Ajker Patrika

চায়ের দোকান ও গণতন্ত্র

বিরস 
চায়ের দোকান ও গণতন্ত্র

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মূল তত্ত্ব একখানা সংবিধানে লেখা, ঠিক। কিন্তু তার প্রয়োগ, প্রতিপত্তি ও প্রতিদিনের বিচার কোথায় হয় জানেন? চায়ের দোকানে। এই দোকানগুলোই তো বাঙালির নিজস্ব পার্লামেন্ট। যেখানে এমপি নেই, স্পিকার নেই, কিন্তু সবাই কথা বলে। এমনকি দোকানদারও।

চায়ের দোকানে কেউ সেন্সর করে না। আপনি চাইলে বলতেই পারেন—‘এই সরকারের কিচ্ছু ঠিক না।’ পাশে বসে যিনি ঠোঁটে কাপ লাগিয়ে আছেন, তিনি হয়তো বলবেন, ‘আরে ভাই, দেশ চালানো এত সহজ না। নোবেল পাওয়া আর মানুষের মন বোঝা এক কথা না।’

আরেকজন হয়তো মুচকি হেসে বলেন, ‘ভাই, অপেক্ষা করেন এবং দেখেন, এনসিপির মধ্যে কী খেলা জমে ওঠে। সমুদ্রস্নান কেবল শুরু হয়েছে।’

আর একজন হয়তো বলেন, ‘এবার আর কোনো খেলায় কাজ হবে না।’

‘তাহলে কী হবে শেষ পর্যন্ত? ভোটটা তো হবে নাকি?’

‘হয়তো হবে, হয়তো হবে না। ভাই রে, আল্লাহর মাইর, দুনিয়ার বাইর।’

সবাই হয়তো একটু চমকে ওঠে। তারপর হয়তো কোনো কারণ ছাড়াই সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তর্ক চলে—কিন্তু কেউ কাউকে তাড়িয়ে দেয় না।

গণতন্ত্র তো এ-ই, তাই নয় কি? সহমতের পাশাপাশি ভিন্নমতেরও জায়গা থাকবে। দেশ যখন দলাদলি, পোস্টার, মিছিল আর হুমকিতে ভরে যায়, তখনো চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকে সেই অবিচল থার্মোমিটার, যেখানে মানুষ বলে—‘সব ঠিক নাই, কিন্তু কিছু ঠিক করা যেতেই পারে।’

একসময় নাকি চায়ের দোকানে লেখা থাকত, ‘এখানে রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ’। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞা কেউ মানত না। চায়ের দোকানের মতো মুক্ত রাজনৈতিক মঞ্চ দেশে আর কোনটা আছে?

এই তো সেদিন শান্তিনগরের এক কমিউনিস্ট কর্মীর কমরেডের চায়ের দোকানে আসন্ন ভোট নিয়ে আলোচনার সময় একজন বয়স্ক লোক বললেন, ‘কত ভোট দেখলাম। জয়-পরাজয় দেখলাম। উত্থান-পতনও কম দেখলাম না।’

তাঁকে থামিয়ে দিয়ে একজন তরুণ বুক ফুলিয়ে বলেন, ‘যত যাই দেখেন, কোনো সরকারপ্রধানের পালিয়ে যাওয়া আগে কখনো দেখেন নাই।’

বয়স্ক ভদ্রলোক একটু থতমত খেয়ে বলেন, ‘কীভাবে যে কী হয়ে গেল!’

আরেক মাঝবয়সী ভদ্রলোক তরুণকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘পালিয়ে যাওয়ার এক বছর পরও কোনো ভালো কিছু তো দেখছি না। চুরিচামারি, ঘুষ-দুর্নীতি সবই তো আগের মতোই আছে। যাদের পেট ভরে টইটম্বুর হয়েছিল, তারা পালিয়ে গেল। আর ক্ষুধার্তরা খাওয়া শুরু করল। পরিবর্তনটা ভালোই হলো।’

বয়স্কজন এবার বললেন, ‘ভাই, এইবার ভোটই দিব না। সব চোর।’

চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। তর্ক হয়: ভোট না দিলে কিসের গণতন্ত্র?

শেষে দোকানদার বলেন, ‘ভাই, এবারও মানুষ ভোট দিতে পারবে কি না, জানি না। কে জিতবে তা-ও জানি না, তবে এটা বুঝতে পারছি, আমারই বিক্রি বাড়বে!’

গণতন্ত্রের প্যাথলজি রিপোর্টও কিন্তু অনেক সময় চায়ের দোকানেই তৈরি হয়। কোন প্রার্থী আসল, কে নকল, কে ভাইরাল, কে ভাইরাস—সব তথ্য জানা যায়। ’৭১-এ বহু গোপন পরিকল্পনার ছায়া পড়েছিল চায়ের দোকানে। ’৯০-এ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতিও হয়েছিল এ রকম দোকানের পেছনে। এমনকি ২০২৪ সালের সেই ছাত্রজাগরণের কথাও বলা হয়—তারা প্রথম সিদ্ধান্ত নেয় টং দোকানের বেঞ্চে বসে।

তাই বলা যায়, চায়ের কাপ শুধু চা বহন করে না, তাত্ত্বিক বিস্ফোরণও ঘটায়। এই দোকানগুলোতে পুলিশও চা খায়। নেতা চা খায়। খুনি চা খায়। কবিও চা খায়। এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে সবাই মানুষ হয়, আগে-পরে কিছু নয়। চায়ের দোকানে ধনী-গরিব সবাই একসঙ্গে বসে। আপনি হোন এমবিএ পাস করা হাই ফ্লায়ার, আর পাশেরজন দিনমজুর—আপনাদের দুজনের মতামত এখানে সমান। এটাই গণতন্ত্রের আসল চেহারা।

শহরে এখন বড় বড় ক্যাফে, এসপ্রেসো মেশিন, ট্রেন্ডি ইনটেরিয়র। কিন্তু সেখানকার আড্ডায় নেই দেশ নিয়ে ভাবনা। নেই সেই হাহাকার, সেই বিদ্রূপ, সেই ঠাট্টা-মার্কা ভবিষ্যদ্বাণী: ‘এই দেশ চলবে না ভাই!’

ফুটপাতের পাশে, গ্রামের হাটবাজারে সাধারণ সব চায়ের দোকানই এ দেশের গণতন্ত্রের অন্তঃস্থ আত্মা। এখন দরকার এই দোকানগুলোকেই বাঁচিয়ে তোলা—সাহসী কথার, মুক্ত তর্কের, সাম্যের বেদি হিসেবে। দরকার, সেই পুরোনো কাঠের বেঞ্চে বসে আবার বলার সাহস—‘ভাই, এই দেশ আমাদেরও!’

আসুন, আবার চায়ের দোকানে বসি। চা খাই, কথা বলি। আবার জিজ্ঞেস করি—‘ভাই, আজ দেশটা কেমন চলছে?’

আর জবাবটা আসুক জনতার মুখ থেকে, নির্বাচনের ব্যালট থেকে এবং অবশ্যই চায়ের কাপের ধোঁয়া থেকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মোবাইল-টাকা ছিনতাইয়ের পর দুই তরুণীকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, গ্রেপ্তার ৩

ইরানি নকশার ড্রোন হয়ে গেছে রাশিয়ার, ক্ষোভ বাড়ছে তেহরানে

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর ‘দমন-পীড়নে’ ২০২ শিক্ষকের উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রক্রয় চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত

নির্বাচনের আগে এসআই-এএসআইদের ব্যক্তিগত তথ্য তালাশে পুলিশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত