Ajker Patrika

বিধ্বস্ত ফিলিস্তিন: যে গল্পগুলো থেমে যাওয়ার নয়

কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা 
বিধ্বস্ত ফিলিস্তিন: যে গল্পগুলো থেমে যাওয়ার নয়

‘আমি একজন শরণার্থী। আমার পরদাদাও শরণার্থী ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের দখলদারত্বে ভিটেছাড়া হয়েছিলেন তিনি। গাজা উপত্যকার খান ইউনিসে এক শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমি সেখানেই জন্মেছি, কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা সেখানে আমাকে থাকতে দেয়নি। ২০০০ সালে আমাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় তারা। দুই বছর আমাদের মাথার ওপর কোনো ছাদ ছিল না। এক শরণার্থীশিবির থেকে আরেকটিতে ঘুরে বেড়িয়েছি।’ ৬ এপ্রিল আল জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দক্ষিণ গাজার বাসিন্দা রুওয়াইদা আমিরের জীবন ও অভিজ্ঞতার কথা ধরা পড়ে এভাবেই।

ফিলিস্তিনের কত প্রজন্ম শরণার্থীশিবিরে বেড়ে উঠে বুড়ো হয়েছে, তার হিসাব বাইরের দুনিয়ায় খুব কমই রাখা হয়েছে। ফিলিস্তিনের অধিবাসীরা সম্ভবত রুওয়াইদা আমিরের মতো উদ্বাস্তু। বিভিন্ন সময় তেমন নারীদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া। তাঁদের কয়েকজনের উদ্বাস্তু জীবনের গল্প রইল আমাদের পাঠকদের জন্য।

রুওয়াইদা আমির। ছবি: সংগৃহীত
রুওয়াইদা আমির। ছবি: সংগৃহীত

এক স্কুলশিক্ষকের লড়াই

নিজের লিংকড ইন অ্যাকাউন্ট থেকে ৯ মাস আগে একটি লেখার লিংক শেয়ার করে রুওয়াইদা আমির লিখেছিলেন, ‘আমি আমার শিক্ষার্থীদের খুব ভালোবাসি। আশা করি, অতিসত্বর একদিন আমি তাদের জড়িয়ে ধরতে পারব।’

১০ বছর ধরে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত রুওয়াইদা। শিক্ষকতার পাশাপাশি একজন সংবাদকর্মী হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও রুওয়াইদা আমির নিজের লেখাপড়া চালিয়ে আজ এই অবস্থানে পৌঁছেছেন।

স্বপ্ন দেখেছেন একটি স্বাধীন ও সুন্দর জীবনের। অথচ এখন এই ভয়ে কুঁকড়ে থাকেন যে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে মৃত্যুর পর তাঁকে শুধু ‘কালো অথবা নীল জামা পরা এক তরুণী’ বলে সম্বোধন করা হবে। এটা ভেবে তাঁর অবাক লাগে যে তিনি শুধু একটা সংখ্যা হিসেবে পরিচিত হবেন। রুওয়াইদা বলেন, ‘আমি সেই মেয়ে, যে কঠিন পরিস্থিতিতেও পড়াশোনা শেষ করেছে। গাজা তখন অত্যন্ত কঠোর অবরোধের মধ্যে ছিল। সেই পরিস্থিতিতে পড়া শেষ করে চারবার চাকরি হারানো অসহায় বাবাকে সাহায্য করতে মরিয়া এক মেয়ে আমি। পরিবারের বড় মেয়ে আমি এবং আমার পরিবার যাতে ভালো ও সুন্দর বাড়িতে থাকতে পারে, তার জন্য উপার্জনের চেষ্টা করেছিলাম। এসবের কোনো কিছু কেউ ভুলুক, তা আমি চাই না।’

এনাস আল-ঘুল। ছবি: সংগৃহীত
এনাস আল-ঘুল। ছবি: সংগৃহীত

মিসাইলে পোড়া মাটিতে পানির ঠিকানা

ফিলিস্তিনের এক কৃষি প্রকৌশলী এনাস আল-ঘুল। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের কারণে পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেখা দেয় পানির সংকট। সেই সংকটের সমাধান দিয়েছিলেন আল-ঘুল। নিরাপত্তা, অর্থনীতি

ও গাজার জীবনযাত্রার উদ্বেগজনক অবস্থা, কাঁচামালের অপ্রতুলতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তিনি ব্যবহৃত উপকরণ দিয়ে একটি যন্ত্র তৈরি করেন। কাঠ, কাচ ও ত্রিপলের মতো বারবার ব্যবহার করা বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে সৌরশক্তিচালিত যন্ত্রটি তৈরি করেছিলেন আল-ঘুল। সেই যন্ত্রের মাধ্যমে নোনাপানিকে দ্রুত সুপেয় পানিতে রূপান্তর করা যেত। এই ব্যবস্থা পরে গাজার খান ইউনিস এলাকায় তাঁবুতে বসবাসকারী অনেকের জন্য জীবন রক্ষাকারী উপকরণ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া আল-ঘুল একটি সৌরশক্তিচালিত চুলা তৈরি করেছিলেন। পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি করেছিলেন গদি ও ব্যাগের মতো জিনিসপত্র। তাঁর কাজের মূলমন্ত্র হলো— প্রয়োজনই আবিষ্কারের জন্মদাতা।

শিরিন আবেদ। ছবি: সংগৃহীত
শিরিন আবেদ। ছবি: সংগৃহীত

যাঁর হাতে জন্ম নিয়েছে নতুন প্রাণ

ফিলিস্তিনের মতো এক মৃত্যু উপত্যকায় শিরিন আবেদ ছিলেন দেবদূতের মতো। পেশায় তিনি ছিলেন পেডিয়াট্রিশিয়ান বা শিশুচিকিৎসক। গাজার একাধিক হাসপাতালে দীর্ঘ সময় ধরে নবজাতকদের চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালে তিনি তাঁর বাড়ি হারান। ঠাঁই হয় গাজার এক আশ্রয়শিবিরে। সেখানেও শিশুদের চিকিৎসা করাতেন তিনি। গাজার মা ও শিশুচিকিৎসা কেন্দ্র আল-শিফা মেডিকেল কমপ্লেক্সের পরিচালক হিসেবে কাজ করছিলেন শিরিন আবেদ। সেখানে তিনি জরুরি চিকিৎসা প্রটোকল তৈরি করেন। এর মাধ্যমে সীমিত অর্থ ব্যয়ে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য অন্য চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। শিরিন গাজার একজন দক্ষ চিকিৎসক ছিলেন, যাঁর হাতে শিশুরা নিরাপদ চিকিৎসা পেয়ে ফিলিস্তিনের মাটিতে বেড়ে ওঠার কথা ছিল; অথচ যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার কারণে একসময় নিজের প্রাণ বাঁচাতে শিরিনকে ছাড়তে হয় দেশ।

সবেয়া আবু রাহমা। ছবি: সংগৃহীত
সবেয়া আবু রাহমা। ছবি: সংগৃহীত

স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা এক মা

২০০৯ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ছোড়া গ্যাস গ্রেনেডের আঘাতে মারা যান ইব্রাহিম আবু রাহমা। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনের রামাল্লার পশ্চিম তীরের বিলিন গ্রামের বাসিন্দা। দুই বছর পর ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হন তাঁর বোন জওয়াহের। তাঁদের মা সবেয়া আবু রাহমা এক বছর ধরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ছোড়া গ্রেনেডের খোসা সংগ্রহ করে সেগুলোতে জলপাইগাছসহ বিভিন্ন ফুলের চাষ করেছিলেন। গ্রেনেডের খোসায় প্রাণ সৃষ্টি করে চলা এক দারুণ প্রতিবাদ বটে। সেই সঙ্গে এটি ফিলিস্তিনিদের সাহস ও বেঁচে থাকার সহজাত বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। সেই সবেয়া কোনো এক শরণার্থীশিবিরে নাকি মারা গেছেন, তা কেউ জানে না।

এ ধরনের গল্পগুলো ফিলিস্তিনের মানুষের বেঁচে থাকার প্রেরণা। শরণার্থীশিবির থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত জনপদে ছড়িয়েছে এসব গল্প। তবে গল্পের চরিত্রদের অনেকের এখন আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। কেউ জানে না, তাঁরা বেঁচে আছেন কি না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত