Ajker Patrika

টিকটক লাইভে ভিক্ষাবৃত্তি, ব্যবহৃত হচ্ছে শিশুরা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৫: ৩১
শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি এবং অন্যান্য ধরনের ভিক্ষাবৃত্তির জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে টিকটিক। ছবি: টিকটক
শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি এবং অন্যান্য ধরনের ভিক্ষাবৃত্তির জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে টিকটিক। ছবি: টিকটক

ক্যামেরার সামনে একত্র হয়ে বসে আছে তিন শিশু। তারা আফগানিস্তানের এক কাঁচা মাটির বাড়িতে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। তাদের মধ্যে একটি ছেলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমরা খুব গরিব, দয়া করে সাহায্য করুন।’ তাদের লাইভ স্ট্রিমটি ব্রিটেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় দেখানো হচ্ছে টিকটক লাইভের মাধ্যমে।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে টিকটকের ভার্চুয়াল ‘গিফট’ চেয়ে যাচ্ছে তারা, যা পরবর্তীকালে অর্থে রূপান্তর করা যাবে। একবার একটি গিফট পাওয়ার পর তারা খুশি হয়ে হাততালি দেয়। অন্য একটি লাইভ স্ট্রিমে ডিজিটাল গোলাপ পাওয়ার পর এক মেয়ে আনন্দিত হয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘ধন্যবাদ, আমরা আপনাকে ভালোবাসি!’ এই গোলাপের মূল্য ছিল মাত্র ১ পেনি। তবে টিকটক থেকে নগদে পরিণত হলে এর মূল্য এক-তৃতীয়াংশের কম হতে পারে।

এদিকে টিকটক দাবি করে, এটি শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি এবং অন্য ধরনের ভিক্ষাবৃত্তির জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং লাইভে অংশগ্রহণকারীদের জন্য কঠোর নীতিমালা রয়েছে। তবে ব্রিটিশ গণমাধ্যম অবসার্ভারের তদন্তে দেখা গেছে, এই ধরনের লাইভ স্ট্রিম প্রচলিত হয়ে উঠেছে এবং এর মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে টিকটক। অর্থাৎ এসব কনটেন্ট থেকে কমিশন এবং ফি কাটছে টিকটক। এসব কমিশন ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি অলিভিয়ে দে শুটার একে ‘চমকপ্রদ ঘটনা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং ‘মানুষের দুর্দশা থেকে লাভ করার’ জন্য টিকটক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অভিযুক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের কষ্ট থেকে মুনাফা নেওয়া ডিজিটাল ডাকাতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি টিকটককে অনুরোধ জানাচ্ছি, তাদের নিজেদের নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে এবং “কমিশন” (ফি) নেওয়ার যৌক্তিকতা পুনর্বিবেচনা করতে।’

‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর ডিজিটাল হানিকর বিশেষজ্ঞ জেফ্রি ডি মারকো বলেছেন, এই ধরনের অভ্যাস গুরুতর অপব্যবহার। এই ধরনের কনটেন্ট থেকে প্ল্যাটফর্মগুলো যেন আর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে লাভবান না হয়, এ জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

এলাকাভিত্তিক বিশ্লেষণে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, মিসর ও কেনিয়ার মতো দেশগুলোতে এই ধরনের লাইভ ভিক্ষাবৃত্তির ঘটনা দেখা গেছে।

তদন্তে দেখা যায়, একটি অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় প্রতিদিন লাইভ স্ট্রিম হয়, যেখানে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন শিশুকে দেখানো হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে লাইভে এসে ডিজিটাল গিফটের জন্য ভিক্ষা চাইছিল সাতজন তরুণ ছেলে। পরদিন একই স্থানে অন্য ছেলেরা উপস্থিত হয়, তাদের পাশে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বসে ছিলেন। ওই অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে অবজারভার জানানোর পর টিকটক দুই ঘণ্টার মধ্যে সেটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ইন-অ্যাপ রিপোর্টিং টুলের মাধ্যমে আগের একটি রিপোর্টের পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

এদিকে ৫ হাজার ৩০০ ফলোয়ারের অ্যাকাউন্টে লাইভ স্ট্রিমে চেয়ারে বসে থাকা বৃদ্ধ এক পুরুষের সম্প্রচার দেখানো হচ্ছিল। অ্যাকাউন্টটি তৃতীয় পক্ষ পরিচালনা করছিল বলে মনে হচ্ছিল। তবে তাদের পরিচয় সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এই অ্যাকাউন্টের বায়োতে লেখা ছিল ‘গরিব মানুষ’ এবং তার পাশে কান্নার ইমোজি ব্যবহার করা হয়েছে।

কিছু লাইভ স্ট্রিমে মানুষের নিকৃষ্ট এবং কখনো কখনো বিপজ্জনক স্টান্ট করতে দেখা গেছে। তারা ভার্চুয়াল গিফটের বিনিময়ে এসব স্টান্ট করে থাকে। যেমন নিজেদের আঘাত করা, দীর্ঘ সময় জেগে থাকা, মাটিতে ঢেকে ফেলা বা ক্যামেরার সামনে ঘুমানো। ইন্দোনেশিয়ার এক লাইভ স্ট্রিমে দেখা গেছে, দুটি ছোট মেয়ে জানালাবিহীন, সাদা দেয়ালবিশিষ্ট স্টুডিওর টাইলযুক্ত মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। এরপর একই অ্যাকাউন্ট থেকে ওই টাইলযুক্ত মেঝেতে ঘুমানো এক পুরুষের লাইভ সম্প্রচার করা হয়।

পাকিস্তানের আরেকটি সম্প্রচারে দেখা গেছে, তিনজন পুরুষ অন্ধকারে বসে আছেন, তাঁদের মাথায় প্লাস্টিকের বালতি ও পার্টি হ্যাট। তাঁরা ক্যামেরার সামনে ঘুমিয়ে ছিলেন। যখন একটি গিফট পাচ্ছিলেন, তখনই তাঁরা জেগে উঠেছিলেন এবং নাচ পরিবেশন করছিলেন।

২০২০ সালে আগস্টে টিকটিকে লাইভ ফিচার চালু হয়। এর মাধ্যমে কনটেন্ট ক্রিয়েটররা সরাসরি দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

টিকটকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে ১০০ মিলিয়ন মানুষ লাইভ করে, যা ‘বিলিয়ন’ সংখ্যক ব্যবহারকারী কাছে পৌঁছেছে। দর্শকেরা সরাসরি মন্তব্য বা গিফট পাঠিয়ে নির্মাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল দাতব্য সংস্থায় কর্মরত এবং ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক অন্তর্ভুক্তিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ নোভিতা আংগ্রেইনি বলেন, অনেক নির্মাতা টিকটক লাইভ ব্যবহার করেন, তাঁদের ‘প্রতিভা প্রদর্শন’ বা ‘মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন’ করার জন্য। সাধারণত এটি ব্যবহার করেন, যাঁরা নিজেদের গান গাওয়া, নাচ, ভিডিও গেম খেলা, ছবি আঁকা বা রান্না করার ভিডিও ধারণ করেন। তবে এখন ক্রমবর্ধমানভাবে ভুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এটি। বিশেষ করে তাঁরা, যাঁরা এটিকে ‘অর্থ উপার্জনের সহজ পথ’ হিসেবে দেখছেন। তিনি আরও যোগ করেন, এই ধরনের ‘ক্ষতিকর’ ভিক্ষাবৃত্তি-সম্পর্কিত ভিডিও অত্যন্ত দ্রুত বাড়ছে। এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের শোষণ।

তিনি আরও বলেন, এসব লাইভ স্ট্রিমের পেছনে মূলত দারিদ্র্য এবং ডিজিটাল শিক্ষা-দক্ষতার অভাব কাজ করছে। এ ছাড়া মানুষগুলোকে এগুলো জোর করে করানো হচ্ছে কি না, তা সহজে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ভুক্তভোগীরা নিজেদের শোষিত হওয়ার কথা অস্বীকার করেন এবং দাবি করেন, ‘এটি একটি সহযোগিতা, যার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা হচ্ছে।’

তবে তিনি সতর্ক করে জানান, সংগঠিত ভিক্ষাবৃত্তি নেটওয়ার্কগুলোর মাধ্যমে শোষণের ‘উচ্চ ঝুঁকি’ রয়েছে। যেগুলো আয় প্রবাহের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং একাধিক পরিবারকে লাইভ স্ট্রিমের জন্য নিয়ন্ত্রণ করে।

টিকটক জানিয়েছে, তারা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ছিল—অবজারভার কর্তৃক চিহ্নিত অ্যাকাউন্টগুলো মুছে ফেলা। তারা বলেছে, তাদের নীতিমালায় লাইভ স্ট্রিমে শোষণমূলক ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে শিশু বা দুর্বল ব্যক্তিদের শোষণমূলক ভিক্ষাবৃত্তি অন্তর্ভুক্ত। টিকটকের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘যেকোনো লাইভ কনটেন্ট, যেখানে শিশুদের গিফটের জন্য ভিক্ষা চায়, তা টিকটক অনুমোদন করে না।’

যেসব ক্ষেত্রে শোষণমূলক ভিক্ষাবৃত্তি বা শিশু শোষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেখানে তারা ‘কঠোর পদক্ষেপ’ নিয়েছে। তারা সেসব লাইভ স্ট্রিম বন্ধ করেছে এবং স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তারা জানায়, ‘প্রতিরোধমূলক শনাক্তকরণ এবং নিবেদিত টিম ও প্রযুক্তির মাধ্যমে’ তারা প্রতি মাসে চার মিলিয়ন লাইভ স্ট্রিম বন্ধ করে ‘আমাদের প্ল্যাটফর্মকে নিরাপদ রাখতে’ সাহায্য করছে। লাইভ স্ট্রিম হোস্ট করার জন্য এক হাজার ফলোয়ার এবং বয়স ১৮ বছরের বেশি হতে হবে। তবে শিশুরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে উপস্থিত থাকলে লাইভে আসতে পারবে।

টিকটক জানায়, তারা যে কমিশন এবং ফি গ্রহণ করে, তা পরিবর্তনশীল। লাইভ স্ট্রিমাররা গিফটের পূর্ণ মূল্য পায় না, বরং তারা ‘ডায়মন্ড’ নামে পয়েন্ট পায়। এই পয়েন্ট গিফট এবং তাদের স্ট্রিমের জনপ্রিয়তা ও সময়কাল অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। কমিশন এবং ফি পরিশোধের পর, সাধারণত তারা মূল গিফটের অর্ধেক পায়, তবে কখনো কখনো মাত্র ৩০ শতাংশ। টিকটক দাবি করেছে, ৩০ শতাংশ আয় ‘অ্যাপ স্টোর ফি এবং পেমেন্ট প্রোভাইডার খরচে’ চলে যায়। টিকটকে ১০০টির বেশি ডিজিটাল গিফট রয়েছে, যার মধ্যে একটি রোজ (১ পেনি) থেকে শুরু করে, টিকটক ইউনিভার্স (প্রায় ৪৫০ পাউন্ড) রয়েছে।

শোষণমূলক কনটেন্ট থেকে লাভ নেওয়ার জন্য আগে সমালোচনার মুখে পড়েছিল টিকটক। বিশেষ করে ২০২২ সালে যৌন নির্যাতন লাইভ স্ট্রিমের ঘটনায়।

২০২৩ সালে আল জাজিরা জানায়, ইন্দোনেশিয়ার অনাথ আশ্রমগুলো লাইভ স্ট্রিমের মাধ্যমে অনুদান সংগ্রহ করছে। এসব লাইভ স্ট্রিমে শিশুদের ঘুমাতে দেখা যায়। টিকটক বলেছে, তারা এমন শোষণমূলক ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করেছে। তবে অনাথ আশ্রমের লাইভ স্ট্রিমটি তাদের নিয়ম ভঙ্গ করেনি।

টিকটক লাইভে ভিক্ষাবৃত্তি-সম্পর্কিত ঝুঁকি থাকলেও অনেক দাতব্য সংস্থা বলছে, এটি সংকটে থাকা মানুষকে সাহায্য পেতে সহায়তা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপাইনের এক পরিবার তাদের যমজ শিশুর অস্ত্রোপচারের জন্য অনুদান সংগ্রহে সফল হয়েছিল। তবে অনেক ক্ষেত্রে এটি স্পষ্ট নয় যে এর মাধ্যমে আসলেই কারা উপকৃত হচ্ছে।

অ্যান্টি-স্লেভারি ইন্টারন্যাশনালের ক্যাথরিন টার্নার বলেন, কিছু শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বেঁচে থাকার জন্য ভিক্ষা করে, তবে অন্যরা তৃতীয় পক্ষ দ্বারা ‘শারীরিক বা মানসিকভাবে শোষিত’ হয়ে থাকে। এই তৃতীয় পক্ষ আয়প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।

লাইভ স্ট্রিমারদের পুরস্কারের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করার জন্য সরকারি ইস্যুকৃত আইডি চায় টিকটক। তবে দর্শকদের জন্য এটি জানার উপায় নেই যে যারা লাইভে থাকছে, তারা বাস্তবে উপকৃত হচ্ছে কি না। অক্সফোর্ডের ক্রিমিনোলজি কেন্দ্রের গবেষক ‘মায়া লাহাভ’ বলেন, লাইভ স্ট্রিম নিয়ন্ত্রণ করা বা নজরদারিতে রাখার জন্য অনেক তথ্য প্রয়োজন, যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি উল্লেখ করেন, এসব কনটেন্ট সরানো উচিত কি না, তা নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন রয়েছে।

তবে তিনি আরও বলেন, তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ এবং শিশু বা অসুস্থদের সম্মতির বিষয়টি নিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। ‘এখানে মূল প্রশ্ন, কখন এটি শোষণ হয়ে ওঠে! এই সঠিক ভারসাম্যই তাদের মানতে হবে।’

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত