Ajker Patrika

মরক্কোর নীল শহরে স্বাগত

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১: ৩৮
মরক্কোর নীল শহরে স্বাগত

উত্তর-পশ্চিম মরক্কোর পর্বতের মধ্যে গুঁজে আছে শেফশাওয়েন নামের এক শহর। এর সরু, খাঁড়া রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় গালিচা আর চামড়ার তৈরি বিভিন্ন সামগ্রীর দোকানগুলো নজর কাড়বে। বাজারে হরেক পদের মসলাও আকৃষ্ট করতে পারে। তবে বলা যায় না, এগুলোর কিছুই হয়তো আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে না। কারণ আপনি তখন মজে গেছেন নীল সৌন্দর্যে। এখানকার ঘর-বাড়ি, দোকানপাট, দরজা-জানালা মোটামুটি সবকিছুই যে নীল। 

রিফ পর্বতমালার পাদদেশে ৬০০ মিটার বা ২০০০ ফুট উচ্চতায় শহরটির অবস্থান। পেছনেই জাবেল এল-কেলা পর্বত, কাছেই জাবেল তিসুকা। অনেকের চোখেই এটি মরক্কোর সবচেয়ে সুন্দর শহর। কেউ আবার একে আদর করে ডাকে ‘ব্লু পার্ল’ বা ‘নীল মুক্তা’। 

নীল শহরে মুগ্ধ এক পর্যটকরাজা পঞ্চম আফনাসোর নেতৃত্বে পর্তুগিজদের এক আক্রমণের পর ১৪৭১ সালে শেফশাওয়েন শহরের গোড়াপত্তন হয়। অবশ্য এর আগে থেকে এখানে মানুষের ছড়ানো-ছিটানো বসতি ছিল। তবে ওই ঘটনার পর থেকে ওই এলাকা শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উত্তর মরক্কোর আদিবাসী ঘোমারাস, মরিসকোস এবং স্পেন ও পর্তুগাল থেকে পালিয়ে আসা ইহুদিরা এখানে বসতি গাড়তে শুরু করেন। পরবর্তীতে পর্তুগিজ ভীতি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো দুর্গের চারপাশে নতুন শহর গড়ে উঠতে শুরু করে। 

শহরের সড়কে এক পর্যটক দম্পতিপর্তুগিজদের দাপটের কারণে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত এখানে ভেড়েনি। এর আগপর্যন্ত শহরে পা রাখা কেবল তিনজন ইউরোপীয় পর্যটকের নাম জানা যায়। এর মধ্যে প্রথম আসেন ফরাসি অভিযাত্রী চার্লস ফোকলদ, ১৮৮৩ সালে। ইহুদি ধর্মযাজকের ছদ্মবেশে এখানে আসেন তিনি। এদিকে ফেজ থেকে মুর বণিকের ছদ্মবেশে ইংরেজ সাংবাদিক ওয়াল্টার হ্যারিসের শহরে আগমন ঘটে ১৮৮৯ সালে। পরে তিনি লেখেন, খ্রিষ্টানদের জন্য জায়গাটি ভ্রমণ অসম্ভবের কাছাকাছি এক কাজ। তৃতীয় ব্যক্তিটি উইলিয়াম সামার নামের এক ধর্ম প্রচারক। হ্যারিসের কথাটা যে সত্যি, এর দুঃখজনক উদাহরণ তিনি, কারণ বিষ খাইয়ে মারা হয় তাঁকে। 

শহরের একটি দোকানের বাইরের দেয়ালে সজ্জিত পণ্যসামগ্রীতবে এই তিন পর্যটকের কেউই এখন শেফশাওয়েনের যে নীল রাস্তা, ঘর-বাড়ি চোখে পড়ে তা দেখতে পাননি। কারণ তখন পর্যন্ত শহরময় এমন নীলের ছড়াছড়ি ছিল না। ১৯২০ সালে স্পেনীয়রা শহরের দখল নেওয়ার পর সবার জন্ম উন্মুক্ত হয় এটি। সেই সঙ্গে নীল হয়ে উঠতে থাকে মরক্কোর এই শহরের বাড়ি-ঘর, দেয়াল। 

শেফশাওয়েন নীল হয়ে ওঠার সবচেয়ে জনপ্রিয় তত্ত্বটি হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নাৎসিদের অত্যাচারে পালিয়ে আসায় শহরে ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে যায়। তখন ধর্মীয় রীতির অংশ হিসেবে ঘরের দেয়াল, মেঝে আর সিঁড়ির ধাপে নীল রং করতে থাকেন তাঁরা। শহরের কিছু অংশ অবশ্য আরও বেশ পরে পর্যটক টানার জন্য নীল করা হয়। 

ওপর থেকে দেখা শেফশাওয়েন শহরএই শহর নীল হয়ে ওঠার পেছনে আরও দুটি তত্ত্বও আছে। এর একটি হলো মশাদের দূরে রাখার জন্য এখানকার দেয়াল, সিঁড়ি সব এভাবে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপরটি হলো গ্রীষ্মে এই অঞ্চলের প্রচণ্ড তাপ থেকে বাসিন্দাদের রক্ষা করতে ঘর-বাড়ি, দোকানপাট সব নীল রং করা হয়েছে। তবে যে কারণেই এটা শুরু করা হোক না কেন, পর্যটকদের জিনিসটা লুফে নেওয়ায় চল রয়ে গেছে। 

এখন বছরে এক বা দুবার গোটা শহরটি নীল রং করা হয়, যেন নীলের মধ্যে কোনো ফ্যাকাশে ভাব না আসে। মোদ্দা কথা, কারণটা যা-ই হোক না কেন, এটি শহরটিকে আলোকচিত্রীদের জন্য রীতিমতো এক স্বপ্নরাজ্যে পরিণত করেছে। আর শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়ার সময় অদ্ভুত এই নীল সৌন্দর্য উপভোগ করেন মুগ্ধ পর্যটকেরা। 

নীলের রাজ্যে যাওয়ার উপায়টা বাতলে দেওয়া যাক আর আগে বাড়ার আগে। মরক্কোর ফেজ, তেতুয়ান, রাবাত, কাসাব্লাংকা (দার আল-বাইদা), টাঙ্গিয়ার থেকে নিয়মিত বাস পাবেন শহরটিতে যাওয়ার জন্য। এমনকি স্পেনের সীমান্তবর্তী শহর সেউটা থেকেও বাস ছাড়ে শেফশাওয়েনের দিকে। 
 
কেউ একে আদর করে ডাকে ‘ব্লু পার্ল’ বা ‘নীল মুক্তা’শহর লাগোয়া রিফ পর্বতমালার চূড়া থেকে দেখতে পাবেন ভূমধ্যসাগরের অসাধারণ দৃশ্য। শেফশাওয়েন থেকে ঘণ্টা দুয়েক গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে যাবেন ৩ লাখ একরের এক অরণ্যভূমিতে। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে মরক্কোর সবচেয়ে সেরা জায়গাগুলোর একটি এটি। তালাসেমতনে ন্যাশনাল পার্ক নামে পরিচিত জঙ্গলটির গিরিখাদ, মাথা উঁচু করে থাকা পাহাড়, সিডার-পাইনের জঙ্গল ও ভোঁদড়, বানরসহ নানা ধরনের পাখি আপনাকে মুগ্ধ করবে। 

যেতে পারেন আকছোর শহরেও। গাড়িতে শেফশাওয়েন থেকে মোটামুটি ৪৫ মিনিটের দূরত্ব। একটি খালের দুপাশে অল্প কিছু বাড়ি নিয়ে ছোট্ট এই শহর। তবে এখানে আপনি খুব একটা বেশি সময় দেবেন না, বরং কিছুটা পথ হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন আকছোর জলপ্রপাতের সামনে। ওপর থেকে নেমে আসা পানিতে ছোট্ট কয়েকটি পুকুরের জন্ম হয়েছে। এগুলোর চারপাশ ঘিরে আছে সবুজ গাছপালায়। এখান থেকে একটু পাহাড় বেয়ে উঠলে আবার পৌঁছে যাবেন গভীর এক জঙ্গলে। 

দরজার রং নীলঘোরাফেরা শেষে বিকেলে আবার ফিরে আসবেন শেফশাওয়েনের নীল রাজ্যে। বেশ কতকটা হাঁটাহাঁটি করে আপনি তখন ক্লান্ত। রাস্তার পাশের একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে এখানকার বিখ্যাত ভেড়ার রানের কাবাব আর পুদিনা পাতার চা খেতে খেতে নীল সৌন্দর্য উপভোগ করতে কেমন লাগবে বলুন তো? 

সূত্র: মাচ বেটার অ্যাডভেঞ্চারস ডটকম, দ্য ওয়ার্ল্ড পারস্যুট ডট কম

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পেহেলগাম হামলা: ধরা খেয়ে গেল মোদির কাশ্মীর ন্যারেটিভ

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: বিমানবাহিনীকে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে বললেন প্রধান উপদেষ্টা

সারজিসের সামনেই বগুড়ায় এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ

‘ঘুষের জন্য’ ৯১টি ফাইল আটকে রাখেন মাউশির ডিডি: দুদক

রাখাইনে মানবিক করিডর কি প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদ হবে, ভারত-চীন কীভাবে দেখবে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত