Ajker Patrika

কাবুল পতনে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সাইগন পতনের স্মৃতি দেখছে যুক্তরাষ্ট্র

জাহাঙ্গীর আলম
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২১, ১৯: ৫৯
কাবুল পতনে ভিয়েতনাম যুদ্ধে সাইগন পতনের স্মৃতি দেখছে যুক্তরাষ্ট্র

সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের আগেই আফগানিস্তানের মাটি থেকে নিজেদের নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে হিমশিম খেতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি রোববার সকালের দিকে রাজধানী কাবুলের পতনের পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত কী হতে পারে, তা নির্ধারণ করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসনের। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের কথাবার্তা ও শরীরী ভাষায় এই বিহ্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার ভাব খুব স্পষ্ট। 

বাইডেন ও তাঁর প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ধারণাই করতে পারেননি যে, তালেবান এত দ্রুত খোদ রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলবে। যেখানে তাঁরা ভেবেছিলেন, তালেবান যদি আফগানিস্তানের আশরাফ গনি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেও, তবে অন্তত কয়েক মাস তো লেগে যাবেই। আর এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিন্তে সৈন্য সরিয়ে নেবে এবং পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য তাঁরা যথেষ্ট সময় পাবেন। 

কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি! বাইডেন তাঁর প্রাথমিক ঘোষণায় বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরের (গ্রীষ্মের শেষে) মধ্যেই আফগানিস্তানে অবস্থানরত ২ হাজার ৫০০ সেনার সবাইকে ফেরানো হবে। অথচ ঘোষণার এক মাসের মধ্যে এখন মার্কিন নাগরিকদের আফগানিস্তান থেকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে উল্টো তাঁকে পাঠাতে হলো ৬ হাজার সেনা!

বাইডেন প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা অবশ্য সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন—তাঁদের হিসাব–নিকাশে ভুল ছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘ঘটনা হলো, আমরা দেখতে পাচ্ছি, (আফগান) নিরাপত্তা বাহিনী তাদের দেশকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এটা আমাদের ধারণার চেয়েও দ্রুত ঘটেছে।’ 

প্রেসিডেন্ট বাইডেন এখন ক্যাম্প ডেভিডে গ্রীষ্মকালীন অবকাশে আছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে জাতির উদ্দেশে তিনি ভাষণ দিতে পারেন। তবে অবকাশ সংক্ষিপ্ত করে এখনই হোয়াইট হাউসে তাঁর ফেরার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে কোনো সূত্র নিশ্চিত করছে না। অবশ্য ক্যাম্প ডেভিড থেকেই ঘটনার প্রতি নজর রাখছেন, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। রোববারও তাঁকে জাতীয় নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা গেছে। বিশালাকৃতির একটি মনিটরের সামনে পোলো শার্ট পরিহিত বাইডেনকে একা বসে থাকার একটি ছবি প্রকাশ পেয়েছে। এতে এমন ধারণা করা যাচ্ছে। 

এদিকে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের রাজনৈতিক ঝুঁকি এখনো অস্পষ্ট। অতি সাম্প্রতিক একটি মতামত জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ মার্কিন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন। দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধের যে ক্লান্তি মার্কিন প্রশাসন ও জনগণকে আচ্ছন্ন করেছে, সেটিই মূলত আমলে নিয়েছেন বাইডেনের কর্মকর্তারা। তাঁরা যত দ্রুত সম্ভব সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন। 

কিন্তু যুদ্ধ সমাপ্তির পরপরই আফগানিস্তানের যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং পুরো পরিস্থিতি যেভাবে আন্তর্জাতিক মহল ও স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তা বাইডেনের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। তাঁর হয়তো এই মুহূর্তে ১৯৭৫ সালের সাইগন পতনের দুঃসহ স্মৃতি আবার জেগে উঠছে। 

দক্ষিণ ভিয়েতনামের তৎকালীন রাজধানী সাইগনের পতন ঘটে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল। উত্তর ভিয়েতনামের পিপলস আর্মি অব ভিয়েতনাম এবং ভিয়েত কং এই শহরের নিয়ন্ত্রণ দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর মাধ্যমেই মূলত ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং দুই ভিয়েতনাম একীভূত হয়ে সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব ভিয়েতনামের অন্তর্ভুক্তির সূচনা হয়। সাইগন এখন হো চি মিন সিটি। 

 ১৯৭৫ সালের ২৯ এপ্রিল জেনারেল ভান তিয়েন দাংয়ের নেতৃত্বে পিপলস আর্মি অব ভিয়েতনাম সাইগনে চূড়ান্ত আক্রমণ চালায়। একনাগাড়ে ভারী গোলার বর্ষণ চলতে থাকে। পরের দিন বিকেলের মধ্যে তারা শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পতাকা উত্তোলন করে পিপলস আর্মি অব ভিয়েতনাম। উত্তর ভিয়েতনামের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হো চি মিনের নামে শহরের নামকরণ করা হয় হো চি মিন সিটি। 

তালেবানের রাজধানী কাবুল দখলের দৃশ্যটি অনেকখানি এই দৃশ্যের সঙ্গে মিলে যায়। গতকাল যেভাবে তালেবান যোদ্ধারা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে ফোটসেশন করেছেন এবং স্ট্যান্ডে রাখা পতাকা গুটিয়ে ফেলেছেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিয়েতনাম স্মৃতি দগদগে হয়ে ওঠারই কথা। 

 কাবুল থেকে মার্কিন নাগরিক ও সহযোগীদের উদ্ধারের দৃশ্য।

এদিকে এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন কংগ্রেস সদস্য আফগানিস্তানের পরিস্থিতি ও যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কৌশল সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানানোর দাবি তুলেছেন। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য প্রশাসনকে কীভাবে ভুল পথে পরিচালিত করল, সেটি তাঁরা জানতে চান। সেই সঙ্গে তাঁরা এও জানতে চান, আমেরিকান ও মিত্রদের নিরাপদে সরিয়ে আনার বিষয়ে কেন আরও বিচক্ষণতার সঙ্গে আগাম পরিকল্পনা করা গেল না। 

গত রোববার আইনপ্রণেতাদের সামনে ঘটনা সম্পর্কে ব্রিফ করতে গিয়ে কঠিন কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হন মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার, মার্কিন নাগরিক, আফগান অনুবাদক ও সহযোগীদের সরিয়ে আনার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের পরিকল্পনা কী ছিল, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চান আইনপ্রণেতারা। 

এর মধ্যে হাউস মাইনরিটি লিডার কেভিন ম্যাককারথি প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলিসহ অন্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান, পুরো প্রক্রিয়াটা কেন এত দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে? যুক্তরাষ্ট্রের এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি শুধু আফগানিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; আগামী কয়েক দশক এ নিয়ে ভুগতে হবে বলেও সতর্ক করে দেন তিনি। 

চলতি সপ্তাহের শেষ নাগাদ ক্যাম্প ডেভিড থেকে বাইডেনের ফেরার কথা আছে। ১০ আগস্ট থেকে আফগানিস্তান বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলেননি প্রেসিডেন্ট। শীর্ষ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও ছুটিতে আছেন। তবে রোববার থেকেই কর্মে ফিরতে শুরু করেছেন। 

অবশ্য তালেবানের শক্তিমত্তা ও প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকার যে তাদের সামনে টিকতে পারবে না, এটি ধারণাতীত কোনো ঘটনা নয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গত বছরই জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তালেবানের আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের একাধিক সময়/তারিখ উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন—এটি অনিবার্য। প্রেসিডেন্ট বাইডেন গত কয়েক মাস ধরে এ ব্যাপারে বলে আসছেন। এমনকি সম্প্রতি ওভাল অফিসে আশরাফ গনির সঙ্গে বৈঠকেও তিনি আফগান প্রেসিডেন্টকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির দিকে নজর দিতে বলেছিলেন। ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলে নিজেদের মধ্যকার অনৈক্যের অবসান ঘটাতে হবে বলে সতর্ক করে দেন তিনি। 

গতকাল রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনও বলেছেন, ‘আমরা সবকিছু জানতাম। প্রেসিডেন্টকে এসব বিষয় বলা হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে যে,২০০১ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সবচেয়ে শক্তিশালী তালেবান এখন আমাদের সামনে। এই তালেবানকেই আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। সে কারণেই আমরা দেখছি, তালেবান এখন দেশের নিয়ন্ত্রণ দখলের ক্ষেত্রে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সক্ষম গোষ্ঠী।’ 

এরপরও আফগান নিরাপত্তা বাহিনী যে এত দ্রুত বশ্যতা স্বীকার করে নেবে, তা বাইডেন প্রশাসন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে গনি প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুরতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি ও আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র ভুল মূল্যায়ন করেছিল—এতে কোনো সন্দেহ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চকরিয়া থানার ওসিকে প্রত্যাহারের নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার

হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আগেই বের হয়ে যেতে বলা হয় জেলেনস্কিকে

‘আমাদের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করলে থানা ঘেরাও করব’, সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য ভাইরাল

সৈয়দ জামিলের অভিযোগের জবাবে যা লিখলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা

এনসিপির কর্মীদের ঢাকায় আনতে সরকারের বাস রিকুইজিশন, সমালোচনার ঝড়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত