Ajker Patrika

মানুষ ও প্রযুক্তি

শহিদুল ইসলাম
Thumbnail image

আশির দশক থেকে সংবাদপত্রে সামান্য লেখালেখি করার অভ্যাস। তখন লেখার সঙ্গে ছবি ছাপানো হতো না। পরে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে লেখার বাঁ পাশে ছবি ছাপানো শুরু হয়। তখন আমার ছবি চেয়ে নেওয়া হয়েছিল। কবে থেকে বলতে পারব না, ক্যামেরায় তোলা ছবির পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি ছবি ছাপানো হচ্ছে বেশ কিছু পত্রিকায়। সেই ছবি আমার ভালো লাগেনি। জানলাম, ধীরে ধীরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছবি প্রকৃত ছবিকে সরিয়ে দেবে।

আমরা কেবল মুখ দিয়েই কথা বলি না। সারা শরীর দিয়ে কথা বলি। তা শব্দযন্ত্র মুখ দিয়ে নির্গত হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে কেবল মুখভঙ্গিই নয়, হাত-পাসহ শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করে। বিভিন্ন ভাষার মানুষের মুখভঙ্গি, শারীরিক মুভমেন্ট হয় ভিন্ন ভিন্ন। ছবিতে সেই সব অঙ্গভঙ্গি প্রতিফলিত হয় না সত্যি, কিন্তু নিজের চেহারাটি চিনতে আমার অসুবিধা হয় না। আমার পরিচিত জনও সহজেই আমাকে চিনতে পারেন।

আমার জনৈক ছাত্রের একটি লেখায় ছবিটি দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার ছবিটা এমন বিকৃত কেন?’
সে বলল, ‘স্যার, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি ছবি।’ গবেষকেরা বলেছেন, এআইয়ের তৈরি মুখমণ্ডল দিয়ে খুব সহজে মানুষকে বোকাও বানানো সম্ভব। এমনটি ভবিষ্যৎ বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে ডিজিটাল প্রতারকদের দ্বারা মানুষের প্রতারিত হওয়ার ঘটনা বাড়বে। এমনকি আইডেনটিটি থেফটের (পরিচয় চুরি) মতো ঘটনাও হয়তো অহরহ ঘটবে। সেই সঙ্গে একটি পার্থক্যের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেটা হলো, শারীরিক অঙ্গভঙ্গির ভিত্তিতে বুঝতে পারা যায় যে কোনটি সত্যিকার মানুষের ছবি আর কোনটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বানানো।

এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিপদের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে প্রতিবেদনটি। ডক্টর অ্যামি ডাওয়েল ভরসা দেন, ‘আমরা হয়তো আর বেশি দিন শারীরিক অঙ্গভঙ্গির ওপর ভরসা রাখতে পারব না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। মানুষের সত্যিকার মুখচ্ছবি ও এআইয়ের বানানো মুখচ্ছবির পার্থক্য খুব শিগগির মুছে যাবে।’ 

কী ভয়ংকর কথা! এ নিয়ে হারারির কথা মনে পড়ল। তিনি এখন এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় অথরিটি। সম্প্রতি এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের কোথায় নিয়ে চলেছে, তা আমি জানি না।’ তা ছাড়া পৃথিবীর ছয় শর বেশি বিজ্ঞানী এক যুক্ত বিবৃতিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আর গবেষণা না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের এ আহ্বানে কোনো লাভ হবে না, ইতিহাস তা বারবার প্রমাণ করেছে। মানুষের কৌতূহল ও জানার আগ্রহের কোনো সীমা নেই। সে জন্যই বিজ্ঞান এই পর্যায়ে আসতে পেরেছে। আমরা দেখেছি, একটা নতুন আবিষ্কার মানুষের অনেক অসুবিধা দূর করেছে। কিছুদিন পরই জানা যায় তার নতুন জটিলতার কথা, নতুন বিপদের কথা। 

এআইয়ের ছবি সম্পর্কেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না। যদি সত্যিকার ছবি ও এআইয়ের তৈরি ছবির মধ্যে পার্থক্য মুছে গিয়ে কোনো অরাজকতা ও হুমকির সৃষ্টি হয়, তাহলে গবেষকেরা বলছেন যে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তা মোকাবিলা করা সম্ভব; অর্থাৎ সচেতনতার বৃদ্ধির ভারে মানুষ যখন সাংঘাতিকভাবে ভারাক্রান্ত, তখন তার ওপর আরও সচেতনতার বোঝা চাপালে, মানুষ কি আরও বেশি আরামে থাকবে? এভাবেই মানুষের সহজ-সরল জীবন ক্রমান্বয়ে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে চলেছে। মানুষের আরাম হারাম হয়ে যাচ্ছে।

মানুষের পক্ষে যদি সচেতনতা বৃদ্ধির আর ক্ষমতা না থাকে, তাহলেও বিজ্ঞানীরা উপায় বাতলে দিয়েছেন, ‘মানুষ যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি চেহারা শনাক্ত করতে না পারে, তখন এমন একটি টুলস (হাতিয়ার) তৈরি করতে হবে, যা এআই প্রতারকদের শনাক্ত করতে সক্ষম হবে।’

কী ভয়ানক কথা। আরও প্রযুক্তির ভার! প্রযুক্তির ভারে শেষ পর্যন্ত তার স্রষ্টা মানুষের অস্তিত্ব থাকবে তো?

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত