Ajker Patrika

‘গডফাদারের সৌদি ভার্সন’: যেভাবে ক্ষমতা দখল করেন যুবরাজ এমবিএস

আব্দুর রহমান
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩: ০৫
‘গডফাদারের সৌদি ভার্সন’: যেভাবে ক্ষমতা দখল করেন যুবরাজ এমবিএস

১.
২০ জুন, ২০১৭। সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদ। দেশটির বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের বাসভবন। প্রাসাদের একটি কামরায় বন্দী দেশটির তৎকালীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ ওরফে এমবিএন। একটি বৈঠকের কথা বলে তাঁকে ডেকে এনে সারা রাত ধরে বন্দী করে রাখা হয়েছে তুর্কি আল-শেখের কামরায়। হুমকি দেওয়া হয়েছে তিনি যুবরাজের পদ না ছাড়লে তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে। বন্ধ করে দেওয়া হবে তাঁর যাবতীয় ওষুধ। সৌদি আরবের বর্তমান যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের উপ-যুবরাজ থেকে যুবরাজ হয়ে ওঠার প্রাসাদ অভ্যুত্থানের শুরু এভাবেই।

দ্বন্দ্বের শুরু আরও আগে। সে বছরেরই ৫ জুন। প্রতিবেশী কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। এমবিএস ও তাঁর মিত্ররা কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে হলেও এমবিএন বিষয়টি আলোচনার টেবিলে মিটিয়ে ফেলতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু এমবিএস এতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কারণ তো রয়েছেই।

কাতারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই আল-ইয়ামামায় ডেকে আনা হয় এমবিএনকে। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি তাঁর এই আসাই ইয়ামামায় শেষ আসা। যুবরাজ হিসেবে তিনি আর কখনো এই প্রাসাদে আসতে পারবেন না। প্রাসাদের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা মাত্র এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীদের বলা হয় বাইরে অপেক্ষা করতে। এমবিএনের নিরাপত্তারক্ষীসহ প্রাসাদের নিরাপত্তারক্ষীদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় এমবিএসের নিরাপত্তারক্ষীরা। এমবিএনকে নিয়ে যাওয়া হয় এমবিএসের প্রিয়পাত্র তুর্কি আল-শেখের কামরায়।

 এমবিএস এবং মোহাম্মদ বিন নায়েফসেখানে সারা রাত ধরে বন্দী করে রেখে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে চাপ দেওয়া হয় পদত্যাগ করার জন্য। প্রথমে তিনি রাজি না হলেও পরে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয় তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের ধর্ষণ করা হবে এবং তাঁকে হাসপাতালে বন্দী করা হবে। এমবিএন ধারণা করেছিলেন, তাঁকে বিষ খাওয়ানোও হতে পারে। তাই তিনি এমনকি পানি পান করতেও অস্বীকৃতি জানান। এমবিএসের লোকেদের চাপে অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এমবিএন। সৌদি সিংহাসনের উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে এমন কমিটির দুই সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যে, ওই দুই সদস্য আগে থেকেই এমবিএসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন।

পরে এমবিএনকে প্রাসাদের আরেকটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে এমবিএস সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীসহ টেলিভিশন ক্যামেরা নিয়ে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের জন্য মোহাম্মদ বিন নায়েফের পদত্যাগের ঘোষণা রেকর্ড করা হয়। পরে রেকর্ডিং শেষ হয়ে যাওয়া মাত্র এমবিএস তাঁর চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁর হাত এবং হাঁটু চুম্বন করেন। তবে সেখানে কৃতজ্ঞতার কোনো বহিঃপ্রকাশ ছিল না। পরে এমবিএন তাঁর উপদেষ্টার কাছে পাঠানো এক খুদে বার্তায় লিখেছিলেন—‘আমি যখন বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলাম তারপরও আমার পিঠে বন্দুক ধরে রাখা হয়েছিল।’

এভাবেই এক রাতের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানে নীরবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে সৌদি রাজপ্রাসাদে। এক সময়ের মার্কিন প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এমবিএন রাতারাতি গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। আর মাত্র ৩১ বছর বয়সে সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক হয়ে ওঠেন এমবিএস। তবে এখানেই শেষ নয়। ভোরে যখন মোহাম্মদ বিন নায়েফ জেদ্দায় তাঁর নিজের বাসভবনে ফিরে যান, তখন দেখতে পান রাতারাতি তাঁর বাসভবনের সব নিরাপত্তারক্ষী পাল্টে গেছে। তাঁর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, তিনি গৃহবন্দী।

তবে এসব ঘটনার সবই ঘটেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাষ্ট্রায়ত্ত টিভিতে বলা হয় এমবিএন জাতীয় স্বার্থে তাঁর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। কোনো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই এই বিষয়ে কোনো কিছু জানত না। এমনকি ওয়াশিংটন ও লন্ডনের সৌদি দূতাবাসও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে।

সাবেক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফ২.
সৌদি আরব প্রতিষ্ঠার পর কয়েক যুগ ধরে দেশটির সিংহাসনের দখল প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ ও তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে যুবরাজ মনোনীত করার মধ্য দিয়ে ভাবা হচ্ছিল ক্ষমতা এবার তৃতীয় প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে এমবিএসের অভ্যুত্থান সেই বিষয়টিকেই ভেস্তে দেয়। সৌদি রাজ পরিবারে প্রচলিত জ্যেষ্ঠতাভিত্তিক সিংহাসন বণ্টনের বিষয়টি এই অভ্যুত্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়।

যুবরাজ এমবিএস কেবল এমবিএনকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেই বসে থাকেননি। নায়েফের পুরোনো মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরিবর্তে তিনি সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ারও লক্ষ্য স্থির করেন। এ লক্ষ্যে তিনি ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। এই যোগাযোগ এমবিএসকে ওয়াশিংটনে বিন নায়েফের ক্ষমতার জায়গাকে টলিয়ে দেয়। একই সঙ্গে এমবিএস মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও আস্থায় চলে আসেন।

সৌদিতে মোহাম্মদ বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন সাদ আল-জাবরি। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমবিএনের যোগাযোগের ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করতেন। অভ্যুত্থানের আগে এমবিএনের হয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে নিজের অনুকূলে নিতে ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে একটি লবিস্ট ফার্ম নিযুক্ত করেছিলেন আল-জাবরি। এমবিএস ক্ষমতা পাওয়ার পরপরই তাঁর লোকজন বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠদের ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এ পর্যায়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় এবং বিষয়টি জানা মাত্র আল-জাবরি তুরস্কে পালিয়ে যান।

তুরস্ক থেকে কিছুদিন আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আব্দুলাজিজ হাওয়ারিনিকে একটি কোডেড বার্তা পাঠান। বার্তায় লেখা ছিল, ‘প্রবল ঠান্ডায় না খেয়ে বেঁচে আছি’—এর অর্থ ছিল, তাঁকে তুরস্কে থেকে যেতে হবে কিনা। হাওয়ারিনি ফিরতি বার্তায় লিখেন, তাঁর দেশে না ফেরাই উচিত। পরে সেবার অর্থাৎ ২০১৭ সালের ১৭ জুন হাওয়ারিনি আল-জাবরির কাছে আরেকটি বার্তা পাঠান। যেখানে লেখা ছিল, এমবিএসের লোকেরা তাঁকে ধরার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে রয়েছে। বিষয়টি এখানেই থেকে থাকেনি। এমবিএস নিজে আল-জাবরিকে দেশে ফেরানোর জন্য উদ্যোগ নেন। তিনি এক বার্তায় বিন নায়েফ এবং এমবিএসের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আল-জাবরিকে দেশে ফেরার অনুরোধ করেন। ১৮ জুন আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় এমবিএস লেখেন, ‘আমি মনে করি না যে, এমন কেউ আছে যে নায়েফকে আপনার চেয়ে ভালো বোঝে।’

মোহাম্মদ বিন সালমান এবং জো বাইডেনআল-জাবরির সঙ্গে এমবিএসের সম্পর্ক ২০১৫ সাল থেকেই খারাপ ছিল। সে সময় এমবিএস বাদশাহ সালমানকে আল-জাবরিকে বরখাস্ত করার অনুরোধ করেছিলেন। আল-জাবরির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি তৎকালীন সিআইএ পরিচালক জন ব্রেনান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব ফিলিপ হ্যামন্ডের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন এবং বৈঠকের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেননি। তবে বাদশাহ তা করেননি। যাই হোক, এমবিএস ওই বার্তায় আরও নমনীয় সুরে লিখেছিলেন, ‘আসুন আমরা অতীতের কথা ভুলে যাই। আমরা কি এখনো শিশু রয়ে গেছি? আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে আসুন।’ তবে আল-জাবরি এমবিএসের কথায় কান দেননি। তিনি চিকিৎসার অজুহাত দেখিয়ে তাঁর নির্বাসিত জীবনকে দীর্ঘায়িত করার পথ বেছে নেন।
এই বার্তা বিনিময়ের মাত্র দুদিন পর অভ্যুত্থান ঘটান মোহাম্মদ বিন সালমান।

৩.
অভ্যুত্থানের কয়েক মাসের মধ্যেই সৌদি আরবের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন এমবিএস। বিন নায়েফের লোকদের সরিয়ে দেওয়া হয় সব পদ থেকেই। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা এমবিএসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী বুদ্ধিজীবী, অধিকারকর্মীদের ওপর খড়গহস্ত হন এমবিএস। দেশজুড়ে ব্যাপক গ্রেপ্তার ও ধর-পাকড় চালানো হয়।

এই অবস্থায় আল-জাবরি সপরিবারে তুরস্কে বসবাস করতে থাকলেও তাঁর দুই সন্তান রয়ে যায় রিয়াদেই। তাদের ওপর এমবিএসের গোয়েন্দারা নজর রাখছিল। ওই দুজন অভ্যুত্থানের রাতে সৌদি ছাড়ার চেষ্টা করলে তাদের বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয়। পরে এমবিএস আল-জাবরির সন্তানদের সৌদি ছাড়ার অনুমতি দেন। তবে এমবিএস দাবি করেন, আল-জাবরি যেন, সৌদিতে ফিরে এসে বিন নায়েফের বিষয়ে একটি ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ফাইল’ নিয়ে আলোচনা করেন। এমবিএস আল-জাবরিকে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, ‘ডাক্তার, আপনাকে আনার জন্য আমরা বিমান কোথায় পাঠাব?’ —এবারও আল-জাবরি জানান, তাঁর দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছা নেই।

মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পআল-জাবরি এই পর্যায়ে এমবিএসকে জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করছেন যে, এমবিএসের প্রতি অনুগত থাকবেন এবং তাঁর কোনো ক্ষতির কারণ হবেন না। বিষয়টি নিশ্চিত করতে তিনি এমবিএসকে লেখেন, ‘আমার কাছে অনেক সংবেদনশীল রাষ্ট্রীয় তথ্য আছে, কিন্তু তারপরও আমি আমি কখনো কিছু ফাঁস করিনি।’ তিনি আরও লিখেন, ‘আমি ফিরে গেলে আমার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে তা আমার জানা নেই। তাই আমার পক্ষে বাইরে থাকাই কি ভালো নয়? যেখানে আমি আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকব এবং সর্বসাধারণের উপকার করে এমন সবকিছুতে আপনাকে সহযোগিতা করব?’

আল-জাবরির এই কথায় চিড়ে ভেজেনি। এমবিএস তাঁকে হুমকি দেন, যেকোনো মূল্যে তাঁকে খুঁজে বের করে পাকড়াও করা হবে। এই হুমকির পরপরই ২০১৭ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি তুরস্ক থেকে কানাডায় পালিয়ে যান। তারপরও সৌদি আরব আল-জাবরিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালায় ইন্টারপোলের সহায়তায়। কানাডাকে অনুরোধ করে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু উভয় চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে আল-জাবরি সৌদির একটি প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা সংস্থার বার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তাঁকে হত্যার জন্য আততায়ী পাঠানো হতে পারে। ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি আল-জাবরিকে কানাডার সৌদি দূতাবাসের আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেয়।

যাই হোক, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কানাডার বর্ডার এজেন্টরা পর্যটন ভিসায় দেশে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত হিটম্যান গ্রুপ টাইগার স্কোয়াডের সদস্যদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে বলে জানানো হয়। তবে রিয়াদ এই বিষয়ে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। কানাডা জানিয়েছে, টাইগার স্কোয়াডের পরিকল্পনার সঙ্গে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের ভেতরে সেই মাসেই ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে যেভাবে হত্যা করেছিল তার যথেষ্ট মিল রয়েছে।

আল-জাবরির সঙ্গে কাজ করা মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে—এমবিএস আল-জাবরিকে হুমকি হিসেবে দেখছিলেন। এই বিষয়ে সাবেক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আল-জাবরি এমন একজন, যাকে সৌদির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো অপছন্দ করে। কারণ তিনি সৌদি রাজপরিবারের প্রতিটি ভুল এবং ভুল পদক্ষেপ সম্পর্কে জানেন।’

৪.
গত বছরের শীতে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আল-জাবরির সাক্ষাৎ হয়েছিল। সে সময় আল-জাবরি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতটাই ভীত ছিলেন যে, কারও সঙ্গেই দেখা করতেন না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এমবিএসের ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ায় আল-জাবরি ওয়াশিংটনেও খুব একটা আসতেন না। যদিও দেশটির বেশ কয়েকজন সিনেটর, হোয়াইট হাউসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে  তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। আল-জাবরি সৌদি সরকারের ‘লম্বা হাত’ সম্পর্কে এতটাই ভীত ছিলেন যে, এতসব ক্ষমতাবান শুভাকাঙ্ক্ষী থাকার পরও তিনি দেশটিতে যেতে চাননি।

সাদ আল-জাবরিস্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া আল-জাবরি সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি শুরু করেন ১৯৯০-এর দশকে। মাঝে তিনি একবার চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিন নায়েফ তাঁকে তা করতে দেননি। এর পর দীর্ঘ সময় বিন নায়েফের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার মূল্য এখনো তাঁকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।

মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাসাদ-অভ্যুত্থানের পরপরই তাঁর লোকেরা আল-জাবরির পরিবারের ৪০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তাঁর দুই সন্তান সারা (২৪) এবং ওমর (২২) ছিল। সৌদি আদালত অর্থ পাচার ও অবৈধভাবে সৌদি আরব ত্যাগের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের আগস্টে কারাদণ্ড দেয়। কারাদণ্ডের পরপরই ভেঙে পড়েন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের কাছে আবেদন জানান যে, এমবিএস যা চান তার বিনিময়ে সারা এবং ওমরকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এমবিএস সেই পথে হাঁটেননি।

জবাবে আল-জাবরিও এক হাত দেখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এমবিএস। ওয়াশিংটনের একটি আদালতে—এমবিএস তাঁকে হত্যার জন্য ডেথ স্কোয়াড পাঠিয়েছিল, এমন অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন তিনি। যদিও আল-জাবরি জানতেন তিনি এমবিএসের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবেন না। তারপরও এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁকে শিগগিরই নতুন হুমকির মুখোমুখি হতে হয়।

২০২১ সালের শুরুতে কানাডার অন্টারিও এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে আল-জাবরির বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করা হয়। অভিযোগ করা হয়, আল-জাবরি সৌদি সরকারের সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপ করেছেন। এই মামলাগুলো দায়ের করে এমন ১০টি ফার্ম যেগুলো বিন নায়েফ যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় নিজের প্রভাব তৈরির জন্য গঠন করেছিলেন। কিন্তু এমবিএস ক্ষমতায় আসার পরপরই সেসব ফার্মের নিয়ন্ত্রণ নেন এবং চেয়ারম্যান বনে যান।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতে না লড়ে বাইরে আলোচনার টেবিলে কোনোভাবে সেরে নেওয়া যায় কিনা। তাদের এই উদ্যোগের কারণ ছিল, বিন নায়েফের সঙ্গে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হয়ে না যায়। রিয়াদে নিযুক্ত এক সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এমবিএসের লোকজন আসলে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, আল-জাবরি চিরতরে মুখ বন্ধ রাখবেন কিনা। তাই তাঁরা বিষয়টি নিয়ে সমঝোতায় উৎসাহী ছিল না।’ তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমবিএসের সঙ্গে সমঝোতার নতুন উদ্যোগ নেন আল-জাবরি। তিনি এমবিএসের সঙ্গে বিষয়টি আইনি উভয়ভাবেই সমাধানের চেষ্টা করেন। তবে এমবিএস বিষয়টি নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এদিকে, গত সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটন আদালত এমবিএসের বিরুদ্ধে আল-জাবরির মামলা খারিজ করে দেয়। তবে আল-জাবরি আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করেছেন। তবে বিষয়টি আল-জাবরিকে আবারও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে।

এদিকে, আল-জাবরির বিরুদ্ধে মামলা চললেও তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির অভিযোগগুলো চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করা কঠিন হতে পারে। কারণ মামলাগুলোর যিনি রাজসাক্ষী হতে পারেন—সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কাজে সেসব অর্থ ছাড় করেছিলেন সেই ব্যক্তি বিন নায়েফ: গুম হয়ে গেছেন।

৫.
২০১৭ সালের শেষ দিকে বিন নায়েফের গৃহবন্দীত্ব দশা খানিকটা শিথিল করা হয়। কিন্তু তাঁকে কোনোভাবেই নিজের বাস ভাবনের বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। বিন নায়েফে প্রিয় শখ ছিল আলজেরিয়ার মরুতে ইগল শিকার করা। তাঁকে সেটি করতে দেওয়া হয়নি। তবে মাঝে মধ্যে তাঁকে সৌদির মরুতে শিকারের সুযোগ দেওয়া হতো—অবশ্যই এমবিএস কর্তৃক নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীসহ। এভাবে বিন নায়েফের গতিবিধি সীমাবদ্ধ করে ফেলার পরও তিনি আশা করছিলেন যে, তাঁকে পদচ্যুত করা হলেও তাঁকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না। তবে তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি।

বিন নায়েফের আশা ছিল, তিনি তাঁর পূর্বসূরি যুবরাজ মুকরিন বিন আব্দুলাজিজের মতোই কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। মুকরিনকে যখন বাদশাহ সালমান যুবরাজের পদ থেকে অব্যাহতি দেন তখন বাদশাহ মুকরিনকে এককালীন ৮০ কোটি ডলার এবং একটি দামি ইয়টসহ বিভিন্ন দামি উপহার দিয়েছিলেন।

বিপরীতে, দেশে থাকা বিন নায়েফের সম্পদের বড় একটি অংশই বাজেয়াপ্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর বিন নায়েফ জেনেভার এইচএসবিসি ব্যাংককে ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড এবং ডলারে যে পরিমাণ অর্থ জমা রয়েছে তা সৌদির একটি ব্যাংকে স্থানান্তর করতে বলে। তবে বিন নায়েফের সম্পদ সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানিয়েছে, জেনেভায় বিন নায়েফের ব্যাংকার এবং আইনজীবীরা এই অনুরোধ উপেক্ষা করেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল যে, বিন নায়েফকে দিয়ে জোর করে এই বার্তা পাঠানো হয়েছে।

 জামাল খাশোগিবিদেশে বিন নায়েফের কি পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তা অস্পষ্ট। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বলছেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা রয়েছে বিন নায়েফের। তারপরও বিন নায়েফের অভ্যন্তরীণ সম্পদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হাতছাড়া হয়েছিল। বিন নায়েফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, জব্দ করা মোট সম্পত্তির পরিমাণ ৫২২ কোটি ডলার। তবে ঘনিষ্ঠ আরেকটি পৃথক সূত্র জানিয়েছে—বাজেয়াপ্ত করা সম্পদের মোট মূল্য ৪৭৫ কোটি ডলার।

বিন নায়েফ ২০১৮ ও ১৯ সালে এসে তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন। রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির হতে দেখা যায় তাঁকে। তবে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় এর পরে। ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার রিয়াদের উপকণ্ঠে অবস্থিত বিন নায়েফের বাসস্থানে অভিযান চালায় এবং তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস তাঁকে একটি নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করা হয়। এমনকি নির্যাতনও করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিন নায়েফ মারাত্মকভাবে আহত হন। বিষয়টি নিয়ে একটি সূত্র বলেছে, ‘নির্যাতনের ফলে তাঁর গোড়ালিতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হয়েছে এবং তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ওজন হারিয়েছেন।’

পরে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ বিন নায়েফকে সেই নির্জন কারাগার থেকে রিয়াদের ইয়ামামা প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ছোট্ট একটি ইউনিটে তাঁকে থাকতে দেওয়া এবং তাঁর ওপর সার্বক্ষণিকভাবে ক্যামেরার সাহায্যে নজরদারি করা হয়। পরিবারের কয়েকজন সদস্য বাদে তাঁর সঙ্গে আর কাউকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং আইনজীবীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয় না।

এরপর ২০২১ সালের বসন্তে ইউরোপে নায়েফের ব্যাংকার ও আইনজীবীরা সম্পদ স্থানান্তরের নতুন আরেকটি অনুরোধ পান। একটি সূত্র জানিয়েছে, যে আইনজীবীকে নায়েফ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়েছিলেন তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মক্কেল চাপের মধ্যে ছিলেন। পরে বিন নায়েফ তাঁর আইনজীবীকে সৌদি আরব সফর করে নিজ চোখে পরিস্থিতি যাচাই করার আমন্ত্রণ জানান। নায়েফ তাঁকে লেখেন, ‘আমি মুক্ত, আপনি রিয়াদে এলে আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাব।’ তবে সেই আইনজীবী তাতে না টলে জোর দিয়ে বলেন, স্থানান্তর অনুমোদনের জন্য বিন নায়েফ এবং তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যান্ডে যেতে হবে। ফলে ইউরোপ থেকে বিন নায়েফের সম্পদ আর সৌদিতে স্থানান্তর করা হয়নি।

সৌদি রাজপ্রাসাদ আল-ইয়ামামা৬.
ক্ষমতা সংহত করার পর মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে ব্যাপক সংস্থার কাজ চালান। বিশেষ করে সামাজিক সংস্কারে উদ্যোগী হন। এমবিএস নারীদের গাড়ি চালানো, সিনেমা হল পরিচালনার ওপর থেকে কয়েক দশক পুরোনো নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিলেন। সংগীত কনসার্টের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।

এক সময় বৈশ্বিক গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়েছিল এমবিএস কর্তৃক বিন নায়েফ ও অন্যান্যদের বন্দী করার কারণ ছিল—তাঁরা এমবিএস ও তাঁর বাবা বাদশাহ সালমানকে অপসারণের ষড়যন্ত্র করছে। বিষয়টি সেরকম নয়। মূল কারণ ছিল, প্রাসাদে এমবিএসের নিজের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে সৌদি রাজ পরিবার এবং প্রশাসনে এমবিএসের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও বিন নায়েফ এবং অন্যান্যরা মুক্তি পাননি। বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন বিন নায়েফকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানালেও মোহাম্মদ বিন সালমান এই বিষয়ে ছিলেন অটল।

সৌদি সিংহাসন দখলের ক্ষেত্রে এমবিএসের এখন আর কোনো দৃশ্যমান প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বাদশাহ হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হতে তাঁকে বাধা দেবে এমন কেউ নেই। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন কিছুই তাঁকে নিজ লক্ষ্য হাসিলের পথ থেকে টলাতে পারেনি। স্বৈরশাসকের সঙ্গে ব্যবসা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরব এবং অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী। ফলে এমবিএসের সঙ্গে ব্যবসায় আগ্রহী রাষ্ট্রের অভাব নেই। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই তালিকায় রয়েছে।

যাই হোক, মোহাম্মদ বিন সালমান ইয়ামামা প্রাসাদ এবং সৌদি আরবসহ বিশ্বে নিজের অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যা তাঁকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। তাই কোনো দিন যদি বিন নায়েফ জনসমক্ষে হাজির হয়ে মোহাম্মদ বিন সালমানকে আশীর্বাদ দেন তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সেটা হবে ২০১৭ সালে বিন নায়েফকে বন্দীর পর যে ভিডিও বার্তা জোর করে রেকর্ড করে টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়েছিল—তার মতোই। এবং তা হয়ে থাকবে এমবিএসের সহিংস উত্থানের এক অনন্য নজির।

 

(দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত অঞ্জু চোপড়ার নিবন্ধ থেকে অনূদিত)

 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত