Ajker Patrika

যে সহে সে রহে

মাসুদ–উর রহমান
দুর্ভোগ নিরসনে এসে নিজেই দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন উপদেষ্টা। ছবি: আজকের পত্রিকা
দুর্ভোগ নিরসনে এসে নিজেই দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন উপদেষ্টা। ছবি: আজকের পত্রিকা

১. ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুর্ভোগ নিরসনে এসে নিজেই দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা। উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বর্তমানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও আছেন। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পরিবহনব্যবস্থা এবং সড়ক পরিবহন খাতের সমস্যা দূরীকরণ, উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে কাজ করা।

ছয়-সাত বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়নের অতি ধীরগতিতে অবর্ণনীয় কষ্ট করে আসছে। গরমে ঘেমে, রোদ-বৃষ্টিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থেকে অনেক প্রবাসী যেমন তাঁদের বিদেশগামী ফ্লাইট মিস করেছেন, তেমনি অনেক অসুস্থ মানুষও সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে না পেরে অ্যাম্বুলেন্সেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বেহাল সড়কে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে এবং এতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়েছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা এবং অফিসগামী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। একটি উন্নয়ন প্রকল্প এত দীর্ঘদিন ধরে চলার নজিরও সম্ভবত এই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম।

গত বছর থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ছয় লেন প্রকল্প। দুই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ধাক্কাধাক্কিতেই যৌথ অধিকারে থাকা আশুগঞ্জ-বিশ্বরোডের অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি নাজুক। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলাকালীন সড়কে যে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হয়, সেটি সম্ভবত প্রকল্প পরিচালকেরা জানেনই না। ফলে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাস্তার এই অংশে, সেই অংশে অর্থাৎ অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়নকাজ শুরু করে। এই অপরিকল্পিত সড়ক প্রশস্তকরণের কারণে সাত বছর ধরে আশুগঞ্জ থেকে কসবার তিনলাখপীর পর্যন্ত দীর্ঘ পথে মানুষকে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। পাশাপাশি এ বছরের শুরু থেকে আশুগঞ্জ-মাধবপুর অংশে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার সড়কপথ অনেকটা অচল হয়ে পড়ে। কয়েক মাস ধরে প্রশাসনের নির্লিপ্ততায়, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনের অবহেলায় রাস্তায় চরম অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছিল। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো জনসাধারণকে। অবস্থা এতই বেগতিক হচ্ছিল যে এক মাস ধরে ঢাকা-সিলেট সড়ক যোগাযোগ একেবারে ভেঙে পড়েছিল। সড়কপথের এই বাড়তি চাপ এসে পড়ল রেলপথের ওপর। প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদে চড়ে, দরজার হ্যান্ডেলে ঝুলে যাতায়াত করা যাত্রীদের চরম দুর্ভোগের চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্যে হয়তো টনক নড়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। তারই জেরে কিনা সড়ক ও সেতু উপদেষ্টার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের দিন-তারিখ ঠিক হলে দ্রুত রাস্তার সংস্কারে যেন হুলুস্থুল পড়ে যায়। উপদেষ্টাকে খুশি করতে ত্বরিত রাস্তা সংস্কারে নেমে আসে সওজ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

কিন্তু তাদের শেষরক্ষা হয়নি। তারা যানজটমুক্ত সড়ক উপহার দিতে পারেনি উপদেষ্টাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উপদেষ্টা যানজটে পড়ে শুধু যে শারীরিক কষ্ট করেছেন, তা-ই শুধু নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ট্রলের শিকার হয়েছেন।

এত দিন দুর্ভোগে কষ্ট করা মানুষগুলো উপদেষ্টার এই কষ্ট দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন মন্তব্য লিখে হয় মনের ঝাল মিটিয়েছেন অথবা সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

অবশ্য রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীদের এমন অবস্থা কখনোই হতো না, যেমন অতীতে হয়নি। প্রশাসনিক কার্যক্রমের আগেই স্থানীয় নেতা-কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কার করে একেবারে নির্বিঘ্নে মন্ত্রীকে যথাযথ গন্তব্যে পৌঁছে দিতেন। অতীতে ভালো রাস্তায়ও মন্ত্রী-এমপিদের অনেককে সহজ যাতায়াতের জন্য উল্টো পথে চলে কিংবা রাস্তা আটকে যানজট তৈরি করে জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে ধুলা উড়িয়ে বুক ফুলিয়ে চলে যেতে দেখেছি। তখন কি মানুষের এ রকম কষ্ট হতো না? বড় নেতাদের দুঃশাসন আর পাতিনেতাদের অতি বাড়াবাড়ির কারণে সাধারণে জন্ম নেওয়া ক্ষোভের প্রকাশই কিন্তু গত আগস্টে সরকার পতনকে ত্বরান্বিত করেছে। আজ যাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বা যাঁরা অচিরেই সরকারে আসবেন মনে করে গোঁফে তা দিচ্ছেন, তাঁরা কি জনগণের সেই বিষাক্ত নিশ্বাসের আঁচ অনুভব করতে পারছেন?

২. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মহত্তম চেতনায়। একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন ছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সে পথে যেতে আমরা বারবার হোঁচট খেয়েছি। সহনশীলতা ও মানবিক রাজনীতি ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি, উল্টো রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে প্রতিশোধ, ষড়যন্ত্র এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে মুছে দেওয়ার প্রবণতা। রাজনৈতিক অঙ্গনে মতবিরোধ থাকবেই এবং এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। মতবিরোধ নিরসনে বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনার টেবিল অতীতে খুব একটা মুখ্য হয়নি। যুক্তি দিয়ে তাঁদের মোকাবিলা করার পরিবর্তে দমন-পীড়নের নামে রাস্তায় ফয়সালাই হয়েছে বেশি। আঠারো শতকের ইউরোপে গণতন্ত্র বিকাশের সময় বারবার বলা হয়েছিল, ‘আই ডিজঅ্যাপ্রুভ অব হোয়াট ইউ সে, বাট আই উইল ডিফেন্ড টু দ্য ডেথ ইউর রাইট টু সে ইট’। অর্থাৎ ভিন্নমতকে মেনে নেওয়া গণতন্ত্রের প্রাণ। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনীতির মূল সুর হয়ে দাঁড়ায়, ‘তুমি ভিন্নমত পোষণ করছ, তাই তোমাকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।’

ধারণা করা হয়েছিল, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে এই মানসিকতা ধীরে ধীরে লুপ্ত হবে কিন্তু কিসের কী? হলো না কিছুই। আর হলো না বলেই সেফ এক্সিট এখন আলোচনার অন্যতম মূল বিষয়। হয়তো কোনো কোনো উপদেষ্টা তাঁদের গত বছরাধিক সময়ের কর্মের দিকে ফিরে তাকিয়ে নিরাপদ বোধ করছেন না। সরকার পরিবর্তনে তাঁদের পরিণতিও বিগত সরকারের মতো হবে ভেবে যারপরনাই উদ্বিগ্ন। এমনটি কেন হলো?

কেন আপনারা গণ-অভ্যুত্থানের আবেগটুকু বুঝতে পারলেন না? আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, এই সেফ এক্সিট গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে কখনোই মঙ্গল বয়ে আনেনি, আনবেও না। নির্বাচনের আরও মাস কয়েক বাকি। কাজেই বর্তমান সরকারের উচিত, যথাযথ তদন্ত করে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে কারা জড়িত কিংবা বিরুদ্ধমতকে নিষ্পেষণ করার সঙ্গে কারা জড়িত, কারা ক্ষমতা পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা। একজন নির্দোষও শাস্তি পাক, তা কখনোই কাম্য হতে পারে না। যাঁরা ক্ষমতা পেয়ে দেশের জন্য সততার সঙ্গে কাজ করে চলেছে, বিরুদ্ধমতের তির্যক মন্তব্যেও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে দেশের মানচিত্র অক্ষত রেখে, আবহমান বাঙালি সংস্কৃতিকে সমুন্নত রেখে, সর্বোপরি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে, তারা কেন সরে যাবে? তারাই তো থাকবে। কথায় আছে না, ‘যে সহে সে রহে।’

লেখক: মাসুদ উর রহমান

কলেজশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত