Ajker Patrika

এক দিনের খৈয়াছড়া ভ্রমণ

প্রকৃতির কোলে স্বর্গীয় অনুভব

রাব্বি মিয়া
প্রকৃতির কোলে স্বর্গীয় অনুভব

ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে ১২টা ছুঁই ছুঁই। আমি আর তানিম শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে ধীরে ধীরে গতি নিতে থাকা ট্রেনে উঠে পড়ি। গন্তব্য ফেনী। জানালার বাইরে ভেসে চলা চা-বাগান, অন্ধকারাচ্ছন্ন কুয়াশায় মোড়া সবুজ পথ আর ছায়াময় বনভূমি যেন আমাদের আগেই খৈয়াছড়ার গহিনে নিয়ে যেতে চাইছিল। এই নীরব প্রস্তুতিই বলে দিচ্ছিল, সামনে অপেক্ষা করছে এক দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।

ভোর ৫টার দিকে আমরা সবাই ফেনী স্টেশনে নামলাম। স্টেশনে পা রাখতেই এক আলাদা অনুভূতি বুকজুড়ে বাজতে থাকে। সেই ভোরে নামাজসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করে আমরা গেলাম মহিপাল বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ঢাকা থেকে আসা কয়েকজন

বন্ধু সেখানে আমাদের অপেক্ষায় রয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর স্থানীয় রেস্টুরেন্টে নাশতা খেয়ে বাসে চড়ে যাত্রা শুরু করি মিরসরাইয়ের দিকে। এর ৪০ মিনিট পর মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের আগে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের কাছে পৌঁছে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ছুটলাম সেই স্বপ্নীল গন্তব্যের দিকে—খৈয়াছড়া জলপ্রপাত। আকার, আকৃতি ও গঠনশৈলীর দিক দিয়ে এই জলপ্রপাত নিঃসন্দেহে এখনো দেশের বড় ও মনোমুগ্ধকর ঝরনাগুলোর একটি। শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে সবুজের নিবিড় আলিঙ্গনে হারিয়ে যাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পৌঁছালাম খৈয়াছড়ার প্রবেশপথে।

খৈয়াছড়া—নামটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে সবুজে ঘেরা পাহাড় আর ঝিরিঝিরি জলের অবিরাম ধারা। এখানে এলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায় পাহাড়ি বাতাসে। চারপাশের নিস্তব্ধতা আর পাখির কলতান এক পবিত্রতম অনুভূতি এনে দিল। ঘন জঙ্গল, আকাশছোঁয়া বিশাল বৃক্ষরাজি আর অজস্র লতাপাতা মিলে এক সবুজ গালিচায় ঢেকে রেখেছে চারপাশ। আমরা ঝিরিপথের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। এটি কোনো মসৃণ পথ নয়। পুরোটাই পাথুরে আর আঁকাবাঁকা। কোথাও পিচ্ছিল কাদা, কোথাও হাঁটু পর্যন্ত শীতল জল, আবার কোথাও বিশাল পাথরের চাঁই ডিঙিয়ে যেতে হচ্ছিল।

অসংখ্য পশুপাখির দল গাছের ডালে ডালে চঞ্চলভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ছোটাছুটি আর দুষ্টুমি দেখে মনটা আরও সতেজ হয়ে উঠল। পথের দুই ধারে বুনোফুলের সমারোহ আর অচেনা সব পাখির কিচিরমিচিরে এক দারুণ ছন্দ তৈরি হয়ে আছে চারদিকে। খৈয়াছড়া ঝরনার কাছে পৌঁছার আগে অতিক্রম করতে হয় নয়টি ধাপ। প্রতিটি ধাপেই প্রকৃতির এক নতুন ও সতেজ রূপের দেখা মেলে। ছোট ছোট ঝরনার ধারাগুলো যেন একেকটি শিল্পকর্ম। পাথরের গা বেয়ে নেমে আসা জলের শব্দ কানে এক মধুর সুরের মতো বাজছিল। এই ঝরনায় অনেকগুলো ধাপ আছে, যেগুলো দেশের আর কোনো ঝরনায় এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। তাই খৈয়াছড়াকে বলা হয় ‘ঝরনার রানি’।

ঝরনার কাছে যাওয়ার আগে অনেকগুলো দোকান আছে। ছোট একটা ব্যাগ ছাড়া বাকি সবকিছু আমরা দোকানির কাছে জমা রাখলাম। সেখানে আবার গোসলের ব্যবস্থা আছে। দোকানগুলোতে অগ্রিম খাবারের অর্ডার করে রেখে যেতে হয়, রেডিমেড খাবার পাওয়া যায় না। আমরা দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে ঝিরিপথ, গিরিপথ ও পাহাড় বেয়ে ওঠার জন্য ২০ টাকা করে কয়েকটি ৫-৬ ফুট লম্বা চিকন বাঁশ কিনলাম। আরও কিনলাম পায়ে পরার জন্য ১০ টাকা দামের এক জোড়া হেলমেটজাতীয় চটি। এই চটি পরে পিচ্ছিল জায়গা সহজে পার হওয়া যায়। এই সামান্য প্রস্তুতিই আমাদের কঠিন পথের পাথেয় হয়ে উঠল।

কথিত আছে, শত বছর ধরে এই ঝরনা তার আপন গতিতে বয়ে চলেছে। মানুষের অগোচরেই সে তার সৌন্দর্য মেলে ধরেছিল। বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলকে ইকো-ট্যুরিজম প্রকল্পের আওতায় এনে সংরক্ষণ ও পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছে।

আমরা খৈয়াছড়া ঝরনার প্রথম ধাপটি পেরিয়ে ওপরে ওঠার জন্য প্রস্তুত হলাম।

শুধু লাঠির সাহায্যেই নয়, কোথাও কোথাও খাড়া পাথরের গা বেয়ে রশি ধরে ওপরে উঠতে হয়েছে। প্রতিটি ধাপ ছিল যেন এক একটি চ্যালেঞ্জ। মনে হলো, এখান থেকেই শুরু আমাদের অভিযাত্রার সত্যিকারের পরীক্ষা। ওপর থেকে নিচে তাকাতে রীতিমতো ভয় লেগেছে। মনে হয়েছে, যেন অতল গহ্বর হাতছানি দিচ্ছে! পাহাড়ের বুক চিরে সাদা ফেনার মতো জলধারা নেমে আসছে অবিরাম—সেই দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝা কঠিন।

অবশেষে যখন খৈয়াছড়ার শীর্ষে পৌঁছালাম, তখন শরীর পুরোপুরি ক্লান্ত। প্রতিটি পেশি যেন বিদ্রোহ করছে। তবে এতটুকু উচ্চতায় উঠে আসাটাই যেন এক বিশাল জয়, এক অসাধারণ প্রাপ্তি। চূড়ায় পৌঁছে কিছুক্ষণ শুয়ে বিশ্রাম নিলাম, প্রাণভরে ঝরনার স্ফটিক শীতল জলে গোসল করলাম।

প্রকৃতির রূপসুধা পান করে, প্রতিটি ধাপের সৌন্দর্য উপভোগ করে আবার যখন আমরা নিচে নামতে শুরু করলাম, ঘড়িতে তখন বেলা ১১টা বাজে। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলেছে আমাদের এই অভিযান। নামার পথও ছিল সমান চ্যালেঞ্জিং। এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে নিচের দোকানের বেঞ্চে বসার বদলে শরীর এলিয়ে শুয়েই পড়তে হলো! ক্লান্তির এমন অনুভূতি সচরাচর হয় না, কিন্তু সেই ক্লান্তিও যেন আনন্দের অংশ হয়ে গিয়েছিল।

3

অবশেষে হোটেলে ফিরে গোসল সেরে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করা হলো। তারপর দুপুরের খাবার। এখানকার খাবারের মান বেশ ভালো। পেট ভরে খেয়ে, দীর্ঘক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বেলা দু্ইটার দিকে বের হলাম। এখন আর শরীরে ক্লান্তি নেই।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল মনোমুগ্ধকর বাওয়াছড়া লেক। সেখানে নৌকা ভ্রমণ করে লেকের শান্ত জলে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন রকম। সবুজ পাহাড়ের মাঝে লেকের স্বচ্ছ জল, আর তার ওপর ভেসে চলা নৌকা! যেন এ এক স্বপ্নের দেশ। সূর্যাস্তের আলোয় বাওয়াছড়ার সৌন্দর্য আরও মায়াবী হয়ে ওঠে।

এক দিনের এই ভ্রমণ স্মৃতিতে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে গেল। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এই অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ। এই নীরব সৌন্দর্য, এই স্নিগ্ধ বাতাস আর জলের অবিরাম গর্জন—সব মিলিয়ে এ এক অন্য জগৎ। যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন এবং প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে চান, তাঁদের জন্য খৈয়াছড়া হতে পারে আদর্শ গন্তব্য।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে উঠে নামতে হবে মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের কাছে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে। এটি সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার যাত্রা। বাসের চালক বা সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে রাখলে তাঁরা নামিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন সঠিক জায়গায়। বড়তাকিয়া বাজার থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত রিকশা দিয়ে খৈয়াছড়া ঝরনার কাছে যাওয়া যায়।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারে গিয়ে সেখান থেকে খৈয়াছড়ায় যাওয়া যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

কৌশলে বিনিয়োগ সরাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি

বিমান বিধ্বস্ত: এক ঘণ্টা পর উদ্ধার হন পাইলট, তখনো বেঁচে ছিলেন

মোহাম্মদপুর থানায় ভুক্তভোগীকে হেনস্তা: চার পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার, ৩ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার

‘ওসি হয়েও আমার কম দামি ফোন, দামি ফোন নিয়ে ঘুরলে ছিনতাই তো হবেই’, ভুক্তভোগীকে মোহাম্মদপুরের ওসি

রংপুরের ১০ কিমি সড়কে ৩৬৫ টন পাথর উধাও

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত