Ajker Patrika

কুকুর লেজ নাড়ে, না লেজে কুকুর নাড়ায়

আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৫, ০৮: ৪৬
কুকুর লেজ নাড়ে, না লেজে কুকুর নাড়ায়

বিএনপির একসময়ের ডাকসাইটে নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর একটি বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তারেক রহমানের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে খালেদা জিয়া নীরব থাকার পরিপ্রেক্ষিতে সা কা চৌ বলেছিলেন, আগে কুকুর লেজ নাড়ত, এখন লেজ কুকুরকে নাড়ায়। এই বক্তব্যের জন্য তাঁকে দলের মধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। কারণ আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু দলের অভ্যন্তরে চলে স্বেচ্ছাতন্ত্র। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় না, এমনকি দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্তও গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে নেওয়া হয় না। দলীয় ফোরামে আলোচনা হলেও অনেক সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব দেওয়া হয় দলীয় প্রধানের ওপর। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে এটা শেখ হাসিনা, বিএনপির ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া। তবে একপর্যায়ে এসে বিএনপির মধ্যে দুজনের ওপর এটা বর্তেছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। সর্বশেষ যা অবস্থা তা থেকে এটা স্পষ্ট যে খালেদা জিয়া এখন অনেকটাই সাইডলাইনে। দলের মূল কান্ডারি তারেক রহমান, যিনি বহু বছর ধরে লন্ডনে আছেন, দল চলে তাঁর নির্দেশে, ভার্চুয়ালি।

দলীয় প্রধানের প্রশংসা করা, তোয়াজ-তোষামোদ করা যেখানে রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কুকুরের লেজ নাড়ানোর উপমা ব্যবহার করে কম হিম্মতের পরিচয় দেননি।

রাজনীতিতে কে কাকে নাড়ায় সেটা সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিএনপি দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল। অনেক দিন ধরে দলটি ক্ষমতার বাইরে আছে। দেশে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপিকে এত দিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হতো না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ চায়নি বিএনপি ক্ষমতায় ফিরুক। আওয়ামী লীগ তার ইচ্ছাপূরণ করেছে। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্রের, রাজনীতির। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহতভাবেই চালিয়ে গেছে। সফল হতে পারেনি। এই না-পারার জন্য বিএনপির কি কোনো দায় বা ভুলত্রুটি নেই বা ছিল না? বিএনপি কি জনবান্ধব নীতি নিয়ে মানুষের কাছে গেছে? বিএনপি কখন কার প্রভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা কে বলতে পারবে?

নানামুখী তৎপরতা, এর সঙ্গে ঐক্য, ওর সঙ্গে বিরোধ ইত্যাদি নাটকীয়তার পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি সামান্য কয়টি আসনে জয় পায়। এটা যে একটি সাজানো ফল তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি। বিএনপি কেন ওই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়েছিল? সংসদ সদস্য হিসেবে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কেন শপথ নিলেন না? তখন আসলে কে কাকে নেড়েছিল, সেটা হয়তো কোনো দিনই আর জানা যাবে না। আমাদের দেশের রাজনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কিছু বিষয় নিয়ে অতি চর্চা হয়, কিছু বিষয় ধামাচাপা দেওয়া হয়। যখন যেটায় যার সুবিধা।

রাজনীতি মানেই ক্ষমতা এবং ক্ষমতা মানেই নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করে? প্রকৃত ক্ষমতা কার হাতে—নেতৃত্বের, প্রশাসনের, না অদৃশ্য কোনো শক্তির? ‘কুকুর লেজ নাড়ে, না লেজে কুকুর নাড়ায়’—এই প্রবচনটি শুধু কথার কথা নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রকৃত বাস্তবতাকে তুলে ধরে। অনেক সময় দেখা যায়, যে দল বা ব্যক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে, তারাই কি আসলে নীতিনির্ধারণ করছে, নাকি অন্য কোনো শক্তি তাদের দিয়ে সিদ্ধান্ত করিয়ে নিচ্ছে? বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে এই প্রশ্নটি উঠেছে এবং প্রতিবারই রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে এটি নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী, কারণ তাদের ভোটের মাধ্যমেই সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ভোট দেওয়ার পর জনগণ কি আদৌ ক্ষমতার অংশীদার থাকে, নাকি তারা কেবল প্রতীকীভাবে ব্যবহৃত হয়? বাস্তবতা হলো, জনগণের ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত হয়ে যায়, যখন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচারব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তখন ক্ষমতার কাঠামো মূলত দুই স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়—একদিকে দৃশ্যমান সরকার, আরেক দিকে পর্দার অন্তরালের শক্তি। এই দ্বিতীয় শক্তিটি কখনো কখনো এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচিত সরকার নির্ভরশীল হয়ে পড়ে প্রশাসনের ওপর, কখনো কখনো বাহ্যিক কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক চাপে, আবার কখনো রাষ্ট্রযন্ত্রের নিজস্ব গতিশীলতার কারণে। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, বরং বাধ্য হয় বিভিন্ন সমীকরণের মধ্যে পড়ে নীতিনির্ধারণ করতে।

একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হলো প্রশাসন। সরকারি আমলাতন্ত্র যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীন থাকে, তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। কিন্তু যখন প্রশাসন স্বাধীনভাবে এমনভাবে পরিচালিত হয় যে রাজনৈতিক নেতৃত্বও তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন প্রশ্ন ওঠে, আসল ক্ষমতা কার হাতে? বাংলাদেশে বহুবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনই সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা প্রশাসনকে ব্যবহার করতে চায়, কিন্তু অনেক সময় প্রশাসনই উল্টো রাজনীতিকে ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখে। এ কারণেই দেখা যায়, নির্বাচিত সরকার থাকা সত্ত্বেও আমলাতন্ত্রের হাতে নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা চলে যায়। এই বাস্তবতায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে সরকার কি প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করছে, নাকি প্রশাসনই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে?

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটি রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তিশালী অংশ, যা সাধারণত সরকারের নির্দেশে চলে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, বাংলাদেশে বহুবার এই বাহিনী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহৃত হয়েছে, আবার কখনো কখনো তারা নিজেরাই রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কখনো দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো রাজনৈতিক দলের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে, আবার কখনো তারা এমনভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা রাজনৈতিক নেতাদেরও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি তখন আরও জটিল হয়ে ওঠে, যখন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় প্রতিটি দেশই কমবেশি বৈশ্বিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তবে প্রশ্ন হলো, এই সম্পর্ক কতটা সমানতালে চলে বা ভারসাম্যের মধ্যে থাকে? একটি দেশ কি নিজের স্বার্থে স্বাধীনভাবে নীতিনির্ধারণ করতে পারছে, নাকি তাকে আন্তর্জাতিক শক্তির ইশারায় চলতে হচ্ছে? বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এ প্রশ্ন বারবার উঠেছে। বিশেষ করে, বৈদেশিক কূটনীতি, ঋণনির্ভরতা, ভূ-রাজনৈতিক কৌশল এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের চাপ অনেক সময় এমন বাস্তবতা তৈরি করে, যেখানে সরকারের নীতিনির্ধারণের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে পড়ে। কখনো দেখা যায়, সরকারকে নির্দিষ্ট নীতির দিকে চালিত করা হচ্ছে, যেখানে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের চেয়ে বৈদেশিক স্বার্থ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ ধরনের বাস্তবতা যখন প্রকট হয়ে ওঠে, তখন বোঝা যায়, আসল ক্ষমতা কোথায় কেন্দ্রীভূত।

একটি রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা তখনই সুষমভাবে কাজ করে, যখন জনগণের মতামত, প্রশাসনের কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে একটি ভারসাম্য থাকে। কিন্তু যখন এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। তখন জনগণের ভোট কেবল আনুষ্ঠানিকতা হয়ে দাঁড়ায়, প্রশাসন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে এবং আন্তর্জাতিক চাপ সরকারের নীতিনির্ধারণের স্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলে। ফলে দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, বরং তাকে বাধ্য হয়ে চলতে হচ্ছে অন্য কোনো শক্তির ইশারায়। তখনই ‘কুকুর লেজ নাড়ে, না লেজে কুকুর নাড়ায়’ প্রবচনটি বাস্তব হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই প্রশ্নগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক। অন্তর্বর্তী সরকার কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, নাকি প্রশাসন বা অন্য কোনো গোষ্ঠী তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে? চোখে দেখা সত্য আর বিজ্ঞানভিত্তিক সত্য যে এক নয়, এটা তো ঠিক। তেমনি দেশের চলমান রাজনীতির যে চিত্র আমরা চোখে দেখছি, সেটাই সত্য নাকি ক্ষমতার আসল লড়াই চলছে অন্যত্র?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলে বোঝা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের বাস্তবতা অতটা সরল নয়, যতটা আমরা ভাবতে চাই। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি জনগণের ক্ষমতা, কিন্তু বাস্তবে জনগণের ক্ষমতা কতটা কার্যকর, তা নির্ভর করে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক বাঁক বদলের ঘটনা আছে। কোনো বদলই কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারেনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে যে পরিবর্তন আমরা দেখছি তা কোথায় গিয়ে স্থিত হবে তা বলার সময় এখনই নয়। ক্ষমতার কাঠামো ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক নেতৃত্বের আছে তো?

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

তানভীর ইমামের বাড়ি ভেবে গুলশানের একটি বাসায় মধ্যরাতে শতাধিক ব্যক্তির অনুপ্রবেশ, তছনছ

৬ জ্যান্ত হাতি নিয়ে রাশিয়ায় মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান, উচ্ছ্বসিত পুতিন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত