Ajker Patrika

ইসির ক্ষমতা সীমিত করে আরপিও বিল সংসদে, আপত্তি কণ্ঠভোটে নাকচ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৫ জুন ২০২৩, ২১: ৩৮
Thumbnail image

বর্তমান আইনে অনিয়ম বা সহিংসতার কারণে যেকোনো পর্যায়ের নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু এ ক্ষমতাকে সীমিত করে সংশোধিত আরপিওতে ‘শুধু ভোটের দিন ভোট বন্ধ করতে পারবে ইসি’ এমন বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদের কোনো আসনে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে না ইসি। যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, শুধু সেসব কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা পাচ্ছে কমিশন। 

এসব বিধান রেখে জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে তুলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। 

এর আগে ‘ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে’ দাবি করে নতুন বিলে আপত্তি জানান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম। তবে তা কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। পরে আইনমন্ত্রী বিলটি সংসদে তোলেন। 

বিলটি পরীক্ষা করে ১৫ দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে প্রস্তাবগুলো সংযোজন বা বিয়োজন হতে পারে। সবশেষে বিল আকারে পাসের জন্য উপস্থাপন করা হবে। 

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, বিলটি আইনে পরিণত হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।

জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয় যে, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।’

তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর ইসি ওই ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করতে পারে কি না, তা নিয়ে মতদ্বৈধতা আছে। এ কারণে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য এই বিধানের সঙ্গে আরেকটি উপধারা যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল ইসি। প্রস্তাবে বলেছিল, কোনো অনিয়ম, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ এলে নির্বাচন কমিশন কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত করতে পারবে। এরপর অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে কোনো কেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোট বাতিল করে নতুন করে নির্বাচন করতে পারবে। 

তবে বিলের সংশোধনী প্রস্তাবে ইসিকে পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত বা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে না। এতে বলা হয়েছে, যেসব ভোটকেন্দ্রে (এক বা একাধিক) অভিযোগ থাকবে, ইসি শুধু সেসব কেন্দ্রে ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করে প্রয়োজনে নতুন নির্বাচন করতে পারবে। 

এর পাশাপাশি ৯১(এ) ধারায়ও সংশোধনী আনা হচ্ছে। সংশোধনীতে আরপিওর ৯১ ধারার এই উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। 

বিলে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের কাজে বাধা দিলে তাঁর শাস্তির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। 

বিলটি উত্থাপনে আপত্তি জানিয়ে সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ‘সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে। আমরা ৫২ বছর পর হলেও নির্বাচন কমিশন (গঠন) আইন করেছি। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনে স্বাধীন থাকবে। আমরা আইন করতে যাচ্ছি। আইন করে যদি স্বাধীনতাটাকে বাতিল করে দিই। তাহলে কমিশন কীভাবে স্বাধীন থাকবে?’ 

জাতীয় পার্টির এ সংসদ সদস্য বলেন, ‘আরপিওতে দেখলাম, আমরা দেখেছি গাইবান্ধার নির্বাচন খারাপ হয়েছিল বলে কমিশন বন্ধ করে দিয়েছে। জানি না কী কারণে আইনমন্ত্রী আবার এখন আনলেন নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। ভোটকেন্দ্র বন্ধ করতে পারবে। যেখানে গন্ডগোল হয়েছে সেটা বন্ধ করতে পারবে। মানে, সেখানে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। নির্বাচন কমিশন যদি সকাল থেকে মনে করেন এখানের অবস্থা খারাপ, গাইবান্ধার মতো পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার এখানে খর্ব করা হয়েছে। এই স্বাধীনতা খর্বের বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ 

বিল সংশোধনী সংবিধানের চেতনা ও গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন ফখরুল ইমাম। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে দেখতে চাই। কমিশন যা পাঠাবে তা সংসদে পাস করা উচিত।’ 

ফখরুল ইমামের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘এই সংশোধনী সংবিধান বা গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়। আইনের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি দেখে কোনো নির্বাচনী এলাকায় যদি সমস্যা হয়, প্রশ্ন থাকে, গন্ডগোল, ভোট দিতে বাধা দান—এটা দেখা গেলে পুরো নির্বাচন ইলেকশন কমিশন বন্ধ করে দিতে পারে।’

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘দুটো-তিনটায় গন্ডগোল, সহিংসতার কারণে সব কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করার ক্ষমতাটা তা দেওয়া হচ্ছে না। এর মানে হচ্ছে যে এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয়। কারণ, যে কয়টায় সঠিকভাবে নির্বাচন হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিকভাবে জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে, সেটা নির্বাচন কমিশন বন্ধ করতে পারবে না। যদি বন্ধ করতে পারত, সেটা অগণতান্ত্রিক হতো।’ 

আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী আইনে (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব গত ২৮ মার্চ নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এ ছাড়া টিআইএন এবং ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের কপি জমা, প্রার্থিতা বাছাইয়ে বৈধ হলেও তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ, দল নিবন্ধনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুত লক্ষ্যমাত্রা ২০২০ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সাল করা এবং ভোটের সংবাদ সংগ্রহে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের কাজে বাধা দিলে কিংবা যন্ত্রপাতি বিনষ্ট করলে শাস্তি-সাজার বিধানসহ কয়েকটি প্রস্তাব রয়েছে বিলে। 

এই বিল সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার প্রশ্নে উচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। আদালতের রায় অনুযায়ী ফলাফলের পরও তদন্ত করে ইসি যেকোনো নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা রাখে। এখানে আরও কিছু অসংগতিও আছে। মনে হচ্ছে, কমিশন এখন শুধু ভোটের দিন ভোট বন্ধ করতে পারবে। তার আগে অনিয়ম বা ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই, এমনটা দেখলেও তারা ভোট আগেভাগে বন্ধ করতে পারবে না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত