Ajker Patrika

ভূ-রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক

চিররঞ্জন সরকার
ব্যাংককে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদিকে একটি ছবি উপহার দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং
ব্যাংককে বৈঠকে নরেন্দ্র মোদিকে একটি ছবি উপহার দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: প্রেস উইং

দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের সমীকরণ বদলে দিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের হাল ধরেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মূলত এর পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে একধরনের শীতলতা সৃষ্টি হয়েছে। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত এই দুটি দেশের সম্পর্কে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।

এই সম্পর্কের অবনতির পেছনে বেশ কিছু কারণও রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এর আগে ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধাও প্রত্যাহার করে নেয় ভারত। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বন্দরগুলোতে কনটেইনারজটের কারণ দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এর পেছনে রয়েছে ‘অন্য’ কারণ। মূলত ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফর এবং সেখানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য (সেভেন সিস্টার্স) নিয়ে করা মন্তব্য ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। ড. ইউনূস ওই অঞ্চলে সমুদ্র যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘অভিভাবক’-এর ভূমিকা পালনের কথা বলেছিলেন, যা ভারত ভালোভাবে নেয়নি। ব্যাংককে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকের পরই ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।

অন্যদিকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা এবং ভারতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয়ও দুই দেশের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ব্যাংককের বৈঠকেও মোদি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে সম্পর্কের এই টানাপোড়েনের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির নানা তৎপরতা। ভারতীয় পত্রপত্রিকাগুলো দাবি করছে, লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি পুনরায় চালুর ক্ষেত্রে চীন ও পাকিস্তানের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে, যা ভারতীয় সীমান্তের কাছে হওয়ায় দিল্লির নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। এ ছাড়া দীর্ঘ ১৫ বছর পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের ঢাকা সফর এবং খুব শিগগির দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের কর্মসূচিও বিশ্লেষকদের নজর এড়ায়নি। তিস্তা প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণকেও ভারত ভালোভাবে দেখছে না।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে? ড. ইউনূস অবশ্য বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সম্পর্কের অবনতির কথা অস্বীকার করেছেন এবং এটিকে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ ও ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ভারতের কূটনীতিকেরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাঁদের কারও কারও মতে, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকার কারণে তাঁর বিদায়ের পর সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান ইউনূস প্রশাসন ভারতের প্রতি ‘বিশেষ প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব’ দেখাচ্ছে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ‘অস্বাভাবিক’। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে এবং এই মুহূর্তে এই মনোভাব পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে এই সম্পর্কের অবনতি কি ভারতের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ? ভারতীয় কূটনীতিকেরা স্বীকার করুন আর না-ই করুন, দীর্ঘদিনের লালিত সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কের এই পরিবর্তন অবশ্যই ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। শেখ হাসিনার আমলে দুই দেশের মধ্যে সংযোগ, বাণিজ্য, কৌশলগত সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি হচ্ছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে তা থমকে যেতে পারে। সবকিছু এখন নেতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে, যা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ।

শুধু ভারত নয়, দুই দেশের মধ্যে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও অনুকূল নয়। কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় বিরোধের উৎস এবং কিছু ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। সংকটগুলোর মূলে রয়েছে পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত ইস্যু, বিশেষত তিস্তা ও ফারাক্কার পানি বণ্টন। এটিকে কেবল উৎস ও নিম্নধারার পানিপ্রবাহের গতানুগতিক বিরোধ হিসেবে দেখলে ভুল হবে, এর আঞ্চলিক ও স্থানীয় প্রভাব অনেক গভীর। বাণিজ্যিক বিষয়ে ভারসাম্যহীনতা এবং কোনো একটি দেশের ওপর অন্য দেশের আধিপত্য বা চাপিয়ে দেওয়া মনোভাব সম্পর্কের ক্ষেত্রে অস্বস্তি তৈরি করে। বিদ্যুৎ ক্রয়, শাড়ি আমদানি বা ট্রানজিটের মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের নিজস্ব অধিকার ও পছন্দকে সম্মান জানানো জরুরি।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শেখ হাসিনার ভূমিকা এবং ভারতে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক একটি উল্লেখযোগ্য সংকট তৈরি করেছে। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দুই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে এবং একে অপরের প্রতি অভিযোগের তির ছোড়া হচ্ছে। উভয় দেশেই সাম্প্রদায়িক সংবেদনশীলতা একটি উদ্বেগের বিষয়। ভারতে মুসলিমবিরোধী নীতি

এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ—এই দুটি বিষয় পারস্পরিক আস্থাকে দুর্বল করে তুলছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

ভারত একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ায় তাদের মধ্যে একটি স্বাভাবিক অহংবোধ কাজ করে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যেও আত্মমর্যাদাবোধ প্রবল। এই মনস্তাত্ত্বিক দিকটি অনেক সময় পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভারত প্রসঙ্গে বিভিন্ন মেরুকরণ দেখা যায়। অনেক নেতাই মনে করেন, ভারতের সঙ্গে গোপন চুক্তি হয়েছে। এই ধরনের অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ জনগণের মধ্যেও বিভ্রান্তি ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

এই পরিস্থিতিতে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা এবং সংকটগুলো সমাধানের জন্য উভয় দেশের সরকার, রাজনীতিবিদ ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, সম্মান ও বোঝাপড়া জরুরি। বৈরিতার পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা উভয় দেশের জন্যই কল্যাণকর। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ভারতের গুরুত্ব এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সংকট সমাধানের কিছু উপায় আলোচনা করা যেতে পারে। যেকোনো সমস্যার সমাধানে নিয়মিত ও আন্তরিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিকল্প নেই। তিস্তা ও ফারাক্কার পানি বণ্টনসহ অমীমাংসিত বিষয়গুলোতে নিয়মিত এবং আন্তরিক আলোচনা প্রয়োজন। উভয় পক্ষকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে বসতে হবে। বাণিজ্যিক লেনদেন বা অন্য কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে কোনো দেশের ওপর জোর খাটিয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের নিজস্ব চাহিদা ও অধিকারকে ভারতের সম্মান জানাতে হবে। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাংলাদেশের হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়।

‘হাসিনা ফ্যাক্টর’ সমাধানে বাংলাদেশকেই উচ্চপর্যায়ে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করতে হবে। ভারতকে তাদের উদ্বেগের কথা বুঝিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করতে হবে। বিকল্প হিসেবে সৌদি আরবে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাবও বিবেচনা করা যেতে পারে, যদিও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। মূল লক্ষ্য হলো এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যেন দুই দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি না ঘটে। উভয় দেশকে নিজ নিজ দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কেবল লোকদেখানো নিরাপত্তা বা আশ্বাস প্রদান যথেষ্ট নয়। সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতকারীদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে এবং এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে কোনো দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অন্য দেশের নীতি দ্বারা আতঙ্কিত বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অহংবোধের কোনো স্থান নেই। উভয় দেশের নেতৃত্বকে বাস্তববাদী ও কৌশলগতভাবে সম্পর্ক পরিচালনা করতে হবে। নিজ দেশের স্বার্থ এবং জনগণের মঙ্গলের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উচিত ভারতের সঙ্গে গোপন চুক্তি নিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ না করে বরং সরকারের কাছে তথ্য চেয়ে স্পষ্টীকরণ দাবি করা। উত্তপ্ত ও অসত্য কথাবার্তা পরিহার করা উচিত, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াতে পারে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতা ও দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমন করা সম্ভব। যেকোনো ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেন বড় ধরনের সংঘাত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের বর্তমান গতি-প্রকৃতি ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে একটি নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে যে ফাটল ধরেছে, তা মেরামত করা এবং একটি স্থিতিশীল ও পারস্পরিক কল্যাণকর সম্পর্ক বজায় রাখা উভয় দেশের জন্যই এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন সরকারের নীতি এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ভারত কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত