Ajker Patrika

জুলাই অভ্যুত্থানের শরিকদের মধ্যে অস্থিরতা

  • আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে এনসিপির ডাকে সাড়া দেয়নি বিএনপি।
  • একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান উপদেষ্টা মাহফুজের।
  • মাহফুজের মন্তব্য ভালোভাবে নিচ্ছে না জামায়াত।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ০৯: ৩৯
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। গত জুলাইয়ের এই অভ্যুত্থানে অনেক দল, সংগঠন, প্ল্যাটফর্ম, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দূরত্ব ও অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে। সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য, স্লোগান ও আলাপচারিতায় তা প্রকাশ পাচ্ছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসতে আসতে সংস্কারের নানা ইস্যু, ভোটের সময়সীমাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অভ্যুত্থানের অংশীজনদের মধ্যে এই দূরত্ব আরও বাড়বে—এমনটা মনে করছেন সংগঠনগুলোর নেতারা।

জুলাইয়ের আন্দোলনে অংশীজনদের অনেকে মনে করছেন, শেখ হাসিনার পতনের পরপরই এতে বড় দল বিএনপির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানকে বড় করে দেখানোর পর থেকে দলটির সঙ্গে আন্দোলনের তরুণ নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি শুরু হয়। এরপর ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ তৈরি, নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও ছাত্রসংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আত্মপ্রকাশ, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের চেষ্টা, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ নেওয়ার আগে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নিয়োগের বিষয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের কথিত আপত্তির দাবি করে ভিডিও প্রকাশসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, জুলাইয়ে গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগকে সরাসরি নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করার দাবিতে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে সর্বশেষ ঢাকায় মিন্টো রোড ও শাহবাগে যে বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে, তা সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্যই করা। এ কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য প্রকাশ্য ও অনানুষ্ঠানিক অনুরোধ করা হয় বিএনপিকে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন এনসিপির কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে। কিন্তু দুই দিন চলা এই আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত বিএনপির কেউ যাননি।

বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে তেমন মতভেদ না থাকলেও এনসিপির কর্মসূচিতে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করা থেকে বিএনপি বিরত থেকেছে মূলত সাবধানতা হিসেবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ, নতুন সংবিধান প্রণয়নের দাবি ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে বিতর্কিত করার চেষ্টাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে এনসিপির সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপি আগেই সরকারকে জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের মতো দলকে নিষিদ্ধ করা আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়ায় হতে হবে। এ কারণে অন্য দলের কর্মসূচিতে যাওয়া দরকার মনে করেনি তারা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, ‘সব বিষয়ে ঐকমত্য থাকবে না, ভিন্নমত থাকবে, এটা স্বাভাবিক। যেমন নতুন সংবিধান হবে কি না, গণপরিষদ কীভাবে গঠিত হবে, সে বিষয়ে দলগুলোর ভিন্নমত আছে। এই ভিন্নমতের বিষয়গুলো যদি আলোচনার টেবিলে সমাধান না করে সরকার চাপিয়ে দিতে চায়, তাহলে দূরত্ব বাড়বে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক গতকাল সোমবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, যে বিষয়গুলো দূরত্ব তৈরির কারণ হিসেবে সামনে আসছে, তার বেশির ভাগই আলোচনার টেবিলে সমাধান করা যেত। তিনি বলেন, ‘সবকিছু রাস্তায় নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। সবকিছু চাপ দিয়ে করানোও ঠিক নয়।’

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যেসব ইস্যুতে মতভেদ থেকে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, তা প্রকাশ্য ও নেপথ্যের আলোচনায়ই হয়তো সমাধান করা যেত। তা না করে চাপ তৈরির জন্য রাস্তায় আন্দোলনের আবহ তৈরি করা, একই সঙ্গে এসব কর্মসূচি সুযোগে নিজেদের মতো চাপিয়ে দিতে অন্য দলের চেষ্টা করা অনেকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না।

জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখ না করে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গত রোববার এক ফেসবুক পোস্টে যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। জামায়াতে ইসলামীর ওপরের সারির এক নেতা এ বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে জানান, দলের ভেতরে বেশ কথা হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে। জামায়াত বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।

ফেসবুক পোস্টে মাহফুজ আলম বলেছিলেন, একাত্তরের প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে।...জুলাইয়ের শক্তির মধ্যে ঢুকে সাবোটাজ করা বন্ধ করতে হবে। সাফ দিলে আসতে হবে।’

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগের কর্মসূচিতে জাতীয় সংগীত থামাতে বলা এবং স্লোগানে ‘গোলাম আযমের বাংলাদেশ’ উচ্চারণের ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর মাহফুজ আলম ফেসবুকে বিবৃতিটি দেন।

একই বিষয়ে এনসিপি গতকাল সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে। দলটি বলছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মত, পক্ষ এবং সাধারণ ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিলেও একটি পক্ষ সচেতনভাবে দলীয় স্লোগান এবং বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামবিরোধী স্লোগান দিয়েছে; যা জুলাই-পরবর্তী সময়ে সাম্প্রতিক আন্দোলনে জাতীয় ঐক্য নবায়নের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থাকা প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমাবেশ ঘটেছে বিভিন্ন মত ও পথের তরুণদের। তাঁদের নেতাদের একটি বড় অংশ নিয়ে এনসিপি ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ গঠন করা হয়েছে। তবে উমামা ফাতেমাসহ কয়েকজন নেতা আলাদা করে ছাত্র আন্দোলন টিকিয়ে রাখেন। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের এমন কয়েকজন সাবেক নেতা পরে ‘আপ বাংলাদেশ’ নামে আলাদা সংগঠন তৈরি করেন।

জুলাই অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ শক্তিগুলো বিভক্ত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটা নানান কারণে হয়। প্রত্যেকের তো আলাদা আলাদা অ্যাজেন্ডা তৈরি হয়েছে। সেটার ভিত্তিতে ভিন্নমত হয়।’

সারোয়ার তুষার আরও বলেন, ‘ভিন্নমত সমস্যা না। ভিন্নমত গণতন্ত্রের জন্য ভালো। তবে এটা বিরোধিতা কিংবা মুখোমুখি অবস্থানে না গেলেই হয়। এদের মধ্যে আবার কিছু কমন জায়গাও আছে; যেমন আওয়ামী লীগ প্রশ্ন, সংস্কার। আমরা এমন কিছু কমন জায়গা তৈরি করে নিলে ভালো।’

নির্বাচন ঘনিয়ে এলে এই ‘মতভিন্নতা’ বাড়তে পারে কি না—এমন প্রশ্নে সারোয়ার তুষার বলেন, ‘সব ঐক্য তো নির্বাচনমুখী না। নির্বাচনের আগে একধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে, বাগ্‌বিতণ্ডা থাকবে। সকল পক্ষই সহনশীলতা দেখিয়েছে। একই কারণে বাগ্‌বিতণ্ডা বড় আকার নেবে না।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে অনৈক্যের যে ধারা তা ৫ আগস্টের পর থেকে শুরু হয়েছিল। রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই শক্তিগুলো বিভক্ত হয়ে পড়ে। যারা এখানে নেতৃত্বে পর্যায়ে ছিল তাদের এটার দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। শুরুতেই তারা তাদের নিজস্ব রাজনীতি তৈরি করতে গিয়ে বিভক্তি তৈরি করেছে। পাঁচ আগস্টের পরে তারা যেভাবে ক্ষমতামুখী রাজনীতিতে ঢুকে গেল তা ঐক্যে ফাটল ধরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। মূলকথা, যারা ক্ষমতা কাঠামোর কাছাকাছি তারাই ঐক্যে ভাঙন ধরানোর জন্য বেশি দায়ী।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত