দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
অনলাইন ডেস্ক
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের একটি হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। গত ১৫ জানুয়ারি এই কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশন এমন সুপারিশ করেছে, যাতে প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চর্চার সুযোগ না থাকে এবং বাংলাদেশে যেন স্বৈরশাসন ফিরে না আসে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতন্ত্রকে মৌলিক নীতিরূপে বজায় রেখে কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি তিনটি নীতি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে মৌলিক নীতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। এই বিষয়টি কিছু মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি জাপানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য ডিপ্লোম্যাটের দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক সুধা রামাচন্দ্রন। সাক্ষাৎকারে আলী রীয়াজ যুক্তি দেন, শেখ হাসিনা সরকারের ঘোষিত ও চর্চিত ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল শুধু ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সহনশীলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাঁর মতে, কমিশন যে বহুত্ববাদের সুপারিশ করেছে তার পরিধি অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক।
সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
দ্য ডিপ্লোম্যাট: সংবিধান সংস্কার কমিশন বর্তমান সংবিধানের চার মূলনীতি—সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র থেকে কেবল ‘গণতন্ত্র’ বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। এর পেছনে যুক্তি কী?
আলী রীয়াজ: কমিশন সুপারিশ করেছে যে, সংবিধানে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত দেশের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ওই ঘোষণাপত্রে তিন মূলনীতি ছিল—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক মাস পরই ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণেতারা এসব মূলনীতি উপেক্ষা করেন। এটি বিস্ময়কর যে, প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিগুলো বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং এর পরিবর্তে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরুর আগে আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে দলীয় চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছিল, সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিশন এবং অনেক অংশীজনের মতামত ছিল যে, দেশ যেন প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিতে ফিরে যায়, যা লক্ষ–কোটি শহীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদনের উপযুক্ত উপায়।
আগে ছিল বলে (প্রস্তাবে) গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এমন নয়, বরং বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আকাঙ্ক্ষা বিশেষ করে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণজাগরণের প্রতিফলন হিসেবে গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করেছেন।
পঞ্চম মূলনীতি (বহুত্ববাদ) সংযোজন করা হয়েছে দেশের বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করতে। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ধর্মীয় ও জাতিগত বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন এবং সেটিকে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির অংশ করা উচিত। শেখ হাসিনা তাঁর বাবা মুজিবের মতোই স্বৈরাচারী শাসনকে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মোড়কে বৈধতা দিয়েছেন। গণ–অভ্যুত্থান এই মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের সুপারিশ কেবল জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কেন বাদ দেওয়া হয়েছে?
আলী রীয়াজ: আমাদের সুপারিশে ধর্মনিরপেক্ষতার (সেক্যুলারিজম অর্থে) পরিবর্তে আরও বিস্তৃত নীতি হিসেবে বহুত্ববাদকে গ্রহণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সংশোধিত বা পরিত্যক্ত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্ব ও এর বিভিন্ন রূপকে বিভিন্ন কারণে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বিশেষ করে, এটি অপশ্চিমা সমাজগুলোর বৈচিত্র্য ধারণে কতটা কার্যকর সে প্রশ্ন তুলেছেন গবেষকেরা। তালাল আসাদ, সাবা মাহমুদ, চার্লস টেলর এবং আশীষ নন্দীর মতো সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি সমস্যাযুক্ত।
এই শব্দটির ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। রাষ্ট্রের নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভব হয় ইউরোপের ধর্মযুদ্ধের (ক্রুসেড) পর। সে সময় থেকেই ধর্ম ও সমাজ এই পৃথক্করণ ক্রমশ মেনে নিতে শুরু করেছে। এর ফলে এই ‘পবিত্রতা’ বা খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবমুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের বৈষয়ীকরণের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা একধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
তবে এসব তাত্ত্বিক বিতর্কের বাইরেও বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতিকে বিভক্ত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে, গত এক দশকে এক স্বৈরাচারী সরকার এটিকে অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশে পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকেরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলত ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সহনশীলতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে। আমাদের কমিশনের সুপারিশ হলো, বহুত্ববাদ গ্রহণ করা। বহুত্ববাদ এমন এক নীতি যা শুধু ধর্মীয় বৈচিত্র্য—হিন্দু, বৌদ্ধ, আহমদিয়া, বাহাই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে না, বরং দলিত ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে। লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু নির্যাতন দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত ছিল।
বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গত ৫২ বছরের মধ্যে মাত্র ১৮ বছর ৬ মাস সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল। বাকি ৩৩ বছর জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও আওয়ামী লীগ সরকারে থেকেও এটি পুনঃপ্রবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এরপর ২০১১ সালে শেখ হাসিনা এটি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তাঁর স্বৈরাচারী শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পথে এগিয়ে যান। এমনকি এই ইস্যুতে উচ্চ আদালতও কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: বর্তমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম সহাবস্থান করছে। কমিশনের প্রস্তাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ইসলামকে আগের জায়গাতেই রাখা হয়েছে। ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হবে?
আলী রীয়াজ: ইসলাম ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে এবং এই সময়ে আটবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে, কিন্তু এরপরও তারা এটি বাতিলে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ২০২৪ সালের এপ্রিলে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা সংবিধানিক স্ববিরোধ সৃষ্টি করে না। আমরা যখন সমাজের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করেছি তখন বিপুলসংখ্যক মানুষ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। আমাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫০ হাজারেরও বেশি মতামত নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে বিপুলসংখ্যক মত ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে রাখার পক্ষে ছিল।
আমরা আমাদের পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১২১টি দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করেছি, যার মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পর্যালোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, ১৯টি দেশে রাষ্ট্রধর্ম আছে এবং ৭৫টি দেশের সংবিধানে ‘পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাস’–এর কথা উল্লেখ আছে। অনেক পশ্চিমা দেশেও একটি রাষ্ট্রধর্ম বা একক ধর্মের সরকারি স্বীকৃতি রয়েছে। ২০১৭ সালে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার জানিয়েছিল, ৮০টিরও বেশি দেশ একটি ধর্মকে সরকারিভাবে অনুমোদন দিয়ে অথবা একটি ধর্মকে অন্য ধর্মের তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে সমর্থন দিয়ে থাকে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৯টি দেশের মধ্যে ২২ শতাংশ দেশের রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে এবং ২০ শতাংশ দেশ একটি ধর্মকে প্রাধান্য দেয়। সুতরাং, বাংলাদেশ কোনোভাবেই ব্যতিক্রম নয়।
রাষ্ট্র অনুমোদিত ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্র এবং ধর্মের ভূমিকা আলাদা হতে পারে। ইসরায়েলের বার এলান ইউনিভার্সিটির ধর্ম ও রাষ্ট্র (আরএসএস) সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে জনাথন ফক্স বলেছিলেন যে, এ ধরনের পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন হতে পারে। তিনি যুক্তরাজ্য এবং ইরানকে উদাহরণ হিসেবে দিয়েছেন। উভয় দেশেই রাষ্ট্রধর্ম বা সরকারি গির্জা আছে, তবে এই দুই রাষ্ট্রের কার্যক্রমে ধর্মের ভূমিকা একেবারে বিপরীত।
সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক গত কয়েক দশকের মতোই থাকবে। যতক্ষণ না ধর্ম আইনগত ব্যবস্থার উৎস হিসেবে কাজ করছে অথবা রাজনৈতিক–আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে, ততক্ষণ উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। অনেক সময় রাষ্ট্রধর্মগুলো প্রতীকীভাবে বেশি দেখা যায়, এর বাস্তবিক প্রভাব থাকে কম।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: স্বৈরশাসন যে আর ফিরবে না, সংবিধান সংস্কার কমিটি এটি কীভাবে নিশ্চিত করতে চায়?
আলী রীয়াজ: আমরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। যা বাস্তবায়িত হলে ক্ষমতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মধ্যে বিতরণ হয়ে যাবে এবং বর্তমানের মতো প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঠেকাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছি। এই পরিষদ সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের বিষয়ে সুপারিশ করবে। বর্তমানে এই ক্ষমতা শুধু প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আমরা কিছু ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে স্থানান্তরের প্রস্তাবও দিয়েছি। বর্তমান সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনো নিয়োগ দিতে পারেন না; আমরা সুপারিশ করেছি এটি সীমিত করা উচিত।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শাসক দলের সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুগত। কারণ, তাঁরা দলের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। এর ফলে খোদ শাসক দলের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন করতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রীর অপসারণের জন্য কোনো প্রস্তাব আনা সম্ভব হয় না। আমরা সুপারিশ করেছি, প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা থাকতে পারবেন না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর জন্য সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনের প্রস্তাবও দিয়েছি।
আমরা সুপারিশ করেছি, বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়া উচিত এবং সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এই সুপারিশগুলো দায়িত্বশীলতা, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই করা, যাতে স্বৈরশাসনের সম্ভাবনা রোধ করা সম্ভব হয়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: রাজনৈতিক দলগুলো কোন ধরনের পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আলী রীয়াজ: আমাদের সুপারিশের সারাংশ প্রকাশের পর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোনো গুরুতর সমালোচনা বা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের মতো কিছু শোনা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই, তারা পুরো প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষেই জনসমক্ষে আনা হবে।
এসব সুপারিশের অনেকগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এসেছে। যেমন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার সুপারিশ। এই প্রস্তাবটি রাজনৈতিক দলগুলো এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। তবে আমি বুঝি যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব প্রস্তাব রয়েছে এবং আমাদের কিছু সুপারিশ তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে মেলে না। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। আমি মনে করি, তেমন কোনো পার্থক্য নেই যা নিয়ে কোনো ধরনের সমঝোতা সম্ভব হবে না।
সবাই এবং আমি বলতে চাচ্ছি, সবারই কিছু পরিবর্তন চাওয়ার রয়েছে। গত ১৬ বছরের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা সবাইকেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে পরিবর্তন প্রয়োজন। বাংলাদেশে নজিরবিহীন মাত্রার সহিংসতা হয়েছে। কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধও হয়েছে। শত শত মানুষের মৃত্যু এবং ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হওয়ার ঘটনা বৃথা যেতে পারে না।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে? নির্বাচিত কোনো সরকারই কী এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাবে?
আলী রীয়াজ: প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, সেগুলো প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যখন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তখন এগুলো রাজনৈতিক দলগুলো যাচাই–বাছাই করে দেখবে। এরপর সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে। অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, শিগগিরই তাঁর নেতৃত্বে একটি ‘কনসেনসাস কমিশন’ গঠন করা হবে, যার মাধ্যমে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া হবে। আশা করছি, একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা হবে। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তায় দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ব্যবস্থা চিহ্নিত করবে। প্রক্রিয়াটি এই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে। এই আলোচনা থেকে একটি বাস্তবায়নের পথ বের হবে।
অনুবাদ করেছে আব্দুর রহমান
ছাত্র–জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের একটি হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। গত ১৫ জানুয়ারি এই কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিশন এমন সুপারিশ করেছে, যাতে প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চর্চার সুযোগ না থাকে এবং বাংলাদেশে যেন স্বৈরশাসন ফিরে না আসে।
সংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতন্ত্রকে মৌলিক নীতিরূপে বজায় রেখে কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি তিনটি নীতি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে মৌলিক নীতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া। এই বিষয়টি কিছু মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি জাপানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য ডিপ্লোম্যাটের দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক সুধা রামাচন্দ্রন। সাক্ষাৎকারে আলী রীয়াজ যুক্তি দেন, শেখ হাসিনা সরকারের ঘোষিত ও চর্চিত ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল শুধু ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সহনশীলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাঁর মতে, কমিশন যে বহুত্ববাদের সুপারিশ করেছে তার পরিধি অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক।
সাক্ষাৎকারটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
দ্য ডিপ্লোম্যাট: সংবিধান সংস্কার কমিশন বর্তমান সংবিধানের চার মূলনীতি—সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র থেকে কেবল ‘গণতন্ত্র’ বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। এর পেছনে যুক্তি কী?
আলী রীয়াজ: কমিশন সুপারিশ করেছে যে, সংবিধানে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বর্ণিত দেশের প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হোক। ওই ঘোষণাপত্রে তিন মূলনীতি ছিল—সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক মাস পরই ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণেতারা এসব মূলনীতি উপেক্ষা করেন। এটি বিস্ময়কর যে, প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিগুলো বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং এর পরিবর্তে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরুর আগে আওয়ামী লীগ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে দলীয় চারটি মূলনীতি নির্ধারণ করেছিল, সেগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিশন এবং অনেক অংশীজনের মতামত ছিল যে, দেশ যেন প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিতে ফিরে যায়, যা লক্ষ–কোটি শহীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদনের উপযুক্ত উপায়।
আগে ছিল বলে (প্রস্তাবে) গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এমন নয়, বরং বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আকাঙ্ক্ষা বিশেষ করে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণজাগরণের প্রতিফলন হিসেবে গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করেছেন।
পঞ্চম মূলনীতি (বহুত্ববাদ) সংযোজন করা হয়েছে দেশের বৈচিত্র্যকে প্রতিফলিত করতে। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ধর্মীয় ও জাতিগত বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন এবং সেটিকে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির অংশ করা উচিত। শেখ হাসিনা তাঁর বাবা মুজিবের মতোই স্বৈরাচারী শাসনকে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির মোড়কে বৈধতা দিয়েছেন। গণ–অভ্যুত্থান এই মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমাদের সুপারিশ কেবল জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: প্রস্তাবনা থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কেন বাদ দেওয়া হয়েছে?
আলী রীয়াজ: আমাদের সুপারিশে ধর্মনিরপেক্ষতার (সেক্যুলারিজম অর্থে) পরিবর্তে আরও বিস্তৃত নীতি হিসেবে বহুত্ববাদকে গ্রহণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সংশোধিত বা পরিত্যক্ত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার তত্ত্ব ও এর বিভিন্ন রূপকে বিভিন্ন কারণে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বিশেষ করে, এটি অপশ্চিমা সমাজগুলোর বৈচিত্র্য ধারণে কতটা কার্যকর সে প্রশ্ন তুলেছেন গবেষকেরা। তালাল আসাদ, সাবা মাহমুদ, চার্লস টেলর এবং আশীষ নন্দীর মতো সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটি সমস্যাযুক্ত।
এই শব্দটির ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। রাষ্ট্রের নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভব হয় ইউরোপের ধর্মযুদ্ধের (ক্রুসেড) পর। সে সময় থেকেই ধর্ম ও সমাজ এই পৃথক্করণ ক্রমশ মেনে নিতে শুরু করেছে। এর ফলে এই ‘পবিত্রতা’ বা খ্রিষ্টধর্মের প্রভাবমুক্ত হয়ে রাষ্ট্রের বৈষয়ীকরণের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা একধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
তবে এসব তাত্ত্বিক বিতর্কের বাইরেও বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে জাতিকে বিভক্ত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে, গত এক দশকে এক স্বৈরাচারী সরকার এটিকে অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশে পূর্ববর্তী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকেরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলত ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সহনশীলতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে। আমাদের কমিশনের সুপারিশ হলো, বহুত্ববাদ গ্রহণ করা। বহুত্ববাদ এমন এক নীতি যা শুধু ধর্মীয় বৈচিত্র্য—হিন্দু, বৌদ্ধ, আহমদিয়া, বাহাই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করবে না, বরং দলিত ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেও সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে। লক্ষণীয় যে, রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও সংখ্যালঘু নির্যাতন দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত ছিল।
বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গত ৫২ বছরের মধ্যে মাত্র ১৮ বছর ৬ মাস সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল। বাকি ৩৩ বছর জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও আওয়ামী লীগ সরকারে থেকেও এটি পুনঃপ্রবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এরপর ২০১১ সালে শেখ হাসিনা এটি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে তাঁর স্বৈরাচারী শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পথে এগিয়ে যান। এমনকি এই ইস্যুতে উচ্চ আদালতও কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: বর্তমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম সহাবস্থান করছে। কমিশনের প্রস্তাবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ইসলামকে আগের জায়গাতেই রাখা হয়েছে। ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী হবে?
আলী রীয়াজ: ইসলাম ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে এবং এই সময়ে আটবার সংবিধান সংশোধন হয়েছে, কিন্তু এরপরও তারা এটি বাতিলে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ২০২৪ সালের এপ্রিলে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখা সংবিধানিক স্ববিরোধ সৃষ্টি করে না। আমরা যখন সমাজের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করেছি তখন বিপুলসংখ্যক মানুষ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। আমাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ৫০ হাজারেরও বেশি মতামত নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে বিপুলসংখ্যক মত ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে রাখার পক্ষে ছিল।
আমরা আমাদের পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১২১টি দেশের সংবিধান পর্যালোচনা করেছি, যার মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পর্যালোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, ১৯টি দেশে রাষ্ট্রধর্ম আছে এবং ৭৫টি দেশের সংবিধানে ‘পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাস’–এর কথা উল্লেখ আছে। অনেক পশ্চিমা দেশেও একটি রাষ্ট্রধর্ম বা একক ধর্মের সরকারি স্বীকৃতি রয়েছে। ২০১৭ সালে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার জানিয়েছিল, ৮০টিরও বেশি দেশ একটি ধর্মকে সরকারিভাবে অনুমোদন দিয়ে অথবা একটি ধর্মকে অন্য ধর্মের তুলনায় অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে সমর্থন দিয়ে থাকে। এতে বলা হয়েছে, ১৯৯টি দেশের মধ্যে ২২ শতাংশ দেশের রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে এবং ২০ শতাংশ দেশ একটি ধর্মকে প্রাধান্য দেয়। সুতরাং, বাংলাদেশ কোনোভাবেই ব্যতিক্রম নয়।
রাষ্ট্র অনুমোদিত ধর্ম থাকলেও রাষ্ট্র এবং ধর্মের ভূমিকা আলাদা হতে পারে। ইসরায়েলের বার এলান ইউনিভার্সিটির ধর্ম ও রাষ্ট্র (আরএসএস) সংক্রান্ত গবেষণার তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে জনাথন ফক্স বলেছিলেন যে, এ ধরনের পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন হতে পারে। তিনি যুক্তরাজ্য এবং ইরানকে উদাহরণ হিসেবে দিয়েছেন। উভয় দেশেই রাষ্ট্রধর্ম বা সরকারি গির্জা আছে, তবে এই দুই রাষ্ট্রের কার্যক্রমে ধর্মের ভূমিকা একেবারে বিপরীত।
সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্ক গত কয়েক দশকের মতোই থাকবে। যতক্ষণ না ধর্ম আইনগত ব্যবস্থার উৎস হিসেবে কাজ করছে অথবা রাজনৈতিক–আইনি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করছে, ততক্ষণ উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। অনেক সময় রাষ্ট্রধর্মগুলো প্রতীকীভাবে বেশি দেখা যায়, এর বাস্তবিক প্রভাব থাকে কম।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: স্বৈরশাসন যে আর ফিরবে না, সংবিধান সংস্কার কমিটি এটি কীভাবে নিশ্চিত করতে চায়?
আলী রীয়াজ: আমরা বেশ কিছু সুপারিশ করেছি। যা বাস্তবায়িত হলে ক্ষমতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মধ্যে বিতরণ হয়ে যাবে এবং বর্তমানের মতো প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঠেকাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ (এনসিসি) গঠনের সুপারিশ করেছি। এই পরিষদ সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের বিষয়ে সুপারিশ করবে। বর্তমানে এই ক্ষমতা শুধু প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আমরা কিছু ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে স্থানান্তরের প্রস্তাবও দিয়েছি। বর্তমান সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া কোনো নিয়োগ দিতে পারেন না; আমরা সুপারিশ করেছি এটি সীমিত করা উচিত।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, শাসক দলের সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুগত। কারণ, তাঁরা দলের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না। এর ফলে খোদ শাসক দলের সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন করতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রীর অপসারণের জন্য কোনো প্রস্তাব আনা সম্ভব হয় না। আমরা সুপারিশ করেছি, প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা থাকতে পারবেন না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর জন্য সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনের প্রস্তাবও দিয়েছি।
আমরা সুপারিশ করেছি, বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়া উচিত এবং সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি আলাদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এই সুপারিশগুলো দায়িত্বশীলতা, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই করা, যাতে স্বৈরশাসনের সম্ভাবনা রোধ করা সম্ভব হয়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: রাজনৈতিক দলগুলো কোন ধরনের পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আলী রীয়াজ: আমাদের সুপারিশের সারাংশ প্রকাশের পর রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে কোনো গুরুতর সমালোচনা বা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যানের মতো কিছু শোনা যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই, তারা পুরো প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে। পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষেই জনসমক্ষে আনা হবে।
এসব সুপারিশের অনেকগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে এসেছে। যেমন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার সুপারিশ। এই প্রস্তাবটি রাজনৈতিক দলগুলো এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। তবে আমি বুঝি যে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব প্রস্তাব রয়েছে এবং আমাদের কিছু সুপারিশ তাদের প্রস্তাবের সঙ্গে মেলে না। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। আমি মনে করি, তেমন কোনো পার্থক্য নেই যা নিয়ে কোনো ধরনের সমঝোতা সম্ভব হবে না।
সবাই এবং আমি বলতে চাচ্ছি, সবারই কিছু পরিবর্তন চাওয়ার রয়েছে। গত ১৬ বছরের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা সবাইকেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে পরিবর্তন প্রয়োজন। বাংলাদেশে নজিরবিহীন মাত্রার সহিংসতা হয়েছে। কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধও হয়েছে। শত শত মানুষের মৃত্যু এবং ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হওয়ার ঘটনা বৃথা যেতে পারে না।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে? নির্বাচিত কোনো সরকারই কী এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাবে?
আলী রীয়াজ: প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, সেগুলো প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যখন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তখন এগুলো রাজনৈতিক দলগুলো যাচাই–বাছাই করে দেখবে। এরপর সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করবে। অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, শিগগিরই তাঁর নেতৃত্বে একটি ‘কনসেনসাস কমিশন’ গঠন করা হবে, যার মাধ্যমে আলোচনা এগিয়ে নেওয়া হবে। আশা করছি, একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা হবে। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তায় দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ব্যবস্থা চিহ্নিত করবে। প্রক্রিয়াটি এই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে। এই আলোচনা থেকে একটি বাস্তবায়নের পথ বের হবে।
অনুবাদ করেছে আব্দুর রহমান
চিন্ময় দাসের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অপূর্ব কুমার ভট্টাচার্য। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও অনীক আর হক। এর আগে বিচারিক আদালতে জামিন না পেয়ে ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টে চিন্ময় দাসের পক্ষে আবেদন করা হয়।
৩৫ মিনিট আগেভোটার তালিকা হালনাগাদে বাদ পড়া ও ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারিতে যোগ্য হবেন এমন নতুন ভোটার মিলিয়ে ৪৯ লাখের মতো নাগরিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবেন এমন ১৫ লাখের বেশি মৃত ভোটারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের...
১ ঘণ্টা আগেশ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে একই জায়গায় কর্মরত আছেন, তাঁদের অন্যত্র বদলির নির্দেশ দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। একই সঙ্গে তিনি মাঠ-পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে কঠোর...
৩ ঘণ্টা আগেসংবিধানের প্রস্তাবনায় গণতন্ত্রকে মৌলিক নীতিরূপে বজায় রেখে কমিশন সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি তিনটি নীতি বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কমিশনের অন্যতম সুপারিশ ছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে মৌলিক নীতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া।
৬ ঘণ্টা আগে