ফজলুল কবির
‘ইলিশের দরে আজো ডুবে যায় কত/ ঝাঁঝালো বিক্ষোভ, অশ্রু, দুঃখ পরাজয়’। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় ‘বিক্ষোভ’ শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ‘ঝাঁঝালো’ বিশেষণ দেখে কি একটু শঙ্কা জাগছে? মনে হচ্ছে বিক্ষোভ বুঝি কাঁদানে গ্যাসের মতো কোনো জিনিস, যার ঝাঁজে চোখে জ্বালা ধরে। বিক্ষোভ কি আসলেই তাই? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই মনে এল শ্রীলঙ্কা ও ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের কথা, যেখানে বিক্ষোভের আগুন জ্বলেছে। তাহলে বিক্ষোভ আর ঝাঁজালো হয়েই আর থাকছে না, এর সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে আগুনের সঙ্গ-প্রসঙ্গও।
শ্রীলঙ্কায় এই তো কিছুদিন আগে বিক্ষোভের আগুনে পুড়েছে দেশটির মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা, এমনকি দেশটির বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের আদি বাড়িও। দেশটিতে এখন যে সংকট, সেটি রাজনৈতিক নাকি অর্থনৈতিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে সেটি নির্ণয় করা দুষ্কর। অর্থনৈতিকভাবে শ্রীলঙ্কার অবস্থা এখন ভঙ্গুর, একই অবস্থায় আছে দেশটির রাজনীতিও। রাজাপক্ষে পরিবারকে অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাকাঠামো থেকে আংশিকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। শেষে এই বিদায় সামগ্রিক রূপ নেয় কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে শ্রীলঙ্কায় জ্বলে ওঠা আগুন এ অঞ্চল শুধু নয়, গোটা বিশ্বেরই কিছু দেশের ক্ষমতাসীনদের মনে ভয় ধরিয়েছে।
এ ভয় যে একেবারে অমূলক নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে একটি জেলার নাম বদলের জেরে জ্বলে ওঠা আগুনে। এ আগুনও কিন্তু জ্বালাল বিক্ষোভকারীরাই। জেলার নাম পরিবর্তন নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষের জেরে বিক্ষুব্ধ জনতা সম্প্রতি ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের পরিবহনমন্ত্রী পিনিপে বিশ্বরূপুর বাড়িতে আগুন দেয়। জানা গেছে, অন্ধ্র প্রদেশের কোনাসিমা জেলার নাম পরিবর্তন করে বি আর আম্বেদকর কোনাসিমা জেলা হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এর প্রতিবাদ জানায় কোনাসিমা সাধনা সমিতি। আর তা থেকেই বিক্ষোভের আগুনের সূত্রপাত। প্রথমে নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টায় পুলিশ (বা ক্ষমতা) বাধা দিয়ে লাঠিপেটা করে। এতেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং বিক্ষোভকারীরা প্রথমে মন্ত্রীর বাড়ি, পরে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়।
তার মানে বিক্ষোভের কর্তা থাকে, যে আগুন জ্বালাতে পারে। এই কর্তার কি বহুবচন হওয়াটাই আবশ্যক। এখনকার সংবাদপত্রগুলো খুললে অন্তত তা-ই মনে হয়। খবরের পাতায় বিক্ষোভ আর একার নয়। এ যেন বহুর কারবার, সমষ্টির কারবার।
তাই কী? তাহলে একটু জীবনানন্দের শরণ নেওয়া যাক। জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘সেদিন এ-ধরণীর’ কবিতায় বিক্ষোভ নয়, ক্ষোভ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেখানে তিনি যে শব্দযুগলে ক্ষোভ শব্দটিকে স্থাপন করেছেন, তা হলো—গর্ভিণীর ক্ষোভে। এই গর্ভিণী কিন্তু আবার ধরণি, মানে পৃথিবী নিজেই। পৃথিবী বা ধরণিকে যুক্ত করে বিক্ষোভ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় অতিপরিচিত কবিতায়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সে কবিতা আমাদের বেদনার গান হয়ে মনে গেঁথে আছে। হ্যাঁ, সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতায় আছে—জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা/ শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা। স্পষ্টই একটা রাগী ভাব আছে বিক্ষোভ শব্দের প্রয়োগের মধ্যে। একটা আর্তনাদও কি নেই?
ক্ষোভ বা বিক্ষোভের মর্মমূলে দাঁড়িয়ে থাকে এক বেদনাপুঞ্জ। এই বেদনার জমাট প্রকাশই বিক্ষোভ। বিক্ষোভের জন্ম তাই পীড়নে, হরণে ও অতি অবশ্যই ক্ষরণে। সে কথায় পরে আসা যাবে।
প্রতিদিন কাগজে বা অনলাইন পোর্টালে কত না ক্ষোভ-বিক্ষোভের খবর আসে। আসে বিক্ষোভ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিলের খবর। এই সবই কিন্তু সামষ্টিক একটা ব্যাপার। যেন জোট না বাঁধলে ঠিক বিক্ষোভ হয় না। বিক্ষোভ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাই কিছু রাগী মুখ, আরও ভালো করে বললে রাগী তরুণের মুখ সামনে আসে, যাদের চোখমুখে আগুন, আর কণ্ঠে জ্বালা ধরানো স্লোগান। কখনো কখনো তাদের হাতে মশালও থাকে। থাকতে পারে আরও অনেক কিছু।
কবিতায় তো বটেই, এমনকি সিনেমাতেও বিক্ষোভের প্রদর্শনমাত্রই রাগী ভাব। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘বিক্ষোভ’-এও তাই। সেখানেও বিক্ষোভ এক সংঘবদ্ধ ব্যাপার। অবশ্য অনিক চরিত্রে সালমান শাহ নায়ক হিসেবেই পর্দায় বড় জায়গা করে নেন। এটা স্বাভাবিকই। নায়ককে বিক্ষোভের আকর হিসেবে না দেখাতে পারলে আর নায়ক কেন? সে যাক, সে অন্য কথা। সিনেমাতেও বিক্ষোভের লক্ষ্য কিন্তু ক্ষমতা।
এই ক্ষমতা কার? আক্ষরিক অর্থ ধরলে তো ক্ষমা করার, সহ্য করার সামর্থ্য যার, তার। আর ক্ষমার সামর্থ্য তো তারই থাকে, যার শক্তি থাকে। হ্যাঁ, ক্ষমতার অর্থ শক্তিও বটে।
কার শক্তি থাকে? সোজা উত্তর সমাজে যে প্রভাবশালী, যার হাতে রাজদণ্ড থাকে। যার হাতে শাস্তি বা সাজা দেওয়ার অধিকার থাকে, তার হাতেই থাকে ক্ষমা করার ভারও। এ পুরোপুরি শক্তির কারবার। কিন্তু ক্ষমতার এমন সহজ সংজ্ঞা বেশ পুরোনো। এর বিবর্তন হয়েছে। সোজা বাংলায় ক্ষমতা বললে কী আসে মাথায়? দাপট। ক্ষমতা মানেই যেন দাপট। আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা বললে বোঝায় শাসকগোষ্ঠী। দেশের আইনকানুন, অর্থনীতি, আদালত, নিরাপত্তা বাহিনী যার বা যাদের আওতায় থাকে, তারাই তো ক্ষমতাসীন। সেই ক্ষমতা এবার সে গণতন্ত্রের নামে পাক, আর বন্দুক দেখিয়ে পাক, বা ছলচাতুরি করে পাক, এ যুগে শাসনই ক্ষমতার ধর্ম।
কিন্তু মূল অর্থে ক্ষমতা কিন্তু শাসিতেরও থাকে। আদি অর্থে ক্ষমতা তো সব মানুষের মধ্যেই আছে। ‘ক্ষম’ গুণ যার আছে, তারই ক্ষমতা আছে। কিন্তু এই ‘ক্ষমতা’ শব্দটিও বিবর্তন ও সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর বদলের মধ্য দিয়ে শুধু শাসকগোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়েছে। যেন শাসক নয়, এমন কারও ‘ক্ষমতা’ নেই। বর্তমান কাঠামোয় শাসকমাত্রেই কিন্তু এমন ভাবে। ফলে সে পীড়ন চালায়।
এই শক্তি বা ক্ষমতার তরফ থেকে যত পীড়ন বাড়ে, যত হরণ বাড়ে, ততই শক্তিহীনের মনের ও মগজের ক্ষরণ বাড়ে। আর এই হৃত হওয়ার বোধ ও ক্ষরণ একসময় জমতে জমতে পাহাড় হয়। ওই যে বলে না, ‘অক্ষম ক্রোধ’। হ্যাঁ, এই অক্ষম ক্রোধই মূল বস্তু। যদিও এর প্রায়োগিক অর্থ এখন অন্যরকম। এর অর্থ এখন দাঁড়িয়েছে যে ক্রোধ কোনো ফল আনতে পারে, নিষ্ফলা। এটি ভেঙে বললে দাঁড়ায়, অক্ষমের ক্রোধ। কিন্তু এই অক্ষমের ক্রোধ কি আসলেই তাই? শ্রীলঙ্কা বা ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে কিন্তু তেমনটি মনে হলো না। সেখানে ‘অক্ষম ক্রোধ’ মানে অ-ক্ষম ক্রোধই। অর্থাৎ, জনতার ক্রোধ আর ‘ক্ষম’ গুণকে অবলম্বন করতে পারল না। তারা আর ক্ষমা করল না। তারা দীর্ঘদিন ধরে অক্ষমের মতো ক্রোধ সংবরণ করে করে নাচার হয়ে গেছে। আর তাই নিজেদের মধ্যকার ‘ক্ষম’ গুণ হারিয়ে তারা আক্ষরিক অর্থেই ‘অক্ষম’ হয়ে গেছে। তারা তাই সেই গুটকয়কে হটাতে চায়, যারা ক্ষমতার মালিক হয়ে বসে আছে। তারা বদল চায়।
এই ‘অক্ষম’ হয়ে ওঠা কিন্তু একদিনে সম্ভব হয় না। দীর্ঘ পীড়ন, দীর্ঘ বঞ্ছনার বোধ না থাকলে মানুষ সহজে তার ক্ষম-গুণ হারায় না। যত দিন হারায় না, তত দিন অপশাসক বেশ আনন্দেই থাকে। ক্ষমা পেয়ে আসে, পেতেই থাকে।
সে যাক, কথা হচ্ছিল ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিয়ে, যা কি না, বরাবরই ক্ষমতাকেই লক্ষ্য করে। কথা হলো, ‘ক্ষম’ গুণ থেকে যে ক্ষমতার উৎপত্তি, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হবে কেন? হতেই পারে। কারণ, শক্তি বা সামর্থ্যের কেন্দ্রটি যখন তার মূল আদল, মূল ভিতটিই হারিয়ে ফেলে তখনই তো এসব কিছুর জন্ম হয়। ক্ষমতা যখন ‘ক্ষম’ গুণটিই হারায়, তখন তা তো আর ক্ষমতা (মূল অর্থে) থাকছে না। তখন তো সে সোজা বনে যায় শক্তি থেকে অপশক্তিতে, যে কি না, ক্ষমার বদলে সাজা দিতে তৎপর হয়। অর্থাৎ, ‘ভাত দেওয়ার নাম নাই, কিল দেওয়ার গোঁসাই’ বনে গেলেই ক্ষমতা আর ক্ষমতা থাকে না। তখনই জমতে শুরু করে ক্ষোভ। এ গেল আদি অর্থকে মাথায় রেখে। আর পরিবর্তিত কাঠামোয় শাসক অর্থে যে ক্ষমতা, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ না জন্মালে, জন্মাবে কী?
এই ক্ষোভ কী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন—চলন, ঝাঁকরানি, অসংযম, বিকার, আন্দোলন, সঞ্চালন, চিত্তচাঞ্চল্য, ব্যথা, পীড়া ইত্যাদি। তা এই যে চলন বা ঝাঁকরানি তা কিসের? মনের নিশ্চয়। কোনো একটা ঘটনায় মনটা একটা পাক হয়ে উঠল, একটা ধাক্কা লাগল। মৃদু নয় কিন্তু। একটু জোরেশোরে। ক্ষোভের অর্থ তো অসংযমও। তবে এ নিছক অসংযম নয়। এই সময়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের এত এত উদাহরণের পর এটা বলা চলে না যে, তরুণ ও তরুণীর মধ্যে চোখাচোখি হতেই তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলো। তাহলে বেশ একটা অনর্থ হবে। তাদের মধ্যে প্রণয় ঘটার আগেই বিরহ হাজির হবে দৃশ্যপটে।
আবার সঞ্চালনকে প্রামাণ্য মেনে যদি বলা হয়, রক্ত ক্ষোভতন্ত্র, তাহলে কিন্তু রক্ত সঞ্চালনতন্ত্রকে ঠিক বোঝা যাবে না। তবে ক্ষোভের সঙ্গে এমনকি এই সময়েও রক্ত, মগজ ও মনের দুলুনি ও তার সঞ্চালনের বিষয়টি জড়িয়ে আছে।
আর বিক্ষোভ কী? বলা হচ্ছে বিক্ষুব্ধের প্রকাশই বিক্ষোভ। তাহলে বিক্ষুব্ধ কে? যার মধ্যে ক্ষোভ আছে। আমি নই, হরিচরণ বলছেন—সঞ্চলিত ও সংঘটিত অশান্তি ও আকুলতাই হলো বিক্ষুব্ধের বৈশিষ্ট্য।
তাহলে কী দাঁড়াল? ‘ক্ষম’ গুণ হারিয়ে পীড়নে অভ্যস্ত হওয়া অপশাসনের কেন্দ্রে থাকা ক্ষমতা জনতার মধ্যে ব্যথা বা পীড়া বা পীড়নের বোধের জন্ম দেয়, তখন ক্ষোভের জন্ম হয়, যা চিত্তে চাঞ্চল্য তৈরি করে। এটি একধরনের তাড়নার জন্ম দেয়, যা সঞ্চালিত হতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে ব্যক্তির বিকার ও অসংযম অন্যের মধ্যে কাঁপন বা আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে। আর তেমনটি হলেই বিক্ষুব্ধের একটা জোট বা সমষ্টি তৈরি হয় অনায়াসে। আর এটি যত অনায়াস হয়, ততই আয়াস নষ্ট হয় ক্ষমতার। শ্রীলঙ্কায় বা ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে কিন্তু তাই হয়েছে, তবে একটু চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই দুই জায়গাতেই ‘ক্ষম’ গুণ ধারণ করে চুপ করে থাকারা আওয়াজ তুলেছেন। আর তাতেই ক্ষমতার আপাত কুসুমশয্যা রূপ নিয়েছে কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
‘ইলিশের দরে আজো ডুবে যায় কত/ ঝাঁঝালো বিক্ষোভ, অশ্রু, দুঃখ পরাজয়’। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় ‘বিক্ষোভ’ শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ‘ঝাঁঝালো’ বিশেষণ দেখে কি একটু শঙ্কা জাগছে? মনে হচ্ছে বিক্ষোভ বুঝি কাঁদানে গ্যাসের মতো কোনো জিনিস, যার ঝাঁজে চোখে জ্বালা ধরে। বিক্ষোভ কি আসলেই তাই? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই মনে এল শ্রীলঙ্কা ও ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের কথা, যেখানে বিক্ষোভের আগুন জ্বলেছে। তাহলে বিক্ষোভ আর ঝাঁজালো হয়েই আর থাকছে না, এর সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে আগুনের সঙ্গ-প্রসঙ্গও।
শ্রীলঙ্কায় এই তো কিছুদিন আগে বিক্ষোভের আগুনে পুড়েছে দেশটির মন্ত্রী, আইনপ্রণেতা, এমনকি দেশটির বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের আদি বাড়িও। দেশটিতে এখন যে সংকট, সেটি রাজনৈতিক নাকি অর্থনৈতিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে সেটি নির্ণয় করা দুষ্কর। অর্থনৈতিকভাবে শ্রীলঙ্কার অবস্থা এখন ভঙ্গুর, একই অবস্থায় আছে দেশটির রাজনীতিও। রাজাপক্ষে পরিবারকে অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে ক্ষমতাকাঠামো থেকে আংশিকভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। শেষে এই বিদায় সামগ্রিক রূপ নেয় কি না, সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে শ্রীলঙ্কায় জ্বলে ওঠা আগুন এ অঞ্চল শুধু নয়, গোটা বিশ্বেরই কিছু দেশের ক্ষমতাসীনদের মনে ভয় ধরিয়েছে।
এ ভয় যে একেবারে অমূলক নয়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে একটি জেলার নাম বদলের জেরে জ্বলে ওঠা আগুনে। এ আগুনও কিন্তু জ্বালাল বিক্ষোভকারীরাই। জেলার নাম পরিবর্তন নিয়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষের জেরে বিক্ষুব্ধ জনতা সম্প্রতি ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের পরিবহনমন্ত্রী পিনিপে বিশ্বরূপুর বাড়িতে আগুন দেয়। জানা গেছে, অন্ধ্র প্রদেশের কোনাসিমা জেলার নাম পরিবর্তন করে বি আর আম্বেদকর কোনাসিমা জেলা হিসেবে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু এর প্রতিবাদ জানায় কোনাসিমা সাধনা সমিতি। আর তা থেকেই বিক্ষোভের আগুনের সূত্রপাত। প্রথমে নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা করে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার চেষ্টায় পুলিশ (বা ক্ষমতা) বাধা দিয়ে লাঠিপেটা করে। এতেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং বিক্ষোভকারীরা প্রথমে মন্ত্রীর বাড়ি, পরে পুলিশের গাড়িতে আগুন দেয়।
তার মানে বিক্ষোভের কর্তা থাকে, যে আগুন জ্বালাতে পারে। এই কর্তার কি বহুবচন হওয়াটাই আবশ্যক। এখনকার সংবাদপত্রগুলো খুললে অন্তত তা-ই মনে হয়। খবরের পাতায় বিক্ষোভ আর একার নয়। এ যেন বহুর কারবার, সমষ্টির কারবার।
তাই কী? তাহলে একটু জীবনানন্দের শরণ নেওয়া যাক। জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘সেদিন এ-ধরণীর’ কবিতায় বিক্ষোভ নয়, ক্ষোভ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেখানে তিনি যে শব্দযুগলে ক্ষোভ শব্দটিকে স্থাপন করেছেন, তা হলো—গর্ভিণীর ক্ষোভে। এই গর্ভিণী কিন্তু আবার ধরণি, মানে পৃথিবী নিজেই। পৃথিবী বা ধরণিকে যুক্ত করে বিক্ষোভ শব্দের ব্যবহার দেখা যায় অতিপরিচিত কবিতায়। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সে কবিতা আমাদের বেদনার গান হয়ে মনে গেঁথে আছে। হ্যাঁ, সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতায় আছে—জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা/ শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা। স্পষ্টই একটা রাগী ভাব আছে বিক্ষোভ শব্দের প্রয়োগের মধ্যে। একটা আর্তনাদও কি নেই?
ক্ষোভ বা বিক্ষোভের মর্মমূলে দাঁড়িয়ে থাকে এক বেদনাপুঞ্জ। এই বেদনার জমাট প্রকাশই বিক্ষোভ। বিক্ষোভের জন্ম তাই পীড়নে, হরণে ও অতি অবশ্যই ক্ষরণে। সে কথায় পরে আসা যাবে।
প্রতিদিন কাগজে বা অনলাইন পোর্টালে কত না ক্ষোভ-বিক্ষোভের খবর আসে। আসে বিক্ষোভ সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিলের খবর। এই সবই কিন্তু সামষ্টিক একটা ব্যাপার। যেন জোট না বাঁধলে ঠিক বিক্ষোভ হয় না। বিক্ষোভ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাই কিছু রাগী মুখ, আরও ভালো করে বললে রাগী তরুণের মুখ সামনে আসে, যাদের চোখমুখে আগুন, আর কণ্ঠে জ্বালা ধরানো স্লোগান। কখনো কখনো তাদের হাতে মশালও থাকে। থাকতে পারে আরও অনেক কিছু।
কবিতায় তো বটেই, এমনকি সিনেমাতেও বিক্ষোভের প্রদর্শনমাত্রই রাগী ভাব। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘বিক্ষোভ’-এও তাই। সেখানেও বিক্ষোভ এক সংঘবদ্ধ ব্যাপার। অবশ্য অনিক চরিত্রে সালমান শাহ নায়ক হিসেবেই পর্দায় বড় জায়গা করে নেন। এটা স্বাভাবিকই। নায়ককে বিক্ষোভের আকর হিসেবে না দেখাতে পারলে আর নায়ক কেন? সে যাক, সে অন্য কথা। সিনেমাতেও বিক্ষোভের লক্ষ্য কিন্তু ক্ষমতা।
এই ক্ষমতা কার? আক্ষরিক অর্থ ধরলে তো ক্ষমা করার, সহ্য করার সামর্থ্য যার, তার। আর ক্ষমার সামর্থ্য তো তারই থাকে, যার শক্তি থাকে। হ্যাঁ, ক্ষমতার অর্থ শক্তিও বটে।
কার শক্তি থাকে? সোজা উত্তর সমাজে যে প্রভাবশালী, যার হাতে রাজদণ্ড থাকে। যার হাতে শাস্তি বা সাজা দেওয়ার অধিকার থাকে, তার হাতেই থাকে ক্ষমা করার ভারও। এ পুরোপুরি শক্তির কারবার। কিন্তু ক্ষমতার এমন সহজ সংজ্ঞা বেশ পুরোনো। এর বিবর্তন হয়েছে। সোজা বাংলায় ক্ষমতা বললে কী আসে মাথায়? দাপট। ক্ষমতা মানেই যেন দাপট। আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা বললে বোঝায় শাসকগোষ্ঠী। দেশের আইনকানুন, অর্থনীতি, আদালত, নিরাপত্তা বাহিনী যার বা যাদের আওতায় থাকে, তারাই তো ক্ষমতাসীন। সেই ক্ষমতা এবার সে গণতন্ত্রের নামে পাক, আর বন্দুক দেখিয়ে পাক, বা ছলচাতুরি করে পাক, এ যুগে শাসনই ক্ষমতার ধর্ম।
কিন্তু মূল অর্থে ক্ষমতা কিন্তু শাসিতেরও থাকে। আদি অর্থে ক্ষমতা তো সব মানুষের মধ্যেই আছে। ‘ক্ষম’ গুণ যার আছে, তারই ক্ষমতা আছে। কিন্তু এই ‘ক্ষমতা’ শব্দটিও বিবর্তন ও সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোর বদলের মধ্য দিয়ে শুধু শাসকগোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়েছে। যেন শাসক নয়, এমন কারও ‘ক্ষমতা’ নেই। বর্তমান কাঠামোয় শাসকমাত্রেই কিন্তু এমন ভাবে। ফলে সে পীড়ন চালায়।
এই শক্তি বা ক্ষমতার তরফ থেকে যত পীড়ন বাড়ে, যত হরণ বাড়ে, ততই শক্তিহীনের মনের ও মগজের ক্ষরণ বাড়ে। আর এই হৃত হওয়ার বোধ ও ক্ষরণ একসময় জমতে জমতে পাহাড় হয়। ওই যে বলে না, ‘অক্ষম ক্রোধ’। হ্যাঁ, এই অক্ষম ক্রোধই মূল বস্তু। যদিও এর প্রায়োগিক অর্থ এখন অন্যরকম। এর অর্থ এখন দাঁড়িয়েছে যে ক্রোধ কোনো ফল আনতে পারে, নিষ্ফলা। এটি ভেঙে বললে দাঁড়ায়, অক্ষমের ক্রোধ। কিন্তু এই অক্ষমের ক্রোধ কি আসলেই তাই? শ্রীলঙ্কা বা ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে কিন্তু তেমনটি মনে হলো না। সেখানে ‘অক্ষম ক্রোধ’ মানে অ-ক্ষম ক্রোধই। অর্থাৎ, জনতার ক্রোধ আর ‘ক্ষম’ গুণকে অবলম্বন করতে পারল না। তারা আর ক্ষমা করল না। তারা দীর্ঘদিন ধরে অক্ষমের মতো ক্রোধ সংবরণ করে করে নাচার হয়ে গেছে। আর তাই নিজেদের মধ্যকার ‘ক্ষম’ গুণ হারিয়ে তারা আক্ষরিক অর্থেই ‘অক্ষম’ হয়ে গেছে। তারা তাই সেই গুটকয়কে হটাতে চায়, যারা ক্ষমতার মালিক হয়ে বসে আছে। তারা বদল চায়।
এই ‘অক্ষম’ হয়ে ওঠা কিন্তু একদিনে সম্ভব হয় না। দীর্ঘ পীড়ন, দীর্ঘ বঞ্ছনার বোধ না থাকলে মানুষ সহজে তার ক্ষম-গুণ হারায় না। যত দিন হারায় না, তত দিন অপশাসক বেশ আনন্দেই থাকে। ক্ষমা পেয়ে আসে, পেতেই থাকে।
সে যাক, কথা হচ্ছিল ক্ষোভ-বিক্ষোভ নিয়ে, যা কি না, বরাবরই ক্ষমতাকেই লক্ষ্য করে। কথা হলো, ‘ক্ষম’ গুণ থেকে যে ক্ষমতার উৎপত্তি, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হবে কেন? হতেই পারে। কারণ, শক্তি বা সামর্থ্যের কেন্দ্রটি যখন তার মূল আদল, মূল ভিতটিই হারিয়ে ফেলে তখনই তো এসব কিছুর জন্ম হয়। ক্ষমতা যখন ‘ক্ষম’ গুণটিই হারায়, তখন তা তো আর ক্ষমতা (মূল অর্থে) থাকছে না। তখন তো সে সোজা বনে যায় শক্তি থেকে অপশক্তিতে, যে কি না, ক্ষমার বদলে সাজা দিতে তৎপর হয়। অর্থাৎ, ‘ভাত দেওয়ার নাম নাই, কিল দেওয়ার গোঁসাই’ বনে গেলেই ক্ষমতা আর ক্ষমতা থাকে না। তখনই জমতে শুরু করে ক্ষোভ। এ গেল আদি অর্থকে মাথায় রেখে। আর পরিবর্তিত কাঠামোয় শাসক অর্থে যে ক্ষমতা, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ না জন্মালে, জন্মাবে কী?
এই ক্ষোভ কী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন—চলন, ঝাঁকরানি, অসংযম, বিকার, আন্দোলন, সঞ্চালন, চিত্তচাঞ্চল্য, ব্যথা, পীড়া ইত্যাদি। তা এই যে চলন বা ঝাঁকরানি তা কিসের? মনের নিশ্চয়। কোনো একটা ঘটনায় মনটা একটা পাক হয়ে উঠল, একটা ধাক্কা লাগল। মৃদু নয় কিন্তু। একটু জোরেশোরে। ক্ষোভের অর্থ তো অসংযমও। তবে এ নিছক অসংযম নয়। এই সময়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের এত এত উদাহরণের পর এটা বলা চলে না যে, তরুণ ও তরুণীর মধ্যে চোখাচোখি হতেই তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলো। তাহলে বেশ একটা অনর্থ হবে। তাদের মধ্যে প্রণয় ঘটার আগেই বিরহ হাজির হবে দৃশ্যপটে।
আবার সঞ্চালনকে প্রামাণ্য মেনে যদি বলা হয়, রক্ত ক্ষোভতন্ত্র, তাহলে কিন্তু রক্ত সঞ্চালনতন্ত্রকে ঠিক বোঝা যাবে না। তবে ক্ষোভের সঙ্গে এমনকি এই সময়েও রক্ত, মগজ ও মনের দুলুনি ও তার সঞ্চালনের বিষয়টি জড়িয়ে আছে।
আর বিক্ষোভ কী? বলা হচ্ছে বিক্ষুব্ধের প্রকাশই বিক্ষোভ। তাহলে বিক্ষুব্ধ কে? যার মধ্যে ক্ষোভ আছে। আমি নই, হরিচরণ বলছেন—সঞ্চলিত ও সংঘটিত অশান্তি ও আকুলতাই হলো বিক্ষুব্ধের বৈশিষ্ট্য।
তাহলে কী দাঁড়াল? ‘ক্ষম’ গুণ হারিয়ে পীড়নে অভ্যস্ত হওয়া অপশাসনের কেন্দ্রে থাকা ক্ষমতা জনতার মধ্যে ব্যথা বা পীড়া বা পীড়নের বোধের জন্ম দেয়, তখন ক্ষোভের জন্ম হয়, যা চিত্তে চাঞ্চল্য তৈরি করে। এটি একধরনের তাড়নার জন্ম দেয়, যা সঞ্চালিত হতে পারে। আর সে ক্ষেত্রে ব্যক্তির বিকার ও অসংযম অন্যের মধ্যে কাঁপন বা আন্দোলনের সৃষ্টি করতে পারে। আর তেমনটি হলেই বিক্ষুব্ধের একটা জোট বা সমষ্টি তৈরি হয় অনায়াসে। আর এটি যত অনায়াস হয়, ততই আয়াস নষ্ট হয় ক্ষমতার। শ্রীলঙ্কায় বা ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে কিন্তু তাই হয়েছে, তবে একটু চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই দুই জায়গাতেই ‘ক্ষম’ গুণ ধারণ করে চুপ করে থাকারা আওয়াজ তুলেছেন। আর তাতেই ক্ষমতার আপাত কুসুমশয্যা রূপ নিয়েছে কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর জনগণের প্রত্যাশা যেমন বাড়ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও গভীর পর্যবেক্ষণ রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে যে, এই সরকার প্রতিশ্রুত সংস্কার বাস্তবায়নে ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছে। ৩১ জ
৩ মিনিট আগেবাঙালি মুসলমানের মনে একটা অদ্ভুত ধারণা ভিত্তি পেয়েছে। তাদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ব্রিটিশ যুগে এসেই মুসলমানরা বঞ্চিত হয়েছে। তুর্কি-মোগলদের শাসনামলে বাঙালি মুসলমানরা ধনে-মানে-শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে এগিয়ে ছিল। ব্রিটিশরা এসে তাদের সেই অবস্থা থেকে টেনে নামিয়েছে। আর তারই সুযোগ নিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়।
১ দিন আগেবর্তমানকালের পরিপ্রেক্ষিতে নয়া ইতিহাস তৈরির বাহানা নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি। বর্তমানে যেভাবে কোনো কোনো মহল থেকে নিজের পছন্দমতো ইতিহাসের ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কখনো কখনো তা অতি হাস্যকর হলেও ডিজিটাল যুগে সেই প্রচারণায় অনেকেই মজে যায়। তা বিশ্বাস করে নেয়। মানুষ যাচাই করে দেখে না, এই প্রচ
১ দিন আগেঅধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নতুন দল গঠন প্রসঙ্গে বলেন, ‘তরুণেরা সত্যিই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের খারাপ কোনো কিছুর সঙ্গে সংস্পর্শ নেই বা নিজেদের রাজনৈতিক আখের গোছানোর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা নেই। তারা এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দল গঠন করছে বা রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দরকার। কারণ, রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে
১ দিন আগে