বিধান রিবেরু
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই। সাধারণত রাজনৈতিক মিছিলে আসা মানুষের মুখই মুখরিত হয় স্লোগানে। আন্দোলন ও সংগ্রামে স্লোগান, এক জায়গার জড়ো হওয়া জনতাকে ঐক্যের অনুভূতি দেয় এবং নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে চিত্তকে আরও দৃঢ় করে। কালে কালে স্লোগান পাল্টেছে, কারণ যুগে যুগে মানুষের সংকট পরিবর্তন হয়েছে, সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা পরিবর্তিত হয়েছে। তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনাকে প্রতিপক্ষের সামনে সম্মিলিত সুরে ছন্দের মাত্রায় বেঁধে জানান দিয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। আমরা যদি ১৮৫৭ সালে যাই, দেখব উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহিরা সম্মিলিত কণ্ঠে বলেছিল: ইনকিলাব জিন্দাবাদ, শব্দবন্ধটি হিন্দুস্তানি। তবে অনেকের ধারণা আরবি ‘ইকলাব’ শব্দ থেকে ‘ইনকিলাব’ শব্দটির উদ্ভব। ইকলাবের আসল অর্থ ‘পরিবর্তন’। অপরদিকে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি উর্দু ও ফারসি ভাষার মিশ্রণ। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি শোনা যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীদের মুখে। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে তাঁরাই সম্ভব করে তুলেছিলেন। তাঁরা ও তাঁদের সমভাবাপন্ন রাজনীতিমনস্ক শিক্ষার্থীদের কণ্ঠেই আমরা গত বছর শুনেছিলাম: আমি কে তুমি কে/রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে, কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার। এই প্রজন্মই, যাদের আমরা জেন-জি বলে জানি, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যুক্ত ছিল। সে সময়ও তারা স্লোগান রচনা করেছে এবং রাজপথে ব্যবহার করেছে। সম্ভবত তখন থেকেই তারা স্লোগানে ইংরেজিতে ‘স্ল্যাং’, ব্যবহার করতে শুরু করে। যার পরিণত রূপ আমরা দেখলাম এই কদিন আগে: এক, দুই, তিন, চার/অমুকের ... মার; অথবা টিনের চালে কাউয়া/অমুক একটা ...।
আরও অনেকের মতো আমিও মনে করি, ভাষা মানুষের মনোজগতে প্রবেশের প্রশস্ত দরজা। এই দরজা দিয়ে ঢুকে বোঝা যায় মানুষের মননের গঠন কেমন। জেন-জিদের একটি স্লোগানে আমরা দেখেছি ইনকিলাব ও জিন্দাবাদ শব্দের ব্যবহার। তারা নিজেরা ভারতবিদ্বেষী হলেও, ব্যবহার করছে ‘হিন্দুস্তানি স্লোগান’ এবং স্লোগানটির প্রথম ব্যবহারকারী কিন্তু ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্ম নেওয়া একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও কবি মাওলানা হাসরাত মোহানি। তিনি এটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯২১ সালে। এরপর এই স্লোগান ব্যবহার করেন উপনিবেশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা ভগত সিং। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এখনো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি ব্যবহার করে। সে জন্য এটা ভাবার কোনো কারণ নেই জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনো সাম্যবাদী দল।
অনুপ্রেরণা যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারে এবং অনুপ্রাণিত হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্ধ বিদ্বেষ অবশ্যই দোষের মধ্যে পড়ে এবং সেটি বিপজ্জনকও বটে। আরও বিপদের দেখা মেলে যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি অশ্রাব্য গালি স্থান করে নেয় স্লোগানে। অক্ষমের শেষ অস্ত্র হলো গালি। যখন কেউ খুব সহজেই নিজের ভাষায় গালাগালিকে স্থান দেয়, তখন বুঝতে হবে সে অথবা তারা ভাষাগত দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে গেছে, সৃজনশীলতা দূর হয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা, যা গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র, সেটিও তাদের ভেতর থেকে উবে গেছে।
যখন কেউ কারও সম্পর্কে মানহানিকর, বিশেষ করে অশ্রাব্য গালাগাল ব্যবহার করে, তখন তার সাংস্কৃতিক মান যেমন পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তেমনি তার রুচিও নগ্ন হয়ে পড়ে। গালাগালের ভেতর সাময়িক উত্তেজনা ও ক্রোধ প্রকাশ পেলেও ভুলে গেলে চলবে না, স্লোগানে গালাগাল কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত হয় না। খুব ভেবেচিন্তে সেসব স্লোগান রচনা করা হয় এবং সম্মিলিত কণ্ঠে সেসব উচ্চারিত হয়। একটি মিছিলে বা সমাবেশে ছোট ও বড় নানা বয়সী মানুষ থাকে। ছেলে ও মেয়ে থাকে। ভাবুন, তারা সবাই মিলে অশালীন গালাগালি করছে এবং অদ্ভুত বিষয়, এতে তারা প্রত্যেকেই যেন একত্রে একধরনের ‘যৌনসুখ’ অনুভব করছে।
স্লোগান কি কেবলই স্লোগান? এটি তো রাজনৈতিক সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নানা সময়ে নানা ধরনের স্লোগানে ধরা থাকে সময় ও কালের সংগ্রামী চেতনা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘জয় হিন্দ’, ‘বন্দে মাতরম’। পাকিস্তান আন্দোলনে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু স্লোগান নয়, রণধ্বনিতে পরিণত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। অসহযোগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রচিত একটি স্লোগান: ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’, কী চমৎকার শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে এখানে! কাব্যিক ঢঙের বাইরে গিয়েও হুমকি, ধমক ও শ্লেষের ঠাঁই মিলেছে তখনকার স্লোগানে। তবে সে সময়কার মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের দলগুলোর স্লোগানের সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের স্লোগানে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়। একদল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য হুমকি দিচ্ছে, অন্যায্য চুক্তি বাতিল করার আলটিমেটাম দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে: ‘ডোন্ট থ্রো দ্য বেবি আউট উইদ দ্য বাথওয়াটার’, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরম ধন, সন্তানের মতো। মুক্তিযুদ্ধ যাদের নেতৃত্বে এসেছে, তারা যদি পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও লুটেরা হয়ে ওঠে, তার মানে এই নয় যে তাদের বিতাড়িত করার পাশাপাশি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকেও বিতাড়িত করব। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু আপামর জনসাধারণই করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সেই অপচেষ্টাই আমরা জোরেশোরে হতে দেখছি। আজকাল ইউটিউবার, টিকটকাররাও ইতিহাসবেত্তা হয়ে উঠেছেন। নানা সময় তাঁরা নানা ধরনের ব্যবস্থাপত্র হাজির করছেন, আর সেটা দেখে হইহই করে সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে থাকা ব্যবহারকারীরা। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, যাঁরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্ববিরোধী ফতোয়া হাজির করছেন, তাঁদের সেই কর্মের পেছনে লাইক, কমেন্ট, ক্লিক ও রিচের ব্যবসা রয়েছে। যাঁর যত ‘অ্যাঙ্গেজমেন্ট’ তাঁর তত পয়সা উপার্জন। কাজেই অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁদের সার্বক্ষণিক উত্তেজনা উৎপাদন করতে হয়। এই উত্তেজনা উৎপাদন করতে গিয়ে তাঁরা অকপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে চলেছেন। এই অস্থির ডিজিটাল সময়ে সবাই সেসব কনটেন্ট ক্রিয়েটরের হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা ঠাওরে পেছন পেছন চলে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপারে থাকা রহস্যঘেরা অজানা জগতে।
কারও যেন কোনো দায় নেই। ইতিহাসের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একটা গোটা প্রজন্ম শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেল। মাতৃভাষায় দক্ষতা থাকার বিচারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আমরা যেন নিজেদের পতন নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছি প্রতিদিন। পতনের একটি উৎকৃষ্ট নির্দেশক এই স্লোগান। যাঁরা এইসব স্লোগান ব্যবহার করছেন, তাঁরা বুঝতেই পারলেন না, ইতিহাসের পাতায় তাঁরা কলঙ্কিত অধ্যায়ের অংশ হয়ে গেলেন। এই অধ্যায়ের বেদনায় গোটা জাতি একদিন আক্রান্ত হবে। তত দিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই। সাধারণত রাজনৈতিক মিছিলে আসা মানুষের মুখই মুখরিত হয় স্লোগানে। আন্দোলন ও সংগ্রামে স্লোগান, এক জায়গার জড়ো হওয়া জনতাকে ঐক্যের অনুভূতি দেয় এবং নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে চিত্তকে আরও দৃঢ় করে। কালে কালে স্লোগান পাল্টেছে, কারণ যুগে যুগে মানুষের সংকট পরিবর্তন হয়েছে, সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা পরিবর্তিত হয়েছে। তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনাকে প্রতিপক্ষের সামনে সম্মিলিত সুরে ছন্দের মাত্রায় বেঁধে জানান দিয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। আমরা যদি ১৮৫৭ সালে যাই, দেখব উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহিরা সম্মিলিত কণ্ঠে বলেছিল: ইনকিলাব জিন্দাবাদ, শব্দবন্ধটি হিন্দুস্তানি। তবে অনেকের ধারণা আরবি ‘ইকলাব’ শব্দ থেকে ‘ইনকিলাব’ শব্দটির উদ্ভব। ইকলাবের আসল অর্থ ‘পরিবর্তন’। অপরদিকে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি উর্দু ও ফারসি ভাষার মিশ্রণ। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি শোনা যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীদের মুখে। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে তাঁরাই সম্ভব করে তুলেছিলেন। তাঁরা ও তাঁদের সমভাবাপন্ন রাজনীতিমনস্ক শিক্ষার্থীদের কণ্ঠেই আমরা গত বছর শুনেছিলাম: আমি কে তুমি কে/রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে, কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার। এই প্রজন্মই, যাদের আমরা জেন-জি বলে জানি, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যুক্ত ছিল। সে সময়ও তারা স্লোগান রচনা করেছে এবং রাজপথে ব্যবহার করেছে। সম্ভবত তখন থেকেই তারা স্লোগানে ইংরেজিতে ‘স্ল্যাং’, ব্যবহার করতে শুরু করে। যার পরিণত রূপ আমরা দেখলাম এই কদিন আগে: এক, দুই, তিন, চার/অমুকের ... মার; অথবা টিনের চালে কাউয়া/অমুক একটা ...।
আরও অনেকের মতো আমিও মনে করি, ভাষা মানুষের মনোজগতে প্রবেশের প্রশস্ত দরজা। এই দরজা দিয়ে ঢুকে বোঝা যায় মানুষের মননের গঠন কেমন। জেন-জিদের একটি স্লোগানে আমরা দেখেছি ইনকিলাব ও জিন্দাবাদ শব্দের ব্যবহার। তারা নিজেরা ভারতবিদ্বেষী হলেও, ব্যবহার করছে ‘হিন্দুস্তানি স্লোগান’ এবং স্লোগানটির প্রথম ব্যবহারকারী কিন্তু ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্ম নেওয়া একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও কবি মাওলানা হাসরাত মোহানি। তিনি এটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯২১ সালে। এরপর এই স্লোগান ব্যবহার করেন উপনিবেশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা ভগত সিং। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এখনো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি ব্যবহার করে। সে জন্য এটা ভাবার কোনো কারণ নেই জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনো সাম্যবাদী দল।
অনুপ্রেরণা যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারে এবং অনুপ্রাণিত হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্ধ বিদ্বেষ অবশ্যই দোষের মধ্যে পড়ে এবং সেটি বিপজ্জনকও বটে। আরও বিপদের দেখা মেলে যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি অশ্রাব্য গালি স্থান করে নেয় স্লোগানে। অক্ষমের শেষ অস্ত্র হলো গালি। যখন কেউ খুব সহজেই নিজের ভাষায় গালাগালিকে স্থান দেয়, তখন বুঝতে হবে সে অথবা তারা ভাষাগত দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে গেছে, সৃজনশীলতা দূর হয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা, যা গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র, সেটিও তাদের ভেতর থেকে উবে গেছে।
যখন কেউ কারও সম্পর্কে মানহানিকর, বিশেষ করে অশ্রাব্য গালাগাল ব্যবহার করে, তখন তার সাংস্কৃতিক মান যেমন পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তেমনি তার রুচিও নগ্ন হয়ে পড়ে। গালাগালের ভেতর সাময়িক উত্তেজনা ও ক্রোধ প্রকাশ পেলেও ভুলে গেলে চলবে না, স্লোগানে গালাগাল কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত হয় না। খুব ভেবেচিন্তে সেসব স্লোগান রচনা করা হয় এবং সম্মিলিত কণ্ঠে সেসব উচ্চারিত হয়। একটি মিছিলে বা সমাবেশে ছোট ও বড় নানা বয়সী মানুষ থাকে। ছেলে ও মেয়ে থাকে। ভাবুন, তারা সবাই মিলে অশালীন গালাগালি করছে এবং অদ্ভুত বিষয়, এতে তারা প্রত্যেকেই যেন একত্রে একধরনের ‘যৌনসুখ’ অনুভব করছে।
স্লোগান কি কেবলই স্লোগান? এটি তো রাজনৈতিক সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নানা সময়ে নানা ধরনের স্লোগানে ধরা থাকে সময় ও কালের সংগ্রামী চেতনা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘জয় হিন্দ’, ‘বন্দে মাতরম’। পাকিস্তান আন্দোলনে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু স্লোগান নয়, রণধ্বনিতে পরিণত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। অসহযোগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রচিত একটি স্লোগান: ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’, কী চমৎকার শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে এখানে! কাব্যিক ঢঙের বাইরে গিয়েও হুমকি, ধমক ও শ্লেষের ঠাঁই মিলেছে তখনকার স্লোগানে। তবে সে সময়কার মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের দলগুলোর স্লোগানের সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের স্লোগানে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়। একদল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য হুমকি দিচ্ছে, অন্যায্য চুক্তি বাতিল করার আলটিমেটাম দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে: ‘ডোন্ট থ্রো দ্য বেবি আউট উইদ দ্য বাথওয়াটার’, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরম ধন, সন্তানের মতো। মুক্তিযুদ্ধ যাদের নেতৃত্বে এসেছে, তারা যদি পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও লুটেরা হয়ে ওঠে, তার মানে এই নয় যে তাদের বিতাড়িত করার পাশাপাশি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকেও বিতাড়িত করব। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু আপামর জনসাধারণই করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সেই অপচেষ্টাই আমরা জোরেশোরে হতে দেখছি। আজকাল ইউটিউবার, টিকটকাররাও ইতিহাসবেত্তা হয়ে উঠেছেন। নানা সময় তাঁরা নানা ধরনের ব্যবস্থাপত্র হাজির করছেন, আর সেটা দেখে হইহই করে সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে থাকা ব্যবহারকারীরা। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, যাঁরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্ববিরোধী ফতোয়া হাজির করছেন, তাঁদের সেই কর্মের পেছনে লাইক, কমেন্ট, ক্লিক ও রিচের ব্যবসা রয়েছে। যাঁর যত ‘অ্যাঙ্গেজমেন্ট’ তাঁর তত পয়সা উপার্জন। কাজেই অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁদের সার্বক্ষণিক উত্তেজনা উৎপাদন করতে হয়। এই উত্তেজনা উৎপাদন করতে গিয়ে তাঁরা অকপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে চলেছেন। এই অস্থির ডিজিটাল সময়ে সবাই সেসব কনটেন্ট ক্রিয়েটরের হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা ঠাওরে পেছন পেছন চলে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপারে থাকা রহস্যঘেরা অজানা জগতে।
কারও যেন কোনো দায় নেই। ইতিহাসের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একটা গোটা প্রজন্ম শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেল। মাতৃভাষায় দক্ষতা থাকার বিচারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আমরা যেন নিজেদের পতন নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছি প্রতিদিন। পতনের একটি উৎকৃষ্ট নির্দেশক এই স্লোগান। যাঁরা এইসব স্লোগান ব্যবহার করছেন, তাঁরা বুঝতেই পারলেন না, ইতিহাসের পাতায় তাঁরা কলঙ্কিত অধ্যায়ের অংশ হয়ে গেলেন। এই অধ্যায়ের বেদনায় গোটা জাতি একদিন আক্রান্ত হবে। তত দিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
বিধান রিবেরু
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই। সাধারণত রাজনৈতিক মিছিলে আসা মানুষের মুখই মুখরিত হয় স্লোগানে। আন্দোলন ও সংগ্রামে স্লোগান, এক জায়গার জড়ো হওয়া জনতাকে ঐক্যের অনুভূতি দেয় এবং নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে চিত্তকে আরও দৃঢ় করে। কালে কালে স্লোগান পাল্টেছে, কারণ যুগে যুগে মানুষের সংকট পরিবর্তন হয়েছে, সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা পরিবর্তিত হয়েছে। তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনাকে প্রতিপক্ষের সামনে সম্মিলিত সুরে ছন্দের মাত্রায় বেঁধে জানান দিয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। আমরা যদি ১৮৫৭ সালে যাই, দেখব উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহিরা সম্মিলিত কণ্ঠে বলেছিল: ইনকিলাব জিন্দাবাদ, শব্দবন্ধটি হিন্দুস্তানি। তবে অনেকের ধারণা আরবি ‘ইকলাব’ শব্দ থেকে ‘ইনকিলাব’ শব্দটির উদ্ভব। ইকলাবের আসল অর্থ ‘পরিবর্তন’। অপরদিকে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি উর্দু ও ফারসি ভাষার মিশ্রণ। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি শোনা যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীদের মুখে। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে তাঁরাই সম্ভব করে তুলেছিলেন। তাঁরা ও তাঁদের সমভাবাপন্ন রাজনীতিমনস্ক শিক্ষার্থীদের কণ্ঠেই আমরা গত বছর শুনেছিলাম: আমি কে তুমি কে/রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে, কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার। এই প্রজন্মই, যাদের আমরা জেন-জি বলে জানি, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যুক্ত ছিল। সে সময়ও তারা স্লোগান রচনা করেছে এবং রাজপথে ব্যবহার করেছে। সম্ভবত তখন থেকেই তারা স্লোগানে ইংরেজিতে ‘স্ল্যাং’, ব্যবহার করতে শুরু করে। যার পরিণত রূপ আমরা দেখলাম এই কদিন আগে: এক, দুই, তিন, চার/অমুকের ... মার; অথবা টিনের চালে কাউয়া/অমুক একটা ...।
আরও অনেকের মতো আমিও মনে করি, ভাষা মানুষের মনোজগতে প্রবেশের প্রশস্ত দরজা। এই দরজা দিয়ে ঢুকে বোঝা যায় মানুষের মননের গঠন কেমন। জেন-জিদের একটি স্লোগানে আমরা দেখেছি ইনকিলাব ও জিন্দাবাদ শব্দের ব্যবহার। তারা নিজেরা ভারতবিদ্বেষী হলেও, ব্যবহার করছে ‘হিন্দুস্তানি স্লোগান’ এবং স্লোগানটির প্রথম ব্যবহারকারী কিন্তু ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্ম নেওয়া একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও কবি মাওলানা হাসরাত মোহানি। তিনি এটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯২১ সালে। এরপর এই স্লোগান ব্যবহার করেন উপনিবেশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা ভগত সিং। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এখনো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি ব্যবহার করে। সে জন্য এটা ভাবার কোনো কারণ নেই জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনো সাম্যবাদী দল।
অনুপ্রেরণা যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারে এবং অনুপ্রাণিত হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্ধ বিদ্বেষ অবশ্যই দোষের মধ্যে পড়ে এবং সেটি বিপজ্জনকও বটে। আরও বিপদের দেখা মেলে যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি অশ্রাব্য গালি স্থান করে নেয় স্লোগানে। অক্ষমের শেষ অস্ত্র হলো গালি। যখন কেউ খুব সহজেই নিজের ভাষায় গালাগালিকে স্থান দেয়, তখন বুঝতে হবে সে অথবা তারা ভাষাগত দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে গেছে, সৃজনশীলতা দূর হয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা, যা গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র, সেটিও তাদের ভেতর থেকে উবে গেছে।
যখন কেউ কারও সম্পর্কে মানহানিকর, বিশেষ করে অশ্রাব্য গালাগাল ব্যবহার করে, তখন তার সাংস্কৃতিক মান যেমন পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তেমনি তার রুচিও নগ্ন হয়ে পড়ে। গালাগালের ভেতর সাময়িক উত্তেজনা ও ক্রোধ প্রকাশ পেলেও ভুলে গেলে চলবে না, স্লোগানে গালাগাল কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত হয় না। খুব ভেবেচিন্তে সেসব স্লোগান রচনা করা হয় এবং সম্মিলিত কণ্ঠে সেসব উচ্চারিত হয়। একটি মিছিলে বা সমাবেশে ছোট ও বড় নানা বয়সী মানুষ থাকে। ছেলে ও মেয়ে থাকে। ভাবুন, তারা সবাই মিলে অশালীন গালাগালি করছে এবং অদ্ভুত বিষয়, এতে তারা প্রত্যেকেই যেন একত্রে একধরনের ‘যৌনসুখ’ অনুভব করছে।
স্লোগান কি কেবলই স্লোগান? এটি তো রাজনৈতিক সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নানা সময়ে নানা ধরনের স্লোগানে ধরা থাকে সময় ও কালের সংগ্রামী চেতনা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘জয় হিন্দ’, ‘বন্দে মাতরম’। পাকিস্তান আন্দোলনে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু স্লোগান নয়, রণধ্বনিতে পরিণত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। অসহযোগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রচিত একটি স্লোগান: ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’, কী চমৎকার শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে এখানে! কাব্যিক ঢঙের বাইরে গিয়েও হুমকি, ধমক ও শ্লেষের ঠাঁই মিলেছে তখনকার স্লোগানে। তবে সে সময়কার মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের দলগুলোর স্লোগানের সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের স্লোগানে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়। একদল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য হুমকি দিচ্ছে, অন্যায্য চুক্তি বাতিল করার আলটিমেটাম দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে: ‘ডোন্ট থ্রো দ্য বেবি আউট উইদ দ্য বাথওয়াটার’, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরম ধন, সন্তানের মতো। মুক্তিযুদ্ধ যাদের নেতৃত্বে এসেছে, তারা যদি পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও লুটেরা হয়ে ওঠে, তার মানে এই নয় যে তাদের বিতাড়িত করার পাশাপাশি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকেও বিতাড়িত করব। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু আপামর জনসাধারণই করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সেই অপচেষ্টাই আমরা জোরেশোরে হতে দেখছি। আজকাল ইউটিউবার, টিকটকাররাও ইতিহাসবেত্তা হয়ে উঠেছেন। নানা সময় তাঁরা নানা ধরনের ব্যবস্থাপত্র হাজির করছেন, আর সেটা দেখে হইহই করে সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে থাকা ব্যবহারকারীরা। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, যাঁরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্ববিরোধী ফতোয়া হাজির করছেন, তাঁদের সেই কর্মের পেছনে লাইক, কমেন্ট, ক্লিক ও রিচের ব্যবসা রয়েছে। যাঁর যত ‘অ্যাঙ্গেজমেন্ট’ তাঁর তত পয়সা উপার্জন। কাজেই অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁদের সার্বক্ষণিক উত্তেজনা উৎপাদন করতে হয়। এই উত্তেজনা উৎপাদন করতে গিয়ে তাঁরা অকপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে চলেছেন। এই অস্থির ডিজিটাল সময়ে সবাই সেসব কনটেন্ট ক্রিয়েটরের হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা ঠাওরে পেছন পেছন চলে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপারে থাকা রহস্যঘেরা অজানা জগতে।
কারও যেন কোনো দায় নেই। ইতিহাসের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একটা গোটা প্রজন্ম শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেল। মাতৃভাষায় দক্ষতা থাকার বিচারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আমরা যেন নিজেদের পতন নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছি প্রতিদিন। পতনের একটি উৎকৃষ্ট নির্দেশক এই স্লোগান। যাঁরা এইসব স্লোগান ব্যবহার করছেন, তাঁরা বুঝতেই পারলেন না, ইতিহাসের পাতায় তাঁরা কলঙ্কিত অধ্যায়ের অংশ হয়ে গেলেন। এই অধ্যায়ের বেদনায় গোটা জাতি একদিন আক্রান্ত হবে। তত দিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই। সাধারণত রাজনৈতিক মিছিলে আসা মানুষের মুখই মুখরিত হয় স্লোগানে। আন্দোলন ও সংগ্রামে স্লোগান, এক জায়গার জড়ো হওয়া জনতাকে ঐক্যের অনুভূতি দেয় এবং নিজেদের দাবিদাওয়া আদায়ে চিত্তকে আরও দৃঢ় করে। কালে কালে স্লোগান পাল্টেছে, কারণ যুগে যুগে মানুষের সংকট পরিবর্তন হয়েছে, সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা পরিবর্তিত হয়েছে। তারা তাদের আকাঙ্ক্ষা ও বাসনাকে প্রতিপক্ষের সামনে সম্মিলিত সুরে ছন্দের মাত্রায় বেঁধে জানান দিয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। আমরা যদি ১৮৫৭ সালে যাই, দেখব উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহিরা সম্মিলিত কণ্ঠে বলেছিল: ইনকিলাব জিন্দাবাদ, শব্দবন্ধটি হিন্দুস্তানি। তবে অনেকের ধারণা আরবি ‘ইকলাব’ শব্দ থেকে ‘ইনকিলাব’ শব্দটির উদ্ভব। ইকলাবের আসল অর্থ ‘পরিবর্তন’। অপরদিকে ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটি উর্দু ও ফারসি ভাষার মিশ্রণ। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি শোনা যাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা-কর্মীদের মুখে। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে তাঁরাই সম্ভব করে তুলেছিলেন। তাঁরা ও তাঁদের সমভাবাপন্ন রাজনীতিমনস্ক শিক্ষার্থীদের কণ্ঠেই আমরা গত বছর শুনেছিলাম: আমি কে তুমি কে/রাজাকার রাজাকার/কে বলেছে, কে বলেছে/স্বৈরাচার স্বৈরাচার। এই প্রজন্মই, যাদের আমরা জেন-জি বলে জানি, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যুক্ত ছিল। সে সময়ও তারা স্লোগান রচনা করেছে এবং রাজপথে ব্যবহার করেছে। সম্ভবত তখন থেকেই তারা স্লোগানে ইংরেজিতে ‘স্ল্যাং’, ব্যবহার করতে শুরু করে। যার পরিণত রূপ আমরা দেখলাম এই কদিন আগে: এক, দুই, তিন, চার/অমুকের ... মার; অথবা টিনের চালে কাউয়া/অমুক একটা ...।
আরও অনেকের মতো আমিও মনে করি, ভাষা মানুষের মনোজগতে প্রবেশের প্রশস্ত দরজা। এই দরজা দিয়ে ঢুকে বোঝা যায় মানুষের মননের গঠন কেমন। জেন-জিদের একটি স্লোগানে আমরা দেখেছি ইনকিলাব ও জিন্দাবাদ শব্দের ব্যবহার। তারা নিজেরা ভারতবিদ্বেষী হলেও, ব্যবহার করছে ‘হিন্দুস্তানি স্লোগান’ এবং স্লোগানটির প্রথম ব্যবহারকারী কিন্তু ভারতের উত্তর প্রদেশে জন্ম নেওয়া একজন বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও কবি মাওলানা হাসরাত মোহানি। তিনি এটি প্রথম ব্যবহার করেন ১৯২১ সালে। এরপর এই স্লোগান ব্যবহার করেন উপনিবেশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা ভগত সিং। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এখনো ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি ব্যবহার করে। সে জন্য এটা ভাবার কোনো কারণ নেই জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনো সাম্যবাদী দল।
অনুপ্রেরণা যেকোনো জায়গা থেকে আসতে পারে এবং অনুপ্রাণিত হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু অন্ধ বিদ্বেষ অবশ্যই দোষের মধ্যে পড়ে এবং সেটি বিপজ্জনকও বটে। আরও বিপদের দেখা মেলে যখন আমরা প্রত্যক্ষ করি অশ্রাব্য গালি স্থান করে নেয় স্লোগানে। অক্ষমের শেষ অস্ত্র হলো গালি। যখন কেউ খুব সহজেই নিজের ভাষায় গালাগালিকে স্থান দেয়, তখন বুঝতে হবে সে অথবা তারা ভাষাগত দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে গেছে, সৃজনশীলতা দূর হয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা, যা গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র, সেটিও তাদের ভেতর থেকে উবে গেছে।
যখন কেউ কারও সম্পর্কে মানহানিকর, বিশেষ করে অশ্রাব্য গালাগাল ব্যবহার করে, তখন তার সাংস্কৃতিক মান যেমন পরিষ্কার হয়ে ওঠে, তেমনি তার রুচিও নগ্ন হয়ে পড়ে। গালাগালের ভেতর সাময়িক উত্তেজনা ও ক্রোধ প্রকাশ পেলেও ভুলে গেলে চলবে না, স্লোগানে গালাগাল কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত হয় না। খুব ভেবেচিন্তে সেসব স্লোগান রচনা করা হয় এবং সম্মিলিত কণ্ঠে সেসব উচ্চারিত হয়। একটি মিছিলে বা সমাবেশে ছোট ও বড় নানা বয়সী মানুষ থাকে। ছেলে ও মেয়ে থাকে। ভাবুন, তারা সবাই মিলে অশালীন গালাগালি করছে এবং অদ্ভুত বিষয়, এতে তারা প্রত্যেকেই যেন একত্রে একধরনের ‘যৌনসুখ’ অনুভব করছে।
স্লোগান কি কেবলই স্লোগান? এটি তো রাজনৈতিক সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নানা সময়ে নানা ধরনের স্লোগানে ধরা থাকে সময় ও কালের সংগ্রামী চেতনা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘জয় হিন্দ’, ‘বন্দে মাতরম’। পাকিস্তান আন্দোলনে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু স্লোগান নয়, রণধ্বনিতে পরিণত হয় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। অসহযোগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রচিত একটি স্লোগান: ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’, কী চমৎকার শব্দের প্রয়োগ ঘটেছে এখানে! কাব্যিক ঢঙের বাইরে গিয়েও হুমকি, ধমক ও শ্লেষের ঠাঁই মিলেছে তখনকার স্লোগানে। তবে সে সময়কার মধ্যপন্থী ও বামপন্থীদের দলগুলোর স্লোগানের সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের স্লোগানে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়। একদল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য হুমকি দিচ্ছে, অন্যায্য চুক্তি বাতিল করার আলটিমেটাম দিচ্ছে, গণতান্ত্রিক দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে: ‘ডোন্ট থ্রো দ্য বেবি আউট উইদ দ্য বাথওয়াটার’, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের পরম ধন, সন্তানের মতো। মুক্তিযুদ্ধ যাদের নেতৃত্বে এসেছে, তারা যদি পরবর্তী সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও লুটেরা হয়ে ওঠে, তার মানে এই নয় যে তাদের বিতাড়িত করার পাশাপাশি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকেও বিতাড়িত করব। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু আপামর জনসাধারণই করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সেই অপচেষ্টাই আমরা জোরেশোরে হতে দেখছি। আজকাল ইউটিউবার, টিকটকাররাও ইতিহাসবেত্তা হয়ে উঠেছেন। নানা সময় তাঁরা নানা ধরনের ব্যবস্থাপত্র হাজির করছেন, আর সেটা দেখে হইহই করে সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে থাকা ব্যবহারকারীরা। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন, যাঁরা ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্ববিরোধী ফতোয়া হাজির করছেন, তাঁদের সেই কর্মের পেছনে লাইক, কমেন্ট, ক্লিক ও রিচের ব্যবসা রয়েছে। যাঁর যত ‘অ্যাঙ্গেজমেন্ট’ তাঁর তত পয়সা উপার্জন। কাজেই অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁদের সার্বক্ষণিক উত্তেজনা উৎপাদন করতে হয়। এই উত্তেজনা উৎপাদন করতে গিয়ে তাঁরা অকপটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে চলেছেন। এই অস্থির ডিজিটাল সময়ে সবাই সেসব কনটেন্ট ক্রিয়েটরের হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা ঠাওরে পেছন পেছন চলে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপারে থাকা রহস্যঘেরা অজানা জগতে।
কারও যেন কোনো দায় নেই। ইতিহাসের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একটা গোটা প্রজন্ম শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেল। মাতৃভাষায় দক্ষতা থাকার বিচারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আমরা যেন নিজেদের পতন নিজেরাই প্রত্যক্ষ করছি প্রতিদিন। পতনের একটি উৎকৃষ্ট নির্দেশক এই স্লোগান। যাঁরা এইসব স্লোগান ব্যবহার করছেন, তাঁরা বুঝতেই পারলেন না, ইতিহাসের পাতায় তাঁরা কলঙ্কিত অধ্যায়ের অংশ হয়ে গেলেন। এই অধ্যায়ের বেদনায় গোটা জাতি একদিন আক্রান্ত হবে। তত দিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।
একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনা
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু রপ্তানির পণ্য নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকার ভিত্তি। গ্রামের নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণী পোশাকশিল্পে কাজ করে নিজের জন্য শুধু আয় করছেন না, তাঁদের ঘামে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গড়ে উঠছে। এই শিল্প খাতে শুধু তৈরি পোশাকই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পোশাক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাপড়ের টুকরাগুল
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ এখন যেন বিপর্যয়কর এক অবস্থায় পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দু-এক দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে আগুন লাগার ঘটনা। এতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেবৈশ্বিক পর্নো সাইটে নামডাক করেছেন বাংলাদেশি যুগল। চলতি বছরের অক্টোবরে পর্নো তারকাদের আন্তর্জাতিক পারফরমার র্যাঙ্কিংয়ে তাঁরা অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন। এক বছরে তাঁদের পর্নো ভিডিও দেখা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখের বেশিবার। বান্দরবান থেকে এই যুগলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেশ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের সমস্যা, সেটির সমাধান তো হয়ইনি, উল্টো ধনবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে যে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আগের শাসকদের মতোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাই অব্যাহত রেখেছেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনার ভেতরই প্রোথিত ছিল। সিরাজুল আলম খানের নিজের ব্যাপারটা মূলত ছিল ব্যক্তিগত; ক্ষমতার উত্তরাধিকার তাঁরই প্রাপ্য—এটা ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস; কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শেখ মুজিবের ভগিনীপুত্র শেখ ফজলুল হক মনি। সিরাজুল আলম খান তাঁর নিজের শক্তির প্রমাণ দেখাতে চেয়েছিলেন এবং সেটা প্রধান কারণ। এ জন্য তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। প্রকৃত সমাজতন্ত্রীরা তখন মাঠে দৃশ্যমান নন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ‘উগ্রপন্থী’ বলে চিহ্নিত, তাঁরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে গোপন তৎপরতায় ছিলেন। এরাই আবার কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, নয়তো রয়েছেন কারাগারে বন্দী অবস্থায়। কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন। তার আগেই এ দেশে রুশ-চীন বিভাজন ঘটে। এই বিভাজন বাম আন্দোলনে বড় ক্ষতি করে।
স্বাধীনতার পরে রুশপন্থীরাই ছিলেন দৃশ্যমান।
তাঁরা ‘উগ্রপন্থা’ তো শুরুতেই পরিহার করেছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী শাসকেরা যে পূর্ববঙ্গকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেটা অনুধাবনেও তাঁদের বিস্তর বিলম্ব ঘটে। ফলে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর দ্বন্দ্বটাই যে তখন প্রধান ছিল, এটা না বুঝে তাঁরা ‘সারা’ পাকিস্তানেই শ্রেণিসংগ্রাম অব্যাহত রেখে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পরে উঠতি বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যে শাসনক্ষমতা পেয়ে গেছেন, এটা তাঁরা দেখেও দেখতে চাইলেন না। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই শাসকদের সহায়তাতেই অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজটি সমাপ্ত করার। উগ্রপন্থা পরিহারের জন্য মস্কো থেকে তখন তাঁরা পরামর্শও পেয়েছিলেন বৈকি। পরিস্থিতিটা এ রকম দাঁড়িয়েছিল যে রুশপন্থীরা সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, চীনপন্থীরা মাঠে নেই, সমাজতন্ত্রের আওয়াজটা সমর্থক পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে এবং আওয়াজটা জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। হিটলার-মুসোলিনির নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিজমকে রুখে দেওয়ার জন্য ইউরোপে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতন্ত্রীরাও তেমন পন্থা ধরেই এগোতে থাকলেন। ‘মুজিব-বিরোধী’ জাতীয়তাবাদীরা খাড়া করলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আসলে উভয় দলই ছিল যথার্থ সমাজতন্ত্রের বিরোধী, যদিও উভয় দলই সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলে দাবি করত।
বামপন্থীদের দমনে সরকার তো তৎপর ছিলই, জাসদও তাতে যুক্ত হলো, যদিও প্রচ্ছন্নভাবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের গলা-ফাটানো আওয়াজ তুলে সামাজিক বিপ্লবের জন্য অধীর হয়ে পড়েছিল যে তরুণেরা, তাদের একাংশকে তারা নিজেদের দলে টেনে নিয়ে বিপ্লব-বিরোধিতার অন্ধগলিতে ঠেলে দিল। একই সঙ্গে আবার সম্ভাব্য সমাজবিপ্লবীদের উন্মোচন করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সহায়ক হলো। লাল পতাকা তুলে লাল পতাকার বিরোধিতা করার আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশেই সংঘটিত হলো বৈকি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে, তখন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, জাতীয়তাবাদের কথা তাঁর বক্তৃতায় শোনা যায়নি। এর কারণ এই যে যুদ্ধটা যেহেতু চলছিল জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই এবং এর অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষাটা যেহেতু ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্র থেকে কেবল যে আয়তনে নয়, চরিত্রেও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাই জাতীয়তাবাদের কথা বলা ছিল অপ্রয়োজনীয়।
জাতীয়তাবাদের কথা না-বলার পেছনে অবশ্য আরও একটি কারণ ছিল, সেটা হলো ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনাগ্রহ। ইন্দিরা গান্ধীর শঙ্কা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম না আবার দুই বাংলার মানুষদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ সৃষ্টি করে। তেমন আবেগ প্রবল হলে বাংলাদেশের বামপন্থীদের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনবিরোধী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের একটি মিলনের সূত্রপাত ঘটে যেতে পারে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের দৃষ্টান্ত তো চোখের সামনেই ছিল; জাতীয় মুক্তির ওই লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে, দুই বাংলার কমিউনিস্টরা ওই রকম কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, এমন শঙ্কা ভারতীয় শাসকদের কাছে অমূলক ঠেকেনি। ইন্দিরা গান্ধী তখন নকশালবাড়ী আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তিনি তাই চাননি যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থী তরুণেরা যোগ দিক। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ও ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিন্ন।
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বিশেষভাবেই বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন নেতা। ভারতে তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে যাননি, গিয়েছিলেন যোদ্ধা হিসেবে। যুদ্ধের ব্যাপারে সহায়তা চাইবার জন্য দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত পতাকার একটি নমুনা সঙ্গে রেখেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পতাকার ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্রের অবস্থান দেখিয়ে এই বলে আশ্বস্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যে বাংলাদেশ বলতে তাঁরা শুধু পূর্ববঙ্গকেই বোঝেন, তার বাইরের বাংলাভাষী অঞ্চলকে নয়। ‘জয় বাংলা’র অর্থ গোটা বাংলার জয় নয়, পূর্ববঙ্গের জয় হোক, এটাই তাঁরা চান; তার বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হোক, এটা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীদের দল আওয়ামী লীগ যেমন চায়নি, সেটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না ভারতের জাতীয়তাবাদীদেরও; বহির্বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর তো বটেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকেও দ্রুত যুদ্ধাবসান কাঙ্ক্ষিত ছিল। কারণ ওই একই—নতুন একটি ভিয়েতনামের অভ্যুদয়ের শঙ্কা।
নানা দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের আওয়াজই যথেষ্ট ছিল, জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তোলা ছিল অনাবশ্যক। কিন্তু শেখ মুজিব যখন পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে এলেন, জাতীয়তাবাদের আওয়াজটা তারপর থেকেই উঠতে থাকল। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের দাবিকে দুর্বল করার জাতীয়তাবাদী যে চিন্তা মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ধারণ করতেন, যুদ্ধ শেষে সেটিকেই ফেরত আনতে তিনি উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সঙ্গেই কেবল নয়, একেবারে প্রথমেই জাতীয়তাবাদকে স্থান দেওয়া হলো। আর এই সংযোজনের তাৎপর্য প্রকাশ পেল বাঙালি ছাড়াও যেসব স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষ বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে, সংবিধানে তাদের অস্তিত্বই অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। এমনকি তাদেরকে বাঙালি হয়ে যেতেও বলা হয়েছিল; অনেকটা সেভাবেই, একদা যেভাবে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের বলা হয়েছিল পাকিস্তানি বনে যেতে। বিদগ্ধজনদের মুখে এবং তাঁদের লেখাতেও বলা শুরু হলো যে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র। এটি যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, সে ধরনের প্রত্যাশা তাঁদের খেয়ালে রইল না।
পরাধীন ভারতবর্ষে মূল সমস্যাটি ছিল শ্রেণির; এবং সেটিকে সামনে আনার জন্যই জাতি সমস্যার সমাধান অত্যাবশ্যক ছিল। সাতচল্লিশের পরে পাকিস্তানের ব্যাপারেও ছিল ওই একই কথা। জাতি সমস্যার সমাধানের সেখানেও প্রয়োজন ছিল শ্রেণি সমস্যা সমাধানে হাত দেওয়ার জন্য। একাত্তরে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হলো, জাতি সমস্যার পুরোপুরি না হলেও একরকমের সমাধান মিলল। স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগুলোকে সাংবিধানিকভাবে অবশ্য এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তবু তারা যে আছে, সেটা মেনে নেওয়া হয়েছে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিদানের পর থেকে বাংলাদেশে অন্তত সরকারিভাবে বাংলা ভাষা ছাড়াও অন্য মাতৃভাষাগুলো রক্ষা করার এবং স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষদের জন্য প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তাটা স্বীকৃতি পেয়েছে।
কিন্তু মূল যে সমস্যা—শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের সমস্যা, সেটির সমাধান তো হয়ইনি, উল্টো ধনবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে যে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আগের শাসকদের মতোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাই অব্যাহত রেখেছেন। আর পুঁজিবাদী উন্নয়ন যে ধনবৈষম্য বাড়াতে বাধ্য, সেটা তো সর্বজনবিদিত।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনার ভেতরই প্রোথিত ছিল। সিরাজুল আলম খানের নিজের ব্যাপারটা মূলত ছিল ব্যক্তিগত; ক্ষমতার উত্তরাধিকার তাঁরই প্রাপ্য—এটা ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস; কিন্তু তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শেখ মুজিবের ভগিনীপুত্র শেখ ফজলুল হক মনি। সিরাজুল আলম খান তাঁর নিজের শক্তির প্রমাণ দেখাতে চেয়েছিলেন এবং সেটা প্রধান কারণ। এ জন্য তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। প্রকৃত সমাজতন্ত্রীরা তখন মাঠে দৃশ্যমান নন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা ‘উগ্রপন্থী’ বলে চিহ্নিত, তাঁরা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে গোপন তৎপরতায় ছিলেন। এরাই আবার কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, নয়তো রয়েছেন কারাগারে বন্দী অবস্থায়। কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন। তার আগেই এ দেশে রুশ-চীন বিভাজন ঘটে। এই বিভাজন বাম আন্দোলনে বড় ক্ষতি করে।
স্বাধীনতার পরে রুশপন্থীরাই ছিলেন দৃশ্যমান।
তাঁরা ‘উগ্রপন্থা’ তো শুরুতেই পরিহার করেছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয়তাবাদী শাসকেরা যে পূর্ববঙ্গকে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, সেটা অনুধাবনেও তাঁদের বিস্তর বিলম্ব ঘটে। ফলে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর দ্বন্দ্বটাই যে তখন প্রধান ছিল, এটা না বুঝে তাঁরা ‘সারা’ পাকিস্তানেই শ্রেণিসংগ্রাম অব্যাহত রেখে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পরে উঠতি বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা যে শাসনক্ষমতা পেয়ে গেছেন, এটা তাঁরা দেখেও দেখতে চাইলেন না। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই শাসকদের সহায়তাতেই অসম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজটি সমাপ্ত করার। উগ্রপন্থা পরিহারের জন্য মস্কো থেকে তখন তাঁরা পরামর্শও পেয়েছিলেন বৈকি। পরিস্থিতিটা এ রকম দাঁড়িয়েছিল যে রুশপন্থীরা সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, চীনপন্থীরা মাঠে নেই, সমাজতন্ত্রের আওয়াজটা সমর্থক পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে এবং আওয়াজটা জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে। হিটলার-মুসোলিনির নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিজমকে রুখে দেওয়ার জন্য ইউরোপে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতন্ত্রীরাও তেমন পন্থা ধরেই এগোতে থাকলেন। ‘মুজিব-বিরোধী’ জাতীয়তাবাদীরা খাড়া করলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আসলে উভয় দলই ছিল যথার্থ সমাজতন্ত্রের বিরোধী, যদিও উভয় দলই সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলে দাবি করত।
বামপন্থীদের দমনে সরকার তো তৎপর ছিলই, জাসদও তাতে যুক্ত হলো, যদিও প্রচ্ছন্নভাবে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের গলা-ফাটানো আওয়াজ তুলে সামাজিক বিপ্লবের জন্য অধীর হয়ে পড়েছিল যে তরুণেরা, তাদের একাংশকে তারা নিজেদের দলে টেনে নিয়ে বিপ্লব-বিরোধিতার অন্ধগলিতে ঠেলে দিল। একই সঙ্গে আবার সম্ভাব্য সমাজবিপ্লবীদের উন্মোচন করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে সহায়ক হলো। লাল পতাকা তুলে লাল পতাকার বিরোধিতা করার আরও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশেই সংঘটিত হলো বৈকি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে, তখন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, জাতীয়তাবাদের কথা তাঁর বক্তৃতায় শোনা যায়নি। এর কারণ এই যে যুদ্ধটা যেহেতু চলছিল জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই এবং এর অভ্যন্তরীণ আকাঙ্ক্ষাটা যেহেতু ছিল পাকিস্তানি রাষ্ট্র থেকে কেবল যে আয়তনে নয়, চরিত্রেও সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, তাই জাতীয়তাবাদের কথা বলা ছিল অপ্রয়োজনীয়।
জাতীয়তাবাদের কথা না-বলার পেছনে অবশ্য আরও একটি কারণ ছিল, সেটা হলো ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনাগ্রহ। ইন্দিরা গান্ধীর শঙ্কা ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম না আবার দুই বাংলার মানুষদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেগ সৃষ্টি করে। তেমন আবেগ প্রবল হলে বাংলাদেশের বামপন্থীদের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনবিরোধী পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের একটি মিলনের সূত্রপাত ঘটে যেতে পারে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে ভিত্তি করে। ভিয়েতনামের যুদ্ধের দৃষ্টান্ত তো চোখের সামনেই ছিল; জাতীয় মুক্তির ওই লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে, দুই বাংলার কমিউনিস্টরা ওই রকম কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে, এমন শঙ্কা ভারতীয় শাসকদের কাছে অমূলক ঠেকেনি। ইন্দিরা গান্ধী তখন নকশালবাড়ী আন্দোলন দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তিনি তাই চাননি যে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থী তরুণেরা যোগ দিক। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ও ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিন্ন।
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বিশেষভাবেই বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন নেতা। ভারতে তিনি আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে যাননি, গিয়েছিলেন যোদ্ধা হিসেবে। যুদ্ধের ব্যাপারে সহায়তা চাইবার জন্য দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সময় তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত পতাকার একটি নমুনা সঙ্গে রেখেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পতাকার ভেতরে বাংলাদেশের মানচিত্রের অবস্থান দেখিয়ে এই বলে আশ্বস্ত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যে বাংলাদেশ বলতে তাঁরা শুধু পূর্ববঙ্গকেই বোঝেন, তার বাইরের বাংলাভাষী অঞ্চলকে নয়। ‘জয় বাংলা’র অর্থ গোটা বাংলার জয় নয়, পূর্ববঙ্গের জয় হোক, এটাই তাঁরা চান; তার বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হোক, এটা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদীদের দল আওয়ামী লীগ যেমন চায়নি, সেটি কাঙ্ক্ষিত ছিল না ভারতের জাতীয়তাবাদীদেরও; বহির্বিশ্বের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর তো বটেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের দিক থেকেও দ্রুত যুদ্ধাবসান কাঙ্ক্ষিত ছিল। কারণ ওই একই—নতুন একটি ভিয়েতনামের অভ্যুদয়ের শঙ্কা।
নানা দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের আওয়াজই যথেষ্ট ছিল, জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তোলা ছিল অনাবশ্যক। কিন্তু শেখ মুজিব যখন পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে এলেন, জাতীয়তাবাদের আওয়াজটা তারপর থেকেই উঠতে থাকল। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের দাবিকে দুর্বল করার জাতীয়তাবাদী যে চিন্তা মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ধারণ করতেন, যুদ্ধ শেষে সেটিকেই ফেরত আনতে তিনি উদ্গ্রীব হয়ে উঠলেন। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির সঙ্গেই কেবল নয়, একেবারে প্রথমেই জাতীয়তাবাদকে স্থান দেওয়া হলো। আর এই সংযোজনের তাৎপর্য প্রকাশ পেল বাঙালি ছাড়াও যেসব স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষ বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে, সংবিধানে তাদের অস্তিত্বই অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে। এমনকি তাদেরকে বাঙালি হয়ে যেতেও বলা হয়েছিল; অনেকটা সেভাবেই, একদা যেভাবে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের বলা হয়েছিল পাকিস্তানি বনে যেতে। বিদগ্ধজনদের মুখে এবং তাঁদের লেখাতেও বলা শুরু হলো যে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র। এটি যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, সে ধরনের প্রত্যাশা তাঁদের খেয়ালে রইল না।
পরাধীন ভারতবর্ষে মূল সমস্যাটি ছিল শ্রেণির; এবং সেটিকে সামনে আনার জন্যই জাতি সমস্যার সমাধান অত্যাবশ্যক ছিল। সাতচল্লিশের পরে পাকিস্তানের ব্যাপারেও ছিল ওই একই কথা। জাতি সমস্যার সমাধানের সেখানেও প্রয়োজন ছিল শ্রেণি সমস্যা সমাধানে হাত দেওয়ার জন্য। একাত্তরে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হলো, জাতি সমস্যার পুরোপুরি না হলেও একরকমের সমাধান মিলল। স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগুলোকে সাংবিধানিকভাবে অবশ্য এখনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তবু তারা যে আছে, সেটা মেনে নেওয়া হয়েছে এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে ইউনেসকোর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতিদানের পর থেকে বাংলাদেশে অন্তত সরকারিভাবে বাংলা ভাষা ছাড়াও অন্য মাতৃভাষাগুলো রক্ষা করার এবং স্বতন্ত্র জাতিসত্তার মানুষদের জন্য প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রয়োজনীয়তাটা স্বীকৃতি পেয়েছে।
কিন্তু মূল যে সমস্যা—শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির সম্পর্কের সমস্যা, সেটির সমাধান তো হয়ইনি, উল্টো ধনবৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। সেটা হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে যে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আগের শাসকদের মতোই পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাই অব্যাহত রেখেছেন। আর পুঁজিবাদী উন্নয়ন যে ধনবৈষম্য বাড়াতে বাধ্য, সেটা তো সর্বজনবিদিত।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই।
২২ আগস্ট ২০২৫বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু রপ্তানির পণ্য নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকার ভিত্তি। গ্রামের নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণী পোশাকশিল্পে কাজ করে নিজের জন্য শুধু আয় করছেন না, তাঁদের ঘামে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গড়ে উঠছে। এই শিল্প খাতে শুধু তৈরি পোশাকই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পোশাক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাপড়ের টুকরাগুল
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ এখন যেন বিপর্যয়কর এক অবস্থায় পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দু-এক দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে আগুন লাগার ঘটনা। এতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেবৈশ্বিক পর্নো সাইটে নামডাক করেছেন বাংলাদেশি যুগল। চলতি বছরের অক্টোবরে পর্নো তারকাদের আন্তর্জাতিক পারফরমার র্যাঙ্কিংয়ে তাঁরা অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন। এক বছরে তাঁদের পর্নো ভিডিও দেখা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখের বেশিবার। বান্দরবান থেকে এই যুগলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেশোয়েব সাম্য সিদ্দিক
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু রপ্তানির পণ্য নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকার ভিত্তি। গ্রামের নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণী পোশাকশিল্পে কাজ করে নিজের জন্য শুধু আয় করছেন না, তাঁদের ঘামে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গড়ে উঠছে। এই শিল্প খাতে শুধু তৈরি পোশাকই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পোশাক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাপড়ের টুকরাগুলো গুরুত্বপূর্ণ, যাকে আমরা ঝুট বলে বর্জ্য আকারে ফেলে দিই। কিন্তু এই ঝুটেরও বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। আমরা ভাবি, কাটিং টেবিলের পাশে যেসব কাপড়ের ছোট্ট টুকরা জমে থাকে, সেগুলো আর কোনো কাজের নয়। অথচ এই ফেলে দেওয়া ঝুটই হতে পারে নতুন অর্থনীতির বীজ।
২০২৫ সালে বাংলাদেশে পোশাক কারখানাগুলো থেকে প্রায় ৫ দশমিক ৭ লাখ (প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার) টন টেক্সটাইল বর্জ্য তৈরি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে Thomson Reuters Foundation, TexSPACE Today এবং The Centre for Child Rights and Business-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। এই বিপুল বর্জ্য সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে তা হতে পারে টেকসই উৎপাদনের শক্তিশালী কাঁচামাল। এটি নতুন একটি শিল্প হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। আজকের পোশাকের বিশ্ববাজার কেবল সস্তা দাম চায় না, চায় দায়বদ্ধতাও। পোশাকের দাম দেওয়ার আগে তারা জানতে চায় এসব তৈরি করতে গিয়ে কী পরিমাণ উপকরণ সাশ্রয় হলো, কত বর্জ্য পুনর্ব্যবহার হলো এবং কত কাঁচামাল উদ্বৃত্ত হলো? যে কারখানা এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, সেই কারখানার দর বাড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা।
এই দায়বদ্ধতার চাহিদা এক বিরাট সুযোগ। ঝুট বাছাই, গ্রেডিং, বেইলিং, স্পিনিং, ফ্যাব্রিক—প্রতিটি ধাপে নতুন কর্মসংস্থান হতে পারে; বিশেষ করে নারী শ্রমিক আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য তৈরি হতে পারে নতুন এক শিল্পের দ্বার। দেশের মধ্যে রিসাইকেলড সুতা তৈরি করা গেলে আরেক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। কারণ, এতে অর্থের সাশ্রয় হবে, কাঁচামাল আমদানির ঝুঁকি কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে।
তবে এই সম্ভাবনার পথ একেবারেই মসৃণ নয়। এর সামনে আছে গেঁথে থাকা বহু পুরোনো গিঁট। প্রথম গিঁটটা আসে আমাদের মনোভাব থেকে। কারখানাগুলোতে এখনো বর্জ্য আলাদা করার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। কাটিং টেবিলের পাশে ঝুট পড়ে থাকে। ভালো-মন্দ সব একসঙ্গে থাকে। এতে ভালো মানের ঝুট খারাপের সঙ্গে মিশে গিয়ে মান হারায়। দাম পড়ে যায়। বাজারে এর জন্য আলাদা মূল্য মেলে না। শ্রমিকও বোঝে না কোনটা রাখবে, কোনটা ফেলবে।
দ্বিতীয় বড় সমস্যা প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে। আমাদের বেশির ভাগ কারখানা এখনো পুরোনো ধরনের ওপেন-এন্ড স্পিনিং পদ্ধতিতে আটকে আছে। এই প্রযুক্তিতে শুধু মাঝারি মানের সুতা তৈরি হয়। এর দাম কম এবং চাহিদাও সীমিত। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বড় ব্র্যান্ডগুলো উচ্চমানের পুনর্ব্যবহৃত (রিসাইকেলড) সুতা চায়। এমন সুতা বানাতে দরকার আধুনিক মেকানিক্যাল ও কেমিক্যাল রিসাইক্লিং যন্ত্র। এই যন্ত্রপাতি অনেক ব্যয়বহুল। তবে এগুলো না আনলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। ফলে আমরা এই গ্লোবাল দৌড়ে পিছিয়েই পড়ছি।
তৃতীয় গিঁট মালিকানা নিয়ে। ঝুট আসলে কার? কারখানা বলবে তাদের। রিসাইক্লার বলবে তাদের। আবার মধ্যস্বত্বভোগীরাও হাত গলিয়ে বসে থাকে মাঝখানে। ফলে কার মালিকানায় কবে ঝুট বিক্রি হবে, তার কোনো নিয়ম থাকে না। বাজারে দাম হঠাৎ বাড়ে, আবার হঠাৎ পড়ে। একেক দিন একেক রকম দর হয়। বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করাই কঠিন হয়ে পড়ে তখন।
এই তিনটি গিঁট সমস্যার সমাধান না হলে সম্ভাবনা শুধু ভাবনার মধ্যে আটকে থাকবে। ঝুট তখন কাঁচামাল নয়, বোঝা হয়ে যাবে। এই গিঁট খুলতে হলে প্রথমে দরকার স্বচ্ছ ভাবনা ও পরিকল্পনা। পরিকল্পনাহীন কোনো কিছুই সম্ভাবনা বয়ে আনে না। সে জন্য কারখানার কাটিং টেবিল থেকে শুরু করতে হবে নিয়মের চর্চা। ঝুটকে ফেলে দেওয়ার জিনিস না ভেবে রাখতে হবে আলাদা বাক্সে। রং, ফ্যাব্রিকের ধরন এবং গ্রেড অনুযায়ী আলাদা করতে হবে। প্রতিদিনের হিসাবও রাখতে হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। কারণ, যেটা মাপা যায়, সেটাই উন্নত করা যায়। এরপর দরকার স্বচ্ছতা, প্রতিটি ঝুটের যাত্রাপথ জানা থাকতে হবে। কারখানার মেঝে থেকে গুদাম, গুদাম থেকে ট্রাক, আর ট্রাক থেকে সুতা কারখানা পর্যন্ত এর যাত্রাপথ চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে। তাহলে ঝুট হারিয়ে যাবে না। ক্রেতার আস্থাও বাড়বে।
এভাবে ক্রেতারা নিশ্চিত হতে পারবে যে এই সুতা সত্যিই পুনর্ব্যবহৃত। এরপর জরুরি দরকার ঝুটের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ। শিল্পাঞ্চলভিত্তিক কমন রিসাইক্লিং পার্ক গড়ে তুলতে হবে। তারপর শ্রমিকদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এতে তাঁদের দক্ষতার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। পুরো প্রক্রিয়ার মানও ওপরের দিকে উঠবে। এখন শুধু সাধারণ টি-শার্ট বানিয়ে গেলে হবে না, বাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতেই হবে। ডেনিম, ফ্লিস, অ্যাকটিভ পোশাক এমনকি পুরোনো কাপড় নতুনভাবে ডিজাইন করেও তৈরি করতে হবে। এতে প্রতি পণ্যে মূল্য অনেক বাড়বে। বাংলাদেশ গর্বের সঙ্গে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে পারবে।
পাশাপাশি এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য সস্তা ঋণ আর প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। স্থানীয় ডিজাইনারদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করলে এই উদ্যোক্তারা পুরোনো কাপড় দিয়ে নতুন ধরনের পোশাক (আপসাইকেলড কালেকশন) বানাতে পারবেন। এতে বাজারে নতুন ভ্যালু অ্যাড যোগ হবে। শিল্পে আসবে সৃজনশীলতার রং। শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা আর সৃজনশীলতা—এই তিন শক্তিই পারে এই গিঁট খুলতে। একবার খুলে গেলে ঝুট আর বর্জ্য নয়, হবে সম্পদ।
আজকের প্রতিযোগিতা শুধু কম দামে পণ্য বানানোর প্রতিযোগিতা নয়, এখন এটি দায়বদ্ধতার প্রতিযোগিতা। যে দেশ নিজের বর্জ্যকে কাঁচামালে রূপ দিতে পারে, আর সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা দেখাতে পারে, বিশ্ববাজার সেই দেশকে আস্থা দেয়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২০২৫ সালেই কয়েক লাখ টন বর্জ্য তৈরি করেছে। এই সংখ্যা ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু আসলে এটা এক বিশাল সম্ভাবনা। বর্জ্য মানেই বোঝা—এমন ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সঠিক নিয়ম আর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করলে এই বর্জ্যই হতে পারে নতুন শিল্পের ভিত।
লেখক: শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু রপ্তানির পণ্য নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকার ভিত্তি। গ্রামের নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণী পোশাকশিল্পে কাজ করে নিজের জন্য শুধু আয় করছেন না, তাঁদের ঘামে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গড়ে উঠছে। এই শিল্প খাতে শুধু তৈরি পোশাকই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পোশাক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাপড়ের টুকরাগুলো গুরুত্বপূর্ণ, যাকে আমরা ঝুট বলে বর্জ্য আকারে ফেলে দিই। কিন্তু এই ঝুটেরও বিশাল বাজার গড়ে উঠেছে। আমরা ভাবি, কাটিং টেবিলের পাশে যেসব কাপড়ের ছোট্ট টুকরা জমে থাকে, সেগুলো আর কোনো কাজের নয়। অথচ এই ফেলে দেওয়া ঝুটই হতে পারে নতুন অর্থনীতির বীজ।
২০২৫ সালে বাংলাদেশে পোশাক কারখানাগুলো থেকে প্রায় ৫ দশমিক ৭ লাখ (প্রায় ৫ লাখ ৭৭ হাজার) টন টেক্সটাইল বর্জ্য তৈরি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে Thomson Reuters Foundation, TexSPACE Today এবং The Centre for Child Rights and Business-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। এই বিপুল বর্জ্য সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে তা হতে পারে টেকসই উৎপাদনের শক্তিশালী কাঁচামাল। এটি নতুন একটি শিল্প হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। আজকের পোশাকের বিশ্ববাজার কেবল সস্তা দাম চায় না, চায় দায়বদ্ধতাও। পোশাকের দাম দেওয়ার আগে তারা জানতে চায় এসব তৈরি করতে গিয়ে কী পরিমাণ উপকরণ সাশ্রয় হলো, কত বর্জ্য পুনর্ব্যবহার হলো এবং কত কাঁচামাল উদ্বৃত্ত হলো? যে কারখানা এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, সেই কারখানার দর বাড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা।
এই দায়বদ্ধতার চাহিদা এক বিরাট সুযোগ। ঝুট বাছাই, গ্রেডিং, বেইলিং, স্পিনিং, ফ্যাব্রিক—প্রতিটি ধাপে নতুন কর্মসংস্থান হতে পারে; বিশেষ করে নারী শ্রমিক আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য তৈরি হতে পারে নতুন এক শিল্পের দ্বার। দেশের মধ্যে রিসাইকেলড সুতা তৈরি করা গেলে আরেক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হবে। কারণ, এতে অর্থের সাশ্রয় হবে, কাঁচামাল আমদানির ঝুঁকি কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাঁচবে।
তবে এই সম্ভাবনার পথ একেবারেই মসৃণ নয়। এর সামনে আছে গেঁথে থাকা বহু পুরোনো গিঁট। প্রথম গিঁটটা আসে আমাদের মনোভাব থেকে। কারখানাগুলোতে এখনো বর্জ্য আলাদা করার অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। কাটিং টেবিলের পাশে ঝুট পড়ে থাকে। ভালো-মন্দ সব একসঙ্গে থাকে। এতে ভালো মানের ঝুট খারাপের সঙ্গে মিশে গিয়ে মান হারায়। দাম পড়ে যায়। বাজারে এর জন্য আলাদা মূল্য মেলে না। শ্রমিকও বোঝে না কোনটা রাখবে, কোনটা ফেলবে।
দ্বিতীয় বড় সমস্যা প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে। আমাদের বেশির ভাগ কারখানা এখনো পুরোনো ধরনের ওপেন-এন্ড স্পিনিং পদ্ধতিতে আটকে আছে। এই প্রযুক্তিতে শুধু মাঝারি মানের সুতা তৈরি হয়। এর দাম কম এবং চাহিদাও সীমিত। কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বড় ব্র্যান্ডগুলো উচ্চমানের পুনর্ব্যবহৃত (রিসাইকেলড) সুতা চায়। এমন সুতা বানাতে দরকার আধুনিক মেকানিক্যাল ও কেমিক্যাল রিসাইক্লিং যন্ত্র। এই যন্ত্রপাতি অনেক ব্যয়বহুল। তবে এগুলো না আনলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। ফলে আমরা এই গ্লোবাল দৌড়ে পিছিয়েই পড়ছি।
তৃতীয় গিঁট মালিকানা নিয়ে। ঝুট আসলে কার? কারখানা বলবে তাদের। রিসাইক্লার বলবে তাদের। আবার মধ্যস্বত্বভোগীরাও হাত গলিয়ে বসে থাকে মাঝখানে। ফলে কার মালিকানায় কবে ঝুট বিক্রি হবে, তার কোনো নিয়ম থাকে না। বাজারে দাম হঠাৎ বাড়ে, আবার হঠাৎ পড়ে। একেক দিন একেক রকম দর হয়। বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করাই কঠিন হয়ে পড়ে তখন।
এই তিনটি গিঁট সমস্যার সমাধান না হলে সম্ভাবনা শুধু ভাবনার মধ্যে আটকে থাকবে। ঝুট তখন কাঁচামাল নয়, বোঝা হয়ে যাবে। এই গিঁট খুলতে হলে প্রথমে দরকার স্বচ্ছ ভাবনা ও পরিকল্পনা। পরিকল্পনাহীন কোনো কিছুই সম্ভাবনা বয়ে আনে না। সে জন্য কারখানার কাটিং টেবিল থেকে শুরু করতে হবে নিয়মের চর্চা। ঝুটকে ফেলে দেওয়ার জিনিস না ভেবে রাখতে হবে আলাদা বাক্সে। রং, ফ্যাব্রিকের ধরন এবং গ্রেড অনুযায়ী আলাদা করতে হবে। প্রতিদিনের হিসাবও রাখতে হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। কারণ, যেটা মাপা যায়, সেটাই উন্নত করা যায়। এরপর দরকার স্বচ্ছতা, প্রতিটি ঝুটের যাত্রাপথ জানা থাকতে হবে। কারখানার মেঝে থেকে গুদাম, গুদাম থেকে ট্রাক, আর ট্রাক থেকে সুতা কারখানা পর্যন্ত এর যাত্রাপথ চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে। তাহলে ঝুট হারিয়ে যাবে না। ক্রেতার আস্থাও বাড়বে।
এভাবে ক্রেতারা নিশ্চিত হতে পারবে যে এই সুতা সত্যিই পুনর্ব্যবহৃত। এরপর জরুরি দরকার ঝুটের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো নির্মাণ। শিল্পাঞ্চলভিত্তিক কমন রিসাইক্লিং পার্ক গড়ে তুলতে হবে। তারপর শ্রমিকদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। এতে তাঁদের দক্ষতার পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়বে। পুরো প্রক্রিয়ার মানও ওপরের দিকে উঠবে। এখন শুধু সাধারণ টি-শার্ট বানিয়ে গেলে হবে না, বাজারে টিকে থাকতে হলে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতেই হবে। ডেনিম, ফ্লিস, অ্যাকটিভ পোশাক এমনকি পুরোনো কাপড় নতুনভাবে ডিজাইন করেও তৈরি করতে হবে। এতে প্রতি পণ্যে মূল্য অনেক বাড়বে। বাংলাদেশ গর্বের সঙ্গে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে পারবে।
পাশাপাশি এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য সস্তা ঋণ আর প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। স্থানীয় ডিজাইনারদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করলে এই উদ্যোক্তারা পুরোনো কাপড় দিয়ে নতুন ধরনের পোশাক (আপসাইকেলড কালেকশন) বানাতে পারবেন। এতে বাজারে নতুন ভ্যালু অ্যাড যোগ হবে। শিল্পে আসবে সৃজনশীলতার রং। শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা আর সৃজনশীলতা—এই তিন শক্তিই পারে এই গিঁট খুলতে। একবার খুলে গেলে ঝুট আর বর্জ্য নয়, হবে সম্পদ।
আজকের প্রতিযোগিতা শুধু কম দামে পণ্য বানানোর প্রতিযোগিতা নয়, এখন এটি দায়বদ্ধতার প্রতিযোগিতা। যে দেশ নিজের বর্জ্যকে কাঁচামালে রূপ দিতে পারে, আর সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা দেখাতে পারে, বিশ্ববাজার সেই দেশকে আস্থা দেয়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ২০২৫ সালেই কয়েক লাখ টন বর্জ্য তৈরি করেছে। এই সংখ্যা ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু আসলে এটা এক বিশাল সম্ভাবনা। বর্জ্য মানেই বোঝা—এমন ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সঠিক নিয়ম আর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করলে এই বর্জ্যই হতে পারে নতুন শিল্পের ভিত।
লেখক: শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
ব্যাংকার এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই।
২২ আগস্ট ২০২৫একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনা
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ এখন যেন বিপর্যয়কর এক অবস্থায় পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দু-এক দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে আগুন লাগার ঘটনা। এতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেবৈশ্বিক পর্নো সাইটে নামডাক করেছেন বাংলাদেশি যুগল। চলতি বছরের অক্টোবরে পর্নো তারকাদের আন্তর্জাতিক পারফরমার র্যাঙ্কিংয়ে তাঁরা অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন। এক বছরে তাঁদের পর্নো ভিডিও দেখা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখের বেশিবার। বান্দরবান থেকে এই যুগলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেমাহফুজা খাতুন
বাংলাদেশ এখন যেন বিপর্যয়কর এক অবস্থায় পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দু-এক দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে আগুন লাগার ঘটনা। এতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার আগে মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় এবং চট্টগ্রামের ইপিজেডে একটি বড় কোম্পানিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই তিনটি ঘটনায় দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক মাস আগে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং দেশের সিভিল এভিয়েশন সেফটি এবং জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে,
তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে মানুষের প্রশ্ন এখন একটাই—দেশে নিরাপত্তা বলতে কিছু আছে, নাকি সবই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে?
আগে আমরা শুধু আগুন নিয়ে আতঙ্কিত হতাম, এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আজ কোনো জায়গাই যেন আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মকানুন না মানা, তদারকির চরম অভাব এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাই এখন দুর্ঘটনাকে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত করেছে। বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণে বা দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি মানে কেবল দুর্ঘটনা নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও এক গভীর সংকট।
এসব অগ্নিদুর্ঘটনার মূল সমস্যা আসলে একটিই—জবাবদিহির অভাব। বারবার দুর্ঘটনার পরও এর জন্য কেউ শাস্তি পাচ্ছে না, যথাযথ জবাবদিহিও নিশ্চিত হচ্ছে না। নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি প্রকট। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম নেই, বিমানের নিরাপত্তা পরীক্ষা দুর্বল, ফায়ার সার্ভিসে জনবল কম, এভিয়েশন অথরিটির নজরদারির অভাবও এসবের জন্য দায়ী। এ ছাড়া অনুমোদন, লাইসেন্স প্রদান এবং রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়মের ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে হতাশাজনক হলো তদন্তের চিত্র, যেখানে সবকিছুর কারণ ‘শর্টসার্কিট’ বা ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ বলে দায় এড়ানো যেন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দোষীরা শাস্তিহীন থাকার কারণে দুর্ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তবে একের পর এক বড় দুর্ঘটনার পেছনে পরিকল্পিত নাশকতার অদৃশ্য ছায়াও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা; যেমন বিমানবন্দর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বড় কলকারখানা টার্গেট হওয়া উদ্বেগজনক। এটা কি শুধু কাকতালীয়, নাকি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির একটি কৌশল? এসব বিষয়ও গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা অতি জরুরি। এমনকি কিছু কারখানায় আগুন দিয়ে বিমা জালিয়াতির প্রমাণও পাওয়া গেছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিল্পায়ন, অর্থনীতি, শিক্ষা, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনও চরম ঝুঁকিতে পড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ কমবে, পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক মহলে বিমান চলাচলের সেফটি রেটিং কমে যেতে পারে।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু যখন অব্যবস্থাপনা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তখন তা জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ফায়ার অডিট এবং সেফটি সার্টিফিকেট হালনাগাদ করা, এভিয়েশন সেফটি কমিশন গঠন ও স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও ট্রেনিং এয়ার রুটের নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। অগ্নিকাণ্ড এবং বিমান দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি, স্কুল, কলেজ, কলকারখানা ও অফিসে নিয়মিত ফায়ার ও সেফটি ড্রিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে—দেশের মানুষের জীবন আর জাতীয় নিরাপত্তা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। জাতির দাবি আজ একটাই—নিরাপত্তা চাই, জবাবদিহি চাই।
লেখক: মাহফুজা খাতুন
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ এখন যেন বিপর্যয়কর এক অবস্থায় পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দু-এক দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে আগুন লাগার ঘটনা। এতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তার আগে মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় এবং চট্টগ্রামের ইপিজেডে একটি বড় কোম্পানিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এই তিনটি ঘটনায় দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক মাস আগে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওপর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং দেশের সিভিল এভিয়েশন সেফটি এবং জাতীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে,
তা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে মানুষের প্রশ্ন এখন একটাই—দেশে নিরাপত্তা বলতে কিছু আছে, নাকি সবই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে?
আগে আমরা শুধু আগুন নিয়ে আতঙ্কিত হতাম, এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। আজ কোনো জায়গাই যেন আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মকানুন না মানা, তদারকির চরম অভাব এবং নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাই এখন দুর্ঘটনাকে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত করেছে। বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণে বা দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি মানে কেবল দুর্ঘটনা নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও এক গভীর সংকট।
এসব অগ্নিদুর্ঘটনার মূল সমস্যা আসলে একটিই—জবাবদিহির অভাব। বারবার দুর্ঘটনার পরও এর জন্য কেউ শাস্তি পাচ্ছে না, যথাযথ জবাবদিহিও নিশ্চিত হচ্ছে না। নিরাপত্তাব্যবস্থার ঘাটতি প্রকট। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম নেই, বিমানের নিরাপত্তা পরীক্ষা দুর্বল, ফায়ার সার্ভিসে জনবল কম, এভিয়েশন অথরিটির নজরদারির অভাবও এসবের জন্য দায়ী। এ ছাড়া অনুমোদন, লাইসেন্স প্রদান এবং রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়মের ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে হতাশাজনক হলো তদন্তের চিত্র, যেখানে সবকিছুর কারণ ‘শর্টসার্কিট’ বা ‘যান্ত্রিক ত্রুটি’ বলে দায় এড়ানো যেন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। দোষীরা শাস্তিহীন থাকার কারণে দুর্ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
তবে একের পর এক বড় দুর্ঘটনার পেছনে পরিকল্পিত নাশকতার অদৃশ্য ছায়াও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা; যেমন বিমানবন্দর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বড় কলকারখানা টার্গেট হওয়া উদ্বেগজনক। এটা কি শুধু কাকতালীয়, নাকি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির একটি কৌশল? এসব বিষয়ও গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা অতি জরুরি। এমনকি কিছু কারখানায় আগুন দিয়ে বিমা জালিয়াতির প্রমাণও পাওয়া গেছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিল্পায়ন, অর্থনীতি, শিক্ষা, এমনকি সাধারণ মানুষের জীবনও চরম ঝুঁকিতে পড়বে। বিদেশি বিনিয়োগ কমবে, পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক মহলে বিমান চলাচলের সেফটি রেটিং কমে যেতে পারে।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য, কিন্তু যখন অব্যবস্থাপনা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়, তখন তা জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় ফায়ার অডিট এবং সেফটি সার্টিফিকেট হালনাগাদ করা, এভিয়েশন সেফটি কমিশন গঠন ও স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও ট্রেনিং এয়ার রুটের নতুন নীতিমালা প্রণয়ন এবং জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করা আবশ্যক। অগ্নিকাণ্ড এবং বিমান দুর্ঘটনা-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এর পাশাপাশি, স্কুল, কলেজ, কলকারখানা ও অফিসে নিয়মিত ফায়ার ও সেফটি ড্রিল বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে—দেশের মানুষের জীবন আর জাতীয় নিরাপত্তা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। জাতির দাবি আজ একটাই—নিরাপত্তা চাই, জবাবদিহি চাই।
লেখক: মাহফুজা খাতুন
শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই।
২২ আগস্ট ২০২৫একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনা
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু রপ্তানির পণ্য নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকার ভিত্তি। গ্রামের নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণী পোশাকশিল্পে কাজ করে নিজের জন্য শুধু আয় করছেন না, তাঁদের ঘামে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গড়ে উঠছে। এই শিল্প খাতে শুধু তৈরি পোশাকই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পোশাক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাপড়ের টুকরাগুল
১২ ঘণ্টা আগেবৈশ্বিক পর্নো সাইটে নামডাক করেছেন বাংলাদেশি যুগল। চলতি বছরের অক্টোবরে পর্নো তারকাদের আন্তর্জাতিক পারফরমার র্যাঙ্কিংয়ে তাঁরা অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন। এক বছরে তাঁদের পর্নো ভিডিও দেখা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখের বেশিবার। বান্দরবান থেকে এই যুগলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়
বৈশ্বিক পর্নো সাইটে নামডাক করেছেন বাংলাদেশি যুগল। চলতি বছরের অক্টোবরে পর্নো তারকাদের আন্তর্জাতিক পারফরমার র্যাঙ্কিংয়ে তাঁরা অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন। এক বছরে তাঁদের পর্নো ভিডিও দেখা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখের বেশিবার। বান্দরবান থেকে এই যুগলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পর্নো এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে ইতিবাচক কিছু কথা বলার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের সামাজিক মূল্যবোধের কথা বিবেচনায় নিলে এই ধরনের সংবাদ খুবই বিব্রতকর।
বিব্রতকর হলেও পর্নো বিষয়ে কথা বলা উচিত। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গোপন ম্যাগাজিন বা বইপত্র প্রকাশিত হতো। স্থূল যৌনতাই ছিল সেই প্রকাশনাগুলোর মূল উপজীব্য। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভিসিআর বা ভিসিপির মাধ্যমে নীল ছবির আমদানি হয়। আশির দশকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ হানা দিয়েছে নীল ছবির ডেরায়, এ রকম খবর তখন দেখা যেত পত্রপত্রিকায়। বর্তমান যুগে ইন্টারনেট দুনিয়ায় রুচিশীল কনটেন্টের বিপরীতে রুচিহীন কনটেন্টেরও ছড়াছড়ি। ফলে অর্থ উপার্জনের জন্য যে কেউ বেছে নিতে পারছেন এমন সব পথ, যা একসময় ভেবেও দেখা যেত না।
গ্রেপ্তার যুগল বড়ই সেয়ানা। ভিডিও আপলোড করা ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রচার চালাতেন। নতুনদের এসব প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাতেন। সম্ভাব্য আগ্রহীদের ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ হিসেবে যুক্ত করার জন্য টেলিগ্রাম চ্যানেলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন দিতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরিয়েই কারিগরি জ্ঞান দিয়ে যা ইচ্ছে তা ঘটানো যায়—এটাও তাঁরা প্রমাণ করেছেন। ফলে চাইলেই এই সখাত সলিলে আত্মবিসর্জন দেওয়া যায়। ব্যাপারটা এতই সহজ হয়ে গেছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ অনেকটা নেশার মতো। বাস্তব জীবনের ভালোবাসা বা যৌন সম্পর্কের প্রতি তাতে আগ্রহ কমে যায়। তাৎক্ষণিক আনন্দের সঙ্গে এর যোগ আছে বলে অনেকে এসব নীল ছবি দেখার জন্য অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। লুকিয়ে পর্নোগ্রাফির আস্বাদ গ্রহণ করতে করতে সামাজিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে পড়ে। যৌনতার অবাস্তব, অতিরঞ্জিত ও বাণিজ্যিক প্রকাশ ঘটানো এই পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে নর-নারীর বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো নিয়ে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এসব সাইট দেখতে দেখতে যেকোনো মানুষের একাকিত্ব ও বিষণ্নতা বেড়ে যেতে পারে, যা জীবনকে ভুল পথে পরিচালনা করতে পারে।
এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। স্কুলেই বয়স-উপযোগী যৌনশিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরি করা, অভিভাবকদেরও সচেতন হয়ে সন্তানদের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি খোলাসা করা, পর্নোতে আসক্ত হয়ে পড়লে মানবিক সহায়তা দেওয়া দরকার। তবে তার চেয়ে বেশি দরকার তরুণদের সামনে এমন এক সৃজনশীল, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করা, যা পর্নোর অশুভ থাবা থেকে তরুণদের রক্ষা করতে পারে। গ্রেপ্তার যুগলের মতো আরও কেউ যদি এই অপকর্মে লিপ্ত থাকেন, তাহলে তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।
বৈশ্বিক পর্নো সাইটে নামডাক করেছেন বাংলাদেশি যুগল। চলতি বছরের অক্টোবরে পর্নো তারকাদের আন্তর্জাতিক পারফরমার র্যাঙ্কিংয়ে তাঁরা অষ্টম স্থান অধিকার করেছেন। এক বছরে তাঁদের পর্নো ভিডিও দেখা হয়েছে ২ কোটি ৬৭ লাখের বেশিবার। বান্দরবান থেকে এই যুগলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পর্নো এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে ইতিবাচক কিছু কথা বলার সুযোগ নেই। আমাদের দেশের সামাজিক মূল্যবোধের কথা বিবেচনায় নিলে এই ধরনের সংবাদ খুবই বিব্রতকর।
বিব্রতকর হলেও পর্নো বিষয়ে কথা বলা উচিত। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গোপন ম্যাগাজিন বা বইপত্র প্রকাশিত হতো। স্থূল যৌনতাই ছিল সেই প্রকাশনাগুলোর মূল উপজীব্য। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভিসিআর বা ভিসিপির মাধ্যমে নীল ছবির আমদানি হয়। আশির দশকে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ হানা দিয়েছে নীল ছবির ডেরায়, এ রকম খবর তখন দেখা যেত পত্রপত্রিকায়। বর্তমান যুগে ইন্টারনেট দুনিয়ায় রুচিশীল কনটেন্টের বিপরীতে রুচিহীন কনটেন্টেরও ছড়াছড়ি। ফলে অর্থ উপার্জনের জন্য যে কেউ বেছে নিতে পারছেন এমন সব পথ, যা একসময় ভেবেও দেখা যেত না।
গ্রেপ্তার যুগল বড়ই সেয়ানা। ভিডিও আপলোড করা ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের কর্মকাণ্ডের প্রচার চালাতেন। নতুনদের এসব প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাতেন। সম্ভাব্য আগ্রহীদের ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ হিসেবে যুক্ত করার জন্য টেলিগ্রাম চ্যানেলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিজ্ঞাপন দিতেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি না পেরিয়েই কারিগরি জ্ঞান দিয়ে যা ইচ্ছে তা ঘটানো যায়—এটাও তাঁরা প্রমাণ করেছেন। ফলে চাইলেই এই সখাত সলিলে আত্মবিসর্জন দেওয়া যায়। ব্যাপারটা এতই সহজ হয়ে গেছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ অনেকটা নেশার মতো। বাস্তব জীবনের ভালোবাসা বা যৌন সম্পর্কের প্রতি তাতে আগ্রহ কমে যায়। তাৎক্ষণিক আনন্দের সঙ্গে এর যোগ আছে বলে অনেকে এসব নীল ছবি দেখার জন্য অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। লুকিয়ে পর্নোগ্রাফির আস্বাদ গ্রহণ করতে করতে সামাজিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে পড়ে। যৌনতার অবাস্তব, অতিরঞ্জিত ও বাণিজ্যিক প্রকাশ ঘটানো এই পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে নর-নারীর বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো নিয়ে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এসব সাইট দেখতে দেখতে যেকোনো মানুষের একাকিত্ব ও বিষণ্নতা বেড়ে যেতে পারে, যা জীবনকে ভুল পথে পরিচালনা করতে পারে।
এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো খুব সহজ কাজ নয়। স্কুলেই বয়স-উপযোগী যৌনশিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরি করা, অভিভাবকদেরও সচেতন হয়ে সন্তানদের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি খোলাসা করা, পর্নোতে আসক্ত হয়ে পড়লে মানবিক সহায়তা দেওয়া দরকার। তবে তার চেয়ে বেশি দরকার তরুণদের সামনে এমন এক সৃজনশীল, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করা, যা পর্নোর অশুভ থাবা থেকে তরুণদের রক্ষা করতে পারে। গ্রেপ্তার যুগলের মতো আরও কেউ যদি এই অপকর্মে লিপ্ত থাকেন, তাহলে তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হোক।
এই উপমহাদেশে সমবেত জনতার কণ্ঠে প্রতিবাদের যে ভাষা আমরা দেখি, অন্ত্যমিলসহ বা ছাড়া, তা আদতে, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কাপলেট’, বাংলায় ‘দ্বিপদী’ সেটাই। স্বরবৃত্ত ছন্দে অন্ত্যমিলে স্লোগান রচনা করলে, সমবেত কণ্ঠে তার আবেদন বেশ জোরালো হয়। আর সে ক্ষেত্রে শব্দচয়ন যদি মিছরির ছুরির মতো হয়, তবে তো কথাই নেই।
২২ আগস্ট ২০২৫একদা ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ মুজিববাদ, মুজিববাদ’ বলা সিরাজুল আলম খানই মুজিবের বলয় থেকে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করেছিলেন। সেটা ছিল পুঁজিবাদী ঘরানার জাতীয়তাবাদীদের মতোই সমাজতন্ত্রবিরোধী দল। নিজেদের দলের নাম তাঁরা যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক রেখেছিলেন, সেটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়; নামটি তাঁদের চেতনা
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধু রপ্তানির পণ্য নয়, বরং লাখো মানুষের জীবিকার ভিত্তি। গ্রামের নারী-পুরুষ বা তরুণ-তরুণী পোশাকশিল্পে কাজ করে নিজের জন্য শুধু আয় করছেন না, তাঁদের ঘামে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও গড়ে উঠছে। এই শিল্প খাতে শুধু তৈরি পোশাকই গুরুত্বপূর্ণ নয়, পোশাক তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাপড়ের টুকরাগুল
১২ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশ এখন যেন বিপর্যয়কর এক অবস্থায় পড়েছে। গত এক সপ্তাহে দু-এক দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি হলো, দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে আগুন লাগার ঘটনা। এতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগে