Ajker Patrika

ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল

জুলাই-আগস্ট হত্যাযজ্ঞের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা

  • শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের নামে অভিযোগ দাখিল।
  • উসকানিমূলক বক্তব্য, আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ, লাশ পুড়িয়ে দেওয়াসহ ৫ অভিযোগ।
  • শেখ হাসিনা-আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি।
  • তিন আসামিকেই আগামী ১৬ জুন ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেন।
  • দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সরাসরি আদালত থেকে সম্প্রচার।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০১ জুন ২০২৫, ২৩: ৫৮
শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আবদুল্লাহ আল-মামুন। ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আবদুল্লাহ আল-মামুন। ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এর ১৫ বছরের ব্যবধানে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হলো। তিনিসহ মামলার তিন আসামির বিরুদ্ধে নির্দেশদানসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া এই মামলার অন্য দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। গতকাল রোববার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক এই অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ আমলে নিয়ে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানি জারি করেন। গ্রেপ্তার থাকা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তিনজনকে ১৬ জুন ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। গত ১২ মে এই তিনজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল তদন্তকারী সংস্থা।

ট্রাইব্যুনালে এটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় এটি দ্বিতীয় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ। প্রথম আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা হয় ২৫ মে। রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সেদিন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ করা হয়।

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের এ কার্যক্রম টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। কোনো আদালতের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচারের ঘটনা দেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম। এই সম্প্রচারের জন্য ট্রাইব্যুনালের অনুমতি নেওয়া হয়। গতকাল রোববার দুপুর ১২টার কিছুক্ষণ পর এজলাসে আসেন তিন বিচারক। কার্যক্রম চলে বেলা ২টা পর্যন্ত। শুরুতেই কার্যক্রম বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি চান চিফ প্রসিকিউটর। অবশ্য বিষয়টি গত শনিবারই সাংবাদিকদের জানানো হয়েছিল প্রসিকিউশন থেকে। এরপর সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর। বক্তব্যের পরই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন তিনি।

চিফ প্রসিকিউটর স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে করা নানা অপকর্ম; গত দেড় দশকে খুন, গুম, ধর্ষণ, নির্যাতন; শেখ পরিবারের জন্য নেওয়া নানা সুযোগ-সুবিধা; শাপলা চত্বরে গণহত্যা; পিলখানা ট্র্যাজেডি; ২৮ অক্টোবর ট্র্যাজেডি; গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও তুলে ধরেন ট্রাইব্যুনালে।

এই মামলার বিচারের জন্য প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য, অপরাধ সংঘটনের সময় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ, ড্রোন এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, আসামিদের মধ্যে ফোনালাপের অডিও ক্লিপস, ডিজিটাল এভিডেন্সের ফরেনসিক প্রতিবেদন, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য-ছবি এবং ভিডিও, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রস্তুত করা প্রতিবেদন, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যান। এখনো তিনি সেখানে অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

কী কী আছে পাঁচ অভিযোগে

১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে আসামি আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় তাঁদের অধীন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায়, পদ্ধতিগতভাবে নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। হত্যা, হত্যাচেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি না দেওয়া এবং ষড়যন্ত্র করার অপরাধ—যা আসামিদের জ্ঞাতসারে হয়েছে।

২ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের হত্যা করে নির্মূলের নির্দেশ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন কর্তৃক শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বাস্তবায়নে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অধীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে কার্যকর করার মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ প্রদান, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন, যা তাঁদের জ্ঞাতসারে কার্যকর করা হয়েছে।

৩ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে স্বল্প দূরত্ব থেকে সরাসরি নিরীহ-নিরস্ত্র আন্দোলনকারী ছাত্র আবু সাঈদের বুক লক্ষ্য করে বিনা উসকানিতে একাধিক গুলি চালিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাঁদের অপরাধ সংঘটনের নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

৪ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগরের চানখাঁরপুল এলাকায় আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। উল্লিখিত আসামিদের জ্ঞাতসারে এবং তাঁদের হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং মারণাস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ তৎকালীন সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে এবং আশপাশে আন্দোলনরত নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর তৎকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের মৃতদেহ এবং একজনকে জীবিত ও গুরুতর আহত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার অপরাধ, যা আসামিদের জ্ঞাতসারে হয়েছে। ওইরূপ হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা এবং ষড়যন্ত্র, অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন।

চিফ প্রসিকিউটর সূচনা বক্তব্যে বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ববিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উগ্র বাসনায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে। এই বিচার শুরু করা হয়েছে জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। যেখানে নিরস্ত্র-নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবক, নারী ও শিশু—যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটাপদ্ধতি নামক কুপ্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস-ন্যায়সংগত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।

তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, অন্যান্য বাহিনী, সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের অধীন সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী এ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত