জাতীয়তাবাদ যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা যায়নি। যে অঙ্গীকার নিয়ে মুক্ত দেশটি গড়ার কথা ছিল, তা আর গড়া যায়নি। দেশপ্রেম মানে যে দেশ ও দশের সেবা করেই দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া, সে কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী এক নয়া সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
জাহীদ রেজা নূর
বায়ান্ন সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানি সৈন্যরা। কাজটা তারা করেছিল সরকারি নির্দেশেই। স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দিলে উত্তেজিত জনগণ ভয় পেয়ে যাবে—এ রকম কিছু ভেবেছিল সরকারি মদদপুষ্ট হামলাকারীরা। তারা কি ভেবে দেখেনি, কেন এ রকম একটি স্তম্ভের কাছে আসছে হাজার হাজার মানুষ? কেন তারা এখানে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যাচ্ছে?
ভেবে দেখেছে, আর তাই পেয়েছে ভয়। স্মৃতিসৌধটি গুঁড়িয়ে দিয়েই তারা মানুষের মন থেকে শহীদদের স্মৃতি মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, জহির রায়হানের বলা ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব’ বাক্যটিই হয়ে উঠেছে বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতিকে বেগবান করার অক্ষয় শক্তি। এই শক্তির খোঁজ করতে গেলে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয়।
২. পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মলাভের পর মূলত রাজনীতির তিনটি ধারা বিরাজ করছিল। মুসলিম লীগ সমর্থিত ইসলামি ধারা, বামপন্থীদের সমাজতান্ত্রিক ধারা আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক ধারা। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা প্রথম ধাক্কা খেল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সেই ধাক্কা আরও জোরালো হলো এবং মুসলিম লীগের রাজনীতির প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হলো। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম লীগের কবর রচনা করেছিল। সেই যে ডুবেছিল, আর কখনোই মুসলিম লীগ বাংলার রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পারেনি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ।
সে সময় বামপন্থা এই অঞ্চলের রাজনীতিকে বেগ দিয়েছিল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন থেকে আগত সাম্যের রাজনীতির প্রতি তরুণদের আগ্রহ জন্মেছিল অপরিসীম। শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান, মেধাবী তরুণদের সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতিকে আপন করে নিয়েছেন। ত্যাগ ও আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা সাম্যবাদীদের প্রতি সাধারণ জনগণের মনে শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি করেছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব আন্দোলন হয়েছিল, সেগুলোয় বামপন্থীদের ছিল অসাধারণ ভূমিকা। কিন্তু ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী রাজনীতি সোভিয়েত ও চীন বলয় সৃষ্টি করলে আমাদের দেশের বামপন্থীরাও মস্কো-পিকিং দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে, বামপন্থী রাজনীতির অগ্রগতি মন্থর হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন দুই বলয় কার্যত একে অন্যের বিরুদ্ধে সরব হয়ে নিজেদের পায়েই কুড়াল মেরেছে। সে সময়ের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক শিবির হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থীরা জনগণের ভাষা পড়তে পারল না। সর্বহারা শ্রেণির জন্য রাজনীতি করলেও মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে বামপন্থা গরিব মানুষের মনের কথা হয়ে উঠতে পারল না।
গণতান্ত্রিক ধারাটি সবল হয়ে ওঠার একটি কারণ হলো বাংলার রাজনীতিতে বামপন্থীদের এই দুরবস্থায় পতিত হওয়া। অন্যটি হলো গণতান্ত্রিক ধারায় যোগ্য রাজনীতিবিদদের সংযুক্তি। সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী, এ কে ফজলুল হকের রাজনীতির প্রতি সাধারণ জনতা আকৃষ্ট হলো। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনই দেখিয়ে দিয়েছিল, বাংলা তার জাতীয়তাবাদী ধারাকেই বেছে নিতে চায়। যুক্তফ্রন্টের যে ২১ দফা ছিল, তার মধ্যে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথাটি যে উপ্ত ছিল এবং সেই স্বায়ত্তশাসনের পথই যে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঠিকানা, সেটা বুঝে নিয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। স্বায়ত্তশাসনের প্রসঙ্গটি ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবেও। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বায়ত্তশাসনের প্রসঙ্গই তুলেছিলেন। এবং সে সময়কার রাজনৈতিক আবহাওয়ার কারণে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের চোখের মণি। সেই পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
৩. বাঙালি মুসলমান মোগল আমলে বা ব্রিটিশ আমলে কখনোই প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব পায়নি। প্রশাসন মূলত চলেছে বহিরাগত মুসলমান আর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মাধ্যমে। ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করত এরাই। তাই বাঙালি মুসলমানের কাছে রাজা-রাজড়ার কাহিনি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আওরঙ্গজেব দিল্লির মসনদে, নাকি সিরাজুদ্দৌলাকে পলাশীর যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে ক্লাইভ চালাচ্ছে দেশটা—এই প্রশ্ন বাঙালি মুসলমানের কাছে ছিল অবান্তর। কারণ, প্রশাসনিকভাবে বাঙালি মুসলমান কখনোই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, মুসলিম বা ইংরেজ শাসকেরা তাদের প্রশাসনিক কাজে স্থানীয় মুসলমানদের সম্পৃক্ত করেনি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে বাঙালি মুসলমানের খুব বেশি চাওয়া ছিল না। নিজের জমিতে নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতা চেয়েছিল বাঙালি মুসলমান। কিন্তু সেখানেও গোল বাধিয়েছিল আশরাফ-আতরাফ প্রশ্নটি। সেখানেও গোল বাধিয়েছিল ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে অবহেলা করার প্রশ্নটি। ভৌগোলিকভাবে ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন দুই পাকিস্তানে ধর্ম ছাড়া আর কোনো মিল ছিল না। ভাষা-সংস্কৃতি একেবারেই আলাদা। বাঙালি মুসলমান নিজেকে বাঙালি ভাববে নাকি মুসলমান ভাববে—এই প্রশ্নের সমাধান করতে অনেকগুলো বছর পার করে দিয়েছিল। বাঙালি হয়েও যে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান হতে বাধা নেই, সে কথা উপলব্ধি করার পরই কেবল বাঙালি মুসলমান ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল। ইতিহাসের এই জায়গাটি বুঝতে না পারলে বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
আজ যাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে মায়াকান্না কাঁদছেন, তাঁরা পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। বাঙালির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণাই যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতির একটি বড় নিয়ামক শক্তি, সে কথা একটু পড়াশোনা করলেই যে কেউ জানতে পারবে। সেই ইতিহাস কেউ কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্য তৈরি করেনি। ব্রিটিশদের মতোই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই দেখে এসেছে। বিরোধের সবচেয়ে বড় কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য হলেও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যকেও একই সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।
৪. পাকিস্তান আমলে যেসব আন্দোলন হয়েছে, তা ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকে সব ধর্ম ও মতের সংস্পর্শে আসা এক মিলনমেলা। জাতীয়তাবাদী চেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা গিয়েছিল সেই আন্দোলনে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা যায়নি। যে অঙ্গীকার নিয়ে মুক্ত দেশটি গড়ার কথা ছিল, তা আর গড়া যায়নি। দেশপ্রেম মানে যে দেশ ও দশের সেবা করেই দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া, সে কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী এক নয়া সমীকরণ তৈরি হয়েছে। জাতিবিদ্বেষ ও ধর্মবিদ্বেষ প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। সাম্যের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মানুষ দিনে দিনে কমছে। এই ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মতলববাজ এসে ঢুকে পড়ছে জাতীয় রাজনীতিতে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের যে পথের কথা বলা হয়েছিল, সেই কাঙ্ক্ষিত পথে দেশ হাঁটছে কি না, সেই প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মধ্যেই আমাদের দেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু উপাদান ঢুকে পড়েছে, যা নিয়ে তরুণদের ভাবতে হবে। শর্ত মেনে লালন উৎসব করা, নাট্যোৎসব স্থগিত করে দেওয়া, অবাধে ভাঙচুর চালানোর স্বাধীনতা পাওয়া, নারীদের খেলাধুলায় হস্তক্ষেপ, মাজার ভাঙা, শোরুম উদ্বোধনে নারী অভিনয়শিল্পীদের বাধা দেওয়া ইত্যাদি আদতে কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা নিয়ে ভাবা দরকার।
৫. ভাষার মাসে লেখাটি শুরু করেছিলাম স্মৃতির মিনারের কথা বলে। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সারা রাত ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্বে এই মিনার গড়ে তোলা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি তা খুলে দেওয়া হয়। স্মৃতির মিনারটি দেখতে হাজির হয় হাজার হাজার মানুষ। এই মিনারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে পাকিস্তান সরকার। এবং তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে।
১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ও মোহাম্মদ সুলতান কর্তৃক প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে একুশের গান হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি। পরের বছর থেকে প্রভাতফেরিতে এই গানই হয়ে ওঠে শহীদদের স্মরণ করার অমর সংগীত।
এ বছর গানটি সেভাবে কেন শোনা যাচ্ছে না, সেই প্রশ্ন কি কারও মনে উঠে এসেছে? আমরা যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কি ঠিক পথে রওনা দিয়েছে? নাকি তা আমাদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা করছে?
ইতিহাস তৈরি হয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে। কেউ চাইলেই মনগড়া তথ্য দিয়ে ইতিহাসকে নির্মূল করতে পারে না। কিছুদিনের মতো তা ঢেকে দেওয়া যায় বটে, কিন্তু একসময় ইতিহাস তার জায়গাটি খুঁজে নেয়।
ভেঙে দেওয়া হয়েছিল শহীদ মিনার। তা আবার গড়ে উঠেছিল সেখানেই। তবে মূলত তা গড়ে উঠেছিল হৃদয়ে হৃদয়ে, নিজেদের ঠিকানা তৈরি করা হয়েছে ইতিহাসকে মনের গভীরে রেখেই।
ইতিহাসের পুনর্নিমাণ যদি তথ্য-উপাত্তভিত্তিক না হয়, তাহলে তা টিকে থাকে না। টিকে থাকে শাশ্বত সংগ্রামের মাধ্যমে আনা মুক্তি এবং মুক্তির স্বপ্ন।
১৯৭১ সালেও শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘মসজিদ’ লিখে বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মপ্রাণ মানুষের এই দেশে তা টেকেনি। সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল শহীদ মিনার।
শহীদ মিনার আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে থাকবে কি না, গুঁড়িয়ে দিলেই তা মন থেকে মুছে যায় কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে আগামী দিনের নাগরিকেরা। তাদের দিকেই তো তাকিয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ।
লেখক: উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা
বায়ান্ন সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানি সৈন্যরা। কাজটা তারা করেছিল সরকারি নির্দেশেই। স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দিলে উত্তেজিত জনগণ ভয় পেয়ে যাবে—এ রকম কিছু ভেবেছিল সরকারি মদদপুষ্ট হামলাকারীরা। তারা কি ভেবে দেখেনি, কেন এ রকম একটি স্তম্ভের কাছে আসছে হাজার হাজার মানুষ? কেন তারা এখানে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করে যাচ্ছে?
ভেবে দেখেছে, আর তাই পেয়েছে ভয়। স্মৃতিসৌধটি গুঁড়িয়ে দিয়েই তারা মানুষের মন থেকে শহীদদের স্মৃতি মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, জহির রায়হানের বলা ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব’ বাক্যটিই হয়ে উঠেছে বাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতিকে বেগবান করার অক্ষয় শক্তি। এই শক্তির খোঁজ করতে গেলে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয়।
২. পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মলাভের পর মূলত রাজনীতির তিনটি ধারা বিরাজ করছিল। মুসলিম লীগ সমর্থিত ইসলামি ধারা, বামপন্থীদের সমাজতান্ত্রিক ধারা আর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক ধারা। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা প্রথম ধাক্কা খেল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সেই ধাক্কা আরও জোরালো হলো এবং মুসলিম লীগের রাজনীতির প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হলো। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম লীগের কবর রচনা করেছিল। সেই যে ডুবেছিল, আর কখনোই মুসলিম লীগ বাংলার রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে পারেনি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ।
সে সময় বামপন্থা এই অঞ্চলের রাজনীতিকে বেগ দিয়েছিল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন থেকে আগত সাম্যের রাজনীতির প্রতি তরুণদের আগ্রহ জন্মেছিল অপরিসীম। শিক্ষিত, সংস্কৃতিমান, মেধাবী তরুণদের সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতিকে আপন করে নিয়েছেন। ত্যাগ ও আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা সাম্যবাদীদের প্রতি সাধারণ জনগণের মনে শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি করেছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যেসব আন্দোলন হয়েছিল, সেগুলোয় বামপন্থীদের ছিল অসাধারণ ভূমিকা। কিন্তু ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী রাজনীতি সোভিয়েত ও চীন বলয় সৃষ্টি করলে আমাদের দেশের বামপন্থীরাও মস্কো-পিকিং দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। ফলে, বামপন্থী রাজনীতির অগ্রগতি মন্থর হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন দুই বলয় কার্যত একে অন্যের বিরুদ্ধে সরব হয়ে নিজেদের পায়েই কুড়াল মেরেছে। সে সময়ের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক শিবির হওয়া সত্ত্বেও বামপন্থীরা জনগণের ভাষা পড়তে পারল না। সর্বহারা শ্রেণির জন্য রাজনীতি করলেও মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে বামপন্থা গরিব মানুষের মনের কথা হয়ে উঠতে পারল না।
গণতান্ত্রিক ধারাটি সবল হয়ে ওঠার একটি কারণ হলো বাংলার রাজনীতিতে বামপন্থীদের এই দুরবস্থায় পতিত হওয়া। অন্যটি হলো গণতান্ত্রিক ধারায় যোগ্য রাজনীতিবিদদের সংযুক্তি। সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী, এ কে ফজলুল হকের রাজনীতির প্রতি সাধারণ জনতা আকৃষ্ট হলো। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনই দেখিয়ে দিয়েছিল, বাংলা তার জাতীয়তাবাদী ধারাকেই বেছে নিতে চায়। যুক্তফ্রন্টের যে ২১ দফা ছিল, তার মধ্যে বাংলার স্বায়ত্তশাসনের কথাটি যে উপ্ত ছিল এবং সেই স্বায়ত্তশাসনের পথই যে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঠিকানা, সেটা বুঝে নিয়েছিল এই ভূখণ্ডের মানুষ। স্বায়ত্তশাসনের প্রসঙ্গটি ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবেও। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বায়ত্তশাসনের প্রসঙ্গই তুলেছিলেন। এবং সে সময়কার রাজনৈতিক আবহাওয়ার কারণে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের চোখের মণি। সেই পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
৩. বাঙালি মুসলমান মোগল আমলে বা ব্রিটিশ আমলে কখনোই প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব পায়নি। প্রশাসন মূলত চলেছে বহিরাগত মুসলমান আর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মাধ্যমে। ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করত এরাই। তাই বাঙালি মুসলমানের কাছে রাজা-রাজড়ার কাহিনি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আওরঙ্গজেব দিল্লির মসনদে, নাকি সিরাজুদ্দৌলাকে পলাশীর যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে ক্লাইভ চালাচ্ছে দেশটা—এই প্রশ্ন বাঙালি মুসলমানের কাছে ছিল অবান্তর। কারণ, প্রশাসনিকভাবে বাঙালি মুসলমান কখনোই সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, মুসলিম বা ইংরেজ শাসকেরা তাদের প্রশাসনিক কাজে স্থানীয় মুসলমানদের সম্পৃক্ত করেনি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাছে বাঙালি মুসলমানের খুব বেশি চাওয়া ছিল না। নিজের জমিতে নিজের মতো করে চলার স্বাধীনতা চেয়েছিল বাঙালি মুসলমান। কিন্তু সেখানেও গোল বাধিয়েছিল আশরাফ-আতরাফ প্রশ্নটি। সেখানেও গোল বাধিয়েছিল ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে অবহেলা করার প্রশ্নটি। ভৌগোলিকভাবে ভারত দ্বারা বিচ্ছিন্ন দুই পাকিস্তানে ধর্ম ছাড়া আর কোনো মিল ছিল না। ভাষা-সংস্কৃতি একেবারেই আলাদা। বাঙালি মুসলমান নিজেকে বাঙালি ভাববে নাকি মুসলমান ভাববে—এই প্রশ্নের সমাধান করতে অনেকগুলো বছর পার করে দিয়েছিল। বাঙালি হয়েও যে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান হতে বাধা নেই, সে কথা উপলব্ধি করার পরই কেবল বাঙালি মুসলমান ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল। ইতিহাসের এই জায়গাটি বুঝতে না পারলে বিভ্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়।
আজ যাঁরা পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে মায়াকান্না কাঁদছেন, তাঁরা পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। বাঙালির প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণাই যে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতির একটি বড় নিয়ামক শক্তি, সে কথা একটু পড়াশোনা করলেই যে কেউ জানতে পারবে। সেই ইতিহাস কেউ কাউকে বিভ্রান্ত করার জন্য তৈরি করেনি। ব্রিটিশদের মতোই পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই দেখে এসেছে। বিরোধের সবচেয়ে বড় কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য হলেও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যকেও একই সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।
৪. পাকিস্তান আমলে যেসব আন্দোলন হয়েছে, তা ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির আলোকে সব ধর্ম ও মতের সংস্পর্শে আসা এক মিলনমেলা। জাতীয়তাবাদী চেতনার সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা গিয়েছিল সেই আন্দোলনে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন স্বাধীন বাংলাদেশে দেখা যায়নি। যে অঙ্গীকার নিয়ে মুক্ত দেশটি গড়ার কথা ছিল, তা আর গড়া যায়নি। দেশপ্রেম মানে যে দেশ ও দশের সেবা করেই দেশকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া, সে কথা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী এক নয়া সমীকরণ তৈরি হয়েছে। জাতিবিদ্বেষ ও ধর্মবিদ্বেষ প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। সাম্যের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মানুষ দিনে দিনে কমছে। এই ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মতলববাজ এসে ঢুকে পড়ছে জাতীয় রাজনীতিতে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের যে পথের কথা বলা হয়েছিল, সেই কাঙ্ক্ষিত পথে দেশ হাঁটছে কি না, সেই প্রশ্ন এখন অনেকেই করছেন। বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মধ্যেই আমাদের দেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু উপাদান ঢুকে পড়েছে, যা নিয়ে তরুণদের ভাবতে হবে। শর্ত মেনে লালন উৎসব করা, নাট্যোৎসব স্থগিত করে দেওয়া, অবাধে ভাঙচুর চালানোর স্বাধীনতা পাওয়া, নারীদের খেলাধুলায় হস্তক্ষেপ, মাজার ভাঙা, শোরুম উদ্বোধনে নারী অভিনয়শিল্পীদের বাধা দেওয়া ইত্যাদি আদতে কোন ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা নিয়ে ভাবা দরকার।
৫. ভাষার মাসে লেখাটি শুরু করেছিলাম স্মৃতির মিনারের কথা বলে। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সারা রাত ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্বে এই মিনার গড়ে তোলা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি তা খুলে দেওয়া হয়। স্মৃতির মিনারটি দেখতে হাজির হয় হাজার হাজার মানুষ। এই মিনারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে পাকিস্তান সরকার। এবং তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে।
১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ও মোহাম্মদ সুলতান কর্তৃক প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে একুশের গান হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি। পরের বছর থেকে প্রভাতফেরিতে এই গানই হয়ে ওঠে শহীদদের স্মরণ করার অমর সংগীত।
এ বছর গানটি সেভাবে কেন শোনা যাচ্ছে না, সেই প্রশ্ন কি কারও মনে উঠে এসেছে? আমরা যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা কি ঠিক পথে রওনা দিয়েছে? নাকি তা আমাদের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা করছে?
ইতিহাস তৈরি হয় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে। কেউ চাইলেই মনগড়া তথ্য দিয়ে ইতিহাসকে নির্মূল করতে পারে না। কিছুদিনের মতো তা ঢেকে দেওয়া যায় বটে, কিন্তু একসময় ইতিহাস তার জায়গাটি খুঁজে নেয়।
ভেঙে দেওয়া হয়েছিল শহীদ মিনার। তা আবার গড়ে উঠেছিল সেখানেই। তবে মূলত তা গড়ে উঠেছিল হৃদয়ে হৃদয়ে, নিজেদের ঠিকানা তৈরি করা হয়েছে ইতিহাসকে মনের গভীরে রেখেই।
ইতিহাসের পুনর্নিমাণ যদি তথ্য-উপাত্তভিত্তিক না হয়, তাহলে তা টিকে থাকে না। টিকে থাকে শাশ্বত সংগ্রামের মাধ্যমে আনা মুক্তি এবং মুক্তির স্বপ্ন।
১৯৭১ সালেও শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘মসজিদ’ লিখে বিজ্ঞপ্তি টানিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধর্মপ্রাণ মানুষের এই দেশে তা টেকেনি। সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল শহীদ মিনার।
শহীদ মিনার আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে থাকবে কি না, গুঁড়িয়ে দিলেই তা মন থেকে মুছে যায় কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে আগামী দিনের নাগরিকেরা। তাদের দিকেই তো তাকিয়ে আছে গোটা বাংলাদেশ।
লেখক: উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা
এবারের মার্চ মাসটাকে কীভাবে দেখা হবে? কে কীভাবে দেখবে? উন্মাতাল এই শহরের ফুঁসে ওঠা দেখে শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন ৩ মার্চের ইত্তেফাকের শিরোনাম করেছিলেন ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন’।
২ ঘণ্টা আগেএবার সিডনির বইমেলায়ও মানুষের সমাগম কম হয়েছে। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত মেলাটিতে ছিল সামান্যসংখ্যক মানুষ। পরদিন রোববার দীর্ঘকালের মেলাটি গতবারের মতো মানুষ টানতে পারেনি। আমি যখন মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে পৌঁছাই, তখন যা দেখেছি তাতে এটা বলা চলে যে মানুষ আগের মতো আসেনি।
২ ঘণ্টা আগেকতভাবে যে লুটপাটের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন চলছে, তার হিসাব কোনো জ্যোতিষী হিসাববিজ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিও করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ২৪ ফেব্রুয়ারি আজকের পত্রিকায় ‘২০০ বছরের মাঠ কেটে পুকুর, উজাড় গাছও’ শিরোনামের খবরটি পড়লে...
২ ঘণ্টা আগেড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। বর্তমানে তিনি বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন...
১ দিন আগে