Ajker Patrika

শিক্ষার গতি ও গন্তব্য

মাসুদ উর রহমান
শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিশুদের জ্ঞান, মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার বিকাশ। ছবি: আজকের পত্রিকা
শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিশুদের জ্ঞান, মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার বিকাশ। ছবি: আজকের পত্রিকা

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা আজ এক গভীর সংকটে নিপতিত, যেখানে শিক্ষাবৈষম্য কেবল আর্থিক সামর্থ্যের নয়, বরং সামাজিক শ্রেণি, অবস্থান ও সংস্কৃতি দ্বারা পরিচালিত একটি গভীর রূপ ধারণ করেছে। যে শিক্ষা একসময় একটি সমতার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হতো, তা এখন একশ্রেণির মানুষের জন্য দুর্লভ ও ব্যয়বহুল পণ্য হয়ে উঠেছে। শিক্ষা আজ আর মানবিক উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি নয়, বরং হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক অবস্থান ধরে রাখার একটি উপকরণ, যেখানে প্রতিযোগিতার প্রাথমিক স্তরেই পিছিয়ে পড়ছে দেশের একটি বিশাল অংশ।

সরকারি নীতিমালায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবচিত্রে তা আদৌ প্রতিফলিত হয় না। শহরাঞ্চলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা যতই থাকুক না কেন, অভিভাবকদের বড় একটি অংশ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি—তাদের সন্তানদের সেখানে পাঠাতে আগ্রহী নয়। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করে শিক্ষা পরিবেশের দুর্বলতা, শিক্ষক-সংকট, অবকাঠামোর অভাব, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ না জন্মানো এবং নিরাপত্তাহীনতা। এর বিপরীতে তারা ছুটছে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের দিকে, যেখানে শিক্ষার মানের চেয়ে কখনো কখনো প্রতিষ্ঠানের নাম ও আড়ম্বর বেশি গুরুত্ব পায়।

শহর ছাড়িয়ে গ্রামীণ জনপদেও একই ধারা এখন প্রসারিত হয়েছে। কোনো একসময় গ্রামের একমাত্র শিক্ষালয় ছিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, সেখানেও গড়ে উঠছে ‘মডার্ন’, ‘ইন্টেলিজেন্ট’, ‘স্টার’জাতীয় নামধারী কিন্ডারগার্টেন, যেগুলো কার্যত একটি ব্যবসা মডেলের আওতায় চলে। এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকেরা অধিকাংশ পেশাদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন, অনেকের উচ্চমাধ্যমিক পাসের নিচে শিক্ষাগত যোগ্যতাও থাকে। তা সত্ত্বেও অভিভাবকেরা সন্তানদের সেখানে ভর্তি করাচ্ছেন শুধু তথাকথিত ‘ভালো ইংরেজি শেখা’ বা ‘ভালো রেজাল্টের’ আশায়।

তথ্যসূত্র হিসেবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই নিম্নবিত্ত বা হতদরিদ্র শ্রেণির। এসব পরিবার অনেক সময় সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর আগে চিন্তা করে—বই, ইউনিফর্ম, জুতা, স্কুলব্যাগ ইত্যাদির খরচ কীভাবে সামলাবে। যদিও সরকার বিনা মূল্যে বই বিতরণ করে, তারপরও আনুষঙ্গিক খরচ এবং শিক্ষার গুণগত ঘাটতি তাদের কাছে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এর বিপরীতে মধ্যবিত্ত পরিবারের চিত্র একরকম করুণ দ্বিধায় ভরা। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়ানোর প্রবল ইচ্ছা থাকলেও মাসিক ফি, বই কেনা, অতিরিক্ত কোচিং ক্লাসের খরচ ইত্যাদি মেটাতে গিয়ে তারা প্রায়ই আর্থিক সংকটে পড়ে। কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত হয়, কেউ আবার পরিবারের অন্য প্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দেয় শুধু সন্তানের শিক্ষা রক্ষায়। এই অর্থনৈতিক চাপ তাদের ওপর একধরনের মানসিক অস্থিরতা এবং সামাজিক প্রতিযোগিতার বোঝা চাপিয়ে দেয়।

এই পরিস্থিতি শিক্ষাব্যবস্থায় দুটি ভিন্ন গতি ও গন্তব্য তৈরি করছে। একদিকে গড়ে উঠছে সুবিধাভোগী শ্রেণির জন্য একধরনের তথাকথিত মানসম্মত শিক্ষা, যেখানে তারা প্রযুক্তিনির্ভর, ইংরেজিমুখী এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিক সিস্টেমে বেড়ে উঠছে। অপর দিকে দরিদ্র শিশুদের এক বিশাল অংশ বড় হচ্ছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, পাঠ্যবস্তু বোঝার উপযুক্ত পরিবেশ এবং সহায়ক শিক্ষকতার বাইরে থেকে। ফলত শিক্ষা হয়ে উঠছে একটি অসম প্রতিযোগিতা, যার ফলাফল অগ্রিম নির্ধারিত।

শিক্ষা গবেষকেরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন যে প্রাথমিক শিক্ষায় সমতা নিশ্চিত না হলে জাতীয় উন্নয়ন হবে অসম, বিকেন্দ্রিক ও টেকসইহীন। শুধু অবকাঠামো বা বই বিতরণ নয়, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিশুদের জ্ঞান, মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতার বিকাশ। সে লক্ষ্য পূরণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে পুনর্গঠন করতে হবে। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে, শিক্ষা উপকরণ যুগোপযোগী করতে হবে এবং শিশুদের শেখার আগ্রহ তৈরির জন্য আবহ তৈরি করতে হবে।

সর্বোপরি, শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি অলাভজনক সামাজিক কাঠামোতে রূপ দিতে হবে। বর্তমানে যেভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলেছে, তা বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা হবে না কোনো ব্যবসা, বরং হবে একটি রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার কেবল বক্তৃতায় নয়, বাস্তব পদক্ষেপে প্রতিফলিত হতে হবে।

বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে একটি উন্নত ও মানবিক সমাজ গঠনের পথে এগোতে চায়, তবে প্রাথমিক শিক্ষার এই বৈষম্য ঘোচানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এখনই সময় শিক্ষাব্যবস্থায় মৌলিক সংস্কার আনার, অন্যথায় বৈষম্যের এই ভিত্তি ভবিষ্যতের জাতিকে ভেঙে দেবে বহু খণ্ডে।

শিক্ষা যখন পণ্যে পরিণত হয়, তখন তা আর গণমুখী থাকে না। শিশুদের মুখস্থবিদ্যা, কোচিং-নির্ভরতা এবং পরীক্ষার চাপের মধ্যে ফেলে আমরা প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।

কোথায় প্রয়োজন সংস্কার

১. সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন ও শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শুধু ভবন নয়, পাঠদানের গুণগত মান উন্নয়নই হবে মূল লক্ষ্য।

২. সরকারি, বেসরকারি ও মাদ্রাসা শিক্ষার বিভাজন তুলে দিয়ে একটি সমন্বিত, বৈজ্ঞানিক, মানবিক ও যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম চালু করা দরকার, যাতে সবাই সমান ভিত্তি থেকে শুরু করতে পারে।

৩. প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যবসায়িক মুনাফা নিষিদ্ধ করা উচিত। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইলে চলুক, তবে তাদের ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ ও নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দিতে হবে।

৪. পরীক্ষার চাপ কমিয়ে সৃজনশীল ও খেলাধুলাভিত্তিক পাঠদান জোরদার করতে হবে, যাতে শিশুদের মধ্যে কৌতূহল, যুক্তিবোধ ও নৈতিকতা গড়ে ওঠে।

৫. গ্রামীণ ও অনগ্রসর অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোকে বিশেষ সহায়তা দিতে হবে, যাতে তারা শহরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে।

বাংলাদেশ যদি সত্যিকারের উন্নত দেশ হতে চায়, তবে শিক্ষা খাতে বৈষম্য দূরীকরণ এবং প্রাথমিক শিক্ষার সংস্কারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার বিভাজনমূলক ব্যবস্থায় সন্তানদের নয়, ভবিষ্যতের সমাজই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখনই সময় শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি বন্ধ করে সদিচ্ছার সঙ্গে প্রশাসনিক উদ্যোগে সত্যিকারের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এক ভিসায় ছয় দেশ

এর জবাব দেশে দিইনি, জাপানে দিলে বিপদ হবে: পদত্যাগ প্রশ্নে ড. ইউনূস

চারটি গুলির পর নিরস্ত্র মেজর সিনহার গলায় পাড়া দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়: অ্যাটর্নি জেনারেল

বাজে হারের পরও পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল ও তুলা কিনতে পারে বাংলাদেশ: নিক্কেইকে ড. ইউনূস

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত