মো. হাবিবুর রহমান
রাজনীতি কখনোই কেবল নীতি আর আদর্শের খেলা ছিল না, বিশেষত যখন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এবং স্বার্থ পরিপূর্ণ করাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এমন সময় প্রবাদ-প্রবচন বাস্তবের আয়না হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, ‘দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না’—এই বাক্যটি যেন সমসাময়িক রাজনীতির প্রতিটি স্তরে অনুরণিত হয়।
এই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছলনার রূপ বহুমাত্রিক। একদিকে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে নাটক, অন্যদিকে বিরোধী কণ্ঠরোধের অভিনব কৌশল। যেমনটি বলা যায়—‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি’—যেখানে যিনি সত্য উচ্চারণ করেন, তাঁকেই যেন দোষারোপ করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ দেখে অনেক সময় বোঝা যায় না কারা আসলে জনগণের পক্ষে, আর কারা নিজের কৌশলের পক্ষে।
আজকের বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে জনমনে ভয়, সংশয় আর অবিশ্বাস গভীর হয়েছে। প্রচারমাধ্যমে একরকম বাস্তবতা, মাঠে-ময়দানে আরেক রকম—যেন ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ গোছের এক ছলচাতুরীর খেল। সরকার বলে তারা গণতান্ত্রিক, কিন্তু বিরোধীদের কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। বিরোধীরা বলে তারা নিপীড়িত, কিন্তু নিজেরাও ক্ষমতায় গেলে ঠিক একই পথ অনুসরণ করে। ফলে সাধারণ জনগণের প্রশ্ন: তাহলে পার্থক্য কোথায়?
এই রাজনীতিতে কৌশল যেমন মুখ্য, তেমনি ছলনারও অভাব নেই। সামাজিক মাধ্যমে গুজব, তথ্য বিকৃতি এবং সাজানো ‘জনমত’ তৈরি এখন রীতিমতো শিল্প। যেন ‘দুধ-কলায় কালনাগিনী’—যেখানে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিষ ছড়ানো হয়। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে যারা শাসন করে, তাদের নীতিহীন ক্ষমতালিপ্সা বোঝা যায় যখন মানুষের মৌলিক অধিকারই খর্ব হতে থাকে।
এ দেশের রাজনীতিতে প্রবচনের সত্যতা আরও বোঝা যায় যখন দেখা যায়—‘আপন গুণে ধ্বংস’। অতীতের বহু শক্তিশালী শাসক বা দল নিজেদের ছলনায় নিজেই পতিত হয়েছে। দুর্নীতির অজুহাতে ক্ষমতায় আসা দলই পরিণামে দুর্নীতির মহাবিস্তার ঘটায়। জনগণ ধোঁকা খায়, আবারও আশায় বুক বাঁধে, আবারও ছলনার শিকার হয়।
তবু প্রশ্ন থাকে—এই ছলনার রাজনীতি কি অনন্তকাল চলবে? নাকি কোনো দিন জনগণ সত্যিকারের জবাবদিহির দাবি জানাবে এবং সব মুখোশ খুলে যাবে?
দুই. এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ছলনার ইতিহাস পুরোনো। ব্রিটিশ শাসনের সময়েও যাঁরা জনগণের বন্ধু সেজেছিল, অনেক সময় তাঁরাই ছিল ইংরেজদের চুপিচুপি সহযোগী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও কিছু মানুষ মুক্তির গান গেয়ে পর্দার আড়ালে পাকিস্তানি সেনার চর ছিল। আজ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর, সেই ছলনার ধারা যেন আরও পাকা, আরও প্রযুক্তিসম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমান রাজনীতিতে ক্ষমতার ভাষা হলো ‘উন্নয়ন’, আর প্রতিপক্ষকে দমন করার নাম ‘আইনের প্রয়োগ’। ভোট না হলে বলা হয়, মানুষ উন্নয়ন চায়; বিরোধী দল দমন করলে বলা হয়, তারা বিশৃঙ্খলা চাইছে। বাস্তবে দেখা যায়, ‘অন্ধের হাতি দেখার মতো’—প্রতিটি পক্ষ কেবল নিজের সুবিধার দৃষ্টিকোণ থেকে দেশ ও জনগণকে ব্যাখ্যা করে।
এই ছলনায় আমরা দেখেছি কীভাবে গণতন্ত্রের নামে ভীতিপ্রদর্শন চলে, আর সংবিধান রক্ষার নামে সংবিধানই পদদলিত হয়। যখন কেউ প্রশ্ন তোলে, তখন তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানানো হয়। আবার গণতন্ত্র রক্ষার নামে যে পক্ষ বিক্ষোভে নামে, তার অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা থাকে না। ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ যেমন দূর থেকে লোভনীয় কিন্তু বাস্তবে অপাপবিদ্ধ—আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো তেমনই।
একসময় যাঁরা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, আজ তাঁদের অনেকেই গদি আঁকড়ে ধরে বসে আছেন—স্বাধীনতা মানে যেন শুধুই ক্ষমতায় টিকে থাকা। আর যাঁরা অতীতে জনগণের পক্ষে কথা বলেছেন, তাঁরাও ক্ষমতার সুযোগ পেয়ে জনগণের কথা ভুলে গেছেন। ‘আপন গুণে ধ্বংস’—এই প্রবচনের নির্মম সত্যতা আমরা একের পর এক রাজনৈতিক পতনের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি।
তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়—এই জাতি কি শুধু ছলনায় বাঁচবে? প্রতিবার নতুন মুখোশ, নতুন আশ্বাসে বিভ্রান্ত হবে? নাকি কোনো দিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবে? ইতিহাস বলে, দীর্ঘ সময় ছলনার রাজনীতি টেকে না। জনগণ সব সময় চুপ করে থাকে না। যখন তারা জেগে ওঠে, তখন সবচেয়ে সুপরিকল্পিত মুখোশও খুলে পড়ে।
এখনো সময় আছে। যাঁরা সত্যিকার অর্থে জনতার রাজনীতি করতে চান, তাঁদের দরকার নৈতিক সাহস। দরকার মুখোশ খুলে জনগণের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি। নইলে এই দেশের প্রবাদগুলো শুধু ভাষার অলংকার হয়ে থাকবে না—তা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী।
তিন. এই সময়ের রাজনীতি আর কেবল বক্তৃতা ও সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এখন রাজনীতি চলে ডিজিটাল পর্দার পেছনে—ডেটা ম্যানিপুলেশন, ভুয়া ট্রেন্ড, আর সাজানো জনমত তৈরির কারখানায়। ‘ছলনা’ শব্দটির আজ নতুন চেহারা। এমন এক চেহারা, যেখানে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রভাব পড়ে মন ও বোধে।
নতুন প্রজন্মের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে একরকম প্রস্তুত করা সংস্করণ—কারা দেশদ্রোহী, কারা রাষ্ট্রদ্রোহী, কারা উন্নয়নের শত্রু। অনেকেই বুঝে ওঠার আগেই একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যার গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ে। যেন ‘সাপের মুখে ব্যাঙ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, কেঁচো খাচ্ছে’—বাস্তবতা এত বিকৃত করে দেখানো হয় যে সত্য-মিথ্যার ফারাক করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষপাতিত্ব। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি বিচারব্যবস্থার একাংশ—সবই যেন নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে পক্ষপাতিত্বের নাচ করে। ‘ঢাকের কাঠি যার হাতে, বাজে তারই তাল’—এমন প্রবচনের যথার্থ রূপ আমরা দেখতে পাই যখন এক পক্ষ অপর পক্ষকে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে।
এই রাজনৈতিক থিয়েটারে সাধারণ মানুষ শুধুই দর্শক নয়, অনেক সময় তারা হয় বলি। ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’—আশা, প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন, উন্নয়নের বুলি—সবই তাদের জন্য, কিন্তু ফল ভোগ করে কেবল ওপরের একটি অংশ। বরং কষ্ট বাড়ে, চাপ বাড়ে, বাক্স্বাধীনতা কমে, জীবনের দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন আজ অতীত মনে হয়। আদর্শের কথা বললেই তাঁকে বলা হয় অবাস্তববাদী। যিনি আপসহীন, তাঁকে বলা হয় পাগল বা ষড়যন্ত্রী। ফলে রাজনীতিতে যাঁরা বেঁচে থাকতে চান, তাঁদের প্রয়োজন হয় ছলনা শিখে নেওয়ার। এক ছলনার চক্র, যেখানে কেউই সম্পূর্ণ নির্দোষ নয়। যেন ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’—জনগণ পালানোর জায়গা খুঁজে পায় না।
কিন্তু ছলনা চিরকাল টেকে না। যে সমাজ চুপচাপ সহ্য করে, তার মধ্যে ক্রমেই জমে ওঠে বিক্ষোভ, ধৈর্যের ভেতরে জন্ম নেয় জেদ। ইতিহাস সাক্ষী যে ‘সময় থাকতে সতর্ক না হলে, কাল সময়ই শাস্তি দেয়।’ এই দেশের রাজনীতি যদি সত্যিকারের জবাবদিহি ও নৈতিকতায় না ফেরে, তবে একসময় মুখোশ ছিঁড়ে মুখ বেরিয়েই পড়বে। তখন ক্ষমতা, প্রচার, কিংবা বাহিনীর সহায়তা কোনো কাজে আসবে না।
চার. প্রতিটি যুগের নিজস্ব ছলনা থাকে। কিন্তু কিছু সময় আসে, যখন সেই ছলনা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, যখন মুখোশ আর টেকে না, তখন সত্য সামনে এসে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের রাজনীতিও এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—যেখানে দীর্ঘদিনের মুখোশধারী শাসনের ক্লান্তি, প্রবচনের মতো সত্যিকারের হুঁশিয়ারি হয়ে উঠেছে।
আমরা দেখেছি, কীভাবে ‘দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না’—এই প্রবাদ শুধুই কথার অলংকার নয়, বাস্তব রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, কীভাবে ‘ঢাকের কাঠি যার হাতে, বাজে তারই তাল’—রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূল করা হয়েছে। এবং আমরা অনুভব করেছি, ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’-এর মতো একটি জাতির নাগরিকদের কেবল আশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে, বাস্তব উন্নয়নের ভাগ না দিয়ে।
এই উপসংহার কেবল একটি পর্যবেক্ষণ নয়, এটি একটি অনুসন্ধান—আমরা কি চিরকাল এই ছলনা মেনে নেব? নাকি একদিন আমরা ‘সত্যের মুখোশ নয়, মুখ’ চেয়ে উঠব?
আমরা বুঝে গেছি, ন্যায়ের পক্ষে থাকার জন্য কেবল সাহস নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক নৈতিকতা, নেতৃত্বে স্বচ্ছতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ভবিষ্যতের রাজনীতি যদি সত্যিকারের মুক্তি ও উন্নয়ন দিতে চায়, তবে তার প্রথম কাজ হবে এই ছলনার যুগের অবসান ঘটানো।
সত্য প্রতিষ্ঠার শক্তি অনেক সময় ধীরে আসে, কিন্তু যখন আসে, তখন তা ইতিহাস বদলে দেয়। আমাদের সামনে এখন সে সময় উপস্থিত—চিরস্থায়ী ছলনার রাজনীতি ভেঙে ফেলার সময়। মুখোশ খুলে ফেলার সময়।
রাজনীতি কখনোই কেবল নীতি আর আদর্শের খেলা ছিল না, বিশেষত যখন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় এবং স্বার্থ পরিপূর্ণ করাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এমন সময় প্রবাদ-প্রবচন বাস্তবের আয়না হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, ‘দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না’—এই বাক্যটি যেন সমসাময়িক রাজনীতির প্রতিটি স্তরে অনুরণিত হয়।
এই দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছলনার রূপ বহুমাত্রিক। একদিকে জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে নাটক, অন্যদিকে বিরোধী কণ্ঠরোধের অভিনব কৌশল। যেমনটি বলা যায়—‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি’—যেখানে যিনি সত্য উচ্চারণ করেন, তাঁকেই যেন দোষারোপ করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ দেখে অনেক সময় বোঝা যায় না কারা আসলে জনগণের পক্ষে, আর কারা নিজের কৌশলের পক্ষে।
আজকের বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে জনমনে ভয়, সংশয় আর অবিশ্বাস গভীর হয়েছে। প্রচারমাধ্যমে একরকম বাস্তবতা, মাঠে-ময়দানে আরেক রকম—যেন ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ গোছের এক ছলচাতুরীর খেল। সরকার বলে তারা গণতান্ত্রিক, কিন্তু বিরোধীদের কণ্ঠরোধে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে। বিরোধীরা বলে তারা নিপীড়িত, কিন্তু নিজেরাও ক্ষমতায় গেলে ঠিক একই পথ অনুসরণ করে। ফলে সাধারণ জনগণের প্রশ্ন: তাহলে পার্থক্য কোথায়?
এই রাজনীতিতে কৌশল যেমন মুখ্য, তেমনি ছলনারও অভাব নেই। সামাজিক মাধ্যমে গুজব, তথ্য বিকৃতি এবং সাজানো ‘জনমত’ তৈরি এখন রীতিমতো শিল্প। যেন ‘দুধ-কলায় কালনাগিনী’—যেখানে শান্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিষ ছড়ানো হয়। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে যারা শাসন করে, তাদের নীতিহীন ক্ষমতালিপ্সা বোঝা যায় যখন মানুষের মৌলিক অধিকারই খর্ব হতে থাকে।
এ দেশের রাজনীতিতে প্রবচনের সত্যতা আরও বোঝা যায় যখন দেখা যায়—‘আপন গুণে ধ্বংস’। অতীতের বহু শক্তিশালী শাসক বা দল নিজেদের ছলনায় নিজেই পতিত হয়েছে। দুর্নীতির অজুহাতে ক্ষমতায় আসা দলই পরিণামে দুর্নীতির মহাবিস্তার ঘটায়। জনগণ ধোঁকা খায়, আবারও আশায় বুক বাঁধে, আবারও ছলনার শিকার হয়।
তবু প্রশ্ন থাকে—এই ছলনার রাজনীতি কি অনন্তকাল চলবে? নাকি কোনো দিন জনগণ সত্যিকারের জবাবদিহির দাবি জানাবে এবং সব মুখোশ খুলে যাবে?
দুই. এই উপমহাদেশের রাজনীতিতে ছলনার ইতিহাস পুরোনো। ব্রিটিশ শাসনের সময়েও যাঁরা জনগণের বন্ধু সেজেছিল, অনেক সময় তাঁরাই ছিল ইংরেজদের চুপিচুপি সহযোগী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও কিছু মানুষ মুক্তির গান গেয়ে পর্দার আড়ালে পাকিস্তানি সেনার চর ছিল। আজ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর, সেই ছলনার ধারা যেন আরও পাকা, আরও প্রযুক্তিসম্পন্ন হয়েছে।
বর্তমান রাজনীতিতে ক্ষমতার ভাষা হলো ‘উন্নয়ন’, আর প্রতিপক্ষকে দমন করার নাম ‘আইনের প্রয়োগ’। ভোট না হলে বলা হয়, মানুষ উন্নয়ন চায়; বিরোধী দল দমন করলে বলা হয়, তারা বিশৃঙ্খলা চাইছে। বাস্তবে দেখা যায়, ‘অন্ধের হাতি দেখার মতো’—প্রতিটি পক্ষ কেবল নিজের সুবিধার দৃষ্টিকোণ থেকে দেশ ও জনগণকে ব্যাখ্যা করে।
এই ছলনায় আমরা দেখেছি কীভাবে গণতন্ত্রের নামে ভীতিপ্রদর্শন চলে, আর সংবিধান রক্ষার নামে সংবিধানই পদদলিত হয়। যখন কেউ প্রশ্ন তোলে, তখন তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানানো হয়। আবার গণতন্ত্র রক্ষার নামে যে পক্ষ বিক্ষোভে নামে, তার অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা থাকে না। ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ যেমন দূর থেকে লোভনীয় কিন্তু বাস্তবে অপাপবিদ্ধ—আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলো তেমনই।
একসময় যাঁরা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, আজ তাঁদের অনেকেই গদি আঁকড়ে ধরে বসে আছেন—স্বাধীনতা মানে যেন শুধুই ক্ষমতায় টিকে থাকা। আর যাঁরা অতীতে জনগণের পক্ষে কথা বলেছেন, তাঁরাও ক্ষমতার সুযোগ পেয়ে জনগণের কথা ভুলে গেছেন। ‘আপন গুণে ধ্বংস’—এই প্রবচনের নির্মম সত্যতা আমরা একের পর এক রাজনৈতিক পতনের মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি।
তবু একটা প্রশ্ন থেকে যায়—এই জাতি কি শুধু ছলনায় বাঁচবে? প্রতিবার নতুন মুখোশ, নতুন আশ্বাসে বিভ্রান্ত হবে? নাকি কোনো দিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবে? ইতিহাস বলে, দীর্ঘ সময় ছলনার রাজনীতি টেকে না। জনগণ সব সময় চুপ করে থাকে না। যখন তারা জেগে ওঠে, তখন সবচেয়ে সুপরিকল্পিত মুখোশও খুলে পড়ে।
এখনো সময় আছে। যাঁরা সত্যিকার অর্থে জনতার রাজনীতি করতে চান, তাঁদের দরকার নৈতিক সাহস। দরকার মুখোশ খুলে জনগণের সামনে দাঁড়ানোর শক্তি। নইলে এই দেশের প্রবাদগুলো শুধু ভাষার অলংকার হয়ে থাকবে না—তা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী।
তিন. এই সময়ের রাজনীতি আর কেবল বক্তৃতা ও সভা-সমাবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এখন রাজনীতি চলে ডিজিটাল পর্দার পেছনে—ডেটা ম্যানিপুলেশন, ভুয়া ট্রেন্ড, আর সাজানো জনমত তৈরির কারখানায়। ‘ছলনা’ শব্দটির আজ নতুন চেহারা। এমন এক চেহারা, যেখানে চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রভাব পড়ে মন ও বোধে।
নতুন প্রজন্মের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে একরকম প্রস্তুত করা সংস্করণ—কারা দেশদ্রোহী, কারা রাষ্ট্রদ্রোহী, কারা উন্নয়নের শত্রু। অনেকেই বুঝে ওঠার আগেই একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যার গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ে। যেন ‘সাপের মুখে ব্যাঙ ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, কেঁচো খাচ্ছে’—বাস্তবতা এত বিকৃত করে দেখানো হয় যে সত্য-মিথ্যার ফারাক করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষপাতিত্ব। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, এমনকি বিচারব্যবস্থার একাংশ—সবই যেন নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে পক্ষপাতিত্বের নাচ করে। ‘ঢাকের কাঠি যার হাতে, বাজে তারই তাল’—এমন প্রবচনের যথার্থ রূপ আমরা দেখতে পাই যখন এক পক্ষ অপর পক্ষকে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে।
এই রাজনৈতিক থিয়েটারে সাধারণ মানুষ শুধুই দর্শক নয়, অনেক সময় তারা হয় বলি। ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’—আশা, প্রতিশ্রুতি, স্বপ্ন, উন্নয়নের বুলি—সবই তাদের জন্য, কিন্তু ফল ভোগ করে কেবল ওপরের একটি অংশ। বরং কষ্ট বাড়ে, চাপ বাড়ে, বাক্স্বাধীনতা কমে, জীবনের দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক নৈতিকতার প্রশ্ন আজ অতীত মনে হয়। আদর্শের কথা বললেই তাঁকে বলা হয় অবাস্তববাদী। যিনি আপসহীন, তাঁকে বলা হয় পাগল বা ষড়যন্ত্রী। ফলে রাজনীতিতে যাঁরা বেঁচে থাকতে চান, তাঁদের প্রয়োজন হয় ছলনা শিখে নেওয়ার। এক ছলনার চক্র, যেখানে কেউই সম্পূর্ণ নির্দোষ নয়। যেন ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’—জনগণ পালানোর জায়গা খুঁজে পায় না।
কিন্তু ছলনা চিরকাল টেকে না। যে সমাজ চুপচাপ সহ্য করে, তার মধ্যে ক্রমেই জমে ওঠে বিক্ষোভ, ধৈর্যের ভেতরে জন্ম নেয় জেদ। ইতিহাস সাক্ষী যে ‘সময় থাকতে সতর্ক না হলে, কাল সময়ই শাস্তি দেয়।’ এই দেশের রাজনীতি যদি সত্যিকারের জবাবদিহি ও নৈতিকতায় না ফেরে, তবে একসময় মুখোশ ছিঁড়ে মুখ বেরিয়েই পড়বে। তখন ক্ষমতা, প্রচার, কিংবা বাহিনীর সহায়তা কোনো কাজে আসবে না।
চার. প্রতিটি যুগের নিজস্ব ছলনা থাকে। কিন্তু কিছু সময় আসে, যখন সেই ছলনা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, যখন মুখোশ আর টেকে না, তখন সত্য সামনে এসে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের রাজনীতিও এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে—যেখানে দীর্ঘদিনের মুখোশধারী শাসনের ক্লান্তি, প্রবচনের মতো সত্যিকারের হুঁশিয়ারি হয়ে উঠেছে।
আমরা দেখেছি, কীভাবে ‘দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না’—এই প্রবাদ শুধুই কথার অলংকার নয়, বাস্তব রাজনৈতিক কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, কীভাবে ‘ঢাকের কাঠি যার হাতে, বাজে তারই তাল’—রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূল করা হয়েছে। এবং আমরা অনুভব করেছি, ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’-এর মতো একটি জাতির নাগরিকদের কেবল আশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে, বাস্তব উন্নয়নের ভাগ না দিয়ে।
এই উপসংহার কেবল একটি পর্যবেক্ষণ নয়, এটি একটি অনুসন্ধান—আমরা কি চিরকাল এই ছলনা মেনে নেব? নাকি একদিন আমরা ‘সত্যের মুখোশ নয়, মুখ’ চেয়ে উঠব?
আমরা বুঝে গেছি, ন্যায়ের পক্ষে থাকার জন্য কেবল সাহস নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক নৈতিকতা, নেতৃত্বে স্বচ্ছতা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ভবিষ্যতের রাজনীতি যদি সত্যিকারের মুক্তি ও উন্নয়ন দিতে চায়, তবে তার প্রথম কাজ হবে এই ছলনার যুগের অবসান ঘটানো।
সত্য প্রতিষ্ঠার শক্তি অনেক সময় ধীরে আসে, কিন্তু যখন আসে, তখন তা ইতিহাস বদলে দেয়। আমাদের সামনে এখন সে সময় উপস্থিত—চিরস্থায়ী ছলনার রাজনীতি ভেঙে ফেলার সময়। মুখোশ খুলে ফেলার সময়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশের মানুষ একটি ভালো পরিবর্তনের আশা করেছিল। মানুষ চেয়েছিল একটি দায়িত্বশীল, সৎ ও বৈষম্যহীন সরকার। যেহেতু কোনো বিশেষ বা একক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নয়, পরিবর্তনটা এসেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে, সেহেতু পরিবর্তিত বাস্তবতায় ন্যায্য
৭ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা আজ এক গভীর সংকটে নিপতিত, যেখানে শিক্ষাবৈষম্য কেবল আর্থিক সামর্থ্যের নয়, বরং সামাজিক শ্রেণি, অবস্থান ও সংস্কৃতি দ্বারা পরিচালিত একটি গভীর রূপ ধারণ করেছে। যে শিক্ষা একসময় একটি সমতার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হতো, তা এখন একশ্রেণির মানুষের জন্য দুর্লভ ও ব্যয়বহুল পণ্য হয়ে
৭ ঘণ্টা আগেকয়েক মাস ধরে রাজধানী ঢাকায় একের পর এক আন্দোলন চলছে। একটা আন্দোলনের দাবি মেনে নেওয়া হলে শুরু হয় অন্য দাবির আরেক আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালে সড়কে যানজট লেগে থাকা যেন অতি সাধারণ ব্যাপার! এই অবস্থায় নগরবাসীর চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, গন্তব্যে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়, জ্যামে আটকে অ্যাম্বুলেন্সের মুমূর্ষু রোগীর কী হাল হয়—
৮ ঘণ্টা আগেপারফিউম মেকার ইলিয়াস নতুন নতুন সুগন্ধি নিয়ে প্রায়ই আমার অফিসে আসেন। গত সপ্তাহে এলেন একটা খুশির খবর জানাতে। তিনি সুগন্ধি তৈরির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের একটা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছেন। গত ঈদুল ফিতরের আগে তাঁর সুগন্ধি বানানোর প্রক্রিয়া নিয়ে একটা অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠান দেখেই নাকি ওই প্রতি
১ দিন আগে