Ajker Patrika

মৎস্যসম্পদ নিয়ে প্রকল্প

আড়াই হাজার কোটির প্রকল্পে অনিয়ম আড়াই শ কোটির

  • অডিটে প্রকল্পজুড়ে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত।
  • চাষিদের উন্নয়নের নামে কর্মকর্তাদের পকেট ভারী।
  • স্পিডবোট কেনার চার বছর আগেই চালক নিয়োগ।
  • মেয়াদ ফুরিয়ে এলেও অগ্রগতি মাত্র অর্ধেক।
সাইফুল মাসুম, ঢাকা 
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মৎস্য খাতের বড় সরকারি উদ্যোগ ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প’তে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্পটিতে অডিট অধিদপ্তর ২৫৮ কোটি টাকার গুরুতর আর্থিক অনিয়ম পেয়েছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাধু একটি চক্র মৎস্য খাতের উন্নয়নের নামে প্রকল্পটি থেকে পকেট ভারী করেছে। বঞ্চিত মৎস্যজীবীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি এ নিয়ে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) একাধিক রাষ্ট্রীয় সংস্থা।

দেশের মৎস্য খাতকে এগিয়ে নিতে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্প’ শুরু করে মৎস্য অধিদপ্তর। বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটিতে শুরু থেকেই অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ ছিল। প্রকল্পের মেয়াদ আর মাত্র দুই মাস থাকলেও অগ্রগতিও অর্ধেকের মতো। কিন্তু প্রকল্পটির অনিয়ম ও ধীরগতি নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা সব সময় অদৃশ্য কারণে নীরব ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার পর প্রকল্পটি থেকে ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ উল্লেখ করে বাদ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। সম্প্রতি দুর্নীতির তথ্য সামনে আসায় কয়েকবার প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদলেরও ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও পাঁচ মাস বাড়াতে সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

অডিটে ধরা রাজ্যের আর্থিক অনিয়ম

টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্যসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। কিন্তু অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সেই উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই অডিট অধিদপ্তর এতে ২৫৮ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম পেয়েছে। মৎস্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অনিয়মে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল প্রকল্প পরিচালকের।

অডিটের তথ্যমতে, প্রকল্পের বড় আর্থিক অনিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজে ডিফর্মড বার ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে ঠিকাদারকে ৪৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা দেওয়া, খালের মাটি খননের অতিরিক্ত উচ্চতা দেখিয়ে বিল পরিশোধ করার মাধ্যমে সরকারের ১৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা ক্ষতি করা, অনুমোদন ছাড়া মূল বিশেষজ্ঞ পরিবর্তন করে আরডিপিপি বরাদ্দ থেকে অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয় করা, কাজ সম্পাদনের ভুয়া তথ্য দিয়ে ঠিকাদারকে তিন কোটি টাকা আর্থিক সুবিধা দেওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় পরামর্শককে বিল পরিশোধ, একই কাজের জন্য দুবার বিল পরিশোধ, আর্থিক বিবরণীতে ৩৭ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা অতিরিক্তভাবে দেখানোর মতো নানা অনিয়ম করা হয়েছে। সমর্থনযোগ্য প্রমাণ ছাড়াই ব্যাংকের হিসাব বিবরণীতে ৪৮ কোটি ৫০ হাজার টাকার ভ্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

চিংড়িচাষিদের উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাট

প্রকল্পে চিংড়িচাষিদের উন্নয়নে নানা কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকলেও অভিযোগ রয়েছে, প্রান্তিক চাষিরা এর ছিটেফোঁটা সুবিধাও পাননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাষিদের নামে বরাদ্দ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিদেশ থেকে উন্নত জাতের রেণু পোনার আমদানির নামে ভুয়া বিল করে দুই কোটি টাকা হাতিয়েছে একটি চক্র। এ বিষয়ে বঞ্চিত একজন চাষি প্রকল্প পরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়, ৫০ হাজার সামুদ্রিক চিংড়ির রেণু পোনা (পিপিএল) আমদানির জন্য কক্সবাজার জেলার নামসর্বস্ব এমকেএ হ্যাচারির সঙ্গে সাড়ে ৫ কোটি টাকার ভুয়া চুক্তি করে মৎস্য অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটিকে এ জন্য আড়াই কোটি টাকার বেশি অগ্রিমও দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র অথবা থাইল্যান্ড থেকে রেণু পোনা কেনার কথা থাকলেও এমকেএ হ্যাচারি উপকূল থেকে অবৈধভাবে ধরা রেণু পোনা বিদেশ থেকে আনা বলে চালিয়ে দেয়। দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, হ্যাচারিকে ভুয়া কাগজপত্র তৈরিতে সহযোগিতা করেন প্রকল্প পরিচালক ও অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। অভিযোগটি আমলে নিয়ে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে দুদক।

মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক জিল্লুর রহমান আজকের পত্রিকার প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রচলিত নিয়মেই এমকেএ হ্যাচারিকে টাকা দেওয়া হয়েছে। আর তিনি ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।

স্পিডবোট কেনার চার বছর আগে চালক নিয়োগ

প্রকল্পে উপকূলের মাছ ধরার নৌযানগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য কিছু স্পিডবোট কেনার কথা ছিল। তবে স্পিডবোট কেনার দীর্ঘ চার বছর আগে ‘রেডিসন ডিজিটাল টেকনোলজিস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৬ জন চালক, ১৬ জন সহকারী এবং ১৬ জন মেকানিক নিয়োগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে জনপ্রতি দেড় থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে চালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া চরমোনাইয়ের বাসিন্দা মো. রেদোয়ান খান বলেছেন, তাঁকে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। রেদোয়ানের প্রথম কর্মস্থল কুতুবদিয়ায় কোনো স্পিডবোট না থাকায় তাঁকে দিয়ে পিয়নের কাজ করানো হতো। স্পিডবোটের সহকারী (ডেকহ্যান্ড) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বরিশাল সদর এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, তিনিও ধার করে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছিলেন। একাধিক স্পিডবোটচালক অভিযোগ করেছেন, রেডিসন টেকনোলজিস তাঁদের বেতনের অ্যাকাউন্টের চেকবই নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। এ বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আবু জাফরকে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তাঁর মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

সম্প্রতি ভারত থেকে ৩ কোটি ৬৮ লাখ ৫২ হাজার টাকা করে ছয়টি স্পিডবোট কেনা হয়েছে। নৌযানগুলো উচ্চমূল্যে কেনার অভিযোগ উঠেছে। স্পিডবোটের ব্যবস্থাপনায় যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘নিম্নমানের স্পিডবোট উচ্চমূল্য দেখিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তারা টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। প্রকৃত বাজারমূল্য যাচাই করলেই এই চুরি ধরা পড়বে।’

এদিকে হঠাৎ করেই চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ১০ জন স্পিডবোটচালক, আটজন সহকারী ও আটজন মেকানিককে।

গাড়ি ভাড়ায়ও অনিয়ম

প্রকল্পের আওতায় চীনের তৈরি ১৬টি চেরি গাড়ির প্রতিটি মাসে ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সরকারি অন্যান্য প্রকল্পে একই গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয় ১ লাখ ৬০ থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। এ বিষয়ে সম্প্রতি প্রকল্পের ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো অভিযোগে বলা হয়, বাড়তি টাকায় গাড়ি ভাড়া নেওয়ার পেছনে পিডি ও ডিপিডি (উপপ্রকল্প পরিচালক) মনীষ কুমার মণ্ডলের ‘কমিশন-বাণিজ্য’ রয়েছে। অভিযুক্ত মনীষ কুমার মণ্ডল বলেছেন, দরপত্রের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। আর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না।

অভিযোগ রয়েছে, গাড়িগুলো ঠিকমতো প্রকল্পের কাজে ব্যবহার করা হয় না। ভাড়া করা গাড়ির একটি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-২১-৮৬৪৬) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব অঞ্জন কুমার সরকার নিয়মিত ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, এই গাড়ি মৎস্য অধিদপ্তরের, তা ঠিক আছে; তবে এই প্রকল্পের নয়। আরও অন্তত চারটি গাড়ি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেন বলে জানা গেছে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. জিয়া হায়দার চৌধুরীকে কয়েক দিন একাধিকবার কল ও মেসেজ দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প দপ্তরে গিয়ে জানা যায়, তিনি ওমরাহ হজ পালনের প্রস্তুতির কারণে অফিসে আসেননি। তবে ভারপ্রাপ্ত পিডি উপপ্রকল্প পরিচালক বরুণ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, অভিযোগের বিষয়গুলো সত্য নয়। একটি পক্ষ বিশেষ উদ্দেশ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।

১ মে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফকে ফোন করলে তিনি বলেন, অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নেবেন। হালনাগাদ তথ্য জানতে এক সপ্তাহ পরে আবার ফোন করা হলে মহাপরিচালক জানান, ব্যস্ততার কারণে খোঁজ নিতে পারেননি।

প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমার কাছে তথ্য নেই। জেনে পরে কথা বলব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

লাহোরে পাল্টা আঘাত হেনে পাকিস্তানকে জবাব দিল ভারত

পাকিস্তানের চীনা জে-১০ দিয়ে ভারতের রাফাল যুদ্ধবিমান ধ্বংস, যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরে এই টক্বর

একটি দলের ওপর ভরসার বিনিময়ে পেয়েছি অশ্বডিম্ব: মাহফুজ আলম

গতকাল রাতে ৪৮টি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি পাকিস্তানের

অহনার দাবি, নিজের দোষ ঢাকতে ডাবল টাইমিংয়ের কথা বলেছেন শামীম

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত