Ajker Patrika

পৃথিবীর সবচেয়ে ভুতুড়ে গোরস্থান

ইশতিয়াক হাসান
আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৩, ১৫: ২২
পৃথিবীর সবচেয়ে ভুতুড়ে গোরস্থান

ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে হাইগেট গোরস্থানের অবস্থান। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিকেই সমাধিস্থ করা হয়েছে এখানে। তবে হাইগেট সিমেট্রিকে মানুষ বেশি চেনে একে কেন্দ্র করে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের ভুতুড়ে কাণ্ড-কীর্তির জন্য। এমনকি গোরস্থানকে নিয়ে প্রচলিত আছে ভ্যাম্পায়ারের কাহিনিও। সবকিছু মিলিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভুতুড়ে গোরস্থানগুলোর একটি হিসেবেই একে বিবেচনা করা হয়। কেউ কেউ আবার এক কাঠি বাড়া, তাঁদের হিসেবে এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে ভুতুড়ে গোরস্থান।

এবার বরং হাইগেট গোরস্থানটির গোড়াপত্তন কীভাবে হয় তা সংক্ষেপে জানানো যাক। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে লন্ডন শহরের জনসংখ্যা বেড়ে ১০ লাখে পৌঁছায়। ক্রমেই সংখ্যাটি আরও বাড়ছিল। এ সময় মৃত্যুহারও ছিল বেশি। দোকান আর সরাইখানার মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় মৃত ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করতে থাকে মানুষ। অনেককেই অগভীর সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয় এ সময়। এতে দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি নানা ধরনের রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। 

১৮৩৯ সালে গোড়াপত্তন হয় গোরস্থানটিরএ সময় লন্ডন শহরের আশপাশে সাতটি গোরস্থান স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এগুলোর মধ্যে তৃতীয়টি ছিল হাইগেট সিমেট্রি বা হাইগেট গোরস্থান। ১৮৩৯ সালে স্থাপিত হয় এটি। এতে কাউকে সমাধিস্থ করতে তেমন কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। ১৮৫৪ সালের দিকে মোটামুটি গোটা এলাকাটি পরিপূর্ণ হয়ে গেল সমাধিতে। তারপর আশপাশের আরও ২০ একর জায়গাকে গোরস্থানের সীমানার মধ্যে আনা হলো। 

অনেক ভাস্কর্যও আছে হাইগেটেতবে বিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই গোরস্থানটি তার সোনালি যুগের শেষ দেখতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কর্মচারীর সংখ্যা একেবারে কমে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে গোরস্থানটি মোটামুটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। ১৯৬০ সালের দিকে এসে গোরস্থানের গেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। গোটা এলাকাটি নানা ঝোপঝাড় আর গুল্মের জঙ্গলে ঢাকা পড়তে থাকে। স্থাপনাগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে। ভেঙে পড়তে থাকে সমাধি ও সমাধি ফলকগুলো। একপর্যায়ে জায়গাটার চেহারা এমন ভুতুড়ে রূপ নেয় যে বিভিন্ন স্টুডিও এখানে ভুতুড়ে ছবির শুটিং করতে শুরু করে। আর তার পরই একে নিয়ে নানা ধরনের গুজব ডালপালা মেলতে শুরু করে। একই সঙ্গে নানা ধরনের অশুভ আচার পালানের জায়গায় পরিণত হয় এটি। 

গোরস্থানটির ভেতরে প্রচুর গাছপালাকালো আলখাল্লা পরা রহস্যময় মানুষের আনাগোনা, কালো জাদুর বিভিন্ন চর্চার খবর ছড়াতে থাকে গোরস্থানটিকে ঘিরে। গোরস্থানের অলিগলিতে নতুন কিছু দেখার আশায় ঘুরঘুর করতে শুরু করেন ঘোস্ট হান্টার বা ভুতুড়ে ঘটনা নিয়ে আগ্রহী মানুষ। এদিকে গোরস্থানের বাইরে চলাচল করা লোকজন দাবি করতে থাকেন, লাল চোখের ভয়ংকর কিছু ভেতর থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

তার পরই আছে হাইগেট ভ্যাম্পায়ারের গল্প। বলা চলে, এই ভ্যাম্পায়ার হাইগেটের গায়ে পৃথিবীর অন্যতম ভুতুড়ে গোরস্থানের তকমা সেঁটে দিতে ভূমিকা রাখে। বলা হয়, এই ভ্যাম্পায়ার মধ্যযুগের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, যিনি রোমানিয়ায় কালো জাদুর চর্চা করতেন। আঠারো শতকের দিকে তাঁর কফিন রোমানিয়া থেকে ইংল্যান্ডে আনা হয়। অনুসারীরা তাঁর কফিন নিয়ে যায় ওয়েস্ট এন্ডের এক বাড়িতে। যে জায়গায় তাঁকে সমাহিত করা হয়, সেখানেই পরে তৈরি হয় হাইগেট সিমেট্রি। বলা হয়, একটা সময় পর্যন্ত শান্তিতেই ঘুমিয়ে ছিল সে। তার পরই কালো জাদুর চর্চাকারীরা গোরস্থানে একটা কালো আচার পালন করে। এটিই জাগিয়ে তোলে তাঁকে। অর্থাৎ, জন্ম হয় হাইগেট ভ্যাম্পায়ারের।

গোরস্থানের একটি অংশের প্রবেশদ্বারঅনেকেই গোরস্থানের ভেতরে লম্বা, কালো একটির অবয়বকে ভেসে বেড়াতে কিংবা চলাফেরা করতে দেখার দাবি করেন। বলা হয়, এটাই হাইগেট গোরস্থানের সেই ভ্যাম্পায়ার। লোকমুখে প্রচলিত, সে যখন উপস্থিত হয়, হঠাৎ কমে যায় আশপাশের তাপমাত্রা। ওই সময় চৌহদ্দির সব ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। আশপাশের বন্যপ্রাণীরাও তার উপস্থিতিতে ঘাবড়ে যায়। গোরস্থান এলাকায় বিভিন্ন সময়ে মৃত শিয়াল খুঁজে পাওয়া যায়। এ ঘটনাগুলোর জন্যও তাকেই দায়ী করা হয়। 

যারা তাকে দেখেছেন বলে দাবি করেন তাঁরা জানান, ভ্যাম্পায়ারটির সম্মোহন করার ক্ষমতা আছে। এবং তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ংকর আতঙ্ক পেয়ে বসে। বিশেষ করে রাতে যাঁরা গোরস্থানে যান, তাঁরাই এ ধরনের অবস্থা ঘটেছে বলে দাবি করেন বেশি। আবার গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়া একাধিক মানুষ কালো আলখেল্লা পরা কেউ তাঁদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

কার্ল মার্ক্সের সমাধি হাইগেটেইহাইগেট ভ্যাম্পায়ারকে বলতে পারেন অতিপ্রাকৃত ঘটনার কেন্দ্র। কিন্তু এর বাইরে আরও নানান ভীতিকর ঘটনার গল্প প্রচলিত আছে গোরস্থানটিকে ঘিরে। ভিক্টোরিয়ান যুগেই এখানে মৃতদের সমাধি ঘিরে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটা শুরু হয়। কফিনের ডালা খুলে যাওয়া ছিল এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। হাইগেট গোরস্থানে যাঁরা আত্মীয়স্বজনদের মাটির ওপরে সমাধিস্থ করতে চান, তাদের জন্য বেশ কয়েকটি সমাধিশালা তৈরি করা হয়। মূলত এই সমাধিগুলোতেই কফিনের ডালা খোলার ঘটনা বেশি শোনা যায়। অবশ্য পরে এ ঘটনা ঘটার একটি যুক্তিসংগত কারণের খোঁজ মেলে। সেটি হলো, সমাধির ভেতরে গ্যাস জমে এভাবে ডালা খুলে গিয়ে থাকতে পারে। 

আরও নানা ধরনের গল্পও প্রচলিত আছে হাইগেট গোরস্থানকে ঘিরে। যেমন বানশির (আইরিশ লোককথার একধরনের অশরীরী) ভয়ংকর চিৎকার, নানের একটা ভুতুড়ে কাঠামোকে ভেসে বেড়াতে দেখা—এমন আরও কত কী। এদিকে ভুতুড়ে এক সাইকেল আরোহীর কাহিনিও প্রচার পেয়েছে, যে কিনা সাইকেল নিয়ে গোরস্থানময় ঘুরে বেড়িয়ে হ্নৎকম্পন থামিয়ে দেওয়ার জোগাড় করে মানুষের। 

রাস্তার দুপাশে সমাধিবর্তমানে ৩৭ একর জায়গায় ৫৩ হাজার সমাধির মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে সমাধিস্থ করা হয়। এখনো খালি জায়গা থাকায় মৃত ব্যক্তিদের সমাধিস্থও করা হয় গোরস্থানটিতে। এখনো ভুতুড়ে বিষয় নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের বিচরণের প্রিয় জায়গা এটি। তেমনি লোকমুখে প্রচলিত গল্প সত্যি হলে এখনো ভুতুড়ে ঘটনা থেমে নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু মানুষেরও সমাধি আছে এই গোরস্থানে। যেমন দার্শনিক কার্ল মার্কস, প্রযোজক, গায়ক ম্যালকম ম্যাকলারেন, লেখক ডগলাস এডামস, বিখ্যাত দৃষ্টিহীন অভিযাত্রী জেমস হলম্যান  জর্জ মিশেল প্রমুখ। আপনি যদি রোমাঞ্চপ্রেমী হন, তবে লন্ডন সফরে হাইগেট গোরস্থানে কিছুটা সময় কাটাতেই পারেন। 

সূত্র: অথেন্টিক ভ্যাকেশানস ডট কম, এটলাস অবসকিউরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত