আব্দুর রহমান

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)
আব্দুর রহমান

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।
দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।
কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।
সেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।
পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’
এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।
তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।
২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।
সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।
তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’
আল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।
৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।
এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।
আল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’
আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।
যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’
৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।
স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।
জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।
২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।
এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।
৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।
বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।
বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।
বিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।
বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’
পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।
এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।
৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।
সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।
যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।
(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)
তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেআবদুল বাছেদ, ঢাকা
তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ। এই অবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌবহর ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজ প্রায় প্রতিদিন মুখোমুখি অবস্থায় থাকে। গত মাসে একবার দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ মাত্র ১৫০ মিটারের দূরত্বে চলে এসেছিল।
গত ২ আগস্ট তাইওয়ানে ‘জিরো ডে অ্যাটাক’ নামে একটি ডিস্টোপিয়ান টেভি সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করতে পারে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ষড়যন্ত্র, গণমাধ্যমে অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানো—সবকিছুই এতে বিশ্লেষণধর্মীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি কল্পকাহিনি হলেও সাম্প্রতিক বাস্তব ঘটনাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে।
১০ সিজনের বহুল প্রচারিত ও প্রশংসিত এই সিরিজের নির্মাতা চেং হসিন-মেই। তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন টাইমকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় গেলে আপনি সত্যিই সেই উত্তেজনা টের পাবেন। চীন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েলিংটন কু মনে করছেন, চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) যেকোনো সামরিক মহড়াকে সত্যিকারের আগ্রাসনে পরিণত করতে পারে। এমন সম্ভাবনা এখন উড়িয়ে দেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই হুমকি আর চ্যালেঞ্জই এখন তাইওয়ানের সামনে।
চীন বলছে, এটি চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়, আর তাইওয়ান সরকারের ভাষায়, আসন্ন আগ্রাসনের সংকেত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যেই চীন তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বৈদেশিক মনোযোগের বিভ্রান্তি দেখা দিলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং হয়তো তার আগেই পদক্ষেপ নিতে পারেন। তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, চীন আক্রমণ করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে একা ছাড়বে না।
এখন ভাবুন, চীন তাইওয়ানে আক্রমণ চালিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপ দেশটির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পেন্টাগনের প্রচলিত যুদ্ধনীতি মেনে মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী হাজার হাজার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে চীনের জাহাজ, কমান্ড সেন্টার ও লজিস্টিক ঘাঁটির দিকে। প্রথম দফার হামলাতেই ৩৩ হাজারেরও বেশি নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র সাড়ে ৮ হাজারের বেশি টার্গেটে আঘাত হেনেছে। সাইবার হামলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চীনের সামরিক নেটওয়ার্ক, ভেঙে পড়ছে নেতৃত্ব। ফলে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে বেইজিং হয় পিছু হটবে, নয়তো নিরুপায় পরাজয় মেনে নেবে।
কিন্তু যদি মনে করেন, এমনটি হবেই হবে, তাহলে ভুল করছেন। কারণ চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার ও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংসের পর যখন একের পর এক পরাজয়ের মুখে পড়বে বেইজিং, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ। তখন দেশটি ভিন্নপথে হাঁটতে পারে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভার্টিক্যাল এস্কেলেশন বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। চীন হয়তো মার্কিন সমুদ্রসীমায় একটি পারমাণবিক পরীক্ষামূলক হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে যে এখানেই থেমে যাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়াশিংটন কি এমন পদক্ষেপকে পারমাণবিক হামলার পূর্বঘোষণা বলে ধরে নেবে না?
এই বিপজ্জনক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে শুধু চীনের পারমাণবিক নীতির কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব যুদ্ধধারণার ফলেও। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার চীনের নেই। তাই বেইজিং হয়তো এখনো মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র আগে পারমাণবিক হামলা চালালে তারা পাল্টা আঘাত করার মতো সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ সক্রিয় পারমাণবিক বোমা ছিল, চীনের সেখানে ছিল মাত্র ৬০০। এই পশ্চাৎপদতার কারণে চীনা নেতারা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন বড় পরাজয় ঠেকাতে।
আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, চীনের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দ্বৈত-ক্ষমতাসম্পন্ন; অর্থাৎ একই লঞ্চার থেকে কখনো প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র, আবার কখনো পারমাণবিক ওয়ারহেড নিক্ষেপ করা যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব লঞ্চারে হামলা চালায়, বেইজিং সেটাকে তাদের পারমাণবিক প্রতিরোধশক্তির ওপর আঘাত হিসেবে দেখতে পারে। এটি পাল্টা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে।
বিশেষ করে ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলো এই জটিলতা বাড়ায়। একই ঘাঁটিতে প্রচলিত ও পারমাণবিক উভয় ধরনের ওয়ারহেড থাকে এবং প্রশিক্ষণে সৈন্যরা প্রথমে প্রচলিত হামলার মহড়া দেয়, পরে সেটি পারমাণবিক ওয়ারহেডে পরিবর্তন করে। যুক্তরাষ্ট্র এসব ঘাঁটিতে আঘাত হানলে চীন সেটিকে পারমাণবিক হামলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে পারে। একেই বলে এনট্যাঙ্গলমেন্ট প্রবলেম বা এক হামলার দ্বৈত ব্যাখ্যা, যা পারমাণবিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে।
এখানে মার্কিন সামরিক পরিকল্পকেরা পড়ে যান এক দোটানায়। তাঁরা যত দ্রুত ও নিশ্চিত বিজয়ের চিন্তায় যুদ্ধের কৌশল সাজাবেন, তত বেশি পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকিতে পড়ে যান। অথচ বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানোর মতো সরঞ্জাম মজুত নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিকল্পনায় যে ধরনের যুদ্ধনীতি প্রাধান্য পায়, সেখানে চীনের কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন, কম্পিউটার, ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেইলেন্স ও রিকনাইসেন্স (সি৪ আইএসআর) ব্যবস্থা লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার আক্রমণ চালানোর কথা বলা হয়। বাস্তবে তা হয়তো যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করার বদলে আরও দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক করে তুলতে পারে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সামরিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী উপগ্রহ এবং সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী কমান্ড সদর দপ্তর পর্যন্ত সবকিছু।
যদি কমান্ডাররা নিহত হন এবং কমান্ড ব্যবস্থা ধ্বংসও হয়ে যায়, তবুও যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদদের মনে করা উচিত নয় যে এতে দ্রুত বিজয় আসবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, কোনো বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরেই বিপুলসংখ্যক রুশ জেনারেল নিহত হন, তবুও তাদের বাহিনী আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, নেতৃত্ব ধ্বংস করলেও তাঁরা কার্যকর সামরিক শক্তি হিসেবে টিকে থেকেছে, যতক্ষণ না তাদের বাহিনীকে ধীরে ধীরে, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সামরিক অভিযানে পুরোপুরি দমন করা হয়েছে।
মার্কিন যুদ্ধনীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক আঘাত হানার ক্ষেপণাস্ত্র তিন দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, আর ভূমি থেকে দূরপাল্লার হামলার অস্ত্র মজুত ফুরোবে ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। এমনকি যদি তাইওয়ান, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে চীনকে ঠেকাতেও পারে, তবু মূল্যটা ভয়াবহ হবে। ডজন-ডজন জাহাজ ডুবে যাবে, শত শত বিমান ধ্বংস হবে, আর হাজার হাজার সেনা নিহত হবে।
পেন্টাগন সম্প্রতি দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতাদের দূরপাল্লার অস্ত্রের উৎপাদন দ্বিগুণ বা এমনকি চারগুণ বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার জাহাজবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ও নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু এতে সমস্যা আরও বাড়ছে, কারণ এই ‘দূরপাল্লার আক্রমণনির্ভর’ যুদ্ধের ধারণাই আসলে পারমাণবিক সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে, কমাচ্ছে না।
এ বিপদের ব্যাপ্তি শুধু প্রশান্ত মহাসাগরেই সীমাবদ্ধ নয়। ন্যাটোর অনেক পরিকল্পনাও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তারাও বুঝতে পারছেন না যে এসব ‘অপারেশনাল কনসেপ্ট’-এর মধ্যে কতটা বিপজ্জনক উত্তেজনা লুকিয়ে আছে।
কিছু কৌশলবিদ বলেন, পারমাণবিক উত্তেজনার ভয় পেলে যুদ্ধই করা যাবে না; এমন মনোভাবই এখনকার বাস্তবতা। কিন্তু যদি সত্যিই যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, কতটা ঝুঁকি নেওয়া যাবে, আর সেই ঝুঁকি কমানোর উপায় কী।
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাইবার শক্তি ও ভবিষ্যৎ সংঘাতবিষয়ক সহযোগী ফেলো ফ্রান্জ-স্টেফান গ্যাডি প্রস্তাব করেন, ‘স্মার্ট অ্যাট্রিশনাল অ্যাপ্রোচ’ একটি বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষয়যুদ্ধনীতি। এতে চীনের কমান্ড সেন্টার বা পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলা না করে তাদের প্রচলিত বাহিনীকে রুখে দেওয়া হবে। এর মানে হলো, যুদ্ধ হবে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর, কিন্তু পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি কমবে।
এই কৌশলে জোর দেওয়া হবে স্বল্পপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারে। বেশি টর্পেডো, ড্রোন এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায়। প্রযুক্তিনির্ভর দ্রুত বিজয়ের মোহ ত্যাগ করে, বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে।
কিন্তু সমস্যাটা রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মতির অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কি সত্যিই হাজারো সেনার প্রাণ এবং অর্ধেক নৌবাহিনী হারানোর বিনিময়ে তাইওয়ানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে রাজি?
অবশেষে প্রশ্ন একটাই, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সামরিক ইতিহাসবিদ মাইকেল হাওয়ার্ড যেমন বলেছিলেন, পশ্চিম এখনো শান্তির কুয়াশার ভেতর দিয়ে নৌযাত্রা করছে। শেষ মহাযুদ্ধ থেকে সময় যতই দূরে সরে যাচ্ছে, ভয়াবহ ভুলের সম্ভাবনাও ততই বাড়ছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। শিল্পক্ষমতা বাড়াতে হবে, পারমাণবিক ঝুঁকি কমানোর কৌশল নিতে হবে এবং জনগণকে জানাতে হবে, এই যুদ্ধের প্রকৃত মূল্য কী হবে। প্রযুক্তি দিয়ে দ্রুত জয়ের ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভেসে চললে, আগামীতে ‘বৃহৎ দুই শক্তির যুদ্ধ’ হবে মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ শিক্ষা। যেমনটি বলেছিলেন এথেন্সের কৌশলবিদ থুসিডিডিস, পরবর্তী মহাশক্তির যুদ্ধ হবে এক কঠোর শিক্ষক।
তথ্যসূত্র: টাইম ও ফরেন পলিসি

তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ। এই অবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌবহর ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজ প্রায় প্রতিদিন মুখোমুখি অবস্থায় থাকে। গত মাসে একবার দুটি চীনা যুদ্ধজাহাজ মাত্র ১৫০ মিটারের দূরত্বে চলে এসেছিল।
গত ২ আগস্ট তাইওয়ানে ‘জিরো ডে অ্যাটাক’ নামে একটি ডিস্টোপিয়ান টেভি সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে চীন তাইওয়ানে আগ্রাসন শুরু করতে পারে। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ষড়যন্ত্র, গণমাধ্যমে অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক প্রভাব খাটানো—সবকিছুই এতে বিশ্লেষণধর্মীভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি একটি কল্পকাহিনি হলেও সাম্প্রতিক বাস্তব ঘটনাগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র রয়েছে।
১০ সিজনের বহুল প্রচারিত ও প্রশংসিত এই সিরিজের নির্মাতা চেং হসিন-মেই। তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক ম্যাগাজিন টাইমকে বলেন, ‘সীমান্ত এলাকায় গেলে আপনি সত্যিই সেই উত্তেজনা টের পাবেন। চীন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েলিংটন কু মনে করছেন, চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) যেকোনো সামরিক মহড়াকে সত্যিকারের আগ্রাসনে পরিণত করতে পারে। এমন সম্ভাবনা এখন উড়িয়ে দেওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই হুমকি আর চ্যালেঞ্জই এখন তাইওয়ানের সামনে।
চীন বলছে, এটি চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়, আর তাইওয়ান সরকারের ভাষায়, আসন্ন আগ্রাসনের সংকেত। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যেই চীন তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বৈদেশিক মনোযোগের বিভ্রান্তি দেখা দিলে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং হয়তো তার আগেই পদক্ষেপ নিতে পারেন। তাইওয়ান ইস্যুতে ট্রাম্প স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, চীন আক্রমণ করলে আমেরিকা তাইওয়ানকে একা ছাড়বে না।
এখন ভাবুন, চীন তাইওয়ানে আক্রমণ চালিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র দ্বীপ দেশটির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। পেন্টাগনের প্রচলিত যুদ্ধনীতি মেনে মার্কিন নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী হাজার হাজার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করছে চীনের জাহাজ, কমান্ড সেন্টার ও লজিস্টিক ঘাঁটির দিকে। প্রথম দফার হামলাতেই ৩৩ হাজারেরও বেশি নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র সাড়ে ৮ হাজারের বেশি টার্গেটে আঘাত হেনেছে। সাইবার হামলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চীনের সামরিক নেটওয়ার্ক, ভেঙে পড়ছে নেতৃত্ব। ফলে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে বেইজিং হয় পিছু হটবে, নয়তো নিরুপায় পরাজয় মেনে নেবে।
কিন্তু যদি মনে করেন, এমনটি হবেই হবে, তাহলে ভুল করছেন। কারণ চীনের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার ও যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংসের পর যখন একের পর এক পরাজয়ের মুখে পড়বে বেইজিং, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নেতাদের মধ্যে যোগাযোগ। তখন দেশটি ভিন্নপথে হাঁটতে পারে। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভার্টিক্যাল এস্কেলেশন বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। চীন হয়তো মার্কিন সমুদ্রসীমায় একটি পারমাণবিক পরীক্ষামূলক হামলা চালাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে যে এখানেই থেমে যাও। প্রশ্ন হচ্ছে, ওয়াশিংটন কি এমন পদক্ষেপকে পারমাণবিক হামলার পূর্বঘোষণা বলে ধরে নেবে না?
এই বিপজ্জনক উত্তেজনা তৈরি হতে পারে শুধু চীনের পারমাণবিক নীতির কারণে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব যুদ্ধধারণার ফলেও। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার চীনের নেই। তাই বেইজিং হয়তো এখনো মনে করে যে যুক্তরাষ্ট্র আগে পারমাণবিক হামলা চালালে তারা পাল্টা আঘাত করার মতো সক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ সক্রিয় পারমাণবিক বোমা ছিল, চীনের সেখানে ছিল মাত্র ৬০০। এই পশ্চাৎপদতার কারণে চীনা নেতারা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন বড় পরাজয় ঠেকাতে।
আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হলো, চীনের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা দ্বৈত-ক্ষমতাসম্পন্ন; অর্থাৎ একই লঞ্চার থেকে কখনো প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র, আবার কখনো পারমাণবিক ওয়ারহেড নিক্ষেপ করা যায়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি এসব লঞ্চারে হামলা চালায়, বেইজিং সেটাকে তাদের পারমাণবিক প্রতিরোধশক্তির ওপর আঘাত হিসেবে দেখতে পারে। এটি পাল্টা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে।
বিশেষ করে ডিএফ-২৬ ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলো এই জটিলতা বাড়ায়। একই ঘাঁটিতে প্রচলিত ও পারমাণবিক উভয় ধরনের ওয়ারহেড থাকে এবং প্রশিক্ষণে সৈন্যরা প্রথমে প্রচলিত হামলার মহড়া দেয়, পরে সেটি পারমাণবিক ওয়ারহেডে পরিবর্তন করে। যুক্তরাষ্ট্র এসব ঘাঁটিতে আঘাত হানলে চীন সেটিকে পারমাণবিক হামলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে পারে। একেই বলে এনট্যাঙ্গলমেন্ট প্রবলেম বা এক হামলার দ্বৈত ব্যাখ্যা, যা পারমাণবিক সংঘাত ডেকে আনতে পারে।
এখানে মার্কিন সামরিক পরিকল্পকেরা পড়ে যান এক দোটানায়। তাঁরা যত দ্রুত ও নিশ্চিত বিজয়ের চিন্তায় যুদ্ধের কৌশল সাজাবেন, তত বেশি পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকিতে পড়ে যান। অথচ বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানোর মতো সরঞ্জাম মজুত নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিকল্পনায় যে ধরনের যুদ্ধনীতি প্রাধান্য পায়, সেখানে চীনের কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন, কম্পিউটার, ইন্টেলিজেন্স, সার্ভেইলেন্স ও রিকনাইসেন্স (সি৪ আইএসআর) ব্যবস্থা লক্ষ্য করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার আক্রমণ চালানোর কথা বলা হয়। বাস্তবে তা হয়তো যুদ্ধকে সংক্ষিপ্ত করার বদলে আরও দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক করে তুলতে পারে। এসব ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে সামরিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক থেকে শুরু করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহকারী উপগ্রহ এবং সামরিক অভিযান পরিচালনাকারী কমান্ড সদর দপ্তর পর্যন্ত সবকিছু।
যদি কমান্ডাররা নিহত হন এবং কমান্ড ব্যবস্থা ধ্বংসও হয়ে যায়, তবুও যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদদের মনে করা উচিত নয় যে এতে দ্রুত বিজয় আসবে। ইতিহাস দেখিয়েছে, কোনো বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম বছরেই বিপুলসংখ্যক রুশ জেনারেল নিহত হন, তবুও তাদের বাহিনী আজও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইসলামিক স্টেটের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, নেতৃত্ব ধ্বংস করলেও তাঁরা কার্যকর সামরিক শক্তি হিসেবে টিকে থেকেছে, যতক্ষণ না তাদের বাহিনীকে ধীরে ধীরে, দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর সামরিক অভিযানে পুরোপুরি দমন করা হয়েছে।
মার্কিন যুদ্ধনীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক আঘাত হানার ক্ষেপণাস্ত্র তিন দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, আর ভূমি থেকে দূরপাল্লার হামলার অস্ত্র মজুত ফুরোবে ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। এমনকি যদি তাইওয়ান, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে চীনকে ঠেকাতেও পারে, তবু মূল্যটা ভয়াবহ হবে। ডজন-ডজন জাহাজ ডুবে যাবে, শত শত বিমান ধ্বংস হবে, আর হাজার হাজার সেনা নিহত হবে।
পেন্টাগন সম্প্রতি দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতাদের দূরপাল্লার অস্ত্রের উৎপাদন দ্বিগুণ বা এমনকি চারগুণ বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। এসবের মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার জাহাজবিরোধী ক্ষেপণাস্ত্র ও নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র। কিন্তু এতে সমস্যা আরও বাড়ছে, কারণ এই ‘দূরপাল্লার আক্রমণনির্ভর’ যুদ্ধের ধারণাই আসলে পারমাণবিক সংঘাতের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলছে, কমাচ্ছে না।
এ বিপদের ব্যাপ্তি শুধু প্রশান্ত মহাসাগরেই সীমাবদ্ধ নয়। ন্যাটোর অনেক পরিকল্পনাও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপীয় সেনা কর্মকর্তারাও বুঝতে পারছেন না যে এসব ‘অপারেশনাল কনসেপ্ট’-এর মধ্যে কতটা বিপজ্জনক উত্তেজনা লুকিয়ে আছে।
কিছু কৌশলবিদ বলেন, পারমাণবিক উত্তেজনার ভয় পেলে যুদ্ধই করা যাবে না; এমন মনোভাবই এখনকার বাস্তবতা। কিন্তু যদি সত্যিই যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে যায়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে জানতে হবে, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, কতটা ঝুঁকি নেওয়া যাবে, আর সেই ঝুঁকি কমানোর উপায় কী।
এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কৌশলগত গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাইবার শক্তি ও ভবিষ্যৎ সংঘাতবিষয়ক সহযোগী ফেলো ফ্রান্জ-স্টেফান গ্যাডি প্রস্তাব করেন, ‘স্মার্ট অ্যাট্রিশনাল অ্যাপ্রোচ’ একটি বুদ্ধিদীপ্ত ক্ষয়যুদ্ধনীতি। এতে চীনের কমান্ড সেন্টার বা পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলা না করে তাদের প্রচলিত বাহিনীকে রুখে দেওয়া হবে। এর মানে হলো, যুদ্ধ হবে দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর, কিন্তু পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকি কমবে।
এই কৌশলে জোর দেওয়া হবে স্বল্পপাল্লার অস্ত্র ব্যবহারে। বেশি টর্পেডো, ড্রোন এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায়। প্রযুক্তিনির্ভর দ্রুত বিজয়ের মোহ ত্যাগ করে, বাস্তব ও দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে।
কিন্তু সমস্যাটা রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্মতির অভাব। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কি সত্যিই হাজারো সেনার প্রাণ এবং অর্ধেক নৌবাহিনী হারানোর বিনিময়ে তাইওয়ানের স্বাধীনতা রক্ষা করতে রাজি?
অবশেষে প্রশ্ন একটাই, যুক্তরাষ্ট্র আসলে কি ত্যাগ করতে প্রস্তুত? সামরিক ইতিহাসবিদ মাইকেল হাওয়ার্ড যেমন বলেছিলেন, পশ্চিম এখনো শান্তির কুয়াশার ভেতর দিয়ে নৌযাত্রা করছে। শেষ মহাযুদ্ধ থেকে সময় যতই দূরে সরে যাচ্ছে, ভয়াবহ ভুলের সম্ভাবনাও ততই বাড়ছে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রকে এখনই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। শিল্পক্ষমতা বাড়াতে হবে, পারমাণবিক ঝুঁকি কমানোর কৌশল নিতে হবে এবং জনগণকে জানাতে হবে, এই যুদ্ধের প্রকৃত মূল্য কী হবে। প্রযুক্তি দিয়ে দ্রুত জয়ের ভ্রান্ত বিশ্বাসে ভেসে চললে, আগামীতে ‘বৃহৎ দুই শক্তির যুদ্ধ’ হবে মানবজাতির জন্য এক ভয়াবহ শিক্ষা। যেমনটি বলেছিলেন এথেন্সের কৌশলবিদ থুসিডিডিস, পরবর্তী মহাশক্তির যুদ্ধ হবে এক কঠোর শিক্ষক।
তথ্যসূত্র: টাইম ও ফরেন পলিসি

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির সূক্ষ্ম শিল্প নয়, বরং আরেকটি ‘শান্তিচুক্তির’ কৃতিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে জানিয়েছে পলিটিকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্মেলনে ‘কুয়ালালামপুর চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেটিই সম্ভবত ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ।
ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ‘বিশ্বজুড়ে বন্ধ করা’ যুদ্ধের তালিকায় যুক্ত করেছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সংঘাতও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে সহায়তা করেছিল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, পাকিস্তান-ভারত, রুয়ান্ডা-কঙ্গো, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান এবং প্রথম মেয়াদে মিসর-ইথিওপিয়া ও সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাতও মিটমাট করেছেন।
তবে এসবের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত এখনো চলমান বা পুনরায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও রয়েছে। তবু ট্রাম্প এই ঘটনাগুলোর সাফল্য ও অতিরঞ্জিত দাবি মিলিয়ে নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য জোর প্রচারও চালান, যদিও চলতি মাসের শুরুতে সেই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেয়েছেন।
তবু এখনই নিরাশ হচ্ছেন না ট্রাম্প ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কম্বোডিয়াসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা এরই মধ্যে আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য আবার ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এসব ‘চাটুকার কূটনীতির’ নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।
তবে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ডের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হবে, নাকি ট্রাম্পের কথিত সাফল্য হয়ে থাকবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রশ্ন হলো, ফটোসেশনের পর ট্রাম্প কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন।
জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক এস. কোগান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে? ট্রাম্প চুক্তি সম্পাদনের পর কি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে, নাকি অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?’
মার্ক এস. কোগান আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার এই অমীমাংসিত তুলনামূলক ছোট সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কতটা মাথা ঘামায়? এটা কি অন্য বড় সংঘাতগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ? না, অবশ্যই না। তবে কি এটা গভীর ও উত্তপ্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব কতটা? খুবই সামান্য।’
কোগানের মতে, ‘চুক্তির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ‘তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ’-এর ওপর। উভয় দেশ চুক্তির শর্ত মানলেই এটি সফল হতে পারে। তবে দুই পক্ষই পরস্পরকে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে এই পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রাখে, তবে অনেকে এ বিষয়ে সংশয়ী।’
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ও থাই গবেষক পাভিন চাচাভালপংপুন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘ট্রাম্পের এই অঞ্চলে শান্তি উদ্যোগের অংশগ্রহণটা পুরোপুরি লেনদেননির্ভর মনে হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান শেষ হলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক চাপ সম্ভবত মিলিয়ে যাবে।’
আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার বলেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।
কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে ‘একটি বিজয় উপহার’ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ১৫ অক্টোবর শাসক দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।’
গবেষক পাভিন আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন সরকার সম্প্রতি সংঘাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আগের প্রশাসনকে অপসারণ করেছে। দেশটি এই প্রক্রিয়ায় সাবধানী ভূমিকা নিচ্ছে, স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তবে আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প কম্বোডিয়ার পক্ষে ঝুঁকতে পারেন।’
থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল গত রোববার বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির দ্বারা শোষিত হতে দেব না। আমরা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
পাভিনের মতে, ট্রাম্প এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সহায়তা করতে পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই চুক্তি ‘স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে, কিন্তু ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হিসেবে ভঙ্গুর’ হিসেবেই রয়ে যাবে।
কম্বোডিয়া চুক্তিতে আগ্রহী হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কত দূর যেতে রাজি। ১৯ অক্টোবর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত লিখেছেন, চুক্তিটি মূলত সংঘাতের অবসান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত ও আচরণবিধি নির্ধারণের মাধ্যম হবে।
তবে তিনি একই সঙ্গে পরিষ্কার করে বলেন, ‘না জুলাই মাসের যুদ্ধবিরতি, না আসন্ন চুক্তি—কোনোটিই কোনো পক্ষের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর আইনি অধিকার ত্যাগের প্রতিশ্রুতি নয়।’
থাই গবেষক পাভিনের মতে, এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়; কারণ, এটি মূল ভূখণ্ড এবং ঐতিহাসিক মানচিত্রসংক্রান্ত সীমান্তবিরোধের সমাধান করছে না, বরং সেই সংঘাতকে সাময়িকভাবে স্থগিত করছে মাত্র।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু তাঁর এই সফরের মূল উদ্দেশ্য বহুপক্ষীয় কূটনীতির সূক্ষ্ম শিল্প নয়, বরং আরেকটি ‘শান্তিচুক্তির’ কৃতিত্ব বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলে জানিয়েছে পলিটিকো।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্মেলনে ‘কুয়ালালামপুর চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে, সেটিই সম্ভবত ট্রাম্পের আসিয়ান সম্মেলনে যোগ দেওয়ার একমাত্র কারণ।
ট্রাম্প এরই মধ্যে তাঁর ‘বিশ্বজুড়ে বন্ধ করা’ যুদ্ধের তালিকায় যুক্ত করেছেন থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সংঘাতও, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র জুলাই মাসে বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করাতে সহায়তা করেছিল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, তিনি এরই মধ্যে ইসরায়েল-হামাস, ইসরায়েল-ইরান, পাকিস্তান-ভারত, রুয়ান্ডা-কঙ্গো, আর্মেনিয়া-আজারবাইজান এবং প্রথম মেয়াদে মিসর-ইথিওপিয়া ও সার্বিয়া-কসোভোর সংঘাতও মিটমাট করেছেন।
তবে এসবের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে শান্তিচুক্তি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সংঘাত এখনো চলমান বা পুনরায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার মধ্যে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার পরিস্থিতিও রয়েছে। তবু ট্রাম্প এই ঘটনাগুলোর সাফল্য ও অতিরঞ্জিত দাবি মিলিয়ে নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য জোর প্রচারও চালান, যদিও চলতি মাসের শুরুতে সেই পুরস্কার ভেনেজুয়েলার বিরোধীদলীয় নেত্রী মারিয়া কোরিনা মাচাদো পেয়েছেন।
তবু এখনই নিরাশ হচ্ছেন না ট্রাম্প ও তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কম্বোডিয়াসহ কয়েকজন বিশ্বনেতা এরই মধ্যে আগামী বছরের পুরস্কারের জন্য আবার ট্রাম্পকে মনোনয়ন দিয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এসব ‘চাটুকার কূটনীতির’ নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।
তবে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ডের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি প্রকৃতপক্ষে অর্জিত হবে, নাকি ট্রাম্পের কথিত সাফল্য হয়ে থাকবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রশ্ন হলো, ফটোসেশনের পর ট্রাম্প কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন।
জাপানের ওসাকার কানসাই গাইদাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘাত অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক এস. কোগান টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি এই ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেবে? ট্রাম্প চুক্তি সম্পাদনের পর কি থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখবে, নাকি অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে?’
মার্ক এস. কোগান আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার এই অমীমাংসিত তুলনামূলক ছোট সংঘাত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কতটা মাথা ঘামায়? এটা কি অন্য বড় সংঘাতগুলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ? না, অবশ্যই না। তবে কি এটা গভীর ও উত্তপ্ত? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রকৃত প্রভাব কতটা? খুবই সামান্য।’
কোগানের মতে, ‘চুক্তির সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে ‘তৃতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষণ’-এর ওপর। উভয় দেশ চুক্তির শর্ত মানলেই এটি সফল হতে পারে। তবে দুই পক্ষই পরস্পরকে যুদ্ধবিরতি ভাঙার অভিযোগে অভিযুক্ত করবে। যুক্তরাষ্ট্র তাত্ত্বিকভাবে এই পর্যবেক্ষণ কার্যকরভাবে পরিচালনা করার সক্ষমতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা রাখে, তবে অনেকে এ বিষয়ে সংশয়ী।’
জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ও থাই গবেষক পাভিন চাচাভালপংপুন টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘ট্রাম্পের এই অঞ্চলে শান্তি উদ্যোগের অংশগ্রহণটা পুরোপুরি লেনদেননির্ভর মনে হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান শেষ হলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় বাহ্যিক চাপ সম্ভবত মিলিয়ে যাবে।’
আসিয়ানের বর্তমান চেয়ারম্যান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বৃহস্পতিবার বলেন, চুক্তির বিস্তারিত বিষয়গুলো এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।
কম্বোডিয়া প্রকাশ্যে ট্রাম্পকে ‘একটি বিজয় উপহার’ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। ১৫ অক্টোবর শাসক দলের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা যেকোনো সময় চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত।’
গবেষক পাভিন আরও বলেন, ‘অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের নতুন সরকার সম্প্রতি সংঘাতের দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে আগের প্রশাসনকে অপসারণ করেছে। দেশটি এই প্রক্রিয়ায় সাবধানী ভূমিকা নিচ্ছে, স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানাচ্ছে, তবে আশঙ্কা করছে, ট্রাম্প কম্বোডিয়ার পক্ষে ঝুঁকতে পারেন।’
থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল গত রোববার বলেন, ‘আমরা আমাদের দেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোনো জাতির দ্বারা শোষিত হতে দেব না। আমরা জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
পাভিনের মতে, ট্রাম্প এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক সহায়তা করতে পারেন। তবে তাঁর বিশ্বাস, এই চুক্তি ‘স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা’ আনতে পারে, কিন্তু ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির ভিত্তি হিসেবে ভঙ্গুর’ হিসেবেই রয়ে যাবে।
কম্বোডিয়া চুক্তিতে আগ্রহী হলেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কত দূর যেতে রাজি। ১৯ অক্টোবর কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন মানেত লিখেছেন, চুক্তিটি মূলত সংঘাতের অবসান এবং দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত ও আচরণবিধি নির্ধারণের মাধ্যম হবে।
তবে তিনি একই সঙ্গে পরিষ্কার করে বলেন, ‘না জুলাই মাসের যুদ্ধবিরতি, না আসন্ন চুক্তি—কোনোটিই কোনো পক্ষের সার্বভৌম ভূখণ্ডের ওপর আইনি অধিকার ত্যাগের প্রতিশ্রুতি নয়।’
থাই গবেষক পাভিনের মতে, এই চুক্তির স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়; কারণ, এটি মূল ভূখণ্ড এবং ঐতিহাসিক মানচিত্রসংক্রান্ত সীমান্তবিরোধের সমাধান করছে না, বরং সেই সংঘাতকে সাময়িকভাবে স্থগিত করছে মাত্র।

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের আলোচনা শুরু করা উচিত। অর্থাৎ ‘বর্তমান সীমান্তরেখায়’ তিনি দুই দেশকে নতুন করে শুরুর কথা বলছেন। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন জানালেও রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
মজার বিষয়, এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে ট্রাম্পের কি কোনো ফায়দা আছে।
গত রোববার এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই থামানো উচিত। বাকিটা পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
এ সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ট্রাম্প বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, এটা সেভাবেই রেখে দেওয়া হোক। তুমি এটা নাও, আমরা এটা নিই—এভাবে বললে হবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৭৮ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ থামানোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।’
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে বলছেন কি না, ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না। শুধু এখন যেভাবে ভাগ হয়ে আছে, সেভাবেই থাকুক।’
এখন যুদ্ধরেখা কোথায় আছে? প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভ প্রদেশের একটি অংশও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে অঞ্চলটি ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, সেখানেই সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে।
রাশিয়া বর্তমানে লুহানস্কের সম্পূর্ণ অংশ ও দোনেৎস্কের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া খেরসনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ার বৃহৎ অংশও রুশ সেনাদের দখলে।
জাপোরিঝিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল, যেখানে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও বিমান তৈরির কারখানা রয়েছে। এখানেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।
তবে অবাক করার বিষয়, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় নেতারা ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি। বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনাবিন্দু হতে পারে।’
এর আগে ইউক্রেন বারবার বলেছে, তারা সব দখল করা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনকে জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জিততে পারে—তাঁর এই অবস্থান বারবার বদলেছে।
গত আগস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষকেই কিছুটা জমি ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তিনি উল্টো মন্তব্য করেন—ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে পারে এবং এমনকি ২০১৪ সালে হারানো ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ পুনর্দখল করতে সক্ষম।
অন্যদিকে রাশিয়া ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কোনো ফল দেবে না।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মস্কো তার দাবিতে অনড়—যুদ্ধ শেষ করতে হলে, দখল করা সমস্ত ভূমি তাদের দিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের বলে দাবি করা পূর্বাঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে শুধু দখল করা অংশ নয়, রাশিয়া পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে।
এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প এ বৈঠক বাতিল করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হলো এই বৈঠক এখন ফলপ্রসূ হবে না, তাই বাতিল করেছি। তবে ভবিষ্যতে আবার বসা হবে।’
এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেদের ক্ষতি জেনেও কেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে ইউরোপ-ইউক্রেন। কারণ, এ মুহূর্তে তাদের কাছে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সর্বশেষ, হোয়াইট হাউসের বৈঠক থেকে আশা করা হয়েছিল, এবার জেলেনস্কি হয়তো টমাহক নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে ইউরোপে আটকে থাকা রুশ অর্থ থেকে ইউক্রেনকে লোন দেওয়ার যে প্রস্তাব উঠেছে, তাতে সবাই একমত হতে পারেনি। ফলে সেটাও আটকে আছে। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও রসদ, দুটোরই সংকট আছে ইউক্রেনের। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করাই তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
সবশেষে আসে ট্রাম্পের কথা। এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমি আরও একটি যুদ্ধ থামিয়েছি। এবার আমাকে নোবেল না দিয়ে যাবে কোথায়!’ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব ঘুচতে পারে।
এদিকে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ওয়াশিংটনের এমন ঘোষণায় চির ধরেছে ট্রাম্প-পুতিনের বন্ধুত্বে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে টিকে যাবে তাঁদের বন্ধুত্ব।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা

ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর প্রস্তাব দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ধারণা, যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেখান থেকেই ভবিষ্যতের আলোচনা শুরু করা উচিত। অর্থাৎ ‘বর্তমান সীমান্তরেখায়’ তিনি দুই দেশকে নতুন করে শুরুর কথা বলছেন। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা সমর্থন জানালেও রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
মজার বিষয়, এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে ট্রাম্পের কি কোনো ফায়দা আছে।
গত রোববার এয়ারফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই থামানো উচিত। বাকিটা পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
এ সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে ট্রাম্প বলেন, ‘এখন যে অবস্থা, এটা সেভাবেই রেখে দেওয়া হোক। তুমি এটা নাও, আমরা এটা নিই—এভাবে বললে হবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রায় ৭৮ শতাংশ দখল করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ থামানোই সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।’
যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে পুরো দনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে বলছেন কি না, ট্রাম্প জবাব দেন, ‘না। শুধু এখন যেভাবে ভাগ হয়ে আছে, সেভাবেই থাকুক।’
এখন যুদ্ধরেখা কোথায় আছে? প্রায় চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ—দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, খেরসন ও জাপোরিঝিয়া দখল করে নিয়েছে। এ ছাড়া খারকিভ প্রদেশের একটি অংশও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বর্তমানে দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক মিলে যে অঞ্চলটি ‘দনবাস’ নামে পরিচিত, সেখানেই সবচেয়ে তীব্র লড়াই চলছে।
রাশিয়া বর্তমানে লুহানস্কের সম্পূর্ণ অংশ ও দোনেৎস্কের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোর্স্কের আশপাশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ছাড়া খেরসনের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং জাপোরিঝিয়ার বৃহৎ অংশও রুশ সেনাদের দখলে।
জাপোরিঝিয়া ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চল, যেখানে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও বিমান তৈরির কারখানা রয়েছে। এখানেই ইউরোপের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অবস্থিত।
তবে অবাক করার বিষয়, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় নেতারা ট্রাম্পের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় নেতারা ও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা ট্রাম্পের প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি। বর্তমান যুদ্ধরেখাই ভবিষ্যৎ আলোচনার সূচনাবিন্দু হতে পারে।’
এর আগে ইউক্রেন বারবার বলেছে, তারা সব দখল করা ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করতে চায়। কিন্তু ট্রাম্প কখনো ইউক্রেনকে জমি ছেড়ে দিতে বলেছেন, আবার কখনো বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ জিততে পারে—তাঁর এই অবস্থান বারবার বদলেছে।
গত আগস্টে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকের আগে ট্রাম্প বলেন, এই যুদ্ধে উভয় পক্ষকেই কিছুটা জমি ছাড় দিতে হবে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তিনি উল্টো মন্তব্য করেন—ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ী হতে পারে এবং এমনকি ২০১৪ সালে হারানো ক্রিমিয়াসহ পুরো দেশ পুনর্দখল করতে সক্ষম।
অন্যদিকে রাশিয়া ট্রাম্পের এই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই শান্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ—তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি কোনো ফল দেবে না।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মস্কো তার দাবিতে অনড়—যুদ্ধ শেষ করতে হলে, দখল করা সমস্ত ভূমি তাদের দিয়ে দিতে হবে এবং নিজেদের বলে দাবি করা পূর্বাঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি গোপন বার্তা পাঠিয়েছে, যেখানে শুধু দখল করা অংশ নয়, রাশিয়া পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে।
এদিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প এ বৈঠক বাতিল করেছেন। এরপর গতকাল বুধবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মনে হলো এই বৈঠক এখন ফলপ্রসূ হবে না, তাই বাতিল করেছি। তবে ভবিষ্যতে আবার বসা হবে।’
এখন সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, যুদ্ধ বন্ধ হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। প্রশ্ন হতে পারে, নিজেদের ক্ষতি জেনেও কেন ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে ইউরোপ-ইউক্রেন। কারণ, এ মুহূর্তে তাদের কাছে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সর্বশেষ, হোয়াইট হাউসের বৈঠক থেকে আশা করা হয়েছিল, এবার জেলেনস্কি হয়তো টমাহক নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি ফিরেছেন খালি হাতে। এদিকে ইউরোপে আটকে থাকা রুশ অর্থ থেকে ইউক্রেনকে লোন দেওয়ার যে প্রস্তাব উঠেছে, তাতে সবাই একমত হতে পারেনি। ফলে সেটাও আটকে আছে। অর্থাৎ যুদ্ধ চালানোর অর্থ ও রসদ, দুটোরই সংকট আছে ইউক্রেনের। তাই এ মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করাই তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো সমাধান।
সবশেষে আসে ট্রাম্পের কথা। এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প বলতে পারবেন, ‘আমি আরও একটি যুদ্ধ থামিয়েছি। এবার আমাকে নোবেল না দিয়ে যাবে কোথায়!’ তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব ঘুচতে পারে।
এদিকে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কেমন হবে, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ওয়াশিংটনের এমন ঘোষণায় চির ধরেছে ট্রাম্প-পুতিনের বন্ধুত্বে। তাই এ যুদ্ধ বন্ধ হলে টিকে যাবে তাঁদের বন্ধুত্ব।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত...
৩ দিন আগেশশী থারুরের নিবন্ধ
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।
লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’
বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।
জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’
তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।
কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।
তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।
চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।
ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।
অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।
আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।
এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।
জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।
বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

জাতিসংঘের ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ, ২৪ অক্টোবর। কিন্তু নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পরিবেশ মোটেও উৎসবমুখর নয়, বরং সেখানে ভর করেছে একধরনের অনিশ্চয়তা, হতাশা আর নিঃশব্দ আতঙ্ক। যে হলঘর একসময় ভরে উঠত যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন, উপনিবেশমুক্তি আর শান্তির আশায়, সেখানে এখন বাজছে এক ক্লান্ত সভ্যতার প্রতিধ্বনি। কূটনীতির জয়গাথা হিসেবে জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজ অস্তিত্বসংকটে। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আর ঠিক তখনই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্র নিজেই পিছিয়ে আসতে চাইছে।
লক্ষণগুলো স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ও ইউনেসকোসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সরে এসেছে। জাতিসংঘের অনেক সংস্থায় অর্থায়নও বন্ধ বা ব্যাপকভাবে কমিয়েছে। এমনকি জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের অনুদান কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র গাজা প্রসঙ্গে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ভিসা বাতিল করেছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক নজিরবিহীন বক্তব্যে মাল্টিল্যাটারালিজম বা বহুপাক্ষিকতার মৌলিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিনিধি সুসান রাইস সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর সেই জায়গাগুলোতে খেলছি না, যেখানে একসময় বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি।’
বহুপাক্ষিকতার এই ক্ষয় এমন একসময়ে ঘটছে, যখন পৃথিবীর আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দরকার সম্মিলিত পদক্ষেপের। ইউক্রেন, সুদানসহ নানা সংঘাতের আগুন জ্বলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। শান্তির কোনো ইঙ্গিত নেই। ট্রাম্প প্রশাসন গাজা শান্তিচুক্তির আয়োজন করেছে, কিন্তু তা জাতিসংঘের কাঠামোর বাইরে।
জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুততর হচ্ছে, বৈষম্য বাড়ছে, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের গতি শাসনব্যবস্থার সক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই পরিস্থিতিকে বলেছেন, ‘বৈশ্বিক সংকট।’ তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভূরাজনৈতিক বিভাজন আমাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে, যা দিয়ে আমরা কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করতে পারি।’
তাহলে কি বহুপাক্ষিকতা ভাঙনের পথে? জাতিসংঘ কি টিকে থাকতে পারবে ক্রমবর্ধমান এই ‘অপ্রাসঙ্গিকতার’ অভিযোগের ভেতর? এর উত্তর খুঁজতে হলে আগে বুঝতে হবে, বহুপাক্ষিকতা আসলে কী ছিল—আর এখন তা কী হয়ে উঠেছে। মূলত বহুপাক্ষিকতা মানে, এমন বিশ্বাস যে বৈশ্বিক সমস্যা (যা জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় বলেছিলেন—সীমানাহীন সমস্যা) সমাধানও হতে হবে বৈশ্বিক পরিসরে, এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেখানে ছোট-বড় সব রাষ্ট্রেরই সমান কণ্ঠস্বর থাকবে। এটি সার্বভৌম সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আইনের শাসনের ওপর দাঁড়ানো এক ব্যবস্থা। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, যেখানে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেরই এক ভোট, এখনো সেই আদর্শের সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রতীক।
কিন্তু বাস্তবতা সব সময়ই আদর্শকে ছায়ায় ফেলে রেখেছে। জাতিসংঘের কাঠামো, বিশেষ করে—নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো ক্ষমতা, বৈষম্যকে স্থায়ী করে রেখেছে। জাতিসংঘের অনেক প্রস্তাব বাধ্যতামূলক নয়, বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও দুর্বল। সাধারণ পরিষদ অনেক সময়ই পরিণত হয় বাস্তব সমাধানের বদলে রাজনৈতিক বক্তব্যের মঞ্চে। আর নিরাপত্তা পরিষদ নিজেও এখনো ১৯৪৫ সালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে বহন করছে, যখন আমরা দাঁড়িয়ে ২০২৫-এর শেষ অংশে।
তবু জাতিসংঘ অনেক কিছু অর্জন করেছে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত সর্বজনীন ঘোষণা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), প্যারিস জলবায়ু চুক্তি—সবই এসেছে বহুপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা সমন্বয় করেছে, সফল শান্তিরক্ষা মিশন চালিয়েছে, অসংখ্য আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে ভূমিকা রেখেছে, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য প্রতিক্রিয়া গড়ে তুলেছে। এটি ছোট দেশগুলোর জন্য দিয়েছে বলার জায়গা, আর বড় দেশগুলোর জন্য শোনার বাধ্যবাধকতা। যদিও অনেক সময় তা কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু আজ সেই ব্যবস্থাও ভাঙনের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দুর্বল হয়েছে, আঞ্চলিক জোটগুলোর উত্থান ঘটেছে, কূটনৈতিক নীতিমালার ঐক্য ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গোটা ব্যবস্থার ওপর দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলেছে। উভয় পক্ষই এখন নিজেদের মতো করে সীমিত গোষ্ঠীগত বা দ্বিপক্ষীয় সমঝোতায় ঝুঁকছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং গাজায় ইসরায়েলের অটল অবস্থান আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আস্থা আরও দুর্বল করেছে। এমনকি যে ইউরোপে একসময় বহুপাক্ষিকতার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ছিল, সেখানে এখন জাতীয়তাবাদের ঢেউ সেই ঐকমত্যকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট মহৎ উদ্দেশ্যে, কিন্তু সীমিত প্রভাবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এখন ঝুঁকির মুখে। তবে পতন অনিবার্য নয়। বহুপাক্ষিকতা হয়তো আঘাতপ্রাপ্ত, কিন্তু এখনো মারা যায়নি। বিশ্বনেতারা এখনো নিউইয়র্কে একত্র হন, কথা বলেন, আলোচনা করেন, তর্ক করেন—এই ঘটনাই প্রমাণ করে, বৈশ্বিক সংলাপের প্রয়োজন এখনো গভীরভাবে বিদ্যমান।
চলতি বছর শুরু হওয়া ‘ইউএন-৮০’ উদ্যোগের লক্ষ্য হলো জাতিসংঘের দায়িত্বের ভার কমানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং জন-আস্থা পুনরুদ্ধার। প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন বিলাসিতা নয়—অস্তিত্বের শর্ত। তবে বহুপাক্ষিকতার সংকট কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, তা দার্শনিকও বটে। এই সংকট এক গভীর টানাপোড়েন উন্মোচন করেছে। আর সেটি হলো—বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক নির্ভরতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বের আওতায় থাকা ‘যেকোনো জায়গার মানুষ’ আর ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষ’-এর আত্মপরিচয়ের মধ্যে।
ডেভিড গুডহার্টের বিশ্লেষণ এখানে প্রাসঙ্গিক। ‘কোনো এক বিশেষ জায়গার মানুষেরা’ ধর্ম, সংস্কৃতি ও স্থানীয় পরিচয়ে প্রোথিত, তারা বৈশ্বিক অভিজাত শ্রেণি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রমশ সন্দিহান। তাদের রাজনৈতিক উত্থান—ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্পবাদ পর্যন্ত—বদলে দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপট। আর এ কারণেই বহুপাক্ষিকতা টিকে থাকার লড়াই করছে।
অতএব, বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শুধু প্রতিষ্ঠান সংস্কারের ওপর নয়, বৈধতা পুনর্গঠনের ওপরও। এই সংস্কারে কেবল কূটনীতিকদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের উদ্বেগের প্রতিফলনও ঘটাতে হবে। প্রমাণ করতে হবে, বৈশ্বিক সহযোগিতা বাস্তব সুফল দিতে পারে—চাকরি, নিরাপত্তা, মর্যাদা সবকিছুর। এগুলো শুধু নীতিগত উচ্চারণ নয়। বহুপাক্ষিকতাকে হতে হবে কম প্রযুক্তিনির্ভর, বেশি মানবিক।
আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসন ও বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা করেছে—যেমন জাপান ও হাঙ্গেরি তারা হয়তো এই প্রতিক্রিয়ার ঝড় থেকে তুলনামূলকভাবে সুরক্ষিত। জাপানের সতর্ক কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক সমরূপতা দেশটিকে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোর মতো জনতুষ্টির চাপে পড়তে দেয়নি। অন্যদিকে ভিক্টর অরবানের নেতৃত্বে হাঙ্গেরি গ্রহণ করেছে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী অবস্থান, যা বহুপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করে।
এগুলো স্বল্প মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বহন করে। চ্যালেঞ্জ তাই এক মধ্যপথ খুঁজে পাওয়া। একটি বহুপাক্ষিকতা, যা নীতিনিষ্ঠ কিন্তু বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক কিন্তু কার্যকর। এর জন্য কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নেতৃত্ব নয়, প্রয়োজন উদীয়মান শক্তিগুলোর, আঞ্চলিক জোটগুলোর, এমনকি নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকারও। উদাহরণস্বরূপ, ভারত একটি ন্যায়সংগত বৈশ্বিক শৃঙ্খলার পক্ষে নেতৃত্ব দিতে পারে—যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংহতি ও টেকসই উন্নয়ন হবে মূল মূল্যবোধ।
জাতিসংঘের ৮০তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন যত সামনে বাড়ছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে ঝুঁকি। বর্তমান পৃথিবী সংকটহীন নয়, সহযোগিতাহীন। জাতিসংঘ নিখুঁত নয়। তবুও দাগ হ্যামারশোল্ড যেমন বলেছিলেন, জাতিসংঘ ‘মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছাতে নয়, নরক থেকে রক্ষা করতে’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল—সেটাকে আবারও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে।
এ উদ্দেশ্য পূরণে জাতিসংঘ হয়তো কখনো কখনো ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু এখনো এটাই একমাত্র মঞ্চ, যেখানে সব দেশ একত্র হয়ে বিশ্বের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে। এটিকে ত্যাগ করা মানে আমাদের সাধারণ মানবতার ধারণাকেই ত্যাগ করা।
বহুপাক্ষিকতা হয়তো ছিন্নভিন্ন, কিন্তু একই সঙ্গে নবজন্মের পথেও আছে। এর টিকে থাকা নির্ভর করছে স্মৃতিচারণা নয়, পুনর্জাগরণের ওপর। আর সেই পুনর্জাগরণ শুরু হয় এই উপলব্ধি থেকে যে এই বিশ্বে যতক্ষণ না সব দেশ স্বাধীন, ততক্ষণ কোনো দেশই প্রকৃত সার্বভৌম নয়।

২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে
০২ ডিসেম্বর ২০২২তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা আবারও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে দুই পক্ষের কূটনৈতিক যোগাযোগ ক্রমেই শীতল হচ্ছে। চীন বারবার বলছে, তাইওয়ান আমাদের অংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বলছে, তাইওয়ানের নিরাপত্তা আমাদের কৌশলগত স্বার্থের অঙ্গ।
১ দিন আগে
ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের প্রতি খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। তবে এবার তাঁর প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় সক্রিয় হয়েছেন। ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো ট্রাম্প নিজেও এবার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় রোববারের আসিয়ান সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পন
২ দিন আগে
এক বছর আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বেশ দম্ভ করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করবেন। অথচ সেই ট্রাম্প এখন বলছেন, যুদ্ধ যেখানে চলছে, সেখানেই এটিকে ‘কাট অ্যান্ড স্টপ’ করা উচিত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ হলে রাশিয়া-ইউক্রেনের কে কী পাবে বা এখানে...
২ দিন আগে