আজাদুর রহমান চন্দন
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেই আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্টের ‘দোসর’ তকমা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তা তো বটেই, কখনো কখনো ব্যক্তি বা জনসমষ্টির ওপর সরাসরি আক্রমণের ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। একই রকমভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিশেষ মতবাদের বিপক্ষের ব্যক্তি-গোষ্ঠী এবং নারীসমাজসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিতর্ক, মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল বা ভাস্কর্য ধ্বংস করার মতো বেশ কিছু ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ শাসনের অবসানের পর থেকে দলটির সঙ্গে একাত্তরকে মিলিয়ে খোদ স্বাধীনতাযুদ্ধকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল ‘মব’ (উন্মত্ত কিছু মানুষের সংঘবদ্ধ আক্রমণ) সৃষ্টি করে ভাস্কর্যসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এবং মাজার ভাঙার তাণ্ডব। ভাস্কর্য-মাজার ইত্যাদি ভাঙচুর এবং বাউল, ফকির-সন্ন্যাসী, নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার এই ধারা চলতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও। এক বছরে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দুই হাজারের মতো স্মারক ধ্বংস করার পাশাপাশি মাজার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতাধিক।
সবশেষ পাওয়া তথ্যমতে, গত শুক্রবার রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার আস্তানায় হামলা, ভাঙচুর ও আগুন লাগানো ছাড়াও কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ওই দিন জুমার নামাজের পর ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোক ওই আস্তানায় গিয়ে হামলা চালালে একজন নিহত ও অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। একই দিনে প্রায় একই সময়ে রাজশাহীর পবা উপজেলার পানিশাইল চন্দ্রপুকুর গ্রামে একটি খানকা শরিফে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে দেড় শতাধিক লোক। স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুর রহমান ভান্ডারি প্রায় ১৫ বছর আগে নিজ জমিতে খানকা শরিফটি প্রতিষ্ঠা করেন। অনুসারীদের কাছে তিনি ‘পীর সাহেব’ হিসেবে পরিচিত। খানকা শরিফে হামলার সময় থানার ওসিসহ পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হামলা ঠেকাতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গোয়ালন্দে কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায় সারার চেষ্টা করলেও পবায় খানকা শরিফে হামলার বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নজরে আসেনি। গত ৩১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বাউল, নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ ভিন্ন মতবাদের মানুষের ওপর এবং মাজারে আক্রমণ হলেও সরকার ও রাষ্ট্রকে নিশ্চুপ-নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। জুলাই গণ-অভুত্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত বছরের ডিসেম্বরে কুমিল্লায় এক মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরানো হয়, হামলা করা হয় তাঁর বাড়িঘরে। একই মাসে হাতিয়ায় মুক্তিযোদ্ধার ওপর হামলার মামলা প্রত্যাহার করা না হলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। রাজশাহীতে প্রয়াত এক মুক্তিযোদ্ধাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার আসামি করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। অতি সম্প্রতি ঢাকায় পরপর ঘটেছে বেশ কিছু ঘটনা।
গত ২৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান বিষয়ে এক গোলটেবিল আলোচনায় মব সৃষ্টি করে হেনস্তা করা হয়েছে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাসহ বেশ কয়েকজনকে। নানা ধরনের ট্যাগ দিয়ে তাঁদের লাঞ্ছিত করা হলেও মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লতিফ সিদ্দিকী সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়, তিনি আওয়ামী লীগ আমলে এমপি-মন্ত্রী ছিলেন এবং ফ্যাসিস্টের দোসর। অথচ ২০১৫ সালেই তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। জুলাই আন্দোলনে শুরু থেকেই তিনি সরাসরি সমর্থন দেন। ফ্যাসিস্টের দোসর ট্যাগ দেওয়া সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খুবই সমালোচনামুখর ছিলেন।
আসলে বর্তমানে যাঁকে বা যাঁদেরই বিশেষ গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ হাসিলের পথে বাধা মনে করা হচ্ছে, তিনি বা তাঁরাই এ ধরনের ট্যাগ ও মবের কবলে পড়ছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ যেসব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন গত তিন দশকের বেশি সময়ে এক দিনের জন্যও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধা দূরের কথা, যুগপৎ কোনো কর্মসূচিতেও অংশ নেয়নি, সেই দলকেও কখনো ফ্যাসিস্টের দোসর, কখনো মুজিববাদী বাম বলে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। সিপিবি, বাসদসহ ওই দল ও সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় মূলত এ ধরনের ট্যাগের শিকার হচ্ছে। কখনো কখনো ওই সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরেও এক পক্ষ অপর পক্ষকে এ ধরনের ট্যাগ দিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বিবিসি বাংলার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও শিরোনাম করা হচ্ছে, ‘আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে কি মুক্তিযুদ্ধকে টার্গেট করা হচ্ছে?’ ২ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের। তিনি বলেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করতে চায়, তাদের জন্য এটা খুব সহজ যে আওয়ামী লীগ-বিরোধিতার নামে তারা মুক্তিযুদ্ধকেই খারিজ করে দিতে চায় এবং সেই চেষ্টাই তারা করছে এখন পর্যন্ত।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ ও মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এসএএইচআর)। তারা বলেছে, গণহারে হত্যা মামলা, অভিযুক্তদের জামিন থেকে বঞ্চিত করা, বিচারপ্রক্রিয়ায় ফাঁকফোকর ও বিলম্বের মতো বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পান্থপথে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ তুলে ধরেন এসএএইচআরের নির্বাহী পরিচালক দীক্ষা ইল্লাঙ্গাসিংহে। এর পরদিনই রাজধানীতে আদালতকক্ষে এক সাংবাদিককে মারধর করা হয়েছে বিচারকের সামনেই। কয়েকজন আইনজীবী মব সৃষ্টি করে হামলে পড়েন ওই সাংবাদিকের ওপর।
বার্ধক্যের কারণে বেশ আগে থেকেই চলাফেরা অনেকটা সীমিত সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেনের। গত ২৯ আগস্ট এক আলোচনা সভায় লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিগত আমলের মতোই একটি অশুভ শক্তির সর্বত্র চাঁদাবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস, খুনোখুনি ও মব সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে। তিনি বলেন, এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে, যা কারও কাম্য নয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে ওই আলোচনা সভায় তাঁর পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। একই সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেউ ভান করে ভুলতে চাইলে সেটা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। আগের দিন অপর এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এখন রাজনীতির অঙ্গনে একদল তরুণ, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; তাদের মুখে একটা স্লোগান শোনা যায়, বিদ্যমান ১৯৭২ সালে প্রণীত যে সংবিধান, সেটি ছুড়ে ফেলতে হবে। এটি তো আওয়ামী লীগের সংবিধান না।’
বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থানের শঙ্কা জানিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর ও একপেশে বলে উল্লেখ করা হলেও, পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ কিংবা ‘হারানো ইউনিয়ন’ পুনরুদ্ধারের খোয়াব বারবার প্রচারিত হলেও, সে বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষকে দিল পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এর জন্যও প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি। সরকারের এমন নিষ্পৃহ ভাব এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মব সৃষ্টিকারীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টতায় একাত্তর মুছে ফেলার ঔদ্ধত্য বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা কোন অন্ধকার গন্তব্যে গিয়ে ভিড়ব, সেটি ভেবেই গায়ে কাঁটা দেয়।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেই আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্টের ‘দোসর’ তকমা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্তা তো বটেই, কখনো কখনো ব্যক্তি বা জনসমষ্টির ওপর সরাসরি আক্রমণের ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। একই রকমভাবে আক্রান্ত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিশেষ মতবাদের বিপক্ষের ব্যক্তি-গোষ্ঠী এবং নারীসমাজসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিতর্ক, মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল বা ভাস্কর্য ধ্বংস করার মতো বেশ কিছু ঘটনাও ঘটেছে। আওয়ামী লীগ শাসনের অবসানের পর থেকে দলটির সঙ্গে একাত্তরকে মিলিয়ে খোদ স্বাধীনতাযুদ্ধকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা চলছে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল ‘মব’ (উন্মত্ত কিছু মানুষের সংঘবদ্ধ আক্রমণ) সৃষ্টি করে ভাস্কর্যসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মারক এবং মাজার ভাঙার তাণ্ডব। ভাস্কর্য-মাজার ইত্যাদি ভাঙচুর এবং বাউল, ফকির-সন্ন্যাসী, নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার এই ধারা চলতে থাকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও। এক বছরে মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দুই হাজারের মতো স্মারক ধ্বংস করার পাশাপাশি মাজার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শতাধিক।
সবশেষ পাওয়া তথ্যমতে, গত শুক্রবার রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার আস্তানায় হামলা, ভাঙচুর ও আগুন লাগানো ছাড়াও কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ওই দিন জুমার নামাজের পর ‘ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে একদল লোক ওই আস্তানায় গিয়ে হামলা চালালে একজন নিহত ও অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। একই দিনে প্রায় একই সময়ে রাজশাহীর পবা উপজেলার পানিশাইল চন্দ্রপুকুর গ্রামে একটি খানকা শরিফে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে দেড় শতাধিক লোক। স্থানীয় বাসিন্দা আজিজুর রহমান ভান্ডারি প্রায় ১৫ বছর আগে নিজ জমিতে খানকা শরিফটি প্রতিষ্ঠা করেন। অনুসারীদের কাছে তিনি ‘পীর সাহেব’ হিসেবে পরিচিত। খানকা শরিফে হামলার সময় থানার ওসিসহ পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও হামলা ঠেকাতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গোয়ালন্দে কবর থেকে লাশ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায় সারার চেষ্টা করলেও পবায় খানকা শরিফে হামলার বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য নজরে আসেনি। গত ৩১ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আয়োজিত নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বাউল, নারী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ ভিন্ন মতবাদের মানুষের ওপর এবং মাজারে আক্রমণ হলেও সরকার ও রাষ্ট্রকে নিশ্চুপ-নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। জুলাই গণ-অভুত্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো।
গত বছরের ডিসেম্বরে কুমিল্লায় এক মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরানো হয়, হামলা করা হয় তাঁর বাড়িঘরে। একই মাসে হাতিয়ায় মুক্তিযোদ্ধার ওপর হামলার মামলা প্রত্যাহার করা না হলে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। রাজশাহীতে প্রয়াত এক মুক্তিযোদ্ধাকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলার আসামি করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। অতি সম্প্রতি ঢাকায় পরপর ঘটেছে বেশ কিছু ঘটনা।
গত ২৮ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান বিষয়ে এক গোলটেবিল আলোচনায় মব সৃষ্টি করে হেনস্তা করা হয়েছে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাসহ বেশ কয়েকজনকে। নানা ধরনের ট্যাগ দিয়ে তাঁদের লাঞ্ছিত করা হলেও মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লতিফ সিদ্দিকী সম্পর্কে অভিযোগ করা হয়, তিনি আওয়ামী লীগ আমলে এমপি-মন্ত্রী ছিলেন এবং ফ্যাসিস্টের দোসর। অথচ ২০১৫ সালেই তাঁকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। জুলাই আন্দোলনে শুরু থেকেই তিনি সরাসরি সমর্থন দেন। ফ্যাসিস্টের দোসর ট্যাগ দেওয়া সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খুবই সমালোচনামুখর ছিলেন।
আসলে বর্তমানে যাঁকে বা যাঁদেরই বিশেষ গোষ্ঠীর হীন স্বার্থ হাসিলের পথে বাধা মনে করা হচ্ছে, তিনি বা তাঁরাই এ ধরনের ট্যাগ ও মবের কবলে পড়ছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ যেসব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন গত তিন দশকের বেশি সময়ে এক দিনের জন্যও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বাঁধা দূরের কথা, যুগপৎ কোনো কর্মসূচিতেও অংশ নেয়নি, সেই দলকেও কখনো ফ্যাসিস্টের দোসর, কখনো মুজিববাদী বাম বলে ট্যাগ দেওয়া হচ্ছে। সিপিবি, বাসদসহ ওই দল ও সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় মূলত এ ধরনের ট্যাগের শিকার হচ্ছে। কখনো কখনো ওই সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরেও এক পক্ষ অপর পক্ষকে এ ধরনের ট্যাগ দিচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বিবিসি বাংলার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও শিরোনাম করা হচ্ছে, ‘আওয়ামী লীগ ট্যাগ দিয়ে কি মুক্তিযুদ্ধকে টার্গেট করা হচ্ছে?’ ২ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার ওই প্রতিবেদনে মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের। তিনি বলেছেন, যারা মুক্তিযুদ্ধকে আক্রমণ করতে চায়, তাদের জন্য এটা খুব সহজ যে আওয়ামী লীগ-বিরোধিতার নামে তারা মুক্তিযুদ্ধকেই খারিজ করে দিতে চায় এবং সেই চেষ্টাই তারা করছে এখন পর্যন্ত।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, নারীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ ও মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস (এসএএইচআর)। তারা বলেছে, গণহারে হত্যা মামলা, অভিযুক্তদের জামিন থেকে বঞ্চিত করা, বিচারপ্রক্রিয়ায় ফাঁকফোকর ও বিলম্বের মতো বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পান্থপথে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ তুলে ধরেন এসএএইচআরের নির্বাহী পরিচালক দীক্ষা ইল্লাঙ্গাসিংহে। এর পরদিনই রাজধানীতে আদালতকক্ষে এক সাংবাদিককে মারধর করা হয়েছে বিচারকের সামনেই। কয়েকজন আইনজীবী মব সৃষ্টি করে হামলে পড়েন ওই সাংবাদিকের ওপর।
বার্ধক্যের কারণে বেশ আগে থেকেই চলাফেরা অনেকটা সীমিত সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেনের। গত ২৯ আগস্ট এক আলোচনা সভায় লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিগত আমলের মতোই একটি অশুভ শক্তির সর্বত্র চাঁদাবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস, খুনোখুনি ও মব সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট বিরাজ করছে। তিনি বলেন, এই অশুভ শক্তিকে দমন করতে সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে, যা কারও কাম্য নয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম হলে ওই আলোচনা সভায় তাঁর পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। একই সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেউ ভান করে ভুলতে চাইলে সেটা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা। আগের দিন অপর এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘এখন রাজনীতির অঙ্গনে একদল তরুণ, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি; তাদের মুখে একটা স্লোগান শোনা যায়, বিদ্যমান ১৯৭২ সালে প্রণীত যে সংবিধান, সেটি ছুড়ে ফেলতে হবে। এটি তো আওয়ামী লীগের সংবিধান না।’
বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উত্থানের শঙ্কা জানিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর ও একপেশে বলে উল্লেখ করা হলেও, পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ কিংবা ‘হারানো ইউনিয়ন’ পুনরুদ্ধারের খোয়াব বারবার প্রচারিত হলেও, সে বিষয়ে কিছুই বলা হচ্ছে না। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষকে দিল পরিষ্কার করার পরামর্শ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এর জন্যও প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি। সরকারের এমন নিষ্পৃহ ভাব এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মব সৃষ্টিকারীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্টতায় একাত্তর মুছে ফেলার ঔদ্ধত্য বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমরা কোন অন্ধকার গন্তব্যে গিয়ে ভিড়ব, সেটি ভেবেই গায়ে কাঁটা দেয়।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক
‘গ্লোবাল সাউথ’ আজ একটি শক্তিশালী ধারণা—যেখানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো নতুন সংহতি গড়ে তুলছে। এটিকে সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন বলা হয়। একসময় যেখানে বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত উত্তর গোলার্ধের উন্নত দেশগুলোর হাতে...
১ দিন আগেবিশ্বব্যাপী ১৯৯৬ সাল থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব ফিজিওথেরাপি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো, ‘সুস্থ বার্ধক্যে ফিজিওথেরাপি—পড়ে যাওয়া ও দুর্বলতা প্রতিরোধে ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব’। ফিজিওথেরাপি ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে চিকিৎসাসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
১ দিন আগেফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবেই—দৃঢ়তা দেখিয়ে এ রকম বক্তব্য রাখা হচ্ছে বটে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে প্রায়ই। বিভিন্ন নাম নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যে হঠকারী ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, তা দূর থেকে দেখছে পুলিশ। তাতে মবকারীরা মদদ পাচ্ছে।
১ দিন আগেদেশের প্রকৌশল ও কারিগরি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিএসসি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার কথা। যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের সুন্দর, সফল বাস্তবায়নের জন্য তা জরুরিও। যেকোনো দেশ ও জাতি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে জনবল তৈরি করে। প্রত্যাশা করে সবার মিলিত প্রয়াসে জনকল্যাণ
৩ দিন আগে