Ajker Patrika

জুলাই থেকে জুলাই: পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মিলাই

এই অভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্যম ও সামাজিক চেতনা মৃত নয়। জনগণ এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পারে। শুধু প্রয়োজন, এই চেতনার সাংগঠনিক রূপ দেওয়া। প্রয়োজন গণতন্ত্রের একটি নতুন সংজ্ঞা, যা জনগণকে কেবল ভোটার হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখবে।

গত জুলাইয়ে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রাম করেছিল, তারা ছিল ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধি। ফাইল ছবি
গত জুলাইয়ে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রাম করেছিল, তারা ছিল ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধি। ফাইল ছবি

২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুলাই। এই এক বছরের হিসাবনিকাশ অনেকেই করতে শুরু করেছেন—কী চেয়ে কী পেলাম। এক বছর আগে যে গণ-অভ্যুত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তা নিছক একটি সাধারণ রাজনৈতিক ঘটনা নয়, বরং এমন একটি সামাজিক বিস্ফোরণ, যেখানে বহুদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা, অসন্তোষ এবং অবদমন একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয়েছে। এমন বিস্ফোরণ রাজনৈতিক অঙ্গনে হুটহাট ঘটে না। ’২৪-এর অভ্যুত্থান ছিল মূলত ছাত্রদের নেতৃত্বে নানা সামাজিক শক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ, যেখানে রাজনৈতিক দল শুধু প্রান্তিক চরিত্রে অবস্থান করেছে। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তা কি সত্যি কোনো গণমুখী রাষ্ট্র গঠনের পথে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে? নাকি আবার পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি?

এই প্রশ্নগুলো খুব জরুরি। কারণ, গণ-অভ্যুত্থান কোনো ফাঁকা আবেগের নাম নয়। এটা একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক মুহূর্ত, যেখানে জনগণ তাদের অবস্থান পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করে। তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোয় প্রবেশ করতে চায়, রাষ্ট্রের গতিপথ নির্ধারণে অংশ নিতে চায়। এক বছর পেরিয়ে এসে প্রশ্ন, সেই সুযোগ কি তারা পেয়েছে?

গণ-অভ্যুত্থান তো আসলে হয়েছিল মানুষের মধ্যে নানামুখী অসন্তুষ্টির ফলে। এই অসন্তুষ্টি ছিল ভোটাধিকার হরণ, উন্নয়নের নামে লুটপাট, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমনপীড়ন, হত্যা, গুম, প্রশাসনিক দুর্নীতি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। মানুষ এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল, জীবন দিয়েছে, ভবিষ্যৎ বিপন্ন করেছে। বিনিময়ে তারা চেয়েছিল একটি নতুন বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, থাকবে সামাজিক ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ এবং সমতা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সেই জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সামান্য। বরং এটাকে বলা যায়, পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতরই একধরনের রদবদল।

শেখ হাসিনার বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ক্ষেত্রে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা কতটা গণতান্ত্রিক ছিল, সেটা নিয়ে লম্বা বিতর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন সমন্বয়ক, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও কিছু রাজনৈতিক নেতার বোঝাপড়ার মাধ্যমেই ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি নতুন সরকার। যারা আগে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল, তাদের একটি বড় অংশ সরে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের জায়গায় নতুন যারা এসেছে, তারা ক্ষমতার খেলায় সমানভাবে পারদর্শী না হলেও তারা মূলত সেই পুরোনো শাসনব্যবস্থারই কোনো না কোনোভাবে সুবিধাভোগী বা সুবিধাবঞ্চিত। শাসকের শুধু মুখাবয়ব বদলেছে, শাসনের চরিত্র বদলায়নি।

এখানেই প্রশ্ন, গণ-অভ্যুত্থান কি তাহলে ব্যর্থ হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব এত সহজ বা এক কথায় দেওয়া ঠিক নয়। কারণ, এই অভ্যুত্থান অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি রাজনৈতিক পরিপক্বতার বিষয় আমাদের সামনে এনেছে। জনগণ অন্তত এটা বুঝিয়েছে যে রাষ্ট্র যদি নাগরিকের সম্মান রক্ষা না করে, তবে জনগণ নিজেরাই পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারে, তারা ক্ষমতাবানদের একচ্ছত্র দাপট কিছুকাল মেনে নিলেও চিরকাল মেনে নেয় না।

জুলাই আন্দোলনের অবশ্যই ব্যর্থতা রয়েছে। বড় ব্যর্থতা হচ্ছে এই যে জনগণের অংশগ্রহণমূলক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, বাস্তবে তা রূপ পায়নি বা হাতছাড়া হয়েছে। অভ্যুত্থান একটি প্রবল রাজনৈতিক ঝড়ের মতো এসে, রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর জমে থাকা আগের ভোগদখলকারীদের ইমারতকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গায় গণমানুষের প্রতিনিধিত্বমূলক কাঠামো না গড়ে, পুরোনো ধারাতেই চুনকাম শুরু হয়েছে। আর এর পেছনে রয়েছে একধরনের হিসাবি রাজনীতি।

যেসব ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, মফস্বলের মানুষ এই আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল, তারাই এখন সবচেয়ে উপেক্ষিত। আমরা যদি অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন এবং কার্যক্রম লক্ষ করি, তাহলে দেখব এই সামাজিক শক্তিগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বরং সরকার গঠনে একটি পরিষ্কার ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ নীতি কাজ করেছে। এর মানে হলো, সরকার নিজেই ঠিক করেছে কারা গ্রহণযোগ্য এবং কারা নয়। যার ফলে সত্যিকারের কোনো সামাজিক দাবিদারেরা জায়গা পাননি, বরং কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বা নমনীয় ‘সুশীল’ ব্যক্তিরা জায়গা পেয়েছেন।

ফলে দেশে আবার একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একদিকে সামাজিক শক্তিগুলো রাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র নিজের মতো করে সুবিধাজনক অংশীদার বেছে নিচ্ছে, যারা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়বদ্ধতাগুলো নিয়েও প্রশ্ন তোলে না। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একধরনের দমননীতি সমান্তরালভাবে চলতে শুরু করেছে। প্রতিবাদী কণ্ঠ দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রশাসন, পুলিশ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অথবা রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম। আবার কেউ কেউ যখন রাষ্ট্রের মৌলিক অবস্থান অর্থাৎ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে, তখন তাকেও সরকার স্বাগত জানাচ্ছে অথবা জায়গা করে দিচ্ছে শুধু রাজনৈতিক সুবিধার জন্য।

এই দ্বিচারিতা সামাজিক আন্দোলনের ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত। গণ-অভ্যুত্থানের সময় যাঁরা সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন হতাশ। তাঁরা হয় নিষ্ক্রিয়, নয়তো মব-শক্তির অংশ হয়ে উঠছেন। কারণ তাঁরা দেখছেন, যুক্তির জায়গা নেই, অংশগ্রহণের জায়গা নেই, ন্যায়ের জায়গা নেই। ফলে অনেকে রাস্তায় সরাসরি প্রতিশোধ বা জবরদস্তির পথে হাঁটছেন। এই পরিস্থিতিতে মবের উত্থান আর মবকে এলিটের ছায়া দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা এখন বাস্তব সত্য।

এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্র যখন যুক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু সুবিধাজনক কণ্ঠগুলোকেই জায়গা দেয়, তখন গণতন্ত্র শুধু আওড়ানো বুলি হয়ে যায়। তখন রাষ্ট্র হয়ে পড়ে এলিটনির্ভর, সুবিধাবাদী এবং একরকম মুখোশধারী আধিপত্যের প্ল্যাটফর্ম। সেখানে সাধারণ নাগরিক, বঞ্চিত গোষ্ঠী, প্রান্তিক মানুষ বা বিকল্প মতধারার কেউ থাকতে পারে না। গণতন্ত্র তখন একটি লোকদেখানো সাজসজ্জামাত্র হয়ে দাঁড়ায়।

অথচ জুলাই অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাটা ছিল অনেক বড়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে ছাত্ররা রাজপথে এসেছিল, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রাম করেছিল, তারা ছিল ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধি। তারা এমন কোনো রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র ছিল না, যাদের অতীত কলঙ্কিত ইতিহাস রয়েছে। তারা এসেছিল এক নতুন রাজনৈতিক কল্পনা নিয়ে। তারা চেয়েছিল রাষ্ট্র যেন নাগরিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়—শুধু ভোটের সময় নয়, প্রতিদিনের জীবনে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে এই আন্দোলনের কাঠামো রাজনৈতিকভাবে পরিণত হয়ে উঠতে পারেনি, সংগঠিত হতে পারেনি এবং সে জন্যই শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামোতে পরিণত হতে না পারায় তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় অনুপ্রবেশ করতে পারেনি।

এটা ঠিক, সামাজিক আন্দোলনের একটা ধরন থাকে। সেটা হয় সময় নেয়, কিংবা দ্রুত রূপান্তরিত হয়।

তবে এটা ঠিক, যে রাজনৈতিক সুযোগ তৈরি হয়েছিল, সেটা কাজে লাগালে সুফল পাওয়া যেত। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এই সামাজিক শক্তিগুলোকে মূলধারায় আনতে পারত। চাইলে রাজনৈতিক সংস্কারে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারত। সেটা না করে সরকার আবার সেই পুরোনো রাস্তা ধরেছে—ক্ষমতার কেন্দ্রে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বসানো, যারা প্রথাগত ক্ষমতার ভাষা বোঝে এবং গণ-আবেগ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে পারে।

এই নীতির ফলে দেশে একটা গভীর রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। যারা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছে, তারা এখন রাষ্ট্র থেকে ছিটকে পড়েছে। যারা মব শক্তি, তারা আবার নানা জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। একদিকে নিরাশা, অন্যদিকে উগ্রতা—এই দুইয়ের মধ্যেই গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ হাঁটছে। রাজনৈতিক সংস্কারের যে সম্ভাবনা ছিল, তা অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে।

তবু আশাবাদের একটা জায়গা আছে। এই অভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্যম ও সামাজিক চেতনা মৃত নয়। জনগণ এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে পারে। শুধু প্রয়োজন, এই চেতনার সাংগঠনিক রূপ দেওয়া। প্রয়োজন গণতন্ত্রের একটি নতুন সংজ্ঞা, যা জনগণকে কেবল ভোটার হিসেবে নয়, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখবে। প্রয়োজন এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে এলিটের বোঝাপড়ার বাইরে সাধারণ মানুষও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

গণ-অভ্যুত্থান কোনো শেষ ব্যবস্থা নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া। এটি রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের পথ তৈরি করে। এটি রাষ্ট্রকে বাধ্য করে নতুন প্রশ্ন শুনতে, নতুন দাবির মুখোমুখি হতে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে না, যদি আমাদের সামনে যেসব প্রশ্ন এসেছে—আমরা যদি সেগুলোর উত্তর বা সমাধান দিতে পারি। প্রশ্নগুলো হচ্ছে, কীভাবে এই রাজনৈতিক মুহূর্তকে গণতন্ত্রে পরিণত করব? এলিট বনাম জনতা, কেন্দ্র বনাম প্রান্ত, ক্ষমতা বনাম অধিকার—এই দ্বন্দ্বগুলোকে কীভাবে আমরা সমন্বয় করব?

এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের অবশ্যই খুঁজে নিতে হবে। সমাজকে বুঝতে হবে, গণতন্ত্র কেবল একটি কাঠামো নয়, এটি একটি ধারাবাহিক সংস্কার প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। সরকারকে বুঝতে হবে, এলিটদের মধ্যে সমঝোতা করে রাষ্ট্র টিকবে না। বরং জনগণের প্রকৃত স্বার্থকে ধারণ না করলে, আবার অন্য একটি অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠবে।

সুতরাং এখনই সময়, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের ভেতরে গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর। এখনই সময় সামাজিক শক্তিগুলোকে সংগঠিতভাবে রাজনৈতিক কাঠামোয় যুক্ত করার। সুযোগ বারবার আসে না। যদি এবার সুযোগ আমরা হারাই, তাহলে রাষ্ট্রের কাঠামো আর জনগণের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যে ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে পুষিয়ে দেওয়া কঠিন হবে।

রাষ্ট্রকে এবার জনগণের হাতে ফিরিয়ে না দিলে ইতিহাস আবার সাক্ষ্য দেবে—গণ-অভ্যুত্থানে সরকারের পরিবর্তন হলেও পরিবর্তিত ব্যবস্থায় গণমানুষের জায়গা তৈরি হয়নি।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত আফ্রিকা

রাজিউল হাসান
পশ্চিম আফ্রিকার বেনিনে ৭ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হন একদল সেনাসদস্য। ছবি: সংগৃহীত
পশ্চিম আফ্রিকার বেনিনে ৭ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হন একদল সেনাসদস্য। ছবি: সংগৃহীত

বেনিন পশ্চিম আফ্রিকার ফরাসিভাষী একটি দেশ। ৭ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হন একদল সেনাসদস্য। তাঁরা ঘোষণা দেন, দেশে অভ্যুত্থান ঘটেছে। যদিও ঘণ্টাখানেক পর সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা আসে, বিপথগামী সেনাসদস্যদের অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

এ ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ গিনি-বিসাউয়ে অভ্যুত্থান ঘটায় সেনাবাহিনী। ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই দুই দেশসহ আফ্রিকার ৯টি দেশে অভ্যুত্থান ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, একটি মহাদেশে মাত্র পাঁচ বছরে এতগুলো অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থানচেষ্টার ঘটনা কেন ঘটল? কেন গণতন্ত্র এভাবে মার খাচ্ছে আফ্রিকায়?

লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কস গ্রুপের বিশ্লেষক বেভারলি ওচিয়েং মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) বলেছেন, আফ্রিকার দেশগুলোয় যে অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থানচেষ্টাগুলো ঘটছে, তার পেছনে আর্থসামাজিক বঞ্চনা, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় বেসামরিক সরকারকে নিয়ে নাগরিকদের হতাশাসহ নানা কারণ রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় এসব সমস্যা বেশি।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো হলো নাইজার, বেনিন, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, ঘানা, বুরকিনা ফাসো, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, মালি, আইভরি কোস্ট, টোগো, সিয়েরা লিওন, গিনি-বিসাউ, কেপ ভার্দে, মৌরিতানিয়া ও চাদ। এই দেশগুলো বিশেষভাবে পরিচিত সহিংস ঘটনার জন্য। এর মধ্যে আটলান্টিক সাগর-তীরবর্তী সেনেগাল, গিনি-বিসাউ, সিয়েরা লিওন এবং ভূখণ্ডবেষ্টিত মালি, বুরকিনা ফাসো ও নাইজারে সহিংসতার খবর বেশি আসে।

নিবিড়ভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, পশ্চিম আফ্রিকার সহিংসতা-প্রবণ এই দেশগুলোয় সামরিক বাহিনী আর রাজনীতি একাকার হয়ে আছে। বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর পাশাপাশি কোনো কোনো দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতাও বেশ ভালোভাবে রয়েছে।

এ ছাড়া রয়েছে আর্থসামাজিক বঞ্চনা, দারিদ্র্যসহ নানা সমস্যা।

কেবল যে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতেই অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থানচেষ্টা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। গত অক্টোবরে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোলিনার পদত্যাগের দাবিতে তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয়। এই সুযোগে ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক বাহিনী। পরে প্রেসিডেন্ট প্রাণ বাঁচাতে দেশ থেকে পালান, পার্লামেন্ট তাঁকে অভিশংসিত করে। ২০২৩ সালে মধ্য আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশ গ্যাবনে সেনাবাহিনী দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গোকে ক্ষমতাচ্যুত করে। অভ্যুত্থানের নেতা ছিলেন আলী বঙ্গোরই চাচাতো ভাই ব্রাইস অলিগুই। এই অভ্যুত্থান ঘটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আলী বঙ্গোকে বিজয়ী ঘোষণার পরপরই। অভ্যুত্থানের পর ব্রাইস অলিগুইকে নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

২০২১ সালের এপ্রিলে চাদে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল মাহামাত ইদ্রিস দেবি। তিনি ক্ষমতা দখলের আগে দেশটির নেতা ছিলেন তাঁরই বাবা। তিনি অবশ্য বাবাকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেননি। বাবার মৃত্যুর পরপরই তিনি ক্ষমতা দখল করেন। আর এর মাধ্যমে তিনি নিজ পরিবারের তিন দশকের শাসন দখলে রেখেছেন। চাদের ওই ঘটনার কয়েক মাস পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গিনিতে মামাদি দৌমবুয়ার নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য প্রেসিডেন্ট আলফা কনডেকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এর কিছুদিন আগেই প্রেসিডেন্ট আলফা কনডে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকতে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন।

২০২১ সালের অক্টোবরে সুদানে জেনারেল আবদেল-ফাত্তাহ বুরহানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সরকারপ্রধান ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এর আগে ওমর ২৬ বছর দেশটি শাসন করেছেন। মালিতে ২০২০ সাল ও ২০২১ সালে দুই দফা সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। বুরকিনা ফাসোয় ২০২২ সালে এবং নাইজারে ২০২৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটেছে।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য, আফ্রিকার দেশগুলোয় এমন সহিংসতা, অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থানচেষ্টা, দারিদ্র্য, আর্থসামাজিক বঞ্চনার মূল কারণ ব্যাপক হারে দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের ব্যর্থতা। ঘানাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আফ্রোব্যারোমিটার নেটওয়ার্কের একটি জরিপের তথ্য বলছে, আফ্রিকা মহাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার তুলনায় গণতন্ত্রকে বেশি পছন্দ করে। তবে তাদের দেশগুলোয় যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা চলে, সেই পদ্ধতি তাদের পছন্দ নয়।

আফ্রিকার দেশগুলোর এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মূলত ব্যাপক হারে দুর্নীতি। সমাজে দুর্নীতি গেড়ে বসলে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা ব্যাহত হয়। শাসনযন্ত্র যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা ব্যর্থতার সুযোগে এমনটা হয়। এ কথা শুধু আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্যই এটি প্রযোজ্য।

সমাজকে যদি আমরা একটি পিরামিড কিংবা ত্রিভুজের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে তার একেবারে নিচের স্তরে থাকে সাধারণ মানুষ। পিরামিড কিংবা ত্রিভুজের এই অংশটিই সবচেয়ে বড়। শাসনযন্ত্রের যত ওপরে ওঠা হয়, পিরামিড বা ত্রিভুজ তত সরু হতে থাকে। একেবারে চূড়ায় থাকেন শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে পিরামিড বা ত্রিভুজের একেবারে নিচের বৃহৎ স্তরের সদস্যদের, অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা যেখানে নেই, সেখানেও সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে উচ্চ স্বরে ঘোষণা করা হয়। বলা হয় জনগণই ঠিক করবে রাষ্ট্রে কী ঘটবে। কিন্তু আদতে জনগণের হাতে কিছু থাকে না। তারা কেবল ভোটের দিন নিজের ভোটটা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর বেশি কিছু করতে পারে না। যে দেশগুলোয় ভোট কারচুপির বা ভোট জালিয়াতির অবাধ চর্চা রয়েছে, সেসব দেশে তো ভোটের দিনও জনগণ রাষ্ট্রের মালিক হতে পারে না। ভোট দিতে গিয়ে ভোটার দেখেন, তাঁর ভোটটি অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছেন।

কিংবা ভোটার ভোট দেন ঠিকই, কিন্তু ব্যালট বাক্স ভরে থাকে আগেই।

এমন ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশগুলোয়ই শাসনযন্ত্র কুক্ষিগত করতে, ক্ষমতা ধরে রাখতে শাসকেরা নানা কৌশল আঁটেন, হাঁটেন দমন-পীড়নের পথে। এই উপসর্গগুলো আফ্রিকার দেশগুলোর রয়েছে। সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী কিংবা জঙ্গিগোষ্ঠী। দুর্বৃত্তগোষ্ঠীও সক্রিয় এসব দেশে। ফলে সাধারণ মানুষ একেবারেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রভাব সরাসরি জনগণের দৈনন্দিন জীবনে পড়ে। এ কারণে বেসামরিক সরকারের ওপর থেকে জনগণ আস্থা হারায়। সে সুযোগ নেন ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেল।

কিন্তু এমন হওয়া উচিত নয়। গণতান্ত্রিক চর্চায় শীর্ষে থাকা ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর গণতন্ত্রও কিন্তু শতভাগ ত্রুটিহীন নয়। তারপরও গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার চেষ্টা এসব দেশে রয়েছে। ইউরোপের কোনো কোনো দেশ তো কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টায় রয়েছে। তারা যদি পারে, তাহলে আফ্রিকা কিংবা এশিয়ার দেশগুলো কেন পারবে না? আমরা সবাই তো একই গ্রহের মানুষ। দুর্নীতি নামক এ রোগের চিকিৎসা অতীতে সাধারণ মানুষকেই করতে হয়েছে, আজ এবং আগামীতেও সাধারণ মানুষকেই করতে হবে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

আব্দুর রহমান 
মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

একুশ শতকের শুরু থেকেই বৈশ্বিক রাজনীতির পট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ক্রমেই বহু মেরুকরণ বিশ্বের ধারণা জোরালো হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য খর্ব হওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনের শেষ প্রকল্প হলো—তথাকথিত ‘নিজ আঙিনা’ কাবু করা। আর সেটাই যেন প্রতিফলিত হলো ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে।

দেশটির নীতিনির্ধারণী মহল বুঝতে পেরেছে, তারা এখন চীন ও রাশিয়াকে সরাসরি মোকাবিলা করে পারবে না। এ জন্য তারা বিকল্প হিসেবে পশ্চিম গোলার্ধ নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই পরিকল্পনা ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রুত এগিয়ে নিতে তৎপর। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে সামরিক তৎপরতা তারই ইঙ্গিত।

দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন নিজেকে বিশ্বের দায়িত্বশীল অভিভাবক বলে দাবি করলেও, সেই পুরোনো চরিত্র এবার ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে, তাদের এখনকার জাতীয় স্বার্থ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের দিকে তাকালে বোঝা যাবে। নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল থেকে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে একধাপ কম ‘শান্তির প্রতিষ্ঠাতা’, তবে একধাপ বেশি ‘শক্তির স্থপতি’ হয়ে উঠছে।

এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম গোলার্ধ তথা পুরো আমেরিকা মহাদেশে ‘মার্কিন প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করতে চাইছে। এটি করতে গিয়ে তারা মনরো মতবাদকে (Monroe Doctrine) পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছে। মনরো মতবাদ হলো, ‘১৮০০ সালের দিকের এক মার্কিন নীতি, যা আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপন ও হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা হয়েছিল।’ এই নীতি অনুযায়ী, তারা এখন বিদেশি প্রভাব ঠেকানো ছাড়াও, মাদক ব্যবসা ও অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলা করার ওপর জোর দেবে এবং ‘বেসরকারীকরণ’কে উৎসাহিত করবে।

‘আমরা এই অঞ্চলের সরকার, রাজনৈতিক দল এবং আন্দোলনগুলোকে পুরস্কৃত এবং উৎসাহিত করব, যারা আমাদের নীতি ও কৌশলের সঙ্গে ব্যাপক অর্থে সংগতিপূর্ণ থাকবে।’ ট্রাম্প ইতিমধ্যেই লাতিন আমেরিকায় রক্ষণশীল রাজনীতিকদের প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এবং ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইয়ের অধীনে আর্জেন্টাইন অর্থনীতিকে ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে উদ্ধার করে এই কৌশল কার্যকর করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র ‘এই-গোলার্ধের বাইরের প্রতিযোগীদের’ পশ্চিম গোলার্ধে ‘সামরিক বা অন্যান্য হুমকিমূলক সক্ষমতা স্থাপন করা কিংবা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলো নিজেদের দখলে নেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অস্বীকার’ করবে। সোজা কথায়, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো শক্তিকেই প্রভাব বিস্তার করতে স্বাগত জানাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পদ পশ্চিম গোলার্ধের দিকে সরিয়ে আনা হবে। এ জন্য আমেরিকান জাতীয় সুরক্ষার কাছে যেসব রণাঙ্গনের আপেক্ষিক গুরুত্ব সাম্প্রতিক দশকগুলোতে কমে এসেছে, সে সবকে সরিয়ে আনা হবে। এই ধারাবাহিকতায় যেন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মনোযোগ কিছুটা কমিয়ে দিচ্ছে।

কারণ, মধ্যপ্রাচ্য এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত অগ্রাধিকার নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের শক্তি উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘মধ্যপ্রাচ্যের ওপর মনোযোগ দেওয়ার আমেরিকার ঐতিহাসিক কারণ কমে আসবে।’ কারণ এই অঞ্চলে সংঘাত ও সহিংসতাও কমছে। যদিও বলা হয়েছে, ‘সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।’ এই অবস্থাতেও মার্কিন প্রশাসন এই অঞ্চলের জন্য সোনালি ভবিষ্যতের কল্পনা করছে। ওয়াশিংটনের স্বার্থে আধিপত্য বজায় রাখার পরিবর্তে, মধ্যপ্রাচ্য ‘ক্রমবর্ধমানভাবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের উৎস এবং গন্তব্যে পরিণত হবে’, যার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্তর্ভুক্ত। এটি এই অঞ্চলকে ‘অংশীদারত্ব, বন্ধুত্ব এবং বিনিয়োগের স্থান হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও সহিংসতায় জর্জরিত। গাজায় যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সেটেলার ও সেনাদের মারাত্মক অভিযান বাড়ছে। ইসরায়েল লেবাননেও বিমান হামলা বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা দুর্বল হিজবুল্লাহকে বলপূর্বক নিরস্ত্র করতে দেশটির বিরুদ্ধে আরেকটি সর্বাত্মক হামলার ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সিরিয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের এক বছর পরেও, ইসরায়েলের দক্ষিণে অধিকৃত গোলান মালভূমির বাইরে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করার জন্য অনুপ্রবেশ এবং হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলের ব্যাপারে মার্কিন অবস্থান আগের মতোই অপরিবর্তিত থাকবে। এই নথি স্বীকার করে যে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ এখনো রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘ইসরায়েল যেন সুরক্ষিত থাকে’ তা নিশ্চিত করা এবং জ্বালানি সরবরাহ ও শিপিং লেনগুলো রক্ষা করা।

ট্রাম্পের নতুন নিরাপত্তা কৌশলে বেইজিংয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সামনে রাখা হয়নি। এই নথিতে এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় জেতা এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে চীনকে মোকাবিলায় ভারসাম্য তৈরির জন্য এশীয় মিত্রদের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেখানে ভারতকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চল সুরক্ষায় আমাদের অবশ্যই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক (ও অন্যান্য) সম্পর্ক উন্নত করতে হবে।’ এর মধ্য দিয়ে একটি ইঙ্গিত স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র যদি দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় সেটি হলো ভারত। আর এ কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোর সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘তাইওয়ান নিয়ে সংঘাত ঠেকানো’কে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে। আর এটি করতে তারা ‘আদর্শগতভাবে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার’ পক্ষে। এটি নিশ্চিত করতে এই অঞ্চলের মার্কিন অংশীদারদের সামরিক ব্যয় বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। একইভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।

এ কৌশল অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। ওয়াশিংটন ‘ইউরোপকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে এবং এক সারিতে থাকা সার্বভৌম জাতিগুলোর একটি গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতে সক্ষম করাকে’ অগ্রাধিকার দেবে।

বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ ম্যার্ৎসও। তিনি বলেছেন, ইউরোপকে এখন নিজের নিরাপত্তা নীতি ও প্রতিরক্ষায় আরও আত্মনির্ভর হতে হবে; যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা রাখা চলবে না।

সব মিলিয়ে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিরাপত্তা কৌশলে ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ এবং ‘আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ’কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এই নিরাপত্তা কৌশল দেশটিকে ইরাক-আফগানিস্তানের মতো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ থেকে বিরত রাখার পরিসর তৈরি করলেও, মাদক, অভিবাসন এবং অপরাধ ইস্যুতে সামরিক হস্তক্ষেপ চালানোর সম্ভাব্যতা খুলে রেখেছে। যার প্রথম শিকার হতে পারে ভেনেজুয়েলা।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইমরান খান প্রতিরোধের প্রতীক

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
ইমরানের জীবন মাঠের উচ্ছ্বাস এবং সাফল্যের উজ্জ্বলতা থেকে রাজনৈতিক নিপীড়নের করুণতম অধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত
ইমরানের জীবন মাঠের উচ্ছ্বাস এবং সাফল্যের উজ্জ্বলতা থেকে রাজনৈতিক নিপীড়নের করুণতম অধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত

ইমরান খানকে বোঝার জন্য তাঁকে শুধু একজন ক্রিকেটার বা রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়। তাঁর জীবন যেন একপ্রকার দ্বৈত পরিসর—একদিকে বলের তীব্র গতি, মাঠের উচ্ছ্বাস এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো; অন্যদিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চের অস্থিরতা, ষড়যন্ত্র এবং ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ইতিহাসের ছায়া। ১৯৫২ সালে লাহোরের সম্ভ্রান্ত পশতুন পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই মানুষটি নিজের প্রতিভা, দৃঢ়সংকল্প এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে ক্রীড়া জগতের যে উচ্চশিখর স্পর্শ করেছিলেন, তা চোখে পড়ার মতোই। কিন্তু শুধু মাঠের সীমাবদ্ধতায় তাঁকে বন্দী রাখা সম্ভব হয়নি। ক্রিকেটের পরিপূর্ণতা ছাড়িয়ে তিনি প্রবেশ করলেন রাজনীতির জটিল রাজপথে—যেখানে স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং সংকল্পের সঙ্গে মিশে থাকে গণমানুষের আশা। খেলাধুলায় অর্জিত বিজয়ী মনোভাব এবং সাফল্যের জ্যোতি তাঁকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি শুধু একজন নেতা নন; তিনি হলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, সংস্কারক এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক—যিনি বিশ্বাস করতেন যে গণমানুষের শক্তিই সমাজের মূলচাকা। তাঁর জন্মভূমির ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং সংগ্রামের প্রভাব তাঁকে এমন এক চরিত্রে গড়ে তুলেছিল, যেখানে খেলাধুলার তীক্ষ্ণ প্রতিযোগিতা এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের অস্থিরতাকে একসঙ্গে বহন করা সম্ভব হয়।

ইমরানের জীবন যেন এক জীবন্ত গল্প—মাঠের উচ্ছ্বাস এবং সাফল্যের উজ্জ্বলতা থেকে রাজনৈতিক নিপীড়নের করুণতম অধ্যায়। এই দ্বৈত পরিসরেই তিনি থাকলেন সংগ্রামের প্রতি অদম্য ধৈর্য ধারণ করে। ইমরান খানের ক্রীড়াজীবনের পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে। তিনি তখন ছিলেন এক যুবক, যাঁর প্রতিভা, উৎসাহ ও অদম্য মনোবল তাঁকে ক্রিকেট জগতের নতুন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। মাঠে তাঁর উপস্থিতি শুধু বল ও ব্যাটের কৌশলের সমষ্টি ছিল না; এটি ছিল নেতৃত্বের এক জীবন্ত উদাহরণ। ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে বিজয় এনে দেওয়া তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত। সেই জয়ের মাধ্যমে ইমরান শুধু জাতীয় নায়ক হয়ে ওঠেননি, তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবেও অভিষিক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বের শৈলী, দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সামলানোর দক্ষতা সমকালীন ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে অমর হয়ে থাকবে। কিন্তু ক্রিকেটের উৎকর্ষই তাঁর জীবনের একমাত্র পরিমাপ নয়। খেলার পরিপূর্ণতা ছেড়ে তিনি মনোনিবেশ করেন মানবসেবায়। তাঁর মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত শওকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল শুধু চিকিৎসার কেন্দ্র নয়; এটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগের প্রতীক হয়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে মূলত সাধারণ মানুষের অনুদানের মাধ্যমে, আর এটি তাঁর সহানুভূতি, মানবিকতা এবং নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে গড়ে ওঠে।

ইমরানের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় যখন তিনি রাজনীতির জটিল পথে পা রাখেন। ১৯৯৬ সালে তিনি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এটি ছিল রাজনৈতিক মঞ্চের এক প্রান্তিক দল, কিন্তু ২০১০-এর দশকে হঠাৎ করেই এটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দুর্নীতির বিরোধিতা, জাতীয় মর্যাদা এবং ইসলামি কল্যাণরাষ্ট্র—এই তিনটি মূল স্লোগান নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মানুষের মনে নতুন আশা, নতুন বিশ্বাস এবং ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দেন, তিনি ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়বেন। কিন্তু শাসনকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সামনে আসে চ্যালেঞ্জের একটি বিশাল পাহাড়—অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, ঋণ এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানের চাপ। কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করা সহজ ছিল না। সেনা এবং ‘ডিপ স্টেট’-এর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে ওঠে অনিবার্য এবং এই দ্বন্দ্ব ক্রমে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাকে আরও জটিল করে তোলে।

২০২২ সাল থেকে শুরু হয় ইমরানের পতন। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অবনতি, একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তার এবং শেষ পর্যন্ত কারাগারে বন্দিত্ব—সবই একটি কঠোর রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। অনেকের কাছে মনে হয়, এসব ঘটনা শুধু আইনের প্রয়োগ নয়; বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এক সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর প্রমাণ। এমন অবস্থায়, ইমরান খানের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। ইমরান খান একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনৈতিক নেতা হলেও তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল গভীর, বিশ্লেষণধর্মী ও মানবিক। তিনি শুধু ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তার পেছনে দৌড়াননি; বরং প্রতিটি বিষয়কে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করতেন এবং আলোচনায় যুক্তি ও সংবেদনশীলতার সমন্বয় ঘটাতেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁকে সাধারণ রাজনীতিকের চেয়ে আলাদা করত—একজন মানুষ যিনি চিন্তা, অনুভূতি এবং নৈতিক দৃঢ়তার সঙ্গে রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়াতে পারতেন। ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবনের এক অধ্যায়কে গভীর দ্বন্দ্ব ও বিরোধের গল্প বলা যায়। অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তনের চ্যালেঞ্জ, ভারতের সঙ্গে স্থায়ী শান্তির আকাঙ্ক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান—সবকিছুর মাঝেও তিনি ক্রমেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই দ্বন্দ্ব ছিল শুধু রাজনৈতিক কৌশল বা ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি ছিল রাষ্ট্রের শাসনকাঠামোর সঙ্গে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও নৈতিক দৃঢ়তার সংঘর্ষ।

২০২৩ সালে তিনি কারাগারে বন্দী হন। তখন তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা বন্ধ, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন—সবকিছু এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে যেন তিনি সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়েছেন। এই কঠিন পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় বলা যেতে পারে।

ইমরানের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথা—যিনি সেনা ও ক্ষমতার শক্তিশালী ছায়ার ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার মূল্য দিতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইমরানও সেই ইতিহাসের ছায়ায়, সেই একই চক্রের শিকার হয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু এখানেই এক গভীর পাঠ নিহিত—যে সাহস, ন্যায় ও বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম করা যায়, তা কখনো ম্লান হয় না। ইমরান খানের জীবন তাই শুধু রাজনৈতিক বিবরণ নয়; এটি আমাদের সবার জন্য এক সাহসের, নৈতিকতার এবং অনমনীয় বিশ্বাসের অমর শিক্ষা হতে পারে।

এটি আমাদের আগামী প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ নয়, তবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহসই চিরকাল গৌরবময়। ইমরানের জীবন তাই শুধুই ইতিহাস নয়; এটি সতর্কতা, প্রেরণা এবং অবিচল বিশ্বাসের এক অমর উদাহরণ।

লেখক: আইনজীবী ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্পর্ধা

সম্পাদকীয়
স্পর্ধা

বেগম রোকেয়া সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন যিনি, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। জগৎ-সংসার সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। তিনি যে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে একেবারেই শ্রদ্ধা করেন না, এবং নারীর মর্যাদা রক্ষা করার ব্যাপারে তাঁর অবস্থান যে ধোঁয়াশায় ঘেরা, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পাওয়া মানুষেরা আজকাল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে, নারী মুক্তি নিয়ে যেভাবে কটাক্ষ করে চলেছেন, তাতে দেশের গতি উল্টো দিকে বহমান কি না, সে প্রশ্ন মনে জাগতে বাধ্য।

চেষ্টা হয়েছে আগেও, কিন্তু বিজয়ের মাসে এসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা যেন বেড়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে টকশোর মধ্যে এমন কাউকে কাউকে এমন কিছু কথা বলতে শোনা যাচ্ছে, যা আমাদের স্বাধীনতা-ভাবনাটিকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। কেন এইসব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রমাণহীন কটাক্ষ করা মানুষদের জায়গা করে দিচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার। স্বাধীনতা মানে স্ব অধীনতা, স্বাধীনতা মানে সত্য-মিথ্যা সবকিছু সেরদরে বলার স্বাধীনতা নয়—এ কথা যারা বুঝতে অক্ষম, তাদেরই আস্ফালন দেখা যাচ্ছে বেশি। এখনই সতর্ক না হলে এই ভণ্ড-প্রতারকের দল গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারে সয়লাব করে দিতে পারে দেশ।

কারও চাপিয়ে দেওয়া বয়ানে স্বাধীনতার ইতিহাস পূর্ণতা পাবে না। কিন্তু দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা নানা তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করেই স্বাধীনতার ইতিহাস লিখিত হবে। কে কোথায় কার নামে কটাক্ষ করল, আর সেটাই হয়ে উঠল স্বাধীনতার ইতিহাস—এ কথা যারা ভাবে, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যই। এমন একটি দেশ গড়ে উঠবে, যে দেশে শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না। নিজের হাতেই থাকবে নিজের নির্ভরতার চাবি। স্বাধীনতার পর সে আশা পূরণ হয়নি বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে পাকিস্তানের ২৩ বছরের দুর্গন্ধযুক্ত ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যারা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসে পাকিস্তানি মনোভাব পোষণ করে, তাদের ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কী-ইবা করার আছে?

আর বেগম রোকেয়া? নারী মুক্তির বিপক্ষে যারা দাঁড়ায়, তারা এই মহীয়সী নারীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতেই থাকে। এটা আজকের ব্যাপার নয়। নারীকে যারা পুরুষের সম্পত্তি বলে মনে করে থাকে, তারা উদার দৃষ্টিতে মানুষের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে অপারগ। কথা বলার স্বাধীনতা থাকায় এরা মুক্তকচ্ছ শব্দাবলি উচ্চারণ করে যাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে, নারী মুক্তি প্রসঙ্গে কেউ যদি কটাক্ষ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।

এসব উদ্ভট প্রসঙ্গ তুলে এনে যারা নিজেদের লাইমলাইটে আনতে চায়, তাদের ব্যাপারে সরকারের ভাবনা কী, সেটা প্রকাশ করা জরুরি। কারণ, সরকার যদি এ ধরনের অন্যায্য, প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে না দাঁড়ায়, তাহলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারি ভাষ্য জানা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত