের একটি বড় ছাতার নিচে আনতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে বিজেপিকে সহায়তা করেছে, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক উদ্যোগ। এসব উদ্যোগকে প্রায়ই সরকারের তরফ থেকে ‘মোদির উপহার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর বাইরে, বিভিন্ন বর্ণহিন্দু গোষ্ঠীর নেতাদের বিভিন্ন সরকারি পদে এনে মোদি আরও চমক সৃষ্টি করেছেন।
দুটি ন্যারেটিভ বা বয়ান বিজেপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও কোনোটিই আসলে সেই অর্থে কখনোই যাচাইবাছাই বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আতশ কাচের নিচে বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। প্রথমটি হলো—মোদি সরকার একাই দুর্নীতির দানবকে নির্মূল করতে সক্ষম। তবে তাঁর প্রশাসন এই লাইনে খুব একটা অগ্রগতি লাভ করেছে এমন প্রমাণ খুব একটা নেই। বরং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি সূচক অনুসারে, ভারত ২০২৩ সালে দুর্নীতিতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ৯৩ তম স্থানে ছিল। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর এই সূচকে ভারতে আট ধাপ নেমেছে। ভারতের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায়ও দেখা যায়, ভারতের ৫৫ শতাংশ মানুষই মনে করেন, গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি বেড়েছে।
ভারতে ছোটখাটো দুর্নীতি রয়েই গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তা, পরিদর্শক বা ঠিকাদারদের ঘুষের দাবি কমেছে বলে মনে হয় না। তদুপরি, ২০১৬ সালে মোদি সরকার যে বিপর্যয়কর ডি–মনিটাইজেশন বা নোট বাতিল কার্যক্রম শুরু করে, তা কালো টাকার মালিকদের শায়েস্তা করার জন্য বলা হলেও চূড়ান্তভাবে তা দেশটির ছোট ব্যবসা ও দরিদ্রদেরই বেশি ক্ষতি করেছিল। মূল উদ্দেশ্যের খুব একটা বাস্তবায়িত হয়েছে বলা যাবে না। আবার বড় বড় দুর্নীতি কমেছে বলে বিশ্বাস করারও খুব একটা কারণ নেই। বড় সরকারি প্রকল্পগুলোতে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কর্মকর্তাদের মোটা ‘কমিশন’ নেওয়ার প্রচুর গল্প বাজারে আছে। সরকার এসব চোখে না দেখলেও বিরোধী নেতাদের দুর্নীতির জন্য হয়রানি করা তাদের নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বিজেপিতে যোগ দিয়ে পার পেয়ে গেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন নেতা। এই দলবদলের গল্প হয়তো সামগ্রিকভাবে দুর্নীতির মামলা বা অভিযোগ নির্মূলে ভূমিকা রাখে, কিন্তু তা কোনোভাবেই দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হবে না।
অপরদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যমের ওপর প্রায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা নিশ্চিত করেছে বিজেপি। রাজনীতি এবং ব্যবসার মধ্যকার সম্পর্কটা তারা আড়ালেই রাখবে। কিন্তু আমরা জানি, চূড়ান্ত ক্ষমতাচর্চা দুর্নীতিকেও চরমে পৌঁছে দিতে পারে। বিশেষ করে, দুর্নীতিতে জড়িত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ করে তাদের একধরনের ‘সার্বভৌম দায়মুক্তি’ দিয়েছে সরকার।
দীর্ঘদিন ধরেই এই সন্দেহ আছে, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিজেপির নেতাদের পকেটে গেছে। এই অর্থ লেনদেনের একটি মাধ্যম ছিল ইলেকটোরাল বন্ড। মোদির সরকার ২০১৭ সালে এটি চালু করেছিল। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও সংস্থাকে পরিচয় লুকিয়ে বিজেপি তহবিল জোগানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট এই বন্ড অবৈধ ঘোষণা করে।
স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ইলেকটোরাল বন্ড স্কিম চালু করার পর থেকে ৩০টি ধাপে ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি রুপির বন্ড ছাড়া হয়। বন্ড কেনায় শীর্ষে রয়েছে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী মার্টিন সান্তিয়াগোর সংস্থা ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’। এই প্রতিষ্ঠান কিনেছে মোট ১ হাজার ৩৬৮ কোটি রুপির বন্ড।
বন্ড কেনায় টাকার অঙ্কে তাদের পরেই রয়েছে বিখ্যাত তেলেগু ব্যবসায়ী কৃষ্ণা রেড্ডির সংস্থা ‘মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’। তারা ৯৬৬ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। মূলত হায়দরাবাদ কেন্দ্রিক এই সংস্থা একাধিক সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি পেয়েছে। এ ছাড়া মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী সংস্থা ‘ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড’ ২২০ কোটি রুপির বন্ড কিনেছে।
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঁচ বছর ধরে তহবিল জোগানো শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে বেদান্ত লিমিটেড, ভারতী এয়ারটেল, আরপিএসজি গ্রুপ ও এসেল মাইনিংসহ অন্য বৃহত্তম ভারতীয় কোম্পানি। এদের মধ্য কেবল সান্তিয়াগোর সংস্থাই নয়, বন্ড কেনার দিক থেকে প্রথম ৩০টি সংস্থার ১৪ টিতেই গত কয়েক বছরে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিবিআই, ইডি কিংবা আয়কর দপ্তর (আইটি)।
বিজেপির নির্বাচনী বন্ড কেনার পর ফিউচার গেমিংয়ের ওপর ভারতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি কমেছে। বলতে গেলে এরপরই অন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলোও নির্বাচনী বন্ড কেনার দিকে ঝুঁকতে থাকে।
বিজেপির আরেকটি স্লোগান ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বেশি অনুরণিত হয়েছে— মেক ইন্ডিয়া গ্রেট অ্যাগেইন বা সংক্ষেপে মিগা। বিজেপির প্রচার মেশিন বলে যাচ্ছে, ভারত শিগগিরই একটি বৈশ্বিক পরাশক্তিতে পরিণত হবে।
পশ্চিমারা যেখানে চীনের একটি বিকল্প বাজার এবং ভূ–রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজছে সেই মঞ্চেই প্রায়শই এই স্লোগান প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ভারতের বিপুলসংখ্যক যুব জনগোষ্ঠী, যারা বেকার এবং কর্মহীন তাদের কল্পনায় ধরে নিয়ে এই ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
কিন্তু শিগগিরই এটি বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই: ডিজিটাল এবং অন্যান্য পরিকাঠামোতে কিছু অর্জন এবং সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের বিপুল সম্পদ অর্জন সত্ত্বেও, ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা গত এক দশক ধরে বড় জোর মধ্যম পর্যায়ে রয়েছে। বিজেপির প্রচারকে বিশ্বাস করে, পশ্চিমা ব্যবসায়ী নেতৃত্ব, রাজনীতিক এবং মিডিয়া ভারতের গণতন্ত্রকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলার সহযোগী হয়ে উঠেছে।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জিততে যাচ্ছে—এই বিষয়টি জনমনে গেঁথে দিতে যে রাজনৈতিক কূটকৌশল ও শক্তিশালী মিথ্যা বয়ান দলটি হাজির করেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতেই হয়। কারণ, এর মধ্য দিয়েই ভারতের গণতন্ত্রের ক্ষয় প্রায় নিশ্চিতভাবেই ত্বরান্বিত হয়েছে।
ছয় সপ্তাহ ধরে চলা ভারতের লোকসভা নির্বাচনের সাত ধাপে প্রায় একশ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছেন। বিষয়টি গণতন্ত্রের একটি দারুণ নজির স্থাপন করেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বাস্তবতা হলো—এর মধ্য দিয়ে ভারতের দশকব্যাপী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ক্ষয়কেই সুনিশ্চিত করা হয়েছে। যার মধ্যে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নাই করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এরপরও যে নেতা এই ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই নরেন্দ্র মোদি এখনো ভারতে বিপুল জনপ্রিয়।
বিজেপির মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের লাখো কোটি স্বেচ্ছাসেবীর শ্রমসাধ্য প্রয়াস মোদিকে এই জনপ্রিয়তা দিয়েছে। এর বাইরে, একই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেছেন কিছু কট্টরপন্থী পণ্ডিতও। যদিও এই দুই শ্রেণির কার্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে। তবুও সেগুলো মোদির জনপ্রিয়তা বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
২০২২ সালে প্রকাশিত আমার বই ‘অ্যা ওয়ার্ল্ড অব ইনসিকিউরিটি: ডেমোক্রেটিক ডিজএনচ্যান্টমেন্ট ইন রিচ অ্যান্ড পুওর কান্ট্রিজ’— এ আমি দেখিয়েছিলাম যে, এ ধরনের শক্তিগুলো (আরএসএস, বিজেপি এবং কট্টরপন্থী পণ্ডিত) সাধারণত অল্পশিক্ষিত, গ্রামীণ ও বৃদ্ধদের নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করে। তবে শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির মাঝেও মোদির প্রতি সমর্থন আছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মতো লোকরঞ্জনবাদী নেতারা ভোটে শহরে জয় পেতে হাঁসফাঁস করেছেন। সেখানে নরেন্দ্র মোদি দিল্লি, মুম্বাই ও বেঙ্গালুরুর মতো মেগাসিটিগুলোতে ব্যাপক জয় পেয়েছেন।
এমনটা হওয়ার মূল কারণ হলো—রাজনৈতিক উদারতাবাদ বা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে আস্থা, সরকারের ক্ষমতায় ভারসাম্য, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ ইত্যাদি পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ভারতের অভিজাত শ্রেণির বাইরে কখনোই দেখা যায়নি। ২০২৩ সালে পিউ রিসার্চের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ ভারতীয় মনে করেন, আদালত বা সংসদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই যে শক্তিশালী নেতা নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাঁকেই তাঁদের পছন্দ। এই অনুপাত জরিপের অধীন দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
লোকরঞ্জনবাদী পণ্ডিতেরা সব সময়ই গণতন্ত্রের অংশগ্রহণমূলক দিকগুলোর ওপর জোর দেন। কিন্তু ভারতে এই বিষয়ের যে পদ্ধতিগত দুর্বলতাগুলো আছে সে বিষয়ে কোনো কথা বলেন না। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার নীতি যে ভয়ংকর রূপ নিয়ে ভিন্নমতাবলম্বী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালাতে পারে সেসব বিষয়ে কোনো কথা বলেন না।
বামপন্থীদের মধ্যেও অ–উদারতাবাদের বিকাশ লাভ করেছে। তাদের কাছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী। এমনকি মহাত্মা গান্ধী—যিনি তাঁর সহনশীলতা ও সহানুভূতির মূল্যবোধের জন্য বিখ্যাত— তাঁর অনুসারীদের মাঝেও গণতন্ত্র হলো পুরুষতন্ত্র ও বংশ পরম্পরায় চলে আসা মূল্যবোধের বিকাশের হাতিয়ার। ফলে এটি জানা কথাই যে, বিজেপি–আরএসএসের মতো যারা হিন্দুত্ববাদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করেন, তাঁরা উদারতাবাদের দিকে ঝুঁকবেন না এটাই স্বাভাবিক।
গরিব ভারতীয়দের মধ্যে যারা আগে মধ্য–বাম ঘেঁষা জাতীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ঝুঁকে ছিলেন তারাও আজকাল বিজেপির প্রতি নিবেদিত। এর মূল কারণ হলো—বিজেপির হিন্দুদের সংহত করার কৌশল কৌশল। যার মাধ্যমে, দলটি ঐতিহাসিক নেতাদের এমনকি দেবতা চরিত্রগুলোকে হিন্দুকরণ করে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে দলটি বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত ভারতীয়দের একটি বড় অংশকে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের একটি বড় ছাতার নিচে আনতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে বিজেপিকে সহায়তা করেছে, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক উদ্যোগ। এসব উদ্যোগকে প্রায়ই সরকারের তরফ থেকে ‘মোদির উপহার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর বাইরে, বিভিন্ন বর্ণহিন্দু গোষ্ঠীর নেতাদের বিভিন্ন সরকারি পদে এনে মোদি আরও চমক সৃষ্টি করেছেন।
দুটি ন্যারেটিভ বা বয়ান বিজেপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও কোনোটিই আসলে সেই অর্থে কখনোই যাচাইবাছাই বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আতশ কাচের নিচে বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েনি। প্রথমটি হলো—মোদি সরকার একাই দুর্নীতির দানবকে নির্মূল করতে সক্ষম। তবে তাঁর প্রশাসন এই লাইনে খুব একটা অগ্রগতি লাভ করেছে এমন প্রমাণ খুব একটা নেই। বরং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতি সূচক অনুসারে, ভারত ২০২৩ সালে দুর্নীতিতে ১৮০টি দেশের মধ্যে ৯৩ তম স্থানে ছিল। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর এই সূচকে ভারতে আট ধাপ নেমেছে। ভারতের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায়ও দেখা যায়, ভারতের ৫৫ শতাংশ মানুষই মনে করেন, গত পাঁচ বছরে দুর্নীতি বেড়েছে।
ভারতে ছোটখাটো দুর্নীতি রয়েই গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তা, পরিদর্শক বা ঠিকাদারদের ঘুষের দাবি কমেছে বলে মনে হয় না। তদুপরি, ২০১৬ সালে মোদি সরকার যে বিপর্যয়কর ডি–মনিটাইজেশন বা নোট বাতিল কার্যক্রম শুরু করে, তা কালো টাকার মালিকদের শায়েস্তা করার জন্য বলা হলেও চূড়ান্তভাবে তা দেশটির ছোট ব্যবসা ও দরিদ্রদেরই বেশি ক্ষতি করেছিল। মূল উদ্দেশ্যের খুব একটা বাস্তবায়িত হয়েছে বলা যাবে না। আবার বড় বড় দুর্নীতি কমেছে বলে বিশ্বাস করারও খুব একটা কারণ নেই। বড় সরকারি প্রকল্পগুলোতে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কর্মকর্তাদের মোটা ‘কমিশন’ নেওয়ার প্রচুর গল্প বাজারে আছে। সরকার এসব চোখে না দেখলেও বিরোধী নেতাদের দুর্নীতির জন্য হয়রানি করা তাদের নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর বিজেপিতে যোগ দিয়ে পার পেয়ে গেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন নেতা। এই দলবদলের গল্প হয়তো সামগ্রিকভাবে দুর্নীতির মামলা বা অভিযোগ নির্মূলে ভূমিকা রাখে, কিন্তু তা কোনোভাবেই দুর্নীতি কমাতে সহায়ক হবে না।
অপরদিকে, ভারতীয় গণমাধ্যমের ওপর প্রায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা নিশ্চিত করেছে বিজেপি। রাজনীতি এবং ব্যবসার মধ্যকার সম্পর্কটা তারা আড়ালেই রাখবে। কিন্তু আমরা জানি, চূড়ান্ত ক্ষমতাচর্চা দুর্নীতিকেও চরমে পৌঁছে দিতে পারে। বিশেষ করে, দুর্নীতিতে জড়িত বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত বন্ধ করে তাদের একধরনের ‘সার্বভৌম দায়মুক্তি’ দিয়েছে সরকার।
দীর্ঘদিন ধরেই এই সন্দেহ আছে, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিজেপির নেতাদের পকেটে গেছে। এই অর্থ লেনদেনের একটি মাধ্যম ছিল ইলেকটোরাল বন্ড। মোদির সরকার ২০১৭ সালে এটি চালু করেছিল। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও সংস্থাকে পরিচয় লুকিয়ে বিজেপি তহবিল জোগানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট এই বন্ড অবৈধ ঘোষণা করে।
স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে ইলেকটোরাল বন্ড স্কিম চালু করার পর থেকে ৩০টি ধাপে ১৬ হাজার ৫১৮ কোটি রুপির বন্ড ছাড়া হয়। বন্ড কেনায় শীর্ষে রয়েছে বিতর্কিত লটারি ব্যবসায়ী মার্টিন সান্তিয়াগোর সংস্থা ‘ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস’। এই প্রতিষ্ঠান কিনেছে মোট ১ হাজার ৩৬৮ কোটি রুপির বন্ড।
বন্ড কেনায় টাকার অঙ্কে তাদের পরেই রয়েছে বিখ্যাত তেলেগু ব্যবসায়ী কৃষ্ণা রেড্ডির সংস্থা ‘মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড’। তারা ৯৬৬ কোটি রুপির নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। মূলত হায়দরাবাদ কেন্দ্রিক এই সংস্থা একাধিক সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি পেয়েছে। এ ছাড়া মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সহযোগী সংস্থা ‘ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড’ ২২০ কোটি রুপির বন্ড কিনেছে।
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঁচ বছর ধরে তহবিল জোগানো শীর্ষ কোম্পানির মধ্যে রয়েছে বেদান্ত লিমিটেড, ভারতী এয়ারটেল, আরপিএসজি গ্রুপ ও এসেল মাইনিংসহ অন্য বৃহত্তম ভারতীয় কোম্পানি। এদের মধ্য কেবল সান্তিয়াগোর সংস্থাই নয়, বন্ড কেনার দিক থেকে প্রথম ৩০টি সংস্থার ১৪ টিতেই গত কয়েক বছরে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে সিবিআই, ইডি কিংবা আয়কর দপ্তর (আইটি)।
বিজেপির নির্বাচনী বন্ড কেনার পর ফিউচার গেমিংয়ের ওপর ভারতীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি কমেছে। বলতে গেলে এরপরই অন্য ভারতীয় কোম্পানিগুলোও নির্বাচনী বন্ড কেনার দিকে ঝুঁকতে থাকে।
বিজেপির আরেকটি স্লোগান ভোটারদের কাছে সবচেয়ে বেশি অনুরণিত হয়েছে— মেক ইন্ডিয়া গ্রেট অ্যাগেইন বা সংক্ষেপে মিগা। বিজেপির প্রচার মেশিন বলে যাচ্ছে, ভারত শিগগিরই একটি বৈশ্বিক পরাশক্তিতে পরিণত হবে।
পশ্চিমারা যেখানে চীনের একটি বিকল্প বাজার এবং ভূ–রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজছে সেই মঞ্চেই প্রায়শই এই স্লোগান প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ভারতের বিপুলসংখ্যক যুব জনগোষ্ঠী, যারা বেকার এবং কর্মহীন তাদের কল্পনায় ধরে নিয়ে এই ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
কিন্তু শিগগিরই এটি বাস্তবে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা নেই: ডিজিটাল এবং অন্যান্য পরিকাঠামোতে কিছু অর্জন এবং সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের বিপুল সম্পদ অর্জন সত্ত্বেও, ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা গত এক দশক ধরে বড় জোর মধ্যম পর্যায়ে রয়েছে। বিজেপির প্রচারকে বিশ্বাস করে, পশ্চিমা ব্যবসায়ী নেতৃত্ব, রাজনীতিক এবং মিডিয়া ভারতের গণতন্ত্রকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলার সহযোগী হয়ে উঠেছে।
ডিজিটাল যুগে আমরা কেবল প্রযুক্তি ব্যবহার করছি না—আমরা প্রযুক্তির কাছে নিজেদের মনোযোগ, অনুভূতি, এমনকি চিন্তার স্বাধীনতাও তুলে দিচ্ছি। অ্যালগরিদম এখন আমাদের সিদ্ধান্ত, সম্পর্ক ও চেতনার গভীর স্তরে হস্তক্ষেপ করছে। শোষণ আজ আর কেবল শ্রমের ওপর নির্ভরশীল নয়—এখন তা মন ও মনোযোগের বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে।
৪ দিন আগেপুতিন যখন যুদ্ধে জয় নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী মনোভাব দেখাচ্ছেন, ঠিক তখনই রাশিয়ার ভেতরে ড্রোন হামলা চালিয়ে অন্তত ৪০টি বোমারু বিমান ধ্বংস করে দিয়েছে ইউক্রেন। এগুলোর মধ্যে কিছু পারমাণবিক অস্ত্রবাহী যুদ্ধবিমানও ছিল।
৫ দিন আগেবিশ্বের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও ‘রুশ আগ্রাসনের নতুন যুগে’ প্রতিরক্ষা খাতে বড় পরিসরে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। গত সোমবার (২ জুন) প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের কৌশলগত প্রতিরক্ষা পর্যালোচনায় (এসডিআর) উঠে এসেছে পারমাণবিক অস্ত্র, সাবমেরিন ও গোলাবারুদ তৈরির নতুন কারখানায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা।
৫ দিন আগেসত্য কী? অধিকাংশ মানুষের কাছে সত্য মানে হলো, যা বাস্তব তথ্যের সঙ্গে মিলে। অবশ্য আজকাল ‘বিকল্প সত্য’ নামে নতুন এক ধারণা অনেকে হাজির করছেন। সে যাই হোক, অভিজ্ঞতা বলে, সত্য শুধু বস্তুনিষ্ঠ হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, সত্য প্রকাশের উপযুক্ত লগ্ন, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই জরুরি।
৫ দিন আগে