Ajker Patrika

সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান: জেনারেল জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা

হাসানুল হক ইনু
আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২১, ০৯: ৩৩
সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান: জেনারেল জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এই দিনের মহানায়ক ছিলেন বীর উত্তম কর্নেল আবু তাহের। খলনায়ক ছিলেন বিশ্বাসঘাতক জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিদ্রোহের বিরুদ্ধে অনেক রকম আলোচনা-সমালোচনা হয়ে থাকে। আমি প্রথমেই বলতে চাই যে এটা সৈনিক হত্যা দিবসও না, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবসও না, অফিসার হত্যা দিবসও না অথবা জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসও না। যাঁরা ওইভাবে বলার চেষ্টা করেন, তাঁরা কার্যত ইতিহাসকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। অবশ্য দেরিতে হলেও ধামাচাপা দেওয়া সত্য আজ প্রকাশিত হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে এখন সবাই সুস্পষ্টভাবে বলছেন, কারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, কারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেছে, কারা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারী তথা মেজর ডালিম-ফারুক-রশীদ গংয়ের নিরাপদে দেশত্যাগ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে, তা সবই প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এমনকি খালেদ মোশাররফকে কার নির্দেশে, কোন অফিসাররা হত্যা করেছে, খোদ খালেদ মোশাররফের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের নামও প্রকাশ করা হয়েছে।

উল্লেখ থাকে যে, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার—এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ৭ তারিখ সকাল বেলা দুজন ক্যাপ্টেন র‍্যাঙ্কের মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। এ ব্যাপারে খালেদ মোশাররফের পরিবার নামধাম দিয়ে সব প্রকাশ করেছে। খালেদ মোশাররফের পক্ষে যেসব অফিসার ছিলেন, তাঁরা বিভিন্ন লেখায় এ বিষয়গুলো প্রকাশ করেছেন।

১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা, ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দমন, খালেদ মোশাররফ হত্যা, জিয়ার শাসনকালে কর্নেল তাহেরকে সাজানো মিথ্যা মামলায় বিচারের নামে প্রহসনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা, সেনানিবাসে শত শত অফিসার হত্যার তদন্ত হওয়া দরকার। সব সত্য উদ্‌ঘাটন করা দরকার। সে জন্য আমি মনে করি, জাতীয় সত্য  উদ্‌ঘাটন কমিশন গঠন করা বাংলাদেশের জন্য বাঞ্ছনীয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যা ও চার জাতীয় নেতা হত্যার পর দেশে যে রাজনৈতিক সংকট ও শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা দূর করতে ৭ নভেম্বর শহীদ কর্নেল আবু তাহের ও জাসদের নেতৃত্বে এবং সমর্থনে ঐতিহাসিক বিপ্লবী অভ্যুত্থানচেষ্টা ইতিহাসের গতি পরিবর্তনের একটা সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু জেনারেল জিয়া ও তাঁর সহযোগী পাকিস্তানপন্থী অফিসার এবং দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী সেই মহান বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে দমন করে দেশকে পাকিস্তানি ধারায় প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে ঠেলে দেয়। জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে শুরু করে।

৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান কেন ঘটল এবং কী জন্য ঘটল? এ ব্যাপারে আমি বলব, ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, অবৈধ ক্ষমতা দখল, সংবিধান লঙ্ঘন, সামরিক শাসন জারি, ক্ষমতার উচ্চাভিলাষী অফিসারদের পাগলা কুকুরের মতো কামড়াকামড়ি বন্ধ করতে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে এবং সেনাবাহিনীসহ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে ৭ তারিখের সিপাহি বিদ্রোহটা একটা মহান প্রচেষ্টা ছিল।

সিপাহি বিদ্রোহ তো হুট করে হয়নি। এর একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল। সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা কী? ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অবৈধ ক্ষমতা দখল এবং সামরিক শাসন জারি করে উচ্ছৃঙ্খল খুনি চক্র ক্যান্টনমেন্টকে কার্যত বিভক্ত করেছিল। এর ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো অবৈধ ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। সেদিন দিবাগত রাতে জেলহত্যাকাণ্ড ঘটে যায়। তারপর খালেদ মোশাররফের সরাসরি ব্যবস্থাপনায় এবং জেনারেল ওসমানীর মধ্যস্থতায় বঙ্গবন্ধুর খুনিসহ ২৯ জনকে বাংলাদেশ ত্যাগ করে থাইল্যান্ডে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শায়েস্তা করার জন্য নয়, নিজে ক্ষমতা দখলের জন্য খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান করেছিলেন। খুনি খন্দকার মোশতাককে আটক করা তো দূরের কথা, তাঁর সঙ্গেই যোগসাজশ করে নিজে সেনাপ্রধানের ব্যাজ লাগান।

সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নাম করে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে বন্দী করে সাংবিধানিক সরকার গঠনের দিকে না হেঁটে খালেদ মোশাররফ নিজেই ১৫ আগস্টের পরে আরেকবার চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করেন। খালেদ মোশাররফ বলপ্রয়োগ করে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন এবং খন্দকার মোশতাককে দিয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়েও সশস্ত্র বাহিনীতে তাঁর পুরো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হন; বরং সশস্ত্র বাহিনীকে বিভক্ত করে আরও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেন। খালেদ মোশাররফের ক্ষমতায়নের পর সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকেরা একে অপরের দিকে বন্দুক তাক করে গৃহযুদ্ধের অবস্থা তৈরি করেন। রক্তগঙ্গা বইয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করলেও দেশের সরকার গঠনে বিলম্ব করেন এবং ৩ থেকে ৬ নভেম্বর দেশে বাস্তবে কোনো সরকার ছিল না। রেডিও-টেলিভিশনের প্রচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খালেদ মোশাররফ পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে বলপ্রয়োগের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ১৫ আগস্টে খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী বিভক্ত হয় এবং খুনিরা নিয়ম ভঙ্গ করে বঙ্গভবনে তাদের অনুগত সৈনিকদের নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে। ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনীকে সেনাপ্রধানের আওতার বাইরে খুনিদের আওতায় রাখা হয়। অথচ নতুন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। ক্যান্টনমেন্ট সৈনিকদের নিরাপদ আস্তানার বদলে ক্ষমতালোভী অফিসারদের আস্তানায় পরিণত হয়। এ অবস্থায় খালেদ মোশাররফের ৩ নভেম্বর ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র বাহিনীতে কোর (Core) ও ইনফেন্ট্রি বা পদাতিক বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ৩ নভেম্বর ফোর্থ বেঙ্গল দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন খালেদ মোশাররফ। ৬৪ জন অফিসারকে তিনি তড়িঘড়ি করে পদোন্নতি দেন। বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক সরকারকে পুনর্বহাল করার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে খালেদ মোশাররফ নিজে ক্ষমতা দখল করার জন্য জেনারেল জিয়াকে বন্দী করেন এবং পার্লামেন্ট বাতিল করে দেন। তিনি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সায়েমকে নিয়ম ভঙ্গ করে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। জেলখানায় জাতীয় চার নেতা, যাঁরা ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরও নেতা, যাঁদের খন্দকার মোশতাক বন্দী করেছিলেন, তাঁদের নিরাপত্তার দিকে তাঁর কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। খালেদ মোশাররফের সহায়তায় খুনি চক্র দেশত্যাগ করলেও তাদের অনুগত আট শতাধিক সৈনিক বাংলাদেশে রেখে যায়। এরা সেনাবাহিনীর ভেতরে একটা দুষ্টচক্র হিসেবে থেকে যায়। তারাও একটা সমস্যা ক্যান্টনমেন্টে তৈরি করে বসে। অন্যদিকে খালেদ মোশাররফের ক্ষমতা দখলের পরে জেনারেল জিয়া কাপুরুষের মতো এটাকে মোকাবিলা না করে পদত্যাগপত্র দেন এবং পেনশনের টাকার জন্য দেনদরবার শুরু করেন খালেদের সঙ্গে। এসব ঘটনা পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলে। খালেদ মোশাররফ অবশেষে স্কেল এ অ্যালার্ট জারি করেন। এই অ্যালার্ট জারি করা মানে হচ্ছে, তিনি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য বলপ্রয়োগ করবেন। ৫ নভেম্বর রংপুর থেকে টেন্থ বেঙ্গল ঢাকায় নিয়ে আসেন। মেজর নওয়াজিশ ও বাহাত্তর ব্রিগেড কর্নেল হুদার নেতৃত্বে ঢাকায় চলে আসে। এই সবকিছুই উত্তেজনা তৈরি করে।

হাসানুল হক ইনু। এ অবস্থায় জিয়ার অনুরোধে নারায়ণগঞ্জে অবস্থানরত সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া কর্নেল তাহের বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলায় আনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

উল্লেখ্য, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে একটি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কাজ চালু ছিল। এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা অসহায় সৈনিকদের শৃঙ্খলার ভেতর রাখার জন্য এবং পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে গোলাগুলি না করার জন্য শুরু থেকেই উদ্যোগ নিয়েছিল। 

সিপাহি বিদ্রোহ হয় কেন? 
১. গৃহযুদ্ধ থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে রক্ষার জন্য। 
২. সশস্ত্র বাহিনীতে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতালোভী অফিসারদের কাছ থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে রক্ষার জন্য।
৩. বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে।
৪. বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনি ও অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে উদ্ধার করার জন্য।
৫. সাংবিধানিক ধারায় বাংলাদেশকে আবার ফেরত আনার জন্য।
৬. রাজনীতিবিদদের দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য। 
৭. ঔপনিবেশিক চালচলন, রীতিনীতি, আইনকানুন পরিবর্তন করার জন্য।

ওপরের লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে ও জাসদের সমর্থনে অবশেষে ৬ নভেম্বর গভীর রাতে অর্থাৎ ৭ নভেম্বর ভোরে সিপাহি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়।

সিপাহি বিদ্রোহ কতটুকু সফল?
সিপাহি বিদ্রোহ গৃহযুদ্ধ ঠেকাতে সফল হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টে রক্তগঙ্গা বন্ধে সফল হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর খুনি ও সামরিক চক্রান্তকারীদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে এবং ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সফল হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাকের পুনরায় ক্ষমতা দখল বানচাল করতে সফল হয়েছে।

৭ নভেম্বরের ব্যর্থতা কী? 
সিপাহি বিদ্রোহ সাংবিধানিক শাসন ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। জিয়ার সমর্থক অফিসারদের চক্রান্ত বানচাল করতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশ আবার জিয়ার সামরিক শাসনের বেড়াজালে আটকা পড়েছে। সিপাহি বিদ্রোহের গতি-প্রকৃতির ওপর কর্নেল তাহের ও সৈনিক সংস্থা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হওয়ায় ৮ নভেম্বর থেকেই পুরো পরিস্থিতির ওপর জেনারেল জিয়া ও সামরিক অফিসাররা পূর্ণকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় সফল হন। কর্নেল তাহেরের সহায়তায় বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে জেনারেল জিয়া উল্টো তাঁর ত্রাতাদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। ২৩ নভেম্বর আমাকে, সদ্য মুক্ত আ স ম আবদুর রব, মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার করে। ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে গ্রেপ্তার করে।

সিপাহিদের এই যে মহান প্রচেষ্টা, তা সম্পূর্ণ সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। কিন্তু ৭ নভেম্বর সার্বিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও দেশপ্রেমিক সিপাহিদের এক মহৎ উদ্যোগ ও বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড ছিল।

কর্নেল তাহের ও জাসদ পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখতে না পারার জন্য জিয়ার চক্রান্ত সফল হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ৭ তারিখের সিপাহি বিদ্রোহের চেষ্টাটা ম্লান হয়ে যায়। আমি তুলনা করছি এভাবে, নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতনের পর খালেদা জিয়ার ক্ষমতায়ন শেখ হাসিনাসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির ক্ষমতা দখলের ব্যর্থতা গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের অন্যায্যতা প্রমাণ করে না বা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ম্লান হয়ে যায় না। ইতিহাসে অনেক ঘটনাই ঘটে। যে ঘটনা পরিপূর্ণতা পায় না। মোদ্দাকথা হলো, সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানচেষ্টা কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না, কোনো চক্রান্ত ছিল না, এককভাবে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টাও ছিল না। এটি একটি দেশপ্রেমিক উদ্যোগই ছিল।

লেখক:  এমপি, সাবেক মন্ত্রী, সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষায় নতুন ৩ ব্যাটালিয়ন, দুই হাজার ২৫৮ পদ সৃষ্টি

সন্তান জন্মের ৪ মাস পর বিয়ের খবর দিলেন জেমস

কাপের অবশিষ্ট কফি ড্রেনে ঢেলে দেওয়ায় নারীকে ২৪ হাজার টাকা জরিমানা

এনসিপিকে ‘নাস্তিকদের সংগঠন’ বলে আমাকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে: মুফতি আমিনীর নাতি

‘মুসলমানদের মতো হইয়ো না’ বলা জাভেদ আখতারকে একহাত নিলেন লাকি আলী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

বাস্তবতার ধারাবাহিকতা

শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের সমস্যা, সেটির সমাধান তো হয়ইনি, উল্টো ধনবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে যে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আগের শাসকদের মতোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাই অব্যাহত রেখেছেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাস্তবতার ধারাবাহিকতা

একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনার ভেতরই প্রোথিত ছিল। সিরাজুল আলম খানের নিজের ব্যাপারটা মূলত ছিল ব্যক্তিগত; ক্ষমতার উত্তরাধিকার তাঁরই প্রাপ্য—এটা ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস; কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শেখ মুজিবের ভগিনীপুত্র শেখ ফজলুল হক মনি। সিরাজুল আলম খান তাঁর নিজের শক্তির প্রমাণ দেখাতে চেয়েছিলেন এবং সেটা প্রধান কারণ। এ জন্য তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। প্রকৃত সমাজতন্ত্রীরা তখন মাঠে দৃশ্যমান নন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ‘উগ্রপন্থী’ বলে চিহ্নিত, তাঁরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে গোপন তৎপরতায় ছিলেন। এরাই আবার কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, নয়তো রয়েছেন কারাগারে বন্দী অবস্থায়। কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন। তার আগেই এ দেশে রুশ-চীন বিভাজন ঘটে। এই বিভাজন বাম আন্দোলনে বড় ক্ষতি করে।

স্বাধীনতার পরে রুশপন্থীরাই ছিলেন দৃশ্যমান।

তাঁরা ‘উগ্রপন্থা’ তো শুরুতেই পরিহার করেছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী শাসকেরা যে পূর্ববঙ্গকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেটা অনুধাবনেও তাঁদের বিস্তর বিলম্ব ঘটে। ফলে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর দ্বন্দ্বটাই যে তখন প্রধান ছিল, এটা না বুঝে তাঁরা ‘সারা’ পাকিস্তানেই শ্রেণিসংগ্রাম অব্যাহত রেখে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পরে উঠতি বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যে শাসনক্ষমতা পেয়ে গেছেন, এটা তাঁরা দেখেও দেখতে চাইলেন না। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই শাসকদের সহায়তাতেই অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজটি সমাপ্ত করার। উগ্রপন্থা পরিহারের জন্য মস্কো থেকে তখন তাঁরা পরামর্শও পেয়েছিলেন বৈকি। পরিস্থিতিটা এ রকম দাঁড়িয়েছিল যে রুশপন্থীরা সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, চীনপন্থীরা মাঠে নেই, সমাজতন্ত্রের আওয়াজটা সমর্থক পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে এবং আওয়াজটা জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। হিটলার-মুসোলিনির নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিজমকে রুখে দেওয়ার জন্য ইউরোপে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতন্ত্রীরাও তেমন পন্থা ধরেই এগোতে থাকলেন। ‘মুজিব-বিরোধী’ জাতীয়তাবাদীরা খাড়া করলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আসলে উভয় দলই ছিল যথার্থ সমাজতন্ত্রের বিরোধী, যদিও উভয় দলই সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলে দাবি করত।

বামপন্থীদের দমনে সরকার তো তৎপর ছিলই, জাসদও তাতে যুক্ত হলো, যদিও প্রচ্ছন্নভাবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের গলা-ফাটানো আওয়াজ তুলে সামাজিক বিপ্লবের জন্য অধীর হয়ে পড়েছিল যে তরুণেরা, তাদের একাংশকে তারা নিজেদের দলে টেনে নিয়ে বিপ্লব-বিরোধিতার অন্ধগলিতে ঠেলে দিল। একই সঙ্গে আবার সম্ভাব্য সমাজবিপ্লবীদের উন্মোচন করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সহায়ক হলো। লাল পতাকা তুলে লাল পতাকার বিরোধিতা করার আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশেই সংঘটিত হলো বৈকি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে, তখন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, জাতীয়তাবাদের কথা তাঁর বক্তৃতায় শোনা যায়নি। এর কারণ এই যে যুদ্ধটা যেহেতু চলছিল জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই এবং এর অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষাটা যেহেতু ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্র থেকে কেবল যে আয়তনে নয়, চরিত্রেও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাই জাতীয়তাবাদের কথা বলা ছিল অপ্রয়োজনীয়।

জাতীয়তাবাদের কথা না-বলার পেছনে অবশ্য আরও একটি কারণ ছিল, সেটা হলো ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনাগ্রহ। ইন্দিরা গান্ধীর শঙ্কা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম না আবার দুই বাংলার মানুষদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ সৃষ্টি করে। তেমন আবেগ প্রবল হলে বাংলাদেশের বামপন্থীদের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনবিরোধী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের একটি মিলনের সূত্রপাত ঘটে যেতে পারে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের দৃষ্টান্ত তো চোখের সামনেই ছিল; জাতীয় মুক্তির ওই লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে, দুই বাংলার কমিউনিস্টরা ওই রকম কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, এমন শঙ্কা ভারতীয় শাসকদের কাছে অমূলক ঠেকেনি। ইন্দিরা গান্ধী তখন নকশালবাড়ী আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তিনি তাই চাননি যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থী তরুণেরা যোগ দিক। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ও ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিন্ন।

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বিশেষভাবেই বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন নেতা। ভারতে তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে যাননি, গিয়েছিলেন যোদ্ধা হিসেবে। যুদ্ধের ব্যাপারে সহায়তা চাইবার জন্য দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত পতাকার একটি নমুনা সঙ্গে রেখেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পতাকার ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্রের অবস্থান দেখিয়ে এই বলে আশ্বস্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যে বাংলাদেশ বলতে তাঁরা শুধু পূর্ববঙ্গকেই বোঝেন, তার বাইরের বাংলাভাষী অঞ্চলকে নয়। ‘জয় বাংলা’র অর্থ গোটা বাংলার জয় নয়, পূর্ববঙ্গের জয় হোক, এটাই তাঁরা চান; তার বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হোক, এটা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীদের দল আওয়ামী লীগ যেমন চায়নি, সেটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না ভারতের জাতীয়তাবাদীদেরও; বহির্বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর তো বটেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকেও দ্রুত যুদ্ধাবসান কাঙ্ক্ষিত ছিল। কারণ ওই একই—নতুন একটি ভিয়েতনামের অভ্যুদয়ের শঙ্কা।

নানা দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের আওয়াজই যথেষ্ট ছিল, জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তোলা ছিল অনাবশ্যক। কিন্তু শেখ মুজিব যখন পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে এলেন, জাতীয়তাবাদের আওয়াজটা তারপর থেকেই উঠতে থাকল। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের দাবিকে দুর্বল করার জাতীয়তাবাদী যে চিন্তা মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ধারণ করতেন, যুদ্ধ শেষে সেটিকেই ফেরত আনতে তিনি উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সঙ্গেই কেবল নয়, একেবারে প্রথমেই জাতীয়তাবাদকে স্থান দেওয়া হলো। আর এই সংযোজনের তাৎপর্য প্রকাশ পেল বাঙালি ছাড়াও যেসব স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষ বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে, সংবিধানে তাদের অস্তিত্বই অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। এমনকি তাদেরকে বাঙালি হয়ে যেতেও বলা হয়েছিল; অনেকটা সেভাবেই, একদা যেভাবে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের বলা হয়েছিল পাকিস্তানি বনে যেতে। বিদগ্ধজনদের মুখে এবং তাঁদের লেখাতেও বলা শুরু হলো যে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র। এটি যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, সে ধরনের প্রত্যাশা তাঁদের খেয়ালে রইল না।

পরাধীন ভারতবর্ষে মূল সমস্যাটি ছিল শ্রেণির; এবং সেটিকে সামনে আনার জন্যই জাতি সমস্যার সমাধান অত্যাবশ্যক ছিল। সাতচল্লিশের পরে পাকিস্তানের ব্যাপারেও ছিল ওই একই কথা। জাতি সমস্যার সমাধানের সেখানেও প্রয়োজন ছিল শ্রেণি সমস্যা সমাধানে হাত দেওয়ার জন্য। একাত্তরে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হলো, জাতি সমস্যার পুরোপুরি না হলেও একরকমের সমাধান মিলল। স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগুলোকে সাংবিধানিকভাবে অবশ্য এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তবু তারা যে আছে, সেটা মেনে নেওয়া হয়েছে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিদানের পর থেকে বাংলাদেশে অন্তত সরকারিভাবে বাংলা ভাষা ছাড়াও অন্য মাতৃভাষাগুলো রক্ষা করার এবং স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষদের জন্য প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তাটা স্বীকৃতি পেয়েছে।

কিন্তু মূল যে সমস্যা—শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের সমস্যা, সেটির সমাধান তো হয়ইনি, উল্টো ধনবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে যে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আগের শাসকদের মতোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাই অব্যাহত রেখেছেন। আর পুঁজিবাদী উন্নয়ন যে ধনবৈষম্য বাড়াতে বাধ্য, সেটা তো সর্বজনবিদিত।

লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষায় নতুন ৩ ব্যাটালিয়ন, দুই হাজার ২৫৮ পদ সৃষ্টি

সন্তান জন্মের ৪ মাস পর বিয়ের খবর দিলেন জেমস

কাপের অবশিষ্ট কফি ড্রেনে ঢেলে দেওয়ায় নারীকে ২৪ হাজার টাকা জরিমানা

এনসিপিকে ‘নাস্তিকদের সংগঠন’ বলে আমাকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে: মুফতি আমিনীর নাতি

‘মুসলমানদের মতো হইয়ো না’ বলা জাভেদ আখতারকে একহাত নিলেন লাকি আলী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পোশাকশিল্পের বর্জ্যের সম্ভাবনা

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
পোশাকশিল্পের বর্জ্যের সম্ভাবনা

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু রপ্তানির পণ্য নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকার ভিত্তি। গ্রামের নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণী পোশাকশিল্পে কাজ করে নিজের জন্য শুধু আয় করছেন না, তাঁদের ঘামে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গড়ে উঠছে। এই শিল্প খাতে শুধু তৈরি পোশাকই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পোশাক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাপড়ের টুকরাগুলো গুরুত্বপূর্ণ, যাকে আমরা ঝুট বলে বর্জ্য আকারে ফেলে দিই। কিন্তু এই ঝুটেরও বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। আমরা ভাবি, কাটিং টেবিলের পাশে যেসব কাপড়ের ছোট্ট টুকরা জমে থাকে, সেগুলো আর কোনো কাজের নয়। অথচ এই ফেলে দেওয়া ঝুটই হতে পারে নতুন অর্থনীতির বীজ।

২০২৫ সালে বাংলাদেশে পোশাক কারখানাগুলো থেকে প্রায় ৫ দশমিক ৭ লাখ (প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার) টন টেক্সটাইল বর্জ্য তৈরি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে Thomson Reuters Foundation, TexSPACE Today এবং The Centre for Child Rights and Business-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। এই বিপুল বর্জ্য সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে তা হতে পারে টেকসই উৎপাদনের শক্তিশালী কাঁচামাল। এটি নতুন একটি শিল্প হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। আজকের পোশাকের বিশ্ববাজার কেবল সস্তা দাম চায় না, চায় দায়বদ্ধতাও। পোশাকের দাম দেওয়ার আগে তারা জানতে চায় এসব তৈরি করতে গিয়ে কী পরিমাণ উপকরণ সাশ্রয় হলো, কত বর্জ্য পুনর্ব্যবহার হলো এবং কত কাঁচামাল উদ্বৃত্ত হলো? যে কারখানা এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, সেই কারখানার দর বাড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা।

এই দায়বদ্ধতার চাহিদা এক বিরাট সুযোগ। ঝুট বাছাই, গ্রেডিং, বেইলিং, স্পিনিং, ফ্যাব্রিক—প্রতিটি ধাপে নতুন কর্মসংস্থান হতে পারে; বিশেষ করে নারী শ্রমিক আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য তৈরি হতে পারে নতুন এক শিল্পের দ্বার। দেশের মধ্যে রিসাইকেলড সুতা তৈরি করা গেলে আরেক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। কারণ, এতে অর্থের সাশ্রয় হবে, কাঁচামাল আমদানির ঝুঁকি কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে।

তবে এই সম্ভাবনার পথ একেবারেই মসৃণ নয়। এর সামনে আছে গেঁথে থাকা বহু পুরোনো গিঁট। প্রথম গিঁটটা আসে আমাদের মনোভাব থেকে। কারখানাগুলোতে এখনো বর্জ্য আলাদা করার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। কাটিং টেবিলের পাশে ঝুট পড়ে থাকে। ভালো-মন্দ সব একসঙ্গে থাকে। এতে ভালো মানের ঝুট খারাপের সঙ্গে মিশে গিয়ে মান হারায়। দাম পড়ে যায়। বাজারে এর জন্য আলাদা মূল্য মেলে না। শ্রমিকও বোঝে না কোনটা রাখবে, কোনটা ফেলবে।

দ্বিতীয় বড় সমস্যা প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে। আমাদের বেশির ভাগ কারখানা এখনো পুরোনো ধরনের ওপেন-এন্ড স্পিনিং পদ্ধতিতে আটকে আছে। এই প্রযুক্তিতে শুধু মাঝারি মানের সুতা তৈরি হয়। এর দাম কম এবং চাহিদাও সীমিত। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বড় ব্র্যান্ডগুলো উচ্চমানের পুনর্ব্যবহৃত (রিসাইকেলড) সুতা চায়। এমন সুতা বানাতে দরকার আধুনিক মেকানিক্যাল ও কেমিক্যাল রিসাইক্লিং যন্ত্র। এই যন্ত্রপাতি অনেক ব্যয়বহুল। তবে এগুলো না আনলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। ফলে আমরা এই গ্লোবাল দৌড়ে পিছিয়েই পড়ছি।

তৃতীয় গিঁট মালিকানা নিয়ে। ঝুট আসলে কার? কারখানা বলবে তাদের। রিসাইক্লার বলবে তাদের। আবার মধ্যস্বত্বভোগীরাও হাত গলিয়ে বসে থাকে মাঝখানে। ফলে কার মালিকানায় কবে ঝুট বিক্রি হবে, তার কোনো নিয়ম থাকে না। বাজারে দাম হঠাৎ বাড়ে, আবার হঠাৎ পড়ে। একেক দিন একেক রকম দর হয়। বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করাই কঠিন হয়ে পড়ে তখন।

এই তিনটি গিঁট সমস্যার সমাধান না হলে সম্ভাবনা শুধু ভাবনার মধ্যে আটকে থাকবে। ঝুট তখন কাঁচামাল নয়, বোঝা হয়ে যাবে। এই গিঁট খুলতে হলে প্রথমে দরকার স্বচ্ছ ভাবনা ও পরিকল্পনা। পরিকল্পনাহীন কোনো কিছুই সম্ভাবনা বয়ে আনে না। সে জন্য কারখানার কাটিং টেবিল থেকে শুরু করতে হবে নিয়মের চর্চা। ঝুটকে ফেলে দেওয়ার জিনিস না ভেবে রাখতে হবে আলাদা বাক্সে। রং, ফ্যাব্রিকের ধরন এবং গ্রেড অনুযায়ী আলাদা করতে হবে। প্রতিদিনের হিসাবও রাখতে হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। কারণ, যেটা মাপা যায়, সেটাই উন্নত করা যায়। এরপর দরকার স্বচ্ছতা, প্রতিটি ঝুটের যাত্রাপথ জানা থাকতে হবে। কারখানার মেঝে থেকে গুদাম, গুদাম থেকে ট্রাক, আর ট্রাক থেকে সুতা কারখানা পর্যন্ত এর যাত্রাপথ চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে। তাহলে ঝুট হারিয়ে যাবে না। ক্রেতার আস্থাও বাড়বে।

এভাবে ক্রেতারা নিশ্চিত হতে পারবে যে এই সুতা সত্যিই পুনর্ব্যবহৃত। এরপর জরুরি দরকার ঝুটের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ। শিল্পাঞ্চলভিত্তিক কমন রিসাইক্লিং পার্ক গড়ে তুলতে হবে। তারপর শ্রমিকদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এতে তাঁদের দক্ষতার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। পুরো প্রক্রিয়ার মানও ওপরের দিকে উঠবে। এখন শুধু সাধারণ টি-শার্ট বানিয়ে গেলে হবে না, বাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতেই হবে। ডেনিম, ফ্লিস, অ্যাকটিভ পোশাক এমনকি পুরোনো কাপড় নতুনভাবে ডিজাইন করেও তৈরি করতে হবে। এতে প্রতি পণ্যে মূল্য অনেক বাড়বে। বাংলাদেশ গর্বের সঙ্গে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে পারবে।

পাশাপাশি এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য সস্তা ঋণ আর প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। স্থানীয় ডিজাইনারদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করলে এই উদ্যোক্তারা পুরোনো কাপড় দিয়ে নতুন ধরনের পোশাক (আপসাইকেলড কালেকশন) বানাতে পারবেন। এতে বাজারে নতুন ভ্যালু অ্যাড যোগ হবে। শিল্পে আসবে সৃজনশীলতার রং। শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা আর সৃজনশীলতা—এই তিন শক্তিই পারে এই গিঁট খুলতে। একবার খুলে গেলে ঝুট আর বর্জ্য নয়, হবে সম্পদ।

আজকের প্রতিযোগিতা শুধু কম দামে পণ্য বানানোর প্রতিযোগিতা নয়, এখন এটি দায়বদ্ধতার প্রতিযোগিতা। যে দেশ নিজের বর্জ্যকে কাঁচামালে রূপ দিতে পারে, আর সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা দেখাতে পারে, বিশ্ববাজার সেই দেশকে আস্থা দেয়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২০২৫ সালেই কয়েক লাখ টন বর্জ্য তৈরি করেছে। এই সংখ্যা ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু আসলে এটা এক বিশাল সম্ভাবনা। বর্জ্য মানেই বোঝা—এমন ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সঠিক নিয়ম আর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করলে এই বর্জ্যই হতে পারে নতুন শিল্পের ভিত।

লেখক: শোয়েব সাম্য সিদ্দিক

ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষায় নতুন ৩ ব্যাটালিয়ন, দুই হাজার ২৫৮ পদ সৃষ্টি

সন্তান জন্মের ৪ মাস পর বিয়ের খবর দিলেন জেমস

কাপের অবশিষ্ট কফি ড্রেনে ঢেলে দেওয়ায় নারীকে ২৪ হাজার টাকা জরিমানা

এনসিপিকে ‘নাস্তিকদের সংগঠন’ বলে আমাকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে: মুফতি আমিনীর নাতি

‘মুসলমানদের মতো হইয়ো না’ বলা জাভেদ আখতারকে একহাত নিলেন লাকি আলী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

অগ্নিকাণ্ড

মাহফুজা খাতুন
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশ এখন যেন বিপর্যয়কর এক অবস্থায় পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দু-এক দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে আগুন লাগার ঘটনা। এতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার আগে মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় এবং চট্টগ্রামের ইপিজেডে একটি বড় কোম্পানিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই তিনটি ঘটনায় দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক মাস আগে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং দেশের সিভিল এভিয়েশন সেফটি এবং জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে,

তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে মানুষের প্রশ্ন এখন একটাই—দেশে নিরাপত্তা বলতে কিছু আছে, নাকি সবই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে?

আগে আমরা শুধু আগুন নিয়ে আতঙ্কিত হতাম, এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আজ কোনো জায়গাই যেন আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মকানুন না মানা, তদারকির চরম অভাব এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাই এখন দুর্ঘটনাকে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত করেছে। বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণে বা দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি মানে কেবল দুর্ঘটনা নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও এক গভীর সংকট।

এসব অগ্নিদুর্ঘটনার মূল সমস্যা আসলে একটিই—জবাবদিহির অভাব। বারবার দুর্ঘটনার পরও এর জন্য কেউ শাস্তি পাচ্ছে না, যথাযথ জবাবদিহিও নিশ্চিত হচ্ছে না। নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি প্রকট। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম নেই, বিমানের নিরাপত্তা পরীক্ষা দুর্বল, ফায়ার সার্ভিসে জনবল কম, এভিয়েশন অথরিটির নজরদারির অভাবও এসবের জন্য দায়ী। এ ছাড়া অনুমোদন, লাইসেন্স প্রদান এবং রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়মের ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে হতাশাজনক হলো তদন্তের চিত্র, যেখানে সবকিছুর কারণ ‘শর্টসার্কিট’ বা ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ বলে দায় এড়ানো যেন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দোষীরা শাস্তিহীন থাকার কারণে দুর্ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

তবে একের পর এক বড় দুর্ঘটনার পেছনে পরিকল্পিত নাশকতার অদৃশ্য ছায়াও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা; যেমন বিমানবন্দর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বড় কলকারখানা টার্গেট হওয়া উদ্বেগজনক। এটা কি শুধু কাকতালীয়, নাকি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির একটি কৌশল? এসব বিষয়ও গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা অতি জরুরি। এমনকি কিছু কারখানায় আগুন দিয়ে বিমা জালিয়াতির প্রমাণও পাওয়া গেছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিল্পায়ন, অর্থনীতি, শিক্ষা, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনও চরম ঝুঁকিতে পড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ কমবে, পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক মহলে বিমান চলাচলের সেফটি রেটিং কমে যেতে পারে।

দুর্ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু যখন অব্যবস্থাপনা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তখন তা জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ফায়ার অডিট এবং সেফটি সার্টিফিকেট হালনাগাদ করা, এভিয়েশন সেফটি কমিশন গঠন ও স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও ট্রেনিং এয়ার রুটের নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। অগ্নিকাণ্ড এবং বিমান দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি, স্কুল, কলেজ, কলকারখানা ও অফিসে নিয়মিত ফায়ার ও সেফটি ড্রিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে—দেশের মানুষের জীবন আর জাতীয় নিরাপত্তা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। জাতির দাবি আজ একটাই—নিরাপত্তা চাই, জবাবদিহি চাই।

লেখক: মাহফুজা খাতুন

শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষায় নতুন ৩ ব্যাটালিয়ন, দুই হাজার ২৫৮ পদ সৃষ্টি

সন্তান জন্মের ৪ মাস পর বিয়ের খবর দিলেন জেমস

কাপের অবশিষ্ট কফি ড্রেনে ঢেলে দেওয়ায় নারীকে ২৪ হাজার টাকা জরিমানা

এনসিপিকে ‘নাস্তিকদের সংগঠন’ বলে আমাকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে: মুফতি আমিনীর নাতি

‘মুসলমানদের মতো হইয়ো না’ বলা জাভেদ আখতারকে একহাত নিলেন লাকি আলী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পর্নো তারকা

সম্পাদকীয়
পর্নো তারকা

বৈশ্বিক পর্নো সাইটে নামডাক করেছেন বাংলাদেশি যুগল। চলতি বছরের অক্টোবরে পর্নো তারকাদের আন্তর্জাতিক পারফরমার র‍্যাঙ্কিংয়ে তাঁরা অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন। এক বছরে তাঁদের পর্নো ভিডিও দেখা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখের বেশিবার। বান্দরবান থেকে এই যুগলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পর্নো এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে ইতিবাচক কিছু কথা বলার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের সামাজিক মূল্যবোধের কথা বিবেচনায় নিলে এই ধরনের সংবাদ খুবই বিব্রতকর।

বিব্রতকর হলেও পর্নো বিষয়ে কথা বলা উচিত। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গোপন ম্যাগাজিন বা বইপত্র প্রকাশিত হতো। স্থূল যৌনতাই ছিল সেই প্রকাশনাগুলোর মূল উপজীব্য। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভিসিআর বা ভিসিপির মাধ্যমে নীল ছবির আমদানি হয়। আশির দশকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ হানা দিয়েছে নীল ছবির ডেরায়, এ রকম খবর তখন দেখা যেত পত্রপত্রিকায়। বর্তমান যুগে ইন্টারনেট দুনিয়ায় রুচিশীল কনটেন্টের বিপরীতে রুচিহীন কনটেন্টেরও ছড়াছড়ি। ফলে অর্থ উপার্জনের জন্য যে কেউ বেছে নিতে পারছেন এমন সব পথ, যা একসময় ভেবেও দেখা যেত না।

গ্রেপ্তার যুগল বড়ই সেয়ানা। ভিডিও আপলোড করা ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রচার চালাতেন। নতুনদের এসব প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাতেন। সম্ভাব্য আগ্রহীদের ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ হিসেবে যুক্ত করার জন্য টেলিগ্রাম চ্যানেলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন দিতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরিয়েই কারিগরি জ্ঞান দিয়ে যা ইচ্ছে তা ঘটানো যায়—এটাও তাঁরা প্রমাণ করেছেন। ফলে চাইলেই এই সখাত সলিলে আত্মবিসর্জন দেওয়া যায়। ব্যাপারটা এতই সহজ হয়ে গেছে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ অনেকটা নেশার মতো। বাস্তব জীবনের ভালোবাসা বা যৌন সম্পর্কের প্রতি তাতে আগ্রহ কমে যায়। তাৎক্ষণিক আনন্দের সঙ্গে এর যোগ আছে বলে অনেকে এসব নীল ছবি দেখার জন্য অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। লুকিয়ে পর্নোগ্রাফির আস্বাদ গ্রহণ করতে করতে সামাজিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে পড়ে। যৌনতার অবাস্তব, অতিরঞ্জিত ও বাণিজ্যিক প্রকাশ ঘটানো এই পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে নর-নারীর বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো নিয়ে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এসব সাইট দেখতে দেখতে যেকোনো মানুষের একাকিত্ব ও বিষণ্নতা বেড়ে যেতে পারে, যা জীবনকে ভুল পথে পরিচালনা করতে পারে।

এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। স্কুলেই বয়স-উপযোগী যৌনশিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরি করা, অভিভাবকদেরও সচেতন হয়ে সন্তানদের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি খোলাসা করা, পর্নোতে আসক্ত হয়ে পড়লে মানবিক সহায়তা দেওয়া দরকার। তবে তার চেয়ে বেশি দরকার তরুণদের সামনে এমন এক সৃজনশীল, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করা, যা পর্নোর অশুভ থাবা থেকে তরুণদের রক্ষা করতে পারে। গ্রেপ্তার যুগলের মতো আরও কেউ যদি এই অপকর্মে লিপ্ত থাকেন, তাহলে তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষায় নতুন ৩ ব্যাটালিয়ন, দুই হাজার ২৫৮ পদ সৃষ্টি

সন্তান জন্মের ৪ মাস পর বিয়ের খবর দিলেন জেমস

কাপের অবশিষ্ট কফি ড্রেনে ঢেলে দেওয়ায় নারীকে ২৪ হাজার টাকা জরিমানা

এনসিপিকে ‘নাস্তিকদের সংগঠন’ বলে আমাকে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে: মুফতি আমিনীর নাতি

‘মুসলমানদের মতো হইয়ো না’ বলা জাভেদ আখতারকে একহাত নিলেন লাকি আলী

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত