Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

সংবিধানের অধিকারকে আইনি জালে আটকে রাখা হয়েছে

ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান

বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে কিছু মানুষ শুধু নেতাই নন, তাঁরা হয়ে ওঠেন সময়ের প্রতিবিম্ব। ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান তেমনই একজন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসক হিসেবে ডিগ্রি নিয়েও তিনি গোটা জীবন ব্যয় করেছেন শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে। শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপ গঠনের অন্যতম কারিগর তিনি। বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন অনেক বছর ধরে। মে দিবসের প্রাক্কালে তাঁর সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার

আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৮: ৩২

মে দিবস সামনে। আপনি যদি বলেন, আমাদের কীভাবে শুরু করা উচিত?

আমার মতে, শুরুটা হওয়া উচিত ইতিহাস বোঝা দিয়ে। আজকাল অনেকেই মে দিবসকে শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখেন—লাল পতাকা, শোভাযাত্রা, বক্তৃতা। কিন্তু মে দিবস হচ্ছে এক ঐতিহাসিক শ্রমিক বিদ্রোহের প্রতীক, যা শিকাগোর হে মার্কেটের সেই রক্তাক্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি নিয়ে যাঁরা পথে নেমেছিলেন, তাঁরা শুধু নিজের জন্য নয়, গোটা মানবজাতির কর্মপরিবেশ বদলে দিতে চেয়েছিলেন। কাজেই মে দিবসের আবেদন শুধু স্মরণে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তব প্রয়োগে যেতে হবে।

তাহলে আপনি কী ধরনের প্রস্তুতির কথা বলছেন?

প্রথমত, শ্রমিক সমাজকে সংগঠিত করতে হবে। আজকের শ্রমিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নানা খাতে—গার্মেন্টস, নির্মাণ, পরিবহন, কৃষি, সেবা খাত। অনেক জায়গায় ট্রেড ইউনিয়ন নিষ্ক্রিয়, কোথাও আবার দমন-পীড়নের মুখে। মে দিবস সামনে রেখে এই অসংগঠিত শক্তিকে সংগঠনের আওতায় আনাই হবে বড় কাজ।

দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের বর্তমান সমস্যাগুলো নিয়ে মাঠে-ময়দানে আলোচনা করতে হবে—ন্যায্য মজুরি, ওভারটাইমে শোষণ, দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ছাঁটাইয়ের হুমকি—এসব ইস্যু নিয়ে জনমত গড়া জরুরি কাজ।

বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়নের ভূমিকা কেমন দেখছেন?

দুঃখজনকভাবে ট্রেড ইউনিয়ন আজ অনেকটাই প্রতীকী রূপে রয়ে গেছে। অনেক জায়গায় রাজনৈতিক প্রভাব, আবার কোথাও মালিকপক্ষের চাপে সংগঠন ভেঙে পড়েছে। মে দিবসের আগে আমাদের দায়িত্ব হবে এই ইউনিয়নগুলোকে কার্যকরী করা, নেতৃত্বে সচেতনতা আনা। আমি বলি, ‘যেখানে শ্রমিক, সেখানেই সংগঠন’। এটা যদি বাস্তবে রূপ না নেয়, তাহলে মে দিবস কেবল গান-বক্তৃতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

আপনার কাছে মে দিবস মানে কী?

আমার কাছে মে দিবস হলো—সংগ্রামের শুরু, শেষ নয়।

চিকিৎসাবিদ্যার মতো একটি পেশা ছেড়ে আপনি শ্রমিক রাজনীতিতে এলেন—এটা তো অনেকটা ‘জীবন বদলে দেওয়া’ সিদ্ধান্ত। কেন এমন সিদ্ধান্ত?

এই সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে আসেনি। ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় সমাজের চিত্র আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। দেখেছি, গার্মেন্টস ছিল না তখন, কিন্তু কলকারখানার শ্রমিকেরা এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমজীবী-কর্মজীবীরা কী ভয়াবহ পরিবেশে কাজ করতেন। অন্যদিকে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ছাত্ররা অনেক সুবিধা পেতাম। প্রশ্ন জাগল—এই বৈষম্য কেন? তখন আমি বুঝলাম, চিকিৎসা দিয়ে শুধু শরীরের ক্ষত সারানো নয়, সমাজের ক্ষতও সারিয়ে তুলতে হবে। আর শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি ছাড়া সমাজের আরোগ্য অসম্ভব।

আপনাদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের দর্শন ও পথচলা অন্যান্য সংগঠন থেকে কীভাবে আলাদা?

আমরা যেটা বলি, সেটা হলো—‘শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকের জন্য, কোনো দলের জন্য নয়’। বাংলাদেশে অনেক ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন আছে, যারা মূলত রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন। এতে করে শ্রমিকদের স্বার্থ বারবার দলীয় স্বার্থের বলি হয়। আমরা চাই এমন এক সংগঠন, যেখানে শ্রমিক তাঁর কর্মক্ষেত্র, জীবনমান ও মর্যাদা নিয়ে সরাসরি কথা বলতে পারেন। ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সেই লক্ষ্যে কাজ করছে—নিয়মতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং শ্রেণি-সচেতন সংগঠন হিসেবে।

আপনি প্রায় ছয় দশক ধরে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। এই সময়ের মধ্যে কী কী বড় পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে অর্থনীতির কাঠামোতে। ৬০-এর দশকে আমরা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিল্প দেখেছি, ৮০-এর পরে উদারীকরণ, বিশ্বায়ন আর বেসরকারীকরণ। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে শ্রমিক শুধু শ্রম নয়—আত্মসম্মানও হারাচ্ছেন। আগে শ্রমিকেরা সংগঠিত হতেন, দাবি জানাতেন, এখন মালিকপক্ষ ও রাষ্ট্র মিলে সংগঠনের পথটাই সংকুচিত করে ফেলেছে। আবার ডিজিটাল শ্রমিকের আবির্ভাবও হয়েছে, যাঁরা একেবারে নতুন বাস্তবতা তৈরি করছেন।

নতুন প্রজন্মের শ্রমিকদের মধ্যে আপনি কী ধরনের মনোভাব দেখছেন? তাঁরা কি সংগঠিত হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী?

এই প্রশ্নটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজন্মের শ্রমিকেরা অনেক বেশি শিক্ষিত, সচেতন, কিন্তু একই সঙ্গে বিভ্রান্ত। তাঁরা ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের যুগে বাস করছেন। রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে অনেকটাই দূরে। কিন্তু যখন তাঁদের ওপর অন্যায় হয়—মজুরি না দেওয়া, ছাঁটাই, দুর্ঘটনা—তখন তাঁরা প্রতিবাদ করেন। এর মানে তাঁরা আগ্রহী, কিন্তু সংগঠনের পথটা তাঁদের কাছে অজানা। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সেই পথটা দেখানো, আধুনিক ভাষায়, প্রযুক্তির সহায়তায়।

আপনি বলছেন, সংগঠিত হওয়ার অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। কিন্তু সংবিধানে তো ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার আছে। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সংবিধানে অধিকার আছে, কিন্তু বাস্তবে বাধা আছে। শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন পেতে গেলে নানা রকম প্রশাসনিক বাধা আসে। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকনেতাদের হুমকি দেওয়া হয়, চাকরিচ্যুত করা হয়। বড় বড় শিল্পকারখানায় তো আপনি নামমাত্র ইউনিয়ন দেখতে পাবেন, যারা মালিকপক্ষের ছায়াতলে কাজ করে। সংবিধানের অধিকারকে বাস্তবের আইনি জালে আটকে রাখা হয়েছে।

তৈরি পোশাক খাতে শোষণ কি শুধু মজুরিসংক্রান্ত, নাকি এর বাইরেও কিছু আছে?

তৈরি পোশাক খাতে শোষণ বহুমাত্রিক। একদিকে নিম্ন মজুরি, অন্যদিকে কাজের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ। ছাঁটাইয়ের ভয়, মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া, ওভারটাইমের অপব্যবহার—এসব প্রতিনিয়ত ঘটছে। এরপর আছে সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন। একজন পোশাকশ্রমিক তাঁর জীবন দিয়ে জাতীয় রপ্তানি আয়ে ভূমিকা রাখছেন, অথচ তিনি আজও বস্তিতে থাকেন, তাঁর শিশুর স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত নয়। এই অসম্মানটা আসলে মানসিক শোষণ।

আপনি বলেছেন, আমরা সহিংসতার বিপক্ষে। কিন্তু যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেও পুলিশি হামলা হয়? তখন শ্রমিকেরা কী করবেন?

আমাদের কৌশল হচ্ছে—আন্দোলনকে গণসংহতির আন্দোলনে রূপ দেওয়া। যদি শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিতে অন্য শ্রেণির মানুষ, যেমন শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণি পাশে দাঁড়ায়, তখন সেই আন্দোলনকে পুলিশ দিয়ে ঠেকানো যাবে না। আমরা এটা শিখেছি—নির্জন রাস্তায় আন্দোলন করলে নির্যাতন সহজ হয়। কিন্তু জনতার রাস্তায় আন্দোলন হলে সে আন্দোলন দমন করা কঠিন।

আপনি চিকিৎসক ছিলেন, স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে ভালো জানেন। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?

শ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন, কিন্তু তাঁরই জন্য স্বাস্থ্যসেবা সবচেয়ে কম। শিল্প এলাকায় সরকারিভাবে কোনো বিশেষ শ্রমিক হাসপাতাল নেই বললেই চলে। যাঁদের আয় সীমিত, তাঁরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন। দুর্ঘটনায় আহত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো দূরের কথা, মালিকেরা অনেক সময় পরিচয়ই অস্বীকার করেন। শ্রমিকদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যনীতি, বিনা মূল্যে চিকিৎসা এবং দুর্ঘটনার পর স্বয়ংক্রিয় ক্ষতিপূরণ—এই তিনটি জরুরি।

আপনি একজন প্রবীণ নেতা। আপনার মতো আরেকজন ‘নতুন ওয়াজেদ’ কীভাবে তৈরি হবে? নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

নেতৃত্ব জন্মায় সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। আমি সব সময় তরুণদের বলি—তোমরা প্রশ্ন করো, প্রতিবাদ করো, নেতৃত্ব নিতে শেখো। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, সংগঠন মানে শুধু মিটিং নয়, মানে দায়িত্ব। নেতৃত্ব মানে ত্যাগ। যারা তা নিতে সাহস করে, তাদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র সব সময় প্রস্তুত।

আপনি ব্যক্তিগত জীবনে কখনো হতাশ হয়েছেন? কখনো মনে হয়েছে, সব চেষ্টা বৃথা?

মানুষ হিসেবে হতাশা আসে। যখন দেখি একজন নারী শ্রমিক তাঁর শিশুকে ফেলে ভোরবেলা কাজে যাচ্ছেন, অথচ তাঁর মালিক এক রাতেই কোটি টাকা আয় করছেন, তখন মন কাঁদে। কিন্তু আমি জানি—লড়াই কখনো বৃথা যায় না। যে চোখ প্রতিবাদ শিখেছে, তাকে আর দাসত্বে রাখা যায় না।

মে দিবস উপলক্ষে নতুন প্রজন্ম ও শ্রমিকদের উদ্দেশে আপনার বার্তা কী?

মে দিবস শুধু উদ্‌যাপনের বিষয় নয়, এটা একটি জীবনদর্শন। শ্রমিক মানে শুধুই হাতের কাজ নয়, শ্রমিক মানে এই সমাজের ভিত। তাই কেউ যদি বলে ‘তুমি শ্রমিক, তুমি নিচু শ্রেণি’—তাকে বলো, ‘আমার ঘামে এই শহর জ্বলে, আমার হাতে দেশ চলে।’ সংগঠিত হও, সচেতন হও, শ্রেণিসংগ্রামকে মানবিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরে নিয়ে যাও। তাহলে হয়তো একদিন সত্যিকারের স্বাধীনতা আসবে—যেখানে মানুষ, তার শ্রম, আর তার স্বপ্ন—সবই অর্থবহ হবে।

দীর্ঘ জীবনে আপনি অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখেছেন। এর মধ্যে কোনটা আপনাকে প্রভাবিত করেছে এবং কেন?

আমার জীবনে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে—যুদ্ধ, বিপ্লব, হত্যাকাণ্ড, অভ্যুত্থান। তবে দুটি ঘটনা আমাকে ভেতর থেকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রথমটি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার অভ্যুদয়। দ্বিতীয়টি, বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা—একটি জাতি কীভাবে রক্ত দিয়ে নিজের পরিচয় গড়ে তোলে, তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তার ভেতরেই ছিল একটি শোষণহীন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা—যেখানে মানুষ শুধু জীবিত থাকবে না, মর্যাদার সঙ্গেও বাঁচবে।

কিন্তু আশির দশকের শেষ ভাগে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটল, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার ভিত্তি কেঁপে উঠল—তখন মনে হয়েছিল, আমরা যেন এক বিশাল আদর্শিক পরাজয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। শুধু একটি রাষ্ট্র নয়, যেন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি বিশ্বাস ধসে পড়ল।

আমি নিজে শ্রমিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি, সমাজতন্ত্রের মানবিক ও সাম্যবাদী বোধে আস্থাশীল ছিলাম। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনে সারা বিশ্বের শোষিত মানুষেরা যেন দিশেহারা হয়ে গেল। পুঁজিবাদের আগ্রাসন, করপোরেট লুট, মানুষের ওপর মানুষের শোষণ আবারও প্রবল হয়ে উঠল। তখন বুঝেছি—রাজনীতি শুধু সংখ্যার খেলা নয়, আদর্শ হারালে মানুষের আত্মবিশ্বাসও চূর্ণ হয়ে যায়।

এই দুই উত্থান-পতন—একটি স্বাধীনতার জয়ের আলো, আরেকটি আদর্শের ধ্বংস—আমাকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াবে।

জীবনসায়াহ্নে কোন পরিবর্তনের খবর শুনলে বেশি স্বস্তি বোধ করবেন?

এই বয়সে এসে চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই। কিন্তু অন্তরের ভেতর এক যন্ত্রণা এখনো বয়ে বেড়াই—আমরা কি আদর্শকে ধরে রাখতে পেরেছি? যেসব স্বপ্ন নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলাম, সেগুলোর কি কোনো বিকাশ ঘটল?

আমি সবচেয়ে স্বস্তি পাব যদি শুনি, বাংলাদেশে একটি মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে—যেখানে শ্রমজীবী মানুষ অপমানিত হয় না, যেখানে শিক্ষা ও চিকিৎসা পণ্য নয়, অধিকার। পুঁজির একচেটিয়া ক্ষমতা ভেঙে শ্রমিক-কৃষকের সম্মান ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

আর যদি দেখি, বিশ্ব আবার সেই মানবিক সমাজতন্ত্রের ধারণার দিকে ফিরছে—শোষণের বদলে সহযোগিতা, প্রতিযোগিতার বদলে সহমর্মিতা, বাজার নয়, মানুষের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে—তবে মৃত্যুশয্যায় শুয়েও মনে শান্তি আসবে।

আমার স্বস্তির খবর হবে: পুঁজিবাদের করালগ্রাস ভেঙে এক নতুন মানবিক সভ্যতা গড়ে উঠছে, যার ভিত রচনা করছে নতুন প্রজন্ম।

তখনই হয়তো নিজের ভেতর বলতে পারব—আহা, এত দিন ধরে যা নিয়ে পথ চলেছি, তা একেবারে বৃথা যায়নি।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত আফ্রিকা

রাজিউল হাসান
পশ্চিম আফ্রিকার বেনিনে ৭ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হন একদল সেনাসদস্য। ছবি: সংগৃহীত
পশ্চিম আফ্রিকার বেনিনে ৭ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হন একদল সেনাসদস্য। ছবি: সংগৃহীত

বেনিন পশ্চিম আফ্রিকার ফরাসিভাষী একটি দেশ। ৭ ডিসেম্বর হঠাৎ করেই দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হন একদল সেনাসদস্য। তাঁরা ঘোষণা দেন, দেশে অভ্যুত্থান ঘটেছে। যদিও ঘণ্টাখানেক পর সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা আসে, বিপথগামী সেনাসদস্যদের অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

এ ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে পশ্চিম আফ্রিকার আরেক দেশ গিনি-বিসাউয়ে অভ্যুত্থান ঘটায় সেনাবাহিনী। ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত এই দুই দেশসহ আফ্রিকার ৯টি দেশে অভ্যুত্থান ঘটেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, একটি মহাদেশে মাত্র পাঁচ বছরে এতগুলো অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থানচেষ্টার ঘটনা কেন ঘটল? কেন গণতন্ত্র এভাবে মার খাচ্ছে আফ্রিকায়?

লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কস গ্রুপের বিশ্লেষক বেভারলি ওচিয়েং মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) বলেছেন, আফ্রিকার দেশগুলোয় যে অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থানচেষ্টাগুলো ঘটছে, তার পেছনে আর্থসামাজিক বঞ্চনা, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় বেসামরিক সরকারকে নিয়ে নাগরিকদের হতাশাসহ নানা কারণ রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় এসব সমস্যা বেশি।

পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো হলো নাইজার, বেনিন, নাইজেরিয়া, লাইবেরিয়া, ঘানা, বুরকিনা ফাসো, সেনেগাল, গাম্বিয়া, গিনি, মালি, আইভরি কোস্ট, টোগো, সিয়েরা লিওন, গিনি-বিসাউ, কেপ ভার্দে, মৌরিতানিয়া ও চাদ। এই দেশগুলো বিশেষভাবে পরিচিত সহিংস ঘটনার জন্য। এর মধ্যে আটলান্টিক সাগর-তীরবর্তী সেনেগাল, গিনি-বিসাউ, সিয়েরা লিওন এবং ভূখণ্ডবেষ্টিত মালি, বুরকিনা ফাসো ও নাইজারে সহিংসতার খবর বেশি আসে।

নিবিড়ভাবে লক্ষ করলেই বোঝা যায়, পশ্চিম আফ্রিকার সহিংসতা-প্রবণ এই দেশগুলোয় সামরিক বাহিনী আর রাজনীতি একাকার হয়ে আছে। বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর পাশাপাশি কোনো কোনো দেশে জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতাও বেশ ভালোভাবে রয়েছে।

এ ছাড়া রয়েছে আর্থসামাজিক বঞ্চনা, দারিদ্র্যসহ নানা সমস্যা।

কেবল যে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতেই অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থানচেষ্টা হয়েছে, তা কিন্তু নয়। গত অক্টোবরে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কারে প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোলিনার পদত্যাগের দাবিতে তরুণদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ হয়। এই সুযোগে ক্ষমতা দখল করেছে সামরিক বাহিনী। পরে প্রেসিডেন্ট প্রাণ বাঁচাতে দেশ থেকে পালান, পার্লামেন্ট তাঁকে অভিশংসিত করে। ২০২৩ সালে মধ্য আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশ গ্যাবনে সেনাবাহিনী দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট আলী বঙ্গোকে ক্ষমতাচ্যুত করে। অভ্যুত্থানের নেতা ছিলেন আলী বঙ্গোরই চাচাতো ভাই ব্রাইস অলিগুই। এই অভ্যুত্থান ঘটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আলী বঙ্গোকে বিজয়ী ঘোষণার পরপরই। অভ্যুত্থানের পর ব্রাইস অলিগুইকে নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

২০২১ সালের এপ্রিলে চাদে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল মাহামাত ইদ্রিস দেবি। তিনি ক্ষমতা দখলের আগে দেশটির নেতা ছিলেন তাঁরই বাবা। তিনি অবশ্য বাবাকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসেননি। বাবার মৃত্যুর পরপরই তিনি ক্ষমতা দখল করেন। আর এর মাধ্যমে তিনি নিজ পরিবারের তিন দশকের শাসন দখলে রেখেছেন। চাদের ওই ঘটনার কয়েক মাস পর ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গিনিতে মামাদি দৌমবুয়ার নেতৃত্বে একদল সেনাসদস্য প্রেসিডেন্ট আলফা কনডেকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এর কিছুদিন আগেই প্রেসিডেন্ট আলফা কনডে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকতে সংবিধান সংশোধন করেছিলেন।

২০২১ সালের অক্টোবরে সুদানে জেনারেল আবদেল-ফাত্তাহ বুরহানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সরকারপ্রধান ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এর আগে ওমর ২৬ বছর দেশটি শাসন করেছেন। মালিতে ২০২০ সাল ও ২০২১ সালে দুই দফা সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। বুরকিনা ফাসোয় ২০২২ সালে এবং নাইজারে ২০২৩ সালে অভ্যুত্থান ঘটেছে।

বিশ্লেষকদের ভাষ্য, আফ্রিকার দেশগুলোয় এমন সহিংসতা, অভ্যুত্থান কিংবা অভ্যুত্থানচেষ্টা, দারিদ্র্য, আর্থসামাজিক বঞ্চনার মূল কারণ ব্যাপক হারে দুর্নীতি এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের ব্যর্থতা। ঘানাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আফ্রোব্যারোমিটার নেটওয়ার্কের একটি জরিপের তথ্য বলছে, আফ্রিকা মহাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার তুলনায় গণতন্ত্রকে বেশি পছন্দ করে। তবে তাদের দেশগুলোয় যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা চলে, সেই পদ্ধতি তাদের পছন্দ নয়।

আফ্রিকার দেশগুলোর এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মূলত ব্যাপক হারে দুর্নীতি। সমাজে দুর্নীতি গেড়ে বসলে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা ব্যাহত হয়। শাসনযন্ত্র যাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা ব্যর্থতার সুযোগে এমনটা হয়। এ কথা শুধু আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেত্রেই নয়, বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্যই এটি প্রযোজ্য।

সমাজকে যদি আমরা একটি পিরামিড কিংবা ত্রিভুজের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে তার একেবারে নিচের স্তরে থাকে সাধারণ মানুষ। পিরামিড কিংবা ত্রিভুজের এই অংশটিই সবচেয়ে বড়। শাসনযন্ত্রের যত ওপরে ওঠা হয়, পিরামিড বা ত্রিভুজ তত সরু হতে থাকে। একেবারে চূড়ায় থাকেন শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে পিরামিড বা ত্রিভুজের একেবারে নিচের বৃহৎ স্তরের সদস্যদের, অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা যেখানে নেই, সেখানেও সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে উচ্চ স্বরে ঘোষণা করা হয়। বলা হয় জনগণই ঠিক করবে রাষ্ট্রে কী ঘটবে। কিন্তু আদতে জনগণের হাতে কিছু থাকে না। তারা কেবল ভোটের দিন নিজের ভোটটা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর বেশি কিছু করতে পারে না। যে দেশগুলোয় ভোট কারচুপির বা ভোট জালিয়াতির অবাধ চর্চা রয়েছে, সেসব দেশে তো ভোটের দিনও জনগণ রাষ্ট্রের মালিক হতে পারে না। ভোট দিতে গিয়ে ভোটার দেখেন, তাঁর ভোটটি অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছেন।

কিংবা ভোটার ভোট দেন ঠিকই, কিন্তু ব্যালট বাক্স ভরে থাকে আগেই।

এমন ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশগুলোয়ই শাসনযন্ত্র কুক্ষিগত করতে, ক্ষমতা ধরে রাখতে শাসকেরা নানা কৌশল আঁটেন, হাঁটেন দমন-পীড়নের পথে। এই উপসর্গগুলো আফ্রিকার দেশগুলোর রয়েছে। সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহী কিংবা জঙ্গিগোষ্ঠী। দুর্বৃত্তগোষ্ঠীও সক্রিয় এসব দেশে। ফলে সাধারণ মানুষ একেবারেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রভাব সরাসরি জনগণের দৈনন্দিন জীবনে পড়ে। এ কারণে বেসামরিক সরকারের ওপর থেকে জনগণ আস্থা হারায়। সে সুযোগ নেন ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষী জেনারেল।

কিন্তু এমন হওয়া উচিত নয়। গণতান্ত্রিক চর্চায় শীর্ষে থাকা ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর গণতন্ত্রও কিন্তু শতভাগ ত্রুটিহীন নয়। তারপরও গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার চেষ্টা এসব দেশে রয়েছে। ইউরোপের কোনো কোনো দেশ তো কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টায় রয়েছে। তারা যদি পারে, তাহলে আফ্রিকা কিংবা এশিয়ার দেশগুলো কেন পারবে না? আমরা সবাই তো একই গ্রহের মানুষ। দুর্নীতি নামক এ রোগের চিকিৎসা অতীতে সাধারণ মানুষকেই করতে হয়েছে, আজ এবং আগামীতেও সাধারণ মানুষকেই করতে হবে।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

আব্দুর রহমান 
মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

একুশ শতকের শুরু থেকেই বৈশ্বিক রাজনীতির পট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ক্রমেই বহু মেরুকরণ বিশ্বের ধারণা জোরালো হওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য খর্ব হওয়া। এই পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াশিংটনের শেষ প্রকল্প হলো—তথাকথিত ‘নিজ আঙিনা’ কাবু করা। আর সেটাই যেন প্রতিফলিত হলো ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে।

দেশটির নীতিনির্ধারণী মহল বুঝতে পেরেছে, তারা এখন চীন ও রাশিয়াকে সরাসরি মোকাবিলা করে পারবে না। এ জন্য তারা বিকল্প হিসেবে পশ্চিম গোলার্ধ নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই পরিকল্পনা ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর দ্রুত এগিয়ে নিতে তৎপর। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে সামরিক তৎপরতা তারই ইঙ্গিত।

দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন নিজেকে বিশ্বের দায়িত্বশীল অভিভাবক বলে দাবি করলেও, সেই পুরোনো চরিত্র এবার ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে, তাদের এখনকার জাতীয় স্বার্থ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা এবং ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসের দিকে তাকালে বোঝা যাবে। নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল থেকে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আগের চেয়ে একধাপ কম ‘শান্তির প্রতিষ্ঠাতা’, তবে একধাপ বেশি ‘শক্তির স্থপতি’ হয়ে উঠছে।

এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম গোলার্ধ তথা পুরো আমেরিকা মহাদেশে ‘মার্কিন প্রাধান্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ করতে চাইছে। এটি করতে গিয়ে তারা মনরো মতবাদকে (Monroe Doctrine) পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছে। মনরো মতবাদ হলো, ‘১৮০০ সালের দিকের এক মার্কিন নীতি, যা আমেরিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপন ও হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করা হয়েছিল।’ এই নীতি অনুযায়ী, তারা এখন বিদেশি প্রভাব ঠেকানো ছাড়াও, মাদক ব্যবসা ও অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলা করার ওপর জোর দেবে এবং ‘বেসরকারীকরণ’কে উৎসাহিত করবে।

‘আমরা এই অঞ্চলের সরকার, রাজনৈতিক দল এবং আন্দোলনগুলোকে পুরস্কৃত এবং উৎসাহিত করব, যারা আমাদের নীতি ও কৌশলের সঙ্গে ব্যাপক অর্থে সংগতিপূর্ণ থাকবে।’ ট্রাম্প ইতিমধ্যেই লাতিন আমেরিকায় রক্ষণশীল রাজনীতিকদের প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এবং ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইয়ের অধীনে আর্জেন্টাইন অর্থনীতিকে ৪০ বিলিয়ন ডলার দিয়ে উদ্ধার করে এই কৌশল কার্যকর করতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র ‘এই-গোলার্ধের বাইরের প্রতিযোগীদের’ পশ্চিম গোলার্ধে ‘সামরিক বা অন্যান্য হুমকিমূলক সক্ষমতা স্থাপন করা কিংবা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদগুলো নিজেদের দখলে নেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অস্বীকার’ করবে। সোজা কথায়, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো শক্তিকেই প্রভাব বিস্তার করতে স্বাগত জানাবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সম্পদ পশ্চিম গোলার্ধের দিকে সরিয়ে আনা হবে। এ জন্য আমেরিকান জাতীয় সুরক্ষার কাছে যেসব রণাঙ্গনের আপেক্ষিক গুরুত্ব সাম্প্রতিক দশকগুলোতে কমে এসেছে, সে সবকে সরিয়ে আনা হবে। এই ধারাবাহিকতায় যেন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মনোযোগ কিছুটা কমিয়ে দিচ্ছে।

কারণ, মধ্যপ্রাচ্য এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশলগত অগ্রাধিকার নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের শক্তি উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ‘মধ্যপ্রাচ্যের ওপর মনোযোগ দেওয়ার আমেরিকার ঐতিহাসিক কারণ কমে আসবে।’ কারণ এই অঞ্চলে সংঘাত ও সহিংসতাও কমছে। যদিও বলা হয়েছে, ‘সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।’ এই অবস্থাতেও মার্কিন প্রশাসন এই অঞ্চলের জন্য সোনালি ভবিষ্যতের কল্পনা করছে। ওয়াশিংটনের স্বার্থে আধিপত্য বজায় রাখার পরিবর্তে, মধ্যপ্রাচ্য ‘ক্রমবর্ধমানভাবে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের উৎস এবং গন্তব্যে পরিণত হবে’, যার মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অন্তর্ভুক্ত। এটি এই অঞ্চলকে ‘অংশীদারত্ব, বন্ধুত্ব এবং বিনিয়োগের স্থান হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে’ বলে আখ্যা দিয়েছে।

বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্য সংকট ও সহিংসতায় জর্জরিত। গাজায় যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও প্রায় প্রতিদিনই ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সেটেলার ও সেনাদের মারাত্মক অভিযান বাড়ছে। ইসরায়েল লেবাননেও বিমান হামলা বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা দুর্বল হিজবুল্লাহকে বলপূর্বক নিরস্ত্র করতে দেশটির বিরুদ্ধে আরেকটি সর্বাত্মক হামলার ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সিরিয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারের পতনের এক বছর পরেও, ইসরায়েলের দক্ষিণে অধিকৃত গোলান মালভূমির বাইরে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করার জন্য অনুপ্রবেশ এবং হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলের ব্যাপারে মার্কিন অবস্থান আগের মতোই অপরিবর্তিত থাকবে। এই নথি স্বীকার করে যে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ এখনো রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ‘ইসরায়েল যেন সুরক্ষিত থাকে’ তা নিশ্চিত করা এবং জ্বালানি সরবরাহ ও শিপিং লেনগুলো রক্ষা করা।

ট্রাম্পের নতুন নিরাপত্তা কৌশলে বেইজিংয়ের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সামনে রাখা হয়নি। এই নথিতে এশিয়ায় অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় জেতা এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে চীনকে মোকাবিলায় ভারসাম্য তৈরির জন্য এশীয় মিত্রদের সঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেখানে ভারতকে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক মহাসাগরীয় অঞ্চল সুরক্ষায় আমাদের অবশ্যই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক (ও অন্যান্য) সম্পর্ক উন্নত করতে হবে।’ এর মধ্য দিয়ে একটি ইঙ্গিত স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র যদি দক্ষিণ এশিয়ায় কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চায় সেটি হলো ভারত। আর এ কারণে বাংলাদেশসহ অন্য দেশগুলোর সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘তাইওয়ান নিয়ে সংঘাত ঠেকানো’কে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করছে। আর এটি করতে তারা ‘আদর্শগতভাবে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার’ পক্ষে। এটি নিশ্চিত করতে এই অঞ্চলের মার্কিন অংশীদারদের সামরিক ব্যয় বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। একইভাবে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।

এ কৌশল অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায়। ওয়াশিংটন ‘ইউরোপকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে এবং এক সারিতে থাকা সার্বভৌম জাতিগুলোর একটি গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতে সক্ষম করাকে’ অগ্রাধিকার দেবে।

বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ ম্যার্ৎসও। তিনি বলেছেন, ইউরোপকে এখন নিজের নিরাপত্তা নীতি ও প্রতিরক্ষায় আরও আত্মনির্ভর হতে হবে; যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা রাখা চলবে না।

সব মিলিয়ে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিরাপত্তা কৌশলে ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ এবং ‘আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ’কে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এই নিরাপত্তা কৌশল দেশটিকে ইরাক-আফগানিস্তানের মতো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ থেকে বিরত রাখার পরিসর তৈরি করলেও, মাদক, অভিবাসন এবং অপরাধ ইস্যুতে সামরিক হস্তক্ষেপ চালানোর সম্ভাব্যতা খুলে রেখেছে। যার প্রথম শিকার হতে পারে ভেনেজুয়েলা।

লেখক: সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইমরান খান প্রতিরোধের প্রতীক

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার
ইমরানের জীবন মাঠের উচ্ছ্বাস এবং সাফল্যের উজ্জ্বলতা থেকে রাজনৈতিক নিপীড়নের করুণতম অধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত
ইমরানের জীবন মাঠের উচ্ছ্বাস এবং সাফল্যের উজ্জ্বলতা থেকে রাজনৈতিক নিপীড়নের করুণতম অধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত

ইমরান খানকে বোঝার জন্য তাঁকে শুধু একজন ক্রিকেটার বা রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখা যথেষ্ট নয়। তাঁর জীবন যেন একপ্রকার দ্বৈত পরিসর—একদিকে বলের তীব্র গতি, মাঠের উচ্ছ্বাস এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলো; অন্যদিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চের অস্থিরতা, ষড়যন্ত্র এবং ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ ইতিহাসের ছায়া। ১৯৫২ সালে লাহোরের সম্ভ্রান্ত পশতুন পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই মানুষটি নিজের প্রতিভা, দৃঢ়সংকল্প এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে ক্রীড়া জগতের যে উচ্চশিখর স্পর্শ করেছিলেন, তা চোখে পড়ার মতোই। কিন্তু শুধু মাঠের সীমাবদ্ধতায় তাঁকে বন্দী রাখা সম্ভব হয়নি। ক্রিকেটের পরিপূর্ণতা ছাড়িয়ে তিনি প্রবেশ করলেন রাজনীতির জটিল রাজপথে—যেখানে স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং সংকল্পের সঙ্গে মিশে থাকে গণমানুষের আশা। খেলাধুলায় অর্জিত বিজয়ী মনোভাব এবং সাফল্যের জ্যোতি তাঁকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি শুধু একজন নেতা নন; তিনি হলেন স্বপ্নদ্রষ্টা, সংস্কারক এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক—যিনি বিশ্বাস করতেন যে গণমানুষের শক্তিই সমাজের মূলচাকা। তাঁর জন্মভূমির ঐতিহ্য, শিক্ষা এবং সংগ্রামের প্রভাব তাঁকে এমন এক চরিত্রে গড়ে তুলেছিল, যেখানে খেলাধুলার তীক্ষ্ণ প্রতিযোগিতা এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের অস্থিরতাকে একসঙ্গে বহন করা সম্ভব হয়।

ইমরানের জীবন যেন এক জীবন্ত গল্প—মাঠের উচ্ছ্বাস এবং সাফল্যের উজ্জ্বলতা থেকে রাজনৈতিক নিপীড়নের করুণতম অধ্যায়। এই দ্বৈত পরিসরেই তিনি থাকলেন সংগ্রামের প্রতি অদম্য ধৈর্য ধারণ করে। ইমরান খানের ক্রীড়াজীবনের পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে। তিনি তখন ছিলেন এক যুবক, যাঁর প্রতিভা, উৎসাহ ও অদম্য মনোবল তাঁকে ক্রিকেট জগতের নতুন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। মাঠে তাঁর উপস্থিতি শুধু বল ও ব্যাটের কৌশলের সমষ্টি ছিল না; এটি ছিল নেতৃত্বের এক জীবন্ত উদাহরণ। ১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে বিজয় এনে দেওয়া তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত। সেই জয়ের মাধ্যমে ইমরান শুধু জাতীয় নায়ক হয়ে ওঠেননি, তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবেও অভিষিক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বের শৈলী, দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সামলানোর দক্ষতা সমকালীন ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে অমর হয়ে থাকবে। কিন্তু ক্রিকেটের উৎকর্ষই তাঁর জীবনের একমাত্র পরিমাপ নয়। খেলার পরিপূর্ণতা ছেড়ে তিনি মনোনিবেশ করেন মানবসেবায়। তাঁর মায়ের স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত শওকত খানুম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল শুধু চিকিৎসার কেন্দ্র নয়; এটি সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগের প্রতীক হয়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে মূলত সাধারণ মানুষের অনুদানের মাধ্যমে, আর এটি তাঁর সহানুভূতি, মানবিকতা এবং নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে গড়ে ওঠে।

ইমরানের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় যখন তিনি রাজনীতির জটিল পথে পা রাখেন। ১৯৯৬ সালে তিনি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে এটি ছিল রাজনৈতিক মঞ্চের এক প্রান্তিক দল, কিন্তু ২০১০-এর দশকে হঠাৎ করেই এটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দুর্নীতির বিরোধিতা, জাতীয় মর্যাদা এবং ইসলামি কল্যাণরাষ্ট্র—এই তিনটি মূল স্লোগান নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মানুষের মনে নতুন আশা, নতুন বিশ্বাস এবং ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দেন, তিনি ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়বেন। কিন্তু শাসনকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সামনে আসে চ্যালেঞ্জের একটি বিশাল পাহাড়—অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, ঋণ এবং সামরিক প্রতিষ্ঠানের চাপ। কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মোকাবিলা করা সহজ ছিল না। সেনা এবং ‘ডিপ স্টেট’-এর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে ওঠে অনিবার্য এবং এই দ্বন্দ্ব ক্রমে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাকে আরও জটিল করে তোলে।

২০২২ সাল থেকে শুরু হয় ইমরানের পতন। অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে অবনতি, একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তার এবং শেষ পর্যন্ত কারাগারে বন্দিত্ব—সবই একটি কঠোর রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। অনেকের কাছে মনে হয়, এসব ঘটনা শুধু আইনের প্রয়োগ নয়; বরং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এক সূক্ষ্ম কিন্তু গভীর প্রমাণ। এমন অবস্থায়, ইমরান খানের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। ইমরান খান একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনৈতিক নেতা হলেও তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল গভীর, বিশ্লেষণধর্মী ও মানবিক। তিনি শুধু ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তার পেছনে দৌড়াননি; বরং প্রতিটি বিষয়কে গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করতেন এবং আলোচনায় যুক্তি ও সংবেদনশীলতার সমন্বয় ঘটাতেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁকে সাধারণ রাজনীতিকের চেয়ে আলাদা করত—একজন মানুষ যিনি চিন্তা, অনুভূতি এবং নৈতিক দৃঢ়তার সঙ্গে রাজনীতির মঞ্চে দাঁড়াতে পারতেন। ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবনের এক অধ্যায়কে গভীর দ্বন্দ্ব ও বিরোধের গল্প বলা যায়। অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তনের চ্যালেঞ্জ, ভারতের সঙ্গে স্থায়ী শান্তির আকাঙ্ক্ষা, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান—সবকিছুর মাঝেও তিনি ক্রমেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই দ্বন্দ্ব ছিল শুধু রাজনৈতিক কৌশল বা ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি ছিল রাষ্ট্রের শাসনকাঠামোর সঙ্গে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও নৈতিক দৃঢ়তার সংঘর্ষ।

২০২৩ সালে তিনি কারাগারে বন্দী হন। তখন তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা বন্ধ, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন—সবকিছু এমনভাবে পরিচালিত হয়েছে যেন তিনি সম্পূর্ণ একাকী হয়ে পড়েছেন। এই কঠিন পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় বলা যেতে পারে।

ইমরানের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দেয় জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথা—যিনি সেনা ও ক্ষমতার শক্তিশালী ছায়ার ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার মূল্য দিতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইমরানও সেই ইতিহাসের ছায়ায়, সেই একই চক্রের শিকার হয়েছেন বলে মনে হয়। কিন্তু এখানেই এক গভীর পাঠ নিহিত—যে সাহস, ন্যায় ও বিশ্বাসের জন্য সংগ্রাম করা যায়, তা কখনো ম্লান হয় না। ইমরান খানের জীবন তাই শুধু রাজনৈতিক বিবরণ নয়; এটি আমাদের সবার জন্য এক সাহসের, নৈতিকতার এবং অনমনীয় বিশ্বাসের অমর শিক্ষা হতে পারে।

এটি আমাদের আগামী প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ নয়, তবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহসই চিরকাল গৌরবময়। ইমরানের জীবন তাই শুধুই ইতিহাস নয়; এটি সতর্কতা, প্রেরণা এবং অবিচল বিশ্বাসের এক অমর উদাহরণ।

লেখক: আইনজীবী ও গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্পর্ধা

সম্পাদকীয়
স্পর্ধা

বেগম রোকেয়া সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন যিনি, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। জগৎ-সংসার সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। তিনি যে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে একেবারেই শ্রদ্ধা করেন না, এবং নারীর মর্যাদা রক্ষা করার ব্যাপারে তাঁর অবস্থান যে ধোঁয়াশায় ঘেরা, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা পাওয়া মানুষেরা আজকাল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে, নারী মুক্তি নিয়ে যেভাবে কটাক্ষ করে চলেছেন, তাতে দেশের গতি উল্টো দিকে বহমান কি না, সে প্রশ্ন মনে জাগতে বাধ্য।

চেষ্টা হয়েছে আগেও, কিন্তু বিজয়ের মাসে এসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা যেন বেড়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে টকশোর মধ্যে এমন কাউকে কাউকে এমন কিছু কথা বলতে শোনা যাচ্ছে, যা আমাদের স্বাধীনতা-ভাবনাটিকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। কেন এইসব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রমাণহীন কটাক্ষ করা মানুষদের জায়গা করে দিচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার। স্বাধীনতা মানে স্ব অধীনতা, স্বাধীনতা মানে সত্য-মিথ্যা সবকিছু সেরদরে বলার স্বাধীনতা নয়—এ কথা যারা বুঝতে অক্ষম, তাদেরই আস্ফালন দেখা যাচ্ছে বেশি। এখনই সতর্ক না হলে এই ভণ্ড-প্রতারকের দল গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারে সয়লাব করে দিতে পারে দেশ।

কারও চাপিয়ে দেওয়া বয়ানে স্বাধীনতার ইতিহাস পূর্ণতা পাবে না। কিন্তু দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা নানা তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করেই স্বাধীনতার ইতিহাস লিখিত হবে। কে কোথায় কার নামে কটাক্ষ করল, আর সেটাই হয়ে উঠল স্বাধীনতার ইতিহাস—এ কথা যারা ভাবে, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যই। এমন একটি দেশ গড়ে উঠবে, যে দেশে শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না। নিজের হাতেই থাকবে নিজের নির্ভরতার চাবি। স্বাধীনতার পর সে আশা পূরণ হয়নি বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে পাকিস্তানের ২৩ বছরের দুর্গন্ধযুক্ত ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যারা এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসে পাকিস্তানি মনোভাব পোষণ করে, তাদের ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কী-ইবা করার আছে?

আর বেগম রোকেয়া? নারী মুক্তির বিপক্ষে যারা দাঁড়ায়, তারা এই মহীয়সী নারীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতেই থাকে। এটা আজকের ব্যাপার নয়। নারীকে যারা পুরুষের সম্পত্তি বলে মনে করে থাকে, তারা উদার দৃষ্টিতে মানুষের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে অপারগ। কথা বলার স্বাধীনতা থাকায় এরা মুক্তকচ্ছ শব্দাবলি উচ্চারণ করে যাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে, নারী মুক্তি প্রসঙ্গে কেউ যদি কটাক্ষ করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার।

এসব উদ্ভট প্রসঙ্গ তুলে এনে যারা নিজেদের লাইমলাইটে আনতে চায়, তাদের ব্যাপারে সরকারের ভাবনা কী, সেটা প্রকাশ করা জরুরি। কারণ, সরকার যদি এ ধরনের অন্যায্য, প্রতিক্রিয়াশীল আচরণের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে না দাঁড়ায়, তাহলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারি ভাষ্য জানা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত