Ajker Patrika

শান্তির দূত: বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা

সৌরেন চক্রবর্ত্তী
শান্তির দূত: বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের এক-দশমাংশ আয়তনজুড়ে রয়েছে তিনটি জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা। এখানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ঐতিহ্য ও কৃষ্টির স্বকীয়তা বজায় রেখে দীর্ঘদিন ধরে বাঙালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বসবাস করছে। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পার্বত্য অঞ্চল দীর্ঘদিন পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত অবস্থায় ছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল উন্নয়নের গতিধারায় যুক্ত হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কুচক্রীদের হাতে বঙ্গবন্ধু স্বজনদের সঙ্গে শাহাদাত বরণের পর ওই অঞ্চলের বহুমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের কারণে সেখানকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এ অচলাবস্থা প্রায় দুযুগ স্থায়ী হয়। 

১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করে পার্বত্য অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সেখানকার মানুষদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এগিয়ে আসেন। ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে জাতীয় সংসদে সরকার দলীয় চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ১১ সদস্যবিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে খাগড়াছড়ির সার্কিট হাউসে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও সরকারের মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা অক্ষুণ্ন রেখে সংবিধানের আওতায় এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই উপজাতীয় জনগণের ন্যায়সংগত দাবি পূরণের সম্ভাব্য সর্বোত্তম সমাধান খুঁজতে উভয় পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছায়। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণে ও প্রচেষ্টায় জাতীয় কমিটি ও জেএসএসের মধ্যে অনুষ্ঠিত সপ্তম বৈঠকে চূড়ান্ত সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ, ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও জনসংহতি সমিতির পক্ষে জেএসএসের সভাপতি ও শান্তিবাহিনীর প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি নামেই বেশি পরিচিত। তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়াই দীর্ঘদিনে বিরাজমান সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান অর্জিত হয়। এটা সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি, বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফলে। এ ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত থেকে তা দেখার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। 

 ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অস্ত্রসমর্পণ করে। পর্যায়ক্রমে চার ধাপে অস্ত্রসমর্পণ করা হয়। সর্বশেষ দুদকছড়িতে শান্তিবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করে। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার স্মৃতি আজও মনে পড়ে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। একই বছরের ১৫ জুলাই এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। কল্পরঞ্জন চাকমাকে মন্ত্রী নিয়োগ করা হয় এবং সন্তু লারমাকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা) নিয়োগ করা হয়। পরে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে তিনজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে পার্বত্য এলাকার উন্নয়নের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে পার্বত্য এলাকার সার্বিক উন্নয়ন, বহুমুখী কল্যাণ ও সুষম উন্নয়নের যাবতীয় কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। 

 ২০০৯ সালের মার্চ মাসে সরকার আমাকে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন করে। সেখানে তিন বছরের বেশি কর্মকালে বাস্তবে এই অঞ্চলের সব নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন কত ত্বরান্বিত হয়েছে, তা দেখেছি। সেখানে লোকজ ও ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পাশাপাশি মূলধারার সাংস্কৃতিক চর্চা সমানভাবে প্রবহমান। মহাসমারোহে বৈসাবি উৎসবের পাশাপাশি পালিত হয় বাংলা নববর্ষ। একইভাবে মহা আনন্দে উদ্‌যাপিত হয় ঈদ উৎসব ও দুর্গা পূজা। সংস্কৃতির বিবর্তনের এসব নবরূপ আমাদের পার্বত্য সংস্কৃতিকে বিকশিত করছে বিভিন্নভাবে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য—কী চমৎকার! 

পার্বত্য শান্তিচুক্তি ও এর বাস্তবায়ন বিষয়ে পার্বত্যবাসীদের কারও কারও মধ্যে কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য যে, পার্বত্য চুক্তির কারণেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার এবং জাতিসত্তাগত স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে এই অঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ি ও বাঙালি নির্বিশেষে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ার সম্ভাবনা দিনে দিনে বিকশিত হচ্ছে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগ, বিচক্ষণ নেতৃত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা, তাঁর সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা, সফল সংলাপ ও শান্তি স্থাপনে উভয় পক্ষের সদিচ্ছার ফলেই জটিল এ সমস্যার সমাধানে এই ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়েছিল। দেশে-বিদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের এই উদ্যোগ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে কোনো তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ও শান্তি স্থাপনের স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তির দূত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মর্যাদাপূর্ণ বহু সম্মাননা লাভ করেন। 

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভ জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। 

সৌরেন চক্রবর্ত্তী: সাবেক সিনিয়র সচিব

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রশিক্ষণ ছাড়াই মাঠে ৪২৬ সহায়ক পুলিশ কর্মকর্তা

গ্রাহকের ২,৬৩৫ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৪৬ বিমা কোম্পানি

‘এই টাকা দিয়ে কী হয়, আমি এত চাপ নিচ্ছি, লাখ পাঁচেক দিতে বলো’, ওসির অডিও ফাঁস

মারধর করে ছাত্রলীগ কর্মীর পিঠে পাড়া দিয়ে অটোরিকশায় শহর ঘোরাল ছাত্রদল, সঙ্গে উচ্চ স্বরে গান

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়: তিন দফা দাবিতে সোমবার মাঠে নামছেন শিক্ষার্থীরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত