Ajker Patrika

আল-জাজিরার বিশ্লেষণ

যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে কত ব্যয় হচ্ছে যুক্তরাজ্যের

অনলাইন ডেস্ক
গত ২ জুন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে প্রতিরক্ষা পর্যালোচনা তুলে ধরেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার। ছবি: এএফপি
গত ২ জুন স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে প্রতিরক্ষা পর্যালোচনা তুলে ধরেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার। ছবি: এএফপি

বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা ও ‘রুশ আগ্রাসনের নতুন যুগে’ প্রতিরক্ষা খাতে বড় পরিসরে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। গত সোমবার (২ জুন) প্রকাশিত যুক্তরাজ্যের কৌশলগত প্রতিরক্ষা পর্যালোচনায় (এসডিআর) উঠে এসেছে পারমাণবিক অস্ত্র, সাবমেরিন ও গোলাবারুদ তৈরির নতুন কারখানায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার জানিয়েছেন, এই এসডিআর বাস্তবায়নের ফলে যুক্তরাজ্য ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত’ অবস্থানে চলে যাবে।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে প্রতিরক্ষা পর্যালোচনা উপস্থাপনকালে স্টারমার বলেন, ‘আমরা এখন যে হুমকির মুখে, তা স্নায়ুযুদ্ধের পর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, তাৎক্ষণিক ও অনির্ণেয়। এই পরিস্থিতিতে আমাদের সব সময় প্রস্তুত থাকা জরুরি।’

এ পর্যালোচনায় রাশিয়াকে ‘তাৎক্ষণিক ও জরুরি হুমকি’ ও চীনকে ‘জটিল ও অবিচল চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানান। এরপর থেকেই ইউরোপজুড়ে সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার তোড়জোড় শুরু হয়।

এসডিআরের মূল দিকগুলো কী

২০২১ সালের পর এটিই যুক্তরাজ্যের প্রথম প্রতিরক্ষা পর্যালোচনা। এটি পরিচালনা করেছেন সাবেক ন্যাটো মহাসচিব জর্জ রবার্টসন। পর্যালোচনায় থাকা ৬২টি সুপারিশই গ্রহণ করেছে সরকার।

স্টারমার বলেছেন, এ পর্যালোচনার সুপারিশ বাস্তবায়নের ফলে সশস্ত্র বাহিনীতে ‘মূলগত পরিবর্তন’ আসবে। এর মধ্যে রয়েছে ‘যুদ্ধের প্রস্তুতি অর্জন’, ‘ন্যাটোর প্রাধান্য’ ও উদ্ভাবনকে আরও গতিশীল করা।

স্টারমার আরও বলেন, ‘সমাজের প্রতিটি অংশ, প্রতিটি নাগরিকেরই এখন ভূমিকা আছে। কারণ, বর্তমান বিশ্ব নতুন এক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। বলা চলে, যুদ্ধের ফ্রন্টলাইন এখন আমাদের ঘরেই।’

অস্ত্র উৎপাদন ও মজুত বৃদ্ধি

এসডিআরের ভিত্তিতে সরকার জানিয়েছে, অস্ত্র মজুত ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হবে, যা প্রয়োজন হলে আরও দ্রুত বাড়ানো সম্ভব হবে। ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে অন্তত ছয়টি গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হবে, যেখানে ৭ হাজার দূরপাল্লার অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। শুধু গোলাবারুদের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ বিলিয়ন পাউন্ড (৮.১ বিলিয়ন ডলার), যা ২০২৯ সাল পর্যন্ত বর্তমান পার্লামেন্ট মেয়াদে ব্যয় হবে।

অকাশ (এইউকেইউএস) সামরিক জোটের (যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র) অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের শেষ নাগাদ সর্বোচ্চ ১২টি আক্রমণাত্মক সাবমেরিন তৈরির পরিকল্পনাও আছে। এসডিআরে বরাদ্দ দেওয়া অর্থের প্রায় অর্ধেকই এ প্রকল্পে ব্যয় হবে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিজস্ব পারমাণবিক ওয়ারহেড বানাতে ১৫ বিলিয়ন পাউন্ড (২০.৩ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ করবে।

পর্যালোচনায় আরও বলা হয়েছে, নতুন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ও গ্লোবাল কমব্যাট এয়ারক্রাফট প্রোগ্রামের অধীনে ষষ্ঠ প্রজন্মের নতুন যুদ্ধবিমান কেনা হবে, যা জাপান ও ইতালির সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা হবে।

সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যায় বড় কোনো পরিবর্তন না এলেও এসডিআরের বরাদ্দ অর্থ কিছুটা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে সেনাবাহিনীতে প্রায় ৭১ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। তবে সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর পরিবর্তে প্রযুক্তি, ড্রোন ও সফটওয়্যার ব্যবহারে সেনাবাহিনীর ‘কমব্যাট পাওয়ার’ ১০ গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এ লক্ষ্যে ১ বিলিয়ন পাউন্ড (১.৩৫ বিলিয়ন ডলার) ব্যয়ে একটি ‘ডিজিটাল টার্গেটিং ওয়েব’ তৈরি করা হবে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা দেবে।

এসডিআরের বিস্তারিত দিকনির্দেশনাতে কী আছে, তা আসছে সপ্তাহে প্রতিরক্ষা শিল্প কৌশলের দলিলে জানানো হবে। তবে স্পষ্টভাবে বলা যায়, যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা খাতে যুক্ত কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বড় লাভবান হবে।

যদিও এটি ১০ বছরের পরিকল্পনা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তবে অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, এসব পরিকল্পনার স্থায়িত্ব বেশির ভাগ সময়ই কম হয়।

উল্লেখ্য, এর আগে ২০২১ সালের পর্যালোচনায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত শক্তি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। এবার রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে ইউরোপকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

যুক্তরাজ্য এই খরচ সামাল দেবে কীভাবে

এসডিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের প্রস্তুতির এই উদ্যোগে যুক্তরাজ্যের ব্যয় হবে অন্তত ৬৭.৬ বিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ৯১.৪ বিলিয়ন ডলার)।

এ ঘোষণার আগেই সরকার জানায়, ২০২৭ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২.৫ শতাংশ ব্যয় করা হবে, যা বর্তমানে ২.৩ শতাংশ। এতে প্রতিবছর বাড়তি ৬ বিলিয়ন পাউন্ড, ১০ বছরে মোট ৬০ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় হবে, যা এসডিআরে উল্লিখিত প্রকৃত চাহিদার চেয়ে কিছুটা কম। সরকার বলেছে, এই বাড়তি ব্যয়ের অর্থ উন্নয়ন সহায়তা বাজেট থেকে কেটে নেওয়া হবে। তবে সমালোচকেরা বলছেন, এটি যথেষ্ট হবে না। প্রকৃত ব্যয় ৩ শতাংশ জিডিপির কাছাকাছি চলে যাবে।

ছায়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস কার্টলিজ বলেন, এসডিআরের রচয়িতারাই বলেছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৩ শতাংশ জিডিপি বরাদ্দ প্রয়োজন।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে লেবার সরকার জানিয়েছিল, ২০২৯ সালের পরবর্তী মেয়াদে প্রতিরক্ষা ব্যয় ৩ শতাংশে উন্নীত করার ‘চেষ্টা’ থাকবে। তবে কার্টলিজ বলেন, নির্বাচনের আগে এ প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ফিসক্যাল স্টাডিজ (আইএফএস) জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৩ শতাংশে নিতে হলে আরও অতিরিক্ত ১৭ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দের দরকার পড়বে, যার হিসাব এখনো সরকার দেয়নি।

ন্যাটো কি আরও বেশি খরচ চায়

এ মাসের শেষদিকে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের আগে ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে সদস্য দেশগুলোর জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব করেন। তাঁর প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ন্যাটোর দেশগুলোকে মোট জিডিপির ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তায় ব্যয় করতে হবে। এর মধ্যে ৩.৫ শতাংশ ‘হার্ড ডিফেন্সে’ এবং ১.৫ শতাংশ সাইবার নিরাপত্তার মতো ‘ব্রডার সিকিউরিটিতে’ ব্যয় করার প্রস্তাব করেছেন তিনি।

রুটে বলেন, ‘এই সম্মেলনে আমরা প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে বড় ধরনের অগ্রগতি আনতে যাচ্ছি।’ তিনি জানান, এ লক্ষ্য অর্জনে আরও বেশি অর্থ, সেনা ও সক্ষমতা প্রয়োজন।

এই পরিস্থিতিতে কি যুক্তরাজ্যে কর বাড়বে

গত সোমবার কিয়ার স্টারমার নতুন করে বিদেশি সহায়তার বাজেট কমিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর কথা অস্বীকার করেননি। তিনি বলেন, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাড়তি কর আদায় করেই এই ব্যয় সামাল দেওয়া যেতে পারে। তবে আইএফএস পরিচালক পল জনসন সতর্ক করে বলেন, ‘এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারকে বেশ বড় আকারের করবৃদ্ধিতে যেতে হবে।’ অন্যথায় প্রতিরক্ষা খাতে বাড়তি ব্যয় অন্য খাত যেমন—পরিবহন বা জ্বালানি খাত থেকে কেটে নেওয়া হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত