Ajker Patrika

স্মৃতির আয়নায় মাহফুজা খানম

সাহিদা পারভীন শিখা
মাহফুজা খানম। ছবি: সংগৃহীত
মাহফুজা খানম। ছবি: সংগৃহীত

১২ আগস্ট মঙ্গলবার, সকালেই এক গভীর শূন্যতা নেমে এল চারপাশে। অধ্যাপক মাহফুজা খানম আর নেই! বুকের ভেতর যেন এক অপার শূন্যতার ঢেউ আছড়ে পড়ল। মানুষ চলে গেলে পৃথিবী তো থেমে যায় না, আকাশের রংও বদলায় না, রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় থাকে। কিন্তু আমাদের ভেতরের পৃথিবী থেমে যায়। আমার কাছে তিনি শুধু একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা বা সংগঠক নন; তিনি ছিলেন পরম স্নেহশীল অভিভাবকের মতো। তাঁর স্নেহ, মমতা ও সাহচর্য আমার জীবনের এক গভীর প্রাপ্তি।

১৯৪৬ সালের ১৪ এপ্রিল কলকাতায় জন্মেছিলেন মাহফুজা খানম। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক হন। পরের বছর একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এই সাফল্যের পথ মোটেও সহজ ছিল না। তিনি ছিলেন সেই সময়ের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একজন, যিনি সমাজের প্রচলিত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। ছাত্রজীবনেই নেতৃত্বের আসনে আসীন হন তিনি। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়ন পেয়ে ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হন তিনি। এটি শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, নারীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইতিহাসেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

মাহফুজা খানমের জীবন শুধু শিক্ষাঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিল না; ১৯৬৮ সালে লন্ডনের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পড়াশোনার সুযোগ পেলেও তৎকালীন রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও শাসকগোষ্ঠীর অবিচারের কারণে সেই সুযোগ হারাতে হয়। সে সময়ের সরকার তাঁকে পাসপোর্ট দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেই অপূর্ণতা তিনি পূর্ণ করেছেন সুবিধাবঞ্চিত মানুষের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করার আজীবন চেষ্টার মধ্য দিয়ে।

শিক্ষকতা ছিল তাঁর ভালোবাসা, দায়িত্ব ও নৈতিক অঙ্গীকার। দীর্ঘদিন বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি অসংখ্য শিক্ষার্থীর জীবন গড়ে দিয়েছেন। আর্থিক কষ্টে থাকা মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো, নারীশিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ নেওয়া, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কল্যাণ তহবিল গঠন—এগুলো তাঁর ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে করা কাজ। প্রায় ১৭টি শিক্ষা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিরল।

শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। খেলাঘর আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন, বিশ্ব শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব—সব জায়গায় তাঁর উপস্থিতি ছিল অনবদ্য। তিনি ছিলেন কর্মে, চিন্তায় ও নৈতিকতায় সমান দৃঢ়।

মাহফুজা খানমের জীবনের আরেকটি বড় অধ্যায় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেননি, যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। এক নারী যোদ্ধার সাহস, দৃঢ়তা ও দেশপ্রেম; এটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গর্বের অংশ। এসব অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একুশে পদক ছাড়াও ২০১২ সালে ‘বেগম রোকেয়া পদক’, ২০১৩ সালে ‘অনন্যা শীর্ষ দশ’ সম্মাননা, ২০১৭ সালে ‘জয়া আলোকিত নারী’ পুরস্কার পেয়েছেন জাতির শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে। কিন্তু আমার কাছে তাঁর বড় পরিচয় একজন সহজ, স্নেহময় ও মানুষকে ভালোবাসতে জানা এক নারী হিসেবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রতি তাঁর যে স্নেহ ছিল, তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আমি তাঁর জীবনের সামান্য অংশে থেকেছি। সেটিই আমার অনন্ত প্রাপ্তি। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন এমনভাবে, যেন আমি তাঁর পরিবারের একজন। পরামর্শ দিতেন, উৎসাহ দিতেন, কখনো ভুল হলে নরমভাবে শাসন করতেন। তাঁর চোখের উজ্জ্বলতা আর হাসির আন্তরিকতা আজও মনে ভাসে।

মাহফুজা খানমের মতো মানুষের চলে যাওয়া শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, বরং একটি যুগের অবসান। এই সময়ে যখন সমাজে উদারতা, সহমর্মিতা ও সততা ক্রমে বিরল হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁর মতো মানুষেরা আমাদের নৈতিক দিশারি ছিলেন। তাঁর জীবন শেখায়, শিক্ষা শুধু ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা হলো মানুষের কল্যাণে কাজ করা, অন্যের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মানসিকতা।

আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর কাজ, তাঁর ভাবনা, তাঁর গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো, তাঁর স্পর্শে বদলে যাওয়া মানুষগুলো—সবকিছু মিলিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।

মাহফুজা খানমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল। তাঁর আত্মা শান্তিতে থাকুক। আর আমরা, যারা তাঁর ছায়ায় একটুখানি পথ হেঁটেছি, তাঁর স্মৃতি বুকে নিয়ে, তাঁর দেখানো পথে চলার চেষ্টা করব।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

অরকার আক্রমণে তরুণী প্রশিক্ষকের মৃত্যু, ভাইরাল ভিডিওটি সম্পর্কে যা জানা গেল

জি এম কাদেরের সাংগঠনিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা ও মামলা প্রত্যাহার

ভারতকে পাকিস্তানি সেনাপ্রধানের পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতেও প্রশ্ন তোলা যাবে না

জর্ডান-মিসরকে নিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে চান নেতানিয়াহু

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত