Ajker Patrika

গোবি মরুভূমির অপার সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ দেয় এই হোটেল

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৩, ১১: ০৪
Thumbnail image

আপাত সীমাহীন মরুভূমির ওপরে ধীরে ধীরে উদিত হচ্ছে সূর্যটা। আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে কমলা আভা। কয়েক ঘণ্টা পরপর ভেড়া এবং ছাগলের পাল নিয়ে নিকটবর্তী পানির উৎসের দিকে যেতে দেখা যাবে রাখালদের। এখানে আপনি কেবল শুনবেন বাতাসের শব্দ, স্থানীয়দের পোষা প্রাণীদের ডাক কিংবা কদাচিৎ নতুন পর্যটক নিয়ে আসা গাড়ির শব্দ। মঙ্গোলিয়ার বিখ্যাত গোবি মরুভূমির অনন্য সৌন্দর্য উপভোগের এমন সুযোগ করে দেয় একটি ইকো লজ বা রিসোর্ট। এসব তথ্য জানা যায় মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে। 

গোবি মরুভূমির খান কনঘোরের থ্রি কেমেল লজকে বিবেচনা করতে পারেন পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত হোটেল বা রিসোর্টগুলোর একটি হিসেবে। 

থ্রি কেমেল লজকে বিবেচনা করতে পারেন পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত হোটেল বা রিসোর্টগুলোর একটি হিসেবে। ছবি: থ্রি কেমেল লজসভ্যতা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এই লজের কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য পর্যটকদের মঙ্গোলিয়ার ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবনধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। যারা কিনা গৃহপালিত পশুর ওপর নির্ভর করে মধ্য এশিয়ার মালভূমিতে টিকে আছে। 

পৃথিবীতে এমন যাযাবর জনগোষ্ঠীর মানুষ এখন আর খুব একটা দেখা না গেলেও মঙ্গোলিয়ার জনসংখ্যার মোটামুটি চার ভাগের এক ভাগ এখনো যাযাবর। 

লজটিতে ২৪টি তাঁবু আছে। গোলাকার এই বিশেষ তাঁবুগুলো কাঠ, দড়ি এবং পশমি কাপড় দিয়ে তৈরি। এর নির্মাণ উপাদানগুলো একদিকে যেমন সহজে বহনযোগ্য, অন্যদিকে এসব তাঁবু মরুর জোর হাওয়ায় টিকে থাকার মতো শক্তিশালী। 

ভেতরের আসবাবগুলো কাঠের তৈরি। প্রতিটি তাঁবুর সঙ্গেই প্রবাহিত পানিসহ বাথরুম এবং সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে, যা সাধারণত এখানকার যাযাবরদের ঐতিহ্যবাহী ঘরগুলোয় পাওয়া যায় না। দ্য থ্রি কেমেল লজে একটি রেস্তোরাঁ, একটি বার এমনকি একটি স্পাও আছে। 

এই লজে থাকা পর্যটকেরা মরুভূমিতে থাকার অভিজ্ঞতা অর্জনের পাশাপাশি স্থানীয়দের জীবনযাত্রা সম্পর্কেও জানতে পারেন। ছবি: থ্রি কেমেল লজএই হোটেলটি ৬৮ বছর বয়স্ক মঙ্গোলিয়ান-আমেরিকান ব্যবসায়ী জালসা উরাবশরোর অনেক শ্রমের ফসল। ১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা জালসার পক্ষে কেবল মঙ্গোলিয়ার নাটকীয় প্রাকৃতিক দৃশ্যের স্বপ্ন দেখার সুযোগ ছিল। কিন্তু দেশটির সংস্কৃতি সব সময়ই ছিল তাঁর হৃদয়জুড়ে, সেটি বাবার বলা চমৎকার সব গল্পের সূত্রে। তাঁর বাবা কালমিকিয়া এলাকায় জন্ম নেন। বর্তমানে রাশিয়ায় পড়া এই জায়গার অধিবাসীরা মঙ্গোলিয়ান ভাষাতেই কথা বলেন। এখনকার বাসিন্দারাও কিন্তু মঙ্গোল জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ।

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে যখন মঙ্গোলিয়া আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়, তখন জালসা প্রথম সেখানে ভ্রমণের সুযোগ পান। ‘আমি সেখানকার প্রত্যন্ত এলাকায় যাই। এক রাখালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং স্থানীয়দের কিছু তাঁবুতে রাত কাটাই। সেটা ছিল অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা।’ বলেন জালসা। 

এর পরপরই মঙ্গোলিয়ার তখনকার প্রধানমন্ত্রী পশ্চিম থেকে আরও পর্যটক নিয়ে আসার দায়িত্ব দেন জালসাকে। ১৯৯২ সালে নোমাডিক এক্সপিডিশনস নামের একটি পর্যটন প্রতিষ্ঠান চালু করেন তিনি। মঙ্গোলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পর্যটকদের ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিত তাঁর প্রতিষ্ঠান। ২০০২ সালে গোবিতে আরও স্থায়ী কিছু করতে চাইলেন জালসা, আর এভাবেই জন্ম থ্রি কেমেল লজের। 

৬৮ বছর বয়স্ক মঙ্গোলিয়ান-আমেরিকান ব্যবসায়ী জালসা উরাবশরোর হাত ধরেই রিসোর্টটির গোড়াপত্তন। ছবি: থ্রি কেমেল লজগোবি কিন্তু ল্যান্ড অব ডাইনোসরস নামেও পরিচিত। থ্রি কেমেল লজ থেকে কেবল আধ ঘণ্টার ভ্রমণে পৌঁছে যাবেন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ডাইনোসরের ফসিলের এলাকায়। এক শতক আগে বায়ানজাগে নামের জায়গাটিতে অভিযাত্রীরা প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ডাইনোসরের ডিম খুঁজে পান। 

আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির দলটির বাকি সদস্যদের সঙ্গে ১৯২০-এর দশকের ভ্রমণের সময় জীবাশ্মবিদ রয় এনড্রিউজ জায়গাটির নাম রাখেন ‘দ্য ফ্লেমিং ক্লিফস’। কারণ এখানকার লাল বেলে পাথরে পড়ন্ত সূর্যের আলো আশ্চর্য এক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। গোটা এলাকা এ সময় আগুনে লাল রং ধারণ করে। এখনো ডাইনোসরের ফসিলের খোঁজ মেলে জায়গাটিতে। 

লজের প্রতিটি তাঁবু সুপরিসর। ছবি: সিএনএন‘এই জায়গাটা সত্যিই রহস্যময়। এর মধ্যে এক ধরনের গোপনীয়তা এবং নির্জনতা আছে। এটা আমার জন্য বিশেষ এক জায়গা।’ সিএনএন ট্রাভেলকে বলেন নোমাডিক এক্সপিডিশনসের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং প্রধান ট্যুর গাইড বায়ানদেলজার গানবাটার। 

লজ থেকে গাড়িতে চেপে মাত্র ১৫ মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় মল্টসগ এলস নামের জায়গাটিতে। এখানে চমৎকার কিছু বালিয়াড়ি বা বালুর পাহাড়ের দেখা পাবেন। সেখানে পৌঁছে হেঁটে কিংবা স্থানীয় যাযাবর জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে উট ভাড়া করে ঘুরে বেড়াতে পারবেন বালিয়াড়ির রাজ্যে। 

বালিয়াড়ি এবং লাল পাথরের পাহাড় ছাড়া গোবি মরুভূমি সবুজের জন্যও বিখ্যাত। লজ থেকে গাড়িতে চেপে এক ঘণ্টায় পৌঁছাবেন ইয়ল ভ্যালি বা ইয়ল উপত্যকায়। ইয়ল বা বিশেষ এক ধরনের শকুনসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মেলে এখানে। 

কাঠ, দড়ি এবং কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এখানকার তাঁবুগুলো। ছবি: থ্রি কেমেল লজটেকসই পর্যটনের জন্য আলাদা পরিচিতি আছে থ্রি কেমেল লজের। প্লাস্টিকের বোতল বাদ দিয়ে অতিথিদের হাতে ধাতব পুনর্ব্যবহারযোগ্য টাম্বলার বা হাতলবিহীন পাত্র তুলে দিয়েছে তারা। তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও চমৎকার। সৌর প্যানেলগুলো লজের প্রায় সমস্ত আলোর চাহিদা পূরণ করে। নির্মাণ, আসবাবপত্র এবং সাজসজ্জার উপকরণ যতটা সম্ভব স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। আর এটা করা হয় লজের ৫০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্য থেকে। 

থ্রি কেমেল লজে প্রায় ৩০ জন মঙ্গোলিয়ান চাকরি করেন। গোবি মরুভূমিতে বাস করা যাযাবরদের উন্নয়নে বিনিয়োগও লজের টেকসই লক্ষ্যগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষামূলক বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তার পাশাপাশি ডাইনোসরের জীবাশ্ম রক্ষায় আন্তর্জাতিক জীবাশ্মসংক্রান্ত সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করে লজটি। 

বর্তমানে লজটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে মে’র শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। জালসা জানান, বার্ষিক পর্যটন মৌসুম কিছুটা হলেও সম্প্রসারণ করতে মঙ্গোলিয়া সরকারের সহায়তা আশা করেন তারা। 

থ্রি কেমেল লজের একটি কামরার অন্দরমহলে। ছবি: ট্রিপ অ্যাডভাইজরজালসা সিএনএনকে জানান, মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটার থেকে গাড়িতে মোটামুটি সাত-আট ঘণ্টার দূরত্ব গোবি মরুভূমির এই লজ। সাধারণ পর্যটকেরা এত লম্বা সময়ের ভ্রমণ পছন্দ নাও করতে পারেন। তবে গোবি মরুভূমির দিকে উড়োজাহাজেও যাওয়া যায়। গভীর রাতের এই ফ্লাইট দালানজাদগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছে সূর্যোদয়ের সময়। তারপর মরুভূমি ধরে আরও এক ঘণ্টার মতো যাত্রার পর দূরে একটি মরূদ্যানের মতোই ধরা দেবে লজটি। 

গোবির থেকে বের হওয়াটা আরও বেশি জটিল। রাজধানীর দিকের ফ্লাইট স্বল্প সময়ের নোটিশে বাতিল হওয়াটা রীতিমতো সাধারণ এক ঘটনা। শীতে ফ্লাইটের সংখ্যা থাকে স্বাভাবিকভাবেই কম। 

তবে কথা হলো, একবার যদি আপনি থ্রি কেমেল লজে পৌঁছে যান, সেখানকার বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা আর মরুর অসাধারণ সৌন্দর্য মুগ্ধ করবে আপনাকে। তখন পথের কষ্টটা নিয়ে আর আক্ষেপ থাকবে না মোটেই।

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত