বিভুরঞ্জন সরকার
ভাষা আন্দোলনের ৭৫ বছর পেরিয়ে কতগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে ঘুরেফিরেই আসছে। রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি বাদ দিলে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন ও অগ্রগতি কী? ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, নিশ্চয়ই এটা গৌরবের। কিন্তু বাংলাকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিতে আমাদের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা কী? ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে, অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ভাষার মধ্যে বাংলা নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রসারে ১২ বছরে অগ্রগতি কতটুকু?
অথচ মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মদানের ইতিহাস বাঙালিরাই প্রথম তৈরি করেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। দাবি ছিল, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার, যা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষ ছিলেন বাংলাভাষী। বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, সে ভাষারই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কায়েমি স্বার্থে এই চিরায়ত গণতান্ত্রিক নীতিবোধ ভেঙে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে বাঙালি তার প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান ছিল একটি বহুভাষিক মানুষের দেশ। বাংলাভাষী সংখ্যায় বেশি। এ ছাড়া উর্দু, সিন্ধি, পশতুভাষী মানুষও ছিলেন। সে জন্য বাঙালিদের দাবি ছিল একাধিক ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কিন্তু তোলা হয়নি। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হয়েছিল।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তির ভাষা বুঝত না, জোরের ভাষা প্রয়োগে পারদর্শী ছিল। আবার বাঙালির রক্তে বহমান প্রতিবাদের ধারা। সংখ্যাল্প মানুষের ভাষাকে ‘একমাত্র’ রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে তাই বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল প্রথম মুহূর্ত থেকেই। এই ধারার এক পরিণতির দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। হ্যাঁ, ঢাকা শহর রক্তে ভাসিয়ে সারা দেশে তার দ্যুতি ছড়িয়ে বাঙালি যে গৌরবের সমাচার তৈরি করেছিল, তার ধারাবাহিকতাই আমাদের নিয়ে গেছে স্বাধীনতার পথে, গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে। তাই একুশ আমাদের কাছে অহংকার। একুশ মানে মাথা নত না করা। শুরুতে একুশ ছিল শোকের দিন, শহীদ দিবস। কিন্তু ১৯৫২ থেকে ২০২৩ সালে এসে একুশে শোকের দিন নেই। একুশ প্রতিবাদের দিন, উদযাপনের দিন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার দিন।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা এখনো নগ্নপদে প্রভাতফেরি করি, অমর ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাঁদের স্মৃতি তর্পণ করি, ফুলে ফুলে শহীদ মিনারের পাদদেশ ভরে তুলি, কিন্তু পরিবেশটা আর শোক দিবসের থাকে না। একুশে এখন উদযাপন করা হয় উৎসবের মেজাজে। এতেও দোষের কিছু নেই। একুশ আমাদের শোকে মুহ্যমান হতে শেখায়নি, শিখিয়েছে প্রতিবাদী হতে, বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা একটি কবিতা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত হয়ে একুশের অমর সংগীত হয়ে উঠেছে। এমন বাঙালি কি আছেন, যাঁর মুখে কখনো ধ্বনিত হয়নি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’
না, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভুলিনি। আমাদের জাতীয় জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে, তখনই একুশের স্মরণ নিয়ে আমরা সাহসে বুক বেঁধেছি। সংকটে আমরা বিহ্বল হইনি। একুশ আমাদের পথ দেখিয়েছে।
এত বছর পরে এসে একটি প্রশ্ন মনে খোঁচা দেয়, আমরা একুশকে আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী করে ফেলছি না তো? একুশ পালনের আয়োজনের ব্যাপকতা আছে, কিন্তু একুশের চেতনার সঙ্গে এসব আয়োজন সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে কি? বাংলা আজ রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারে আমরা কতটুকু যত্নবান? আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ অটুট আছে তো? বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য বিদেশি, প্রধানত ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে বাংলাকে ‘অবহেলা’ করে ভুল করছি না তো? বাংলা ভালোভাবে শিখছি না। ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা কি ভালোভাবে শিখছি? ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা গদগদ হয়ে উঠি, নানা বোলচালে গণমাধ্যম মাতিয়ে রাখি, ফেব্রুয়ারি বিদায় নিলে আমরা বুঝি মনে মনে জপি, ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’!
বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা এখন একুশ উদযাপনের বড় অনুষঙ্গ। বইমেলার ব্যাপ্তি বেড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিবছর (করোনার কারণে দুই বছর কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল) বইমেলা হচ্ছে। ছয় শতাধিক প্রকাশনা সংস্থা বইমেলায় স্টল দিচ্ছে। এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো বই প্রকাশে কতটুকু যত্নবান? প্রতিদিন মেলায় শত শত নতুন বই আসছে। এগুলোর মধ্যে কতটি বই মানসম্পন্ন? হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসা-যাওয়া করছেন। তাঁদের মধ্যে কতজন বই কিনছেন? সারা বছরে যদি একটি ভালো বই তিন শ কপিও বিক্রি না হয়, তাহলে চলবে কেন? বই প্রকাশের সংখ্যা দেখে মনে হয়, আমাদের দেশে লেখক বাড়ছেন, এটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে পাঠক না বাড়লে তো তাকে আদর্শ অবস্থান বলা যাবে না।
আমাদের সাহিত্যের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ কতটা পাঠকদের নজর কাটতে পারছে? সৃজনশীলতা-মননশীলতায় আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি? বর্তমান সময়ের সেরা লেখক কে—এই প্রশ্ন যদি কারও মনে আসে, তাহলে জবাব পাওয়া যাবে কি? একুশে উদযাপনের সময় এই সব প্রশ্নের জবাব খোঁজা প্রয়োজন বলেই মনে হয়। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সরকার দাবি করছে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। এখন নতুন করে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু মেধা-মননে স্মার্ট হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? আমরা যদি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি, তাহলে সেটা তো একুশের চেতনারই জয় বলে মনে হবে।
আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে, তা কি একুশের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? উচ্চশিক্ষার মাধ্যম কি বাংলা হয়েছে? শিক্ষাকে যে আমরা এক ধারায় আনতে পারলাম না, এর দায় কার? বিত্তবৈভবের বৈষম্য যে উৎকট হয়ে উঠছে এবং বাংলা যে বিত্তহীনদের ভাষা হওয়ার পথে হাঁটছে, তাতে কি কারও মনে কোনো গ্লানিবোধ জাগছে? শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাঁরা আসছেন, তাঁরাও ১০ শতাংশের বেশি নয়, যাঁরা নির্ভুলভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারেন। স্বাধীনতার এত বছর পরেও যদি বাংলা ভাষা ব্যবহারে এমন দৈন্য থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের ভাষা শিক্ষায় মস্ত বড় গলদ আছে।
দেশের রাজনীতির দিকে তাকালে কি আমাদের মনে হয়, আমরা একুশের চেতনার আলোকবাহী? দেশের রাজনীতি সংঘাত ও অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারছে না, এ দায় কার? গণতন্ত্র চর্চাতেও যে আমরা শিশুকাল অতিক্রম করতে পারছি না—এটাও কি একুশে উদযাপনে আমাদের পীড়িত করে না? চিন্তনে ও মননে আমরা যদি বিকশিত হতে না পারি, তাহলে একদিন হয়তো আমরা একুশের মর্মবাণী ভুলে কেবল খোলস নিয়েই মাতামাতি করব।
একুশে উদযাপনের সময় এই কামনাই করি যে তেমন দুর্দিন বা দুঃসময় যেন আমাদের জীবনে না আসে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
ভাষা আন্দোলনের ৭৫ বছর পেরিয়ে কতগুলো প্রশ্ন আমাদের সামনে ঘুরেফিরেই আসছে। রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি বাদ দিলে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন ও অগ্রগতি কী? ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, নিশ্চয়ই এটা গৌরবের। কিন্তু বাংলাকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিতে আমাদের উদ্যোগ-প্রচেষ্টা কী? ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে, অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিশ্বের শীর্ষ ১০ ভাষার মধ্যে বাংলা নেই। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রসারে ১২ বছরে অগ্রগতি কতটুকু?
অথচ মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মদানের ইতিহাস বাঙালিরাই প্রথম তৈরি করেছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। দাবি ছিল, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার, যা অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষ ছিলেন বাংলাভাষী। বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, সে ভাষারই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কায়েমি স্বার্থে এই চিরায়ত গণতান্ত্রিক নীতিবোধ ভেঙে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে বাঙালি তার প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান ছিল একটি বহুভাষিক মানুষের দেশ। বাংলাভাষী সংখ্যায় বেশি। এ ছাড়া উর্দু, সিন্ধি, পশতুভাষী মানুষও ছিলেন। সে জন্য বাঙালিদের দাবি ছিল একাধিক ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কিন্তু তোলা হয়নি। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হয়েছিল।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যুক্তির ভাষা বুঝত না, জোরের ভাষা প্রয়োগে পারদর্শী ছিল। আবার বাঙালির রক্তে বহমান প্রতিবাদের ধারা। সংখ্যাল্প মানুষের ভাষাকে ‘একমাত্র’ রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে তাই বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল প্রথম মুহূর্ত থেকেই। এই ধারার এক পরিণতির দিন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। হ্যাঁ, ঢাকা শহর রক্তে ভাসিয়ে সারা দেশে তার দ্যুতি ছড়িয়ে বাঙালি যে গৌরবের সমাচার তৈরি করেছিল, তার ধারাবাহিকতাই আমাদের নিয়ে গেছে স্বাধীনতার পথে, গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে। তাই একুশ আমাদের কাছে অহংকার। একুশ মানে মাথা নত না করা। শুরুতে একুশ ছিল শোকের দিন, শহীদ দিবস। কিন্তু ১৯৫২ থেকে ২০২৩ সালে এসে একুশে শোকের দিন নেই। একুশ প্রতিবাদের দিন, উদযাপনের দিন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার দিন।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা এখনো নগ্নপদে প্রভাতফেরি করি, অমর ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাঁদের স্মৃতি তর্পণ করি, ফুলে ফুলে শহীদ মিনারের পাদদেশ ভরে তুলি, কিন্তু পরিবেশটা আর শোক দিবসের থাকে না। একুশে এখন উদযাপন করা হয় উৎসবের মেজাজে। এতেও দোষের কিছু নেই। একুশ আমাদের শোকে মুহ্যমান হতে শেখায়নি, শিখিয়েছে প্রতিবাদী হতে, বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখা একটি কবিতা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত হয়ে একুশের অমর সংগীত হয়ে উঠেছে। এমন বাঙালি কি আছেন, যাঁর মুখে কখনো ধ্বনিত হয়নি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’
না, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভুলিনি। আমাদের জাতীয় জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে, তখনই একুশের স্মরণ নিয়ে আমরা সাহসে বুক বেঁধেছি। সংকটে আমরা বিহ্বল হইনি। একুশ আমাদের পথ দেখিয়েছে।
এত বছর পরে এসে একটি প্রশ্ন মনে খোঁচা দেয়, আমরা একুশকে আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী করে ফেলছি না তো? একুশ পালনের আয়োজনের ব্যাপকতা আছে, কিন্তু একুশের চেতনার সঙ্গে এসব আয়োজন সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে কি? বাংলা আজ রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারে আমরা কতটুকু যত্নবান? আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ অটুট আছে তো? বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য বিদেশি, প্রধানত ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে বাংলাকে ‘অবহেলা’ করে ভুল করছি না তো? বাংলা ভালোভাবে শিখছি না। ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা কি ভালোভাবে শিখছি? ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা গদগদ হয়ে উঠি, নানা বোলচালে গণমাধ্যম মাতিয়ে রাখি, ফেব্রুয়ারি বিদায় নিলে আমরা বুঝি মনে মনে জপি, ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’!
বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা এখন একুশ উদযাপনের বড় অনুষঙ্গ। বইমেলার ব্যাপ্তি বেড়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিবছর (করোনার কারণে দুই বছর কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল) বইমেলা হচ্ছে। ছয় শতাধিক প্রকাশনা সংস্থা বইমেলায় স্টল দিচ্ছে। এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো বই প্রকাশে কতটুকু যত্নবান? প্রতিদিন মেলায় শত শত নতুন বই আসছে। এগুলোর মধ্যে কতটি বই মানসম্পন্ন? হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসা-যাওয়া করছেন। তাঁদের মধ্যে কতজন বই কিনছেন? সারা বছরে যদি একটি ভালো বই তিন শ কপিও বিক্রি না হয়, তাহলে চলবে কেন? বই প্রকাশের সংখ্যা দেখে মনে হয়, আমাদের দেশে লেখক বাড়ছেন, এটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে পাঠক না বাড়লে তো তাকে আদর্শ অবস্থান বলা যাবে না।
আমাদের সাহিত্যের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ কতটা পাঠকদের নজর কাটতে পারছে? সৃজনশীলতা-মননশীলতায় আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি? বর্তমান সময়ের সেরা লেখক কে—এই প্রশ্ন যদি কারও মনে আসে, তাহলে জবাব পাওয়া যাবে কি? একুশে উদযাপনের সময় এই সব প্রশ্নের জবাব খোঁজা প্রয়োজন বলেই মনে হয়। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সরকার দাবি করছে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। এখন নতুন করে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু মেধা-মননে স্মার্ট হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? আমরা যদি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি, তাহলে সেটা তো একুশের চেতনারই জয় বলে মনে হবে।
আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে যে হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে, তা কি একুশের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? উচ্চশিক্ষার মাধ্যম কি বাংলা হয়েছে? শিক্ষাকে যে আমরা এক ধারায় আনতে পারলাম না, এর দায় কার? বিত্তবৈভবের বৈষম্য যে উৎকট হয়ে উঠছে এবং বাংলা যে বিত্তহীনদের ভাষা হওয়ার পথে হাঁটছে, তাতে কি কারও মনে কোনো গ্লানিবোধ জাগছে? শিক্ষাবিদ ও লেখক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাঁরা আসছেন, তাঁরাও ১০ শতাংশের বেশি নয়, যাঁরা নির্ভুলভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারেন। স্বাধীনতার এত বছর পরেও যদি বাংলা ভাষা ব্যবহারে এমন দৈন্য থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের ভাষা শিক্ষায় মস্ত বড় গলদ আছে।
দেশের রাজনীতির দিকে তাকালে কি আমাদের মনে হয়, আমরা একুশের চেতনার আলোকবাহী? দেশের রাজনীতি সংঘাত ও অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারছে না, এ দায় কার? গণতন্ত্র চর্চাতেও যে আমরা শিশুকাল অতিক্রম করতে পারছি না—এটাও কি একুশে উদযাপনে আমাদের পীড়িত করে না? চিন্তনে ও মননে আমরা যদি বিকশিত হতে না পারি, তাহলে একদিন হয়তো আমরা একুশের মর্মবাণী ভুলে কেবল খোলস নিয়েই মাতামাতি করব।
একুশে উদযাপনের সময় এই কামনাই করি যে তেমন দুর্দিন বা দুঃসময় যেন আমাদের জীবনে না আসে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
রুমিন ফারহানা বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও রাজনীতি বিশ্লেষক। তিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। তিনি বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
২ ঘণ্টা আগেদেশে প্রতিবছর বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বাস্তবায়নের সময় মাঝে মাঝে সংবাদ চোখে পড়ে যে প্রকল্পের ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে গাছ কাটা পড়ছে, বনভূমি উজাড় হচ্ছে, খাল ও জলাভূমি ভরাট হচ্ছে, নির্মাণস্থলে নির্মাণকাজের ফলে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, এমনকি কোনো কোনো প্রকল্প গ্রহণের ফলে পরিবেশের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব...
৩ ঘণ্টা আগেপাহাড় রক্ষা করা যখন খুবই জরুরি, তখন সে পাহাড় কেটে গোটা অঞ্চলের জন্য বিপদ ডেকে আনছে একদল দুর্বৃত্ত। খাগড়াছড়ির পানছড়ি এলাকায় অবাধে পাহাড় কাটা হচ্ছে, অথচ সরকারি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকার চেষ্টা করছেন।
৩ ঘণ্টা আগে১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন, তাঁকে করা হয়েছিল দলের যুগ্ম সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে শামসুল হক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
১ দিন আগে