Ajker Patrika

চীন-পাকিস্তানে ঝুঁকছে আফগানিস্তান, চাপে পড়ছে ভারত

আব্দুর রহমান
আপডেট : ২৬ মে ২০২৫, ১৮: ০৭
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আফগানিস্তানের তালেবান সরকার গত ২১ মে বেইজিংকে আশ্বাস দিয়েছে, তারা ‘কোনো শক্তিকে’ চীনের বিরুদ্ধে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না। আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী বেইজিংয়ে শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াং ই-এর সাক্ষাৎকালে বলেন, আফগানিস্তান চীনের নিরাপত্তা উদ্বেগকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় এবং চীনের ক্ষতি করে এমন কর্মকাণ্ড চালাতে কোনো শক্তিকে আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে না।

ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার গত ২২ এপ্রিলের প্রতিবেদন এটি।

এর কয়েক দিন আগেই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সেই আলাপ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও জয়শঙ্কর আগ বাড়িয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—তালেবান সরকার কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তানের ভূমিকার নিন্দা করেছে। কিন্তু ভারতের সেই বাগাড়ম্বরের মুখে ছাই দিয়েছে তালেবান সরকার। এর পরপরই আমির খান মুত্তাকী বেইজিংয়ে চীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।

সম্প্রতি বেইজিংয়ে চীনের মধ্যস্থতায় আয়োজিত এক বৈঠকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এর ফলে দুই দেশ উভয় দেশে রাষ্ট্রদূত পাঠাবে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আফগানিস্তান ও পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সুস্পষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীন এটিকে স্বাগত জানায় এবং বেইজিং আফগানিস্তান-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়তা করে যাবে।’

এ ছাড়া পাকিস্তান ও চীন জানিয়েছে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) আফগানিস্তানে সম্প্রসারণের বিষয়েও একটি চুক্তি হয়েছে। এ বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর আফগানিস্তানে সম্প্রসারণের বিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে।’ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বলেছে, ‘চীন ও পাকিস্তান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) সহযোগিতার বৃহত্তর কাঠামোর অধীনে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) আফগানিস্তানে সম্প্রসারণের জন্য তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।’

চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক চমৎকার হলেও ইসলামাবাদ ও কাবুলের সম্পর্ক খানিকটা শীতল। চীনের মধ্যস্থতায় এই দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাবুল-ইসলামাবাদ সম্পর্কোন্নয়নে সময় লাগবে, বিষয়টি এত দ্রুত স্বাভাবিক হবে না। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাকিস্তানি কূটনীতিক বলেন, ‘স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া দ্রুত হবে না, তবে ইসলামাবাদ ও কাবুল এই (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) স্তরে আবার কথা বলছে এবং রাষ্ট্রদূতদের বিষয়ে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।’

বেইজিং তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানে দূতাবাস বজায় রেখেছে দীর্ঘদিন ধরে এবং গত বছর বেইজিংয়ে নিযুক্ত তালেবানের রাষ্ট্রদূতকেও স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের স্বীকৃতি না দিলেও চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ কাবুলে রাষ্ট্রদূত বজায় রেখেছে। চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজ দেশেও তালেবানের রাষ্ট্রদূতদের স্বীকৃতি দিয়েছে। গত মাসে রাশিয়াও মস্কোতে তালেবান রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেইজিংয়ের বৈঠক পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের বরফ গলাতে সাহায্য করেছে। এই সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে গভীর অবিশ্বাস, আন্তসীমান্ত হামলা এবং আফগান ভূখণ্ডে নিষিদ্ধ তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) জঙ্গিদের কার্যকলাপ নিয়ে তীব্র মতবিরোধে জর্জরিত ছিল। ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে কাবুলের বিরুদ্ধে টিটিপি যোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে, যাদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ৭০ শতাংশ হামলা বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে।

সাম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা মূলত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে। ২০২৫ সালের মার্চে আফগানিস্তানের জন্য মনোনীত পাকিস্তানের বিশেষ দূত মোহাম্মদ সাদিক এক বছরের বেশি সময় পর কাবুল সফর করেন। তাঁর এই মিশনের পর ১৯ এপ্রিল উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের উচ্চপর্যায়ের সফর হয়। যেখানে উভয় পক্ষ তাদের ভূখণ্ডকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বাণিজ্য সহজীকরণের পদক্ষেপে সম্মত হয়।

বেইজিংয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক এই গতিকে আরও বাড়িয়েছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সংহতিতে চীনের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে এবং তারা চীন-আফগানিস্তান-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় সংলাপ পুনরায় শুরু করতে এই বৈঠকের আয়োজন করেছে, যা ২০২৩ সাল থেকে স্থগিত ছিল।

বেইজিং বৈঠকের মূল অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে—একে অপরের রাজধানীতে রাষ্ট্রদূত রাখার চুক্তি, নিরাপত্তা ও সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতা বৃদ্ধি, যার মধ্যে জঙ্গিগোষ্ঠী ও বাইরের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যৌথ পদক্ষেপ, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) আফগানিস্তানে সম্প্রসারণের জন্য সমর্থন এবং কাবুলে ষষ্ঠ চীন-আফগানিস্তান-পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সংলাপ আয়োজনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিপক্ষীয় প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার সমঝোতা।

বৈঠকের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আফগানিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, সহযোগিতামূলক সম্পর্ক, বিশেষ করে বাণিজ্য, ট্রানজিট, স্বাস্থ্য ও সংযোগের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।’ চীনও জোর দিয়ে বলেছে, সব পক্ষকে অবশ্যই ‘তাদের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও জাতীয় মর্যাদা রক্ষা করতে হবে’ এবং আঞ্চলিক অংশীদারদের ‘নিজেদের উপযোগী’ উন্নয়ন পথ অনুসরণ করার জন্য তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।

এই অগ্রগতির মাধ্যমে পাকিস্তান ও চীন মনে করছে, গভীর যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনা কাবুলকে কাছাকাছি আনতে পারে এবং এই অঞ্চলে অস্থিরতা কমাতে পারে। ভারতও ঠিকই একই কৌশল নিয়েছিল। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, ভারত আফগানিস্তানকে খুব একটা অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে রাজি নয়। অথচ, তালেবান শাসনাধীন আফগানিস্তানের এটিই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার।

গত ১৫ মে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে জয়শঙ্কর বলেন, মুত্তাকীর সঙ্গে ‘ভালো আলোচনা’ হয়েছে বলে জানান। তিনি লেখেন, উভয় পক্ষ ‘সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার উপায় ও মাধ্যম’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তালেবান সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলোচনায় ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার, বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির’ ওপর জোর দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনায় তালেবান সরকার পাকিস্তানের নিন্দা জানিয়েছে—এমন দাবিও করেছেন জয়শঙ্কর।

পাকিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত করে জয়শঙ্কর আরও উল্লেখ করেন, নয়াদিল্লি ‘ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের মাধ্যমে অবিশ্বাস তৈরির সাম্প্রতিক প্রচেষ্টার প্রতি (মুত্তাকীর) দৃঢ় প্রত্যাখ্যানকে স্বাগত জানিয়েছে’।

কিন্তু তালেবানের বিবৃতিতে গত ২২ এপ্রিলের পেহেলগাম হামলা বা ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের কোনো উল্লেখ ছিল না।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জয়শঙ্করের সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর একই দিনে কাবুলে আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকী চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পঞ্চম পর্বের আয়োজন করেন। এই বৈঠকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও সন্ত্রাস দমনে নিবিড় সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়। এর কয়েক দিন পরই বেইজিংয়ে মুত্তাকী, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়।

ইসলামাবাদভিত্তিক পাকিস্তান-চায়না ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা হায়দার সাইয়্যেদ বেইজিং বৈঠককে ‘খুবই তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেছেন। আফগানিস্তানের
ভূরাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে এটি গুরুত্বপূর্ণ। সাইয়্যেদ বলেন, পাকিস্তান ও চীনের জন্য ভারতের সঙ্গে সংঘাত আফগানিস্তানের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করেছে।

কাবুলভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তামিম বাহিসও এতে একমত। তিনি বলেন, ‘মুত্তাকী ও জয়শঙ্করের মধ্যে এই ফোনালাপ ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কে একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি ইসলামাবাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে, কারণ আঞ্চলিক পরিস্থিতি এমনিতেই অস্থির। এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সময় এবং এর বিষয়বস্তু উভয়ই দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক গতিমুখ বদলে যাওয়ায় এই তিন দেশের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।’

আফগানিস্তান পাকিস্তান ও চীনের নিরাপত্তা এবং কৌশলগত অবস্থানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে পাকিস্তানে ৫২১টি হামলা হয়েছে। এই সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি। এসব হামলায় প্রায় ১ হাজার বেসামরিক ও নিরাপত্তা কর্মী নিহত হয়েছেন। আর পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ, এসব হামলার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে ইসলামাবাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ স্পষ্ট।

কাবুলের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে পাকিস্তানই উদ্যোগী। পেহেলগাম হামলার ঠিক তিন দিন আগে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার কাবুল সফর করেন। এই সফরের গুরুত্বের বিষয়ে ইসলামাবাদভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইহসানুল্লাহ টিপু বলেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন কূটনৈতিক যোগাযোগে কয়েকটি বিষয় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে—ব্যবসা, সীমান্ত বিরোধ ও সীমান্ত বন্ধের চেয়ে নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চীনও একই মনোভাব পোষণ করে বলে জানান তিনি।

টিপু আল জাজিরাকে বলেন, ‘অর্থবহ বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলো প্রথমে সমাধান করতে হবে।’ তবে তিনি সতর্ক করে দেন, তা না হলে উত্তেজনা সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিতে পারে। টিপু আরও বলেন, ‘তবে চীনের বৈশ্বিক প্রভাব এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয়ের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় বেইজিং যেকোনো অঙ্গীকারের নিশ্চয়তা দানকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’

তবে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের যে নিরাপত্তা উদ্বেগ, তা কেবল একপক্ষীয় নয়। কারণ, পাকিস্তান আফগান তালেবানের বিরুদ্ধে নিজ দেশে হামলাকারী জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ অব্যাহত রেখেছে। এসব হামলার অধিকাংশই পাকিস্তানে সিপেক প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে হয়েছে। ফলে বিষয়টি চীনা প্রকল্পেরও নিরাপত্তা ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পাকিস্তান সরকারের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় ২০ হাজার চীনা নাগরিক বাস করেন। ২০২১ সাল থেকে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানের মতো প্রদেশগুলোতে হামলায় অন্তত ২০ চীনা নিহত হয়েছেন। টিটিপিসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী এসব হামলার দায় স্বীকার করেছে।

চীনও আফগানিস্তানভিত্তিক ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিম) নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের অভিযোগ, এই গোষ্ঠীর জঙ্গিরা আফগান ভূমি ব্যবহার করে চীনের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। পিসিআই-এর সাইয়্যেদ জোর দিয়ে বলেছেন, পাকিস্তান ও চীন উভয়ই আফগানিস্তানে নিরাপত্তাকে তাদের ‘মূল স্বার্থ’ হিসেবে দেখে।

তিনি বলেন, ‘এটি একটি যৌথ হুমকি এবং অতীতে ইটিএমের আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। এই জঙ্গি নেটওয়ার্কগুলো একে অপরের সঙ্গেও যুক্ত। তাই যেকোনো সহযোগিতা এগিয়ে নিতে হলে, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে প্রথমে নিষ্ক্রিয় করা জরুরি, যাদের আফগানিস্তানে অবাধে ও আরামে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে।’

তবে বাহিস উল্লেখ করেছেন, তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর চীনসহ বেশির ভাগ আঞ্চলিক শক্তি আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে গ্রহণযোগ্য মনে করেছে, যা চলমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সম্ভব করেছে। তিনি বলেন, ‘মূল ব্যতিক্রম হলো পাকিস্তান, যারা আফগান ভূমি থেকে গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। পাকিস্তান টিটিপিকে নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণে রাখাকে অগ্রাধিকার দিলেও কাবুল বাণিজ্য, ট্রানজিট ও আঞ্চলিক সংহতির দিকে মনোনিবেশ করছে।’

কাবুলভিত্তিক এই বিশ্লেষক বলেন, ‘এখানেই চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নিরাপত্তা সহযোগিতা উৎসাহিত করার পাশাপাশি বাণিজ্য ও ট্রানজিট উদ্যোগের অগ্রগতি ঘটিয়ে চীন মধ্যস্থতা করার ক্ষেত্রে অনন্য অবস্থানে রয়েছে, এতে তিনটি দেশই উপকৃত হবে।’

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নয়াদিল্লি ও কাবুলের কর্মকর্তাদের মধ্যকার বর্ধিত যোগাযোগ কী ইসলামাবাদে উদ্বেগ তৈরি করছে? সাইয়্যেদ অবশ্য তা মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান কাবুলকে অবিশ্বাস করে না। তবে পাকিস্তান পদক্ষেপের কথা বলেছে। কাবুলের শাসকদের টিটিপি এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিষয়ে দেওয়া কথা রাখতে হবে। আমি মনে করি না যে, বেইজিং বা ইসলামাবাদ কেউই ভারতের সঙ্গে কাবুলের ইতিবাচক সম্পর্কের বিরোধিতা করবে, যতক্ষণ না তা পাকিস্তান ও চীনের স্বার্থে আঘাত হানে।’

তবে বাহিস বলছেন, তালেবানের সঙ্গে নয়াদিল্লির এই পুনঃসম্পর্ক স্থাপন পাকিস্তান ও চীনের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। উভয় দেশের সঙ্গেই ভারতের ঐতিহাসিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভারত-আফগানিস্তান যোগাযোগ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও এক সময় ইসলামাবাদের উদ্বেগ বাড়াতে পারে।’

বাহিস আরও বলেন, ‘আফগানিস্তানের যেকোনো দেশের সঙ্গে, এমনকি ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। তবে তাদের সতর্ক থাকতে হবে। স্পষ্ট বার্তা দেওয়া জরুরি, যাতে নয়াদিল্লির সঙ্গে তাদের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ককে অন্য আঞ্চলিক শক্তিগুলো হুমকি হিসেবে মনে করার মতো ঝুঁকি তৈরি না হয়। এই জটিল সম্পর্কগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করতে কূটনীতি, স্বচ্ছতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার প্রয়োজন।’

ভারতের আফগানিস্তান নীতি কাবুলের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলি এবং বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সংগতি রেখে বিকশিত হয়েছে। তবে পেহেলগামের পর আঞ্চলিক বাস্তবতার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নয়াদিল্লি এই অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারণের কথা ভাবছে। ভারতের তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হলো, আফগানিস্তানে তাদের অসমাপ্ত উন্নয়ন উদ্যোগগুলো সম্পন্ন করা, যা তালেবানের দীর্ঘদিনের দাবি।

তবে ভারতের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তালেবান তাদের বহুমুখী কূটনীতি অব্যাহত রাখবে বলে মনে করেন দিল্লিভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক রুশালি সাহা। তিনি বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময়ও এই প্রচেষ্টা পুরোপুরি দৃশ্যমান ছিল। ভারত, পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তালেবান সরকার দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক রাখার ইঙ্গিত তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দিয়েছে।’

রুশালি সাহা বলেন, ‘মুত্তাকী জয়শঙ্করের সঙ্গে কথোপকথনের সময় ভারতকে অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে বর্ণনা করলেও, তিনি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে সব পক্ষের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তালেবানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।’ তবে তালেবান সরকার আদৌ ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে কি না, সেটাই প্রশ্নের বিষয়। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে তুলনামূলক শান্তির সময়ে এই ভারসাম্য খুব একটা কঠিন হবে না। তবে উত্তেজনা ও সংঘাতের সময় ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে।

তথ্যসূত্র: দ্য ডন, আল জাজিরা, দ্য ডিপ্লোম্যাট ও হিন্দুস্তান টাইমস

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চট্টগ্রামে নারীকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া ‘শিবিরের লোক’ আকাশ চৌধুরীকে ধরছে না পুলিশ

প্রফেসর আনোয়ারা আ.লীগের লোক হলে এত অপমান নিয়ে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হত না: ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময়

আলিপুরদুয়ার থেকে মোদির ‘মিশন বেঙ্গল’, নজর বাংলাদেশে

বৈষম্যবিরোধীদের মিছিল থেকে জি এম কাদেরের বাড়ি ভাঙচুর, মোটরসাইকেলে আগুন

পরিচালক পদ বাতিল, বিসিবি সভাপতির পদ থেকে ফারুককে অপসারণ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত