Ajker Patrika

কান্ডারি! বলো ডুবিছে মানুষ

তাপস মজুমদার 
Thumbnail image
তাপস মজুমদার

যে মানুষটি মারা গেলেন তাঁর মৃত্যু নিয়ে আমাদের কূট তর্ক-বিতর্কের কোনো শেষ নেই। মারা যাওয়াটা সত্য না মিথ্যা, কে মেরেছে, কীভাবে মেরেছে, যেভাবে মারা হয়েছে বলা হচ্ছে সেটা কি সত্য নাকি অন্যভাবে মারা হয়েছে—এতসব কিছুর মধ্যে সবার ওপরের সত্য হচ্ছে তিনি নেই। তাঁর পরিবার, তাঁর কাছের জনের কাছে সেটাই সবচেয়ে বড় সত্য এবং অপূরণীয় ক্ষত। ক্ষত যত ক্ষতি তত। যাঁরা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত থাকেন, এই ক্ষতির মাত্রা তাঁদের বোধে আনা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় মানবতার।

যেকোনো শাসনব্যবস্থার কাছে জনগণের সবচেয়ে বড় দাবি বেকারত্ব, দুর্নীতি, দারিদ্র্য, কুসংস্কার, নিরাপত্তাহীনতা তথা অন্ধকার দূরীভূত করা। মুক্ত বাতাসে প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারা, নির্বিঘ্নে প্রকৃতিপ্রদত্ত আলোকরশ্মি উপভোগ করতে পারার সুযোগ। সরকার পরিবর্তনে একেবারে সাধারণ মানুষের তেমন কিছু আসে-যায় না। রাষ্ট্র সংস্কার, বিপ্লব অথবা গণ-অভ্যুত্থান কাকে বলে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ নিয়ে এদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা তো চায় শুধু নিরুপদ্রব জীবন, পেট চলার মতো আয়, সুস্থির বাজার, রাতের নিরাপদ নিদ্রা। কোনো দল বা মতকে দাবিয়ে রাখলেও আপাতত সাধারণ খেটে খাওয়া জনগণের তাতে তেমন কিছু এসে-যায় না। তবে অবশ্যই ক্ষমতাবানেরা সুবিবেচনার পরিচয় দিলে প্রত্যক্ষভাবে জনগণের স্বার্থ রক্ষিত হয়। সেইসব সুবিবেচনার আশ্রয়ে পরিত্যক্ত হয় বিচ্ছিন্নতা, হিংস্রতা, বিবাদ আর অসহিষ্ণুতা। আখেরে সেটাই জনগণের লাভ। এতেই ধীরে ধীরে মুক্তি ঘটে মানবতার।

আমাদের জাতীয় জীবনে নানা সময়ে অনেক উত্তম ঘটনা ঘটলেও এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলো জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জায় ফেলে। সেটা আইন প্রণয়ন হোক, বড় কোনো নেতা বা পদবিধারীর বক্তব্য হোক, রাজনৈতিক দল বা মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত হোক...। চিন্তার দীনতা ছাড়া একে আর কীই-বা বলা যায়?

সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই ওপরের নির্দেশে ছাপোষা কর্মীরা পরিপালন করে থাকেন। তাঁরা দু পয়সার চাকরি করেন। তাঁদের সাধ্য কী ওপরের নির্দেশ অন্যথা করেন! কিন্তু এর ফলে নৈতিকতার যে অবক্ষয় হয় তা আরও মানুষকে দশটি অনৈতিক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এভাবে অনৈতিকতা প্রোপাগেটেড হয়ে অজস্র মানুষকে ক্ষতির সম্মুখীন করে। তখন মানুষই ডোবে।

দেশ স্বাধীনের আগের ২৪ বছরে মানুষের দুর্গতির অন্ত ছিল না। পরের ৫৩ বছরেও নিরবচ্ছিন্নভাবে জাতির দুর্ভোগ ঘুচল না। একটু স্থির হতে না হতেই আবার অস্থির। দ্বন্দ্ব, খুনাখুনি, রক্তপাত, প্রতিশোধপরায়ণতা, বিষোদ্গার। সহনশীলতা লুপ্ত হলে সম্মান বজায় থাকে না।

যুগের পর যুগ ধরে দেশে যা কিছু ঘটে চলেছে তাতে আর যা-ই হোক সহনশীল, অধিকার-সচেতন, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক জনশক্তি গড়ে ওঠেনি। আমরা অনেক সুযোগ পেয়েছি অধিকার বুঝে নেওয়ার। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব অধিকার। অন্যান্যের সঙ্গে দৃঢ় চিত্তে প্রশ্ন করার অধিকার। বহু বিপন্নতাকে মাথায় নিয়ে তবু বুক ভরা সাহসে ভর করে এগিয়ে যাওয়ার, রাজযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে সুযোগ আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আখেরে মানুষের বিপন্নতাই বৃদ্ধি পেয়েছে। হিন্দু-মুসলিম, গ্রাম্য-শহুরে, নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ, ধনী-দরিদ্র, পাহাড়ি-সমতলি সবাই মানুষ। বাঁচলে সবাই বাঁচি, মরলেও সবাই। সেই একতায় বেঁধে বেঁধে চলা আমাদের হয়ে উঠল না। কবি নজরুলের বিখ্যাত কবিতার সেই বিখ্যাত পঙক্তিটির ভাবার্থ আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেল—‘কান্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’

জনগণকে সঠিক পথ বাতলে দিতে না পারলে, সঠিক বন্ধু চেনাতে না পারলে কোনো সংগ্রাম সফল হয় না। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের যুববান্ধব নীতি গ্রহণ, চীন, মালয়েশিয়া, জাপান, কোরিয়ার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থার অনুসরণে এ দেশের যুবসমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে তো উদ্যোগ নেওয়া যায়। ওইসব দেশে প্রশিক্ষণ অথবা উপযুক্ত প্রশিক্ষক এনে দেশে বড় প্রকল্প তো হাতে নেওয়া যায়।

তরুণদের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে ও তাদের চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারাই তো মৌলিক অগ্রগতির পথ। যুবকদের যে অংশকে নৈরাজ্যবাদী হিসেবে দেখা যায়, তার বিপরীতে উৎসাহিত করে যদি উন্নত দক্ষ কর্মী হিসেবে দেখা যেত তাহলে বিপরীত ও আনন্দিত এক চিত্র উপহার পেত দেশ। আহা! মানুষ তো ডুবতে চায় না। বাঁচার আনন্দ চায়। মানুষ যে কত বড় সম্পদশালী তা আমরা প্রায়ই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হই। এই ব্যর্থতাই আমাদের অবশেষে কাঙাল করে রাখে।

সার্বিকভাবে সুস্থ ও বিশ্বমানব হিসেবে গড়ে ওঠা—প্রজন্মের জন্মগত অধিকার। অভিভাবকদের থেকে এটা তাদের প্রাপ্য। হোক সে অভিভাবক পারিবারিক বা সংগঠনিক বা রাষ্ট্রীয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্নীতি, খুন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, নিষ্পেষণ, অবিচার, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার অভাব, মতাদর্শগত সংকীর্ণতা, অবিচার, অনৈক্য, বিভক্তি, ভয়সহ যেকোনো অস্বাভাবিক অবস্থায় মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি। আর্থিকভাবে, সামাজিকভাবে, মানসিকভাবে ও মানবিকতায়।

সেখানে মানুষ ছোট হয়ে যায়। আমরা কি পারব এমন কোনো সুস্থ পথ খুঁজে বের করতে, অথবা বলা ভালো আমরা কি চাই তেমন কোনো সুস্থ পথ খুঁজে বের করতে, যাতে এই ক্ষতি আর না ঘটে?

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, সাংস্কৃতিক সংগঠক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত