Ajker Patrika

এ কেমন মুক্তির স্বাদ

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
যুদ্ধবিরতির পর অবস্থা কিছুটা বদলালেও কেউ জানে না, মৃত্যুর ছায়া তাদের পিছু ছাড়বে কি না। ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধবিরতির পর অবস্থা কিছুটা বদলালেও কেউ জানে না, মৃত্যুর ছায়া তাদের পিছু ছাড়বে কি না। ছবি: সংগৃহীত

বাড়িঘর ফেলে স্বজনদের সঙ্গে জীবন বাঁচাতে মানুষ ছুটছে আশ্রয়শিবিরে কিংবা নিরাপদ কোনো জায়গায়। এমনও হয়েছে, মসজিদে নামাজ আদায় করতে গিয়ে আর ফেরেনি বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলেটি। খাবারের খোঁজে বাইরে বের হওয়া বাবা ফেরেননি সন্তানের কাছে। কয়েক দিন আগে এমনই ছিল ফিলিস্তিন নামের দেশটির গাজার অবস্থা। যুদ্ধবিরতির পর অবস্থা কিছুটা বদলেছে বলা চলে। কিন্তু কেউ জানে না, মৃত্যুর ছায়া তাদের পিছু ছাড়বে কি না।

শিশুর জন্মে নিরানন্দ জনপদ

গাজায় শিশুর জন্ম হলে অনাবিল আনন্দ বয়ে যায় না পরিবারগুলোয়; বরং নতুন প্রাণের সঞ্চারে সেখানে বাজে হতাশা আর হারানোর সুর। তারা নবজাতককে নোংরা পানিতে তৈরি ইনফ্যান্ট ফর্মুলা খাওয়াতে বাধ্য হচ্ছে। সেই খাবার ডিহাইড্রেশন, হেপাটাইটিস এ এবং ত্বকের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধের কারণে সেখানের গর্ভাবস্থা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সব বয়সী নারীর স্বাস্থ্যের অবস্থা গুরুতর। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, গাজায় গত ১৫ মাসের বোমাবর্ষণ এবং অবরোধের মধ্যে গর্ভবতী, পরবর্তী সময়ে মা এবং সব বয়সী মেয়ের স্বাস্থ্যের ওপর ‘গুরুতর এবং কখনো কখনো জীবন সংকটাপন্ন বিপদ’ সৃষ্টি করেছে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ

গত মাসের শেষ মঙ্গলবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘একটি ইনকিউবেটরে পাঁচটি শিশুর মতো গাজায় ইসরায়েলের হামলার মধ্যে গর্ভবতী নারীদের অধিকার লঙ্ঘন’ শীর্ষক ৫০ পাতার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে গাজায় চিকিৎসাকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর আক্রমণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় ‘গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং পরবর্তী সময়ে’ নারী ও মেয়েদের ওপর সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এই প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইসরায়েলের ওপর যে অভিযোগগুলো এনেছে, সেগুলো হলো—

  • অবৈধ অবরোধ আরোপ
  • পানি, খাবার ও বিদ্যুৎ-সংযোগে প্রায় সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা
  • যুদ্ধের পদ্ধতি হিসেবে বেসামরিক মানুষকে ক্ষুধার্ত করা
  • চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর আক্রমণ
  • পুনর্বাসন অনিশ্চিত করতে বাধ্য করা।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাবি করেছে, এসব বিষয় গর্ভবতী নারী ও মেয়েদের এবং তাঁদের সন্তানদের জন্য প্রাথমিক ও পরবর্তী চিকিৎসার অধিকার লঙ্ঘন করেছে।

চাপান-উতোর খেলা

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পুনরায় গাজায় গণহত্যার অভিযোগ করেছে। স্বাভাবিকভাবে এই অভিযোগ ইসরায়েল দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে। এসব ঘটনায় ইসরায়েল আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে দায় দিয়েছে হামাসকে। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আবার অভিযোগ করেছে, হামাস হাসপাতালগুলোকে তার সামরিক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহার করছে।

গর্ভপাতের হার ৩০০ শতাংশ

ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশন গত জুলাই মাসে জানায়, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় গর্ভপাতের হার ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। দুজন নারী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানান, একই বিস্ফোরণের ঘটনায় তাঁদের দুজনের স্বামীরা ও গর্ভের সন্তান মারা গেছে এবং তাঁরা আহত হয়েছেন। গর্ভবতী ও বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েরা সেখানে অস্থায়ী ও ভিড়ে ঠাসা জায়গায় শৌচাগার শেয়ার করছেন। এর ফলে বিশেষভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। এর ফলে প্রি-টার্ম লেবার, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং মৃত সন্তান প্রসবের আশঙ্কা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে নারীরা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে অস্বস্তি কিংবা লজ্জা পান। এই গোপনীয়তার অভাব মানসিক চাপ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে।

গত ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের প্রজনন অধিকার সংস্থা জানিয়েছিল, ৪৮ হাজারের বেশি গর্ভবতী জরুরি বা বিপজ্জনক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছেন।

গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। এর শর্ত অনুযায়ী প্রথম ধাপে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে কয়েক ধাপে। কাতার জানিয়েছে, প্রথম ধাপে মুক্তি পাওয়া জিম্মিদের মধ্যে ছিল বেসামরিক নারী, নারী সেনা, শিশু, বয়স্ক, অসুস্থ ও আহত বেসামরিক নাগরিক।

একজন ইনশিরাহর গল্প

ইনশিরাহ দারাবেহ। গাজার অধিবাসী। যুদ্ধের সময় মেয়ে মারা গেলে তিনি শহরতলিতে শ্বশুরবাড়ি চলে যান। যুদ্ধবিরতির সপ্তম দিনে ইনশিরাহ সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার পথ

হেঁটে গাজা শহরে নিজ বাড়িতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সংবাদমাধ্যমকে ইনশিরাহ জানান, যেভাবেই হোক, তিনি তাঁর মেয়ে মারামের মৃতদেহ খুঁজে বের করবেন এবং তাকে সম্মানজনকভাবে দাফন করবেন। ইনশিরাহ বলেন, ‘আমি আমার বাড়ি ফিরে যেতে চাই না। আমি শুধু তাকে খুঁজে বের করতে চাই এবং তার নাম একটি সমাধিফলকে লিখে দাফন করতে চাই।’

ইনশিরাহর মতো এমন অনেক নারী আছেন, যাঁরা স্বজনের লাশও দেখতে পারেননি। ইনশিরাহর গল্প তেমন হাজারো নারীর গল্পের মতো, যাঁরা সন্তান, স্বামী, বাবা ও ভাই হারানোর বেদনায় নীল হয়ে আছেন। যারা বেঁচে গেছে, তাদের দেখাশোনার ভার তাঁদের ওপর এসে পড়েছে। এ ভার বহন করা মুক্তির স্বাদ আসলে কেমন?

সূত্র: সিএনএন, আল জাজিরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত