Ajker Patrika

নান্দনিকতার দিন শেষ, ফ্যাশনে এখন যেমন খুশি তেমন সাজো

আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২: ৫৯
নান্দনিকতার দিন শেষ, ফ্যাশনে এখন যেমন খুশি তেমন সাজো

বিশ্বব্যবস্থা এখন বিশৃঙ্খলার চূড়ায়। মানুষের হাতে নান্দনিকতা নিয়ে অতকিছু ভাবার আর সময় নেই! ফ্যাশনের দুনিয়াতে এই অস্থির সময়ের গুরুতর প্রভাব ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। বিষণ্নতার ভারে উন্নাসিকতা ভর করছে সচেতন সংবেদনশীল মানুষের মনে। ফলে পোশাকে চলনে আর সচেতন রুচির ছাপ নেই। ফ্যাশন চলছে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ স্টাইলে! 

অবশ্য ফ্যাশন জগতে অদ্ভুত পোশাকের চল আসা নতুন নয়। নামি ফ্যাশন শোগুলোতে অদ্ভুত পোশাক–আশাক দেখে কেউ হাসেন, কেউ অভিভূত হন, কেউ দেখতে পান ভবিষ্যৎ। 

কিন্তু ইদানীং ফ্যাশনে যা চলছে তা অদ্ভুতুড়ের সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরের ফ্যাশন শোগুলোতে প্রথম দেখা যায় এমনসব বিভ্রান্তিকর পোশাক যা ঠিক স্বাভাবিক মনে হবে না। 

জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউস ক্লোইয়ের পোশাকে ছিল অসংখ্য ছিদ্র, মারনির কুশিকাটা টপসের প্রান্তগুলো ছেঁড়া, হ্যান্ডব্যাগ দিয়ে তৈরি জিভনশি অন্তর্বাস, আর প্রায় প্রত্যেক শোতেই ট্রাউজারগুলো এত চওড়া এবং দীর্ঘ যে পরনের জুতা প্রায় অদৃশ্য। 

বলা হয়, ফ্যাশন ট্রেন্ড দিয়ে ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অবস্থা আন্দাজ করা যায়। হেমলাইন ইনডেক্স তত্ত্ব অনুসারে, অর্থনৈতিক অবস্থা যত ভালো হতে থাকে, স্কার্টের দৈর্ঘ্য তত কমতে থাকে। 

তবে সব সময় যে এ ধারণা ঠিক হবে তা নয়। কখনো একটা স্কার্ট কেবল একটা স্কার্টই। পুরুষের অন্তর্বাস বিক্রির পরিমাণ কখনোই অর্থনৈতিক অবস্থার সঠিক নির্দেশক হতে পারে না। তবে ফ্যাশন শোতে মডেলদের পায়ের নিচে লুটিয়ে পড়া ভীষণ দর্শন আজানুলম্বিত পোশাক দেখে মনে হয়, যেন তারা বলতে চাইছে বিশ্বের অর্থনীতিও এভাবে লুটিয়ে পড়বে!

ট্রেন্ড আসবে যাবে। তবে খেলাধুলা, সংগীত, শিল্প ও পোশাকে আমাদের সমাজের ছাপ রয়ে যায়। এখন মানুষ আর সমাজ বা সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখে পোশাক পরে না। কিংবা পোশাকে ব্যক্তিত্বের ছাপ রাখার চেষ্টাও করে না। তারা তা–ই পরে যা তাদের মন চায়। অর্থাৎ পোশাক হলো তার বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিফলন।

যেমন: হুটহাট কোনো সেলিব্রেটিকে এখন মাংসের পোশাক, পাতার পোশাক, কাগজের পোশাক অথবা অদ্ভুত ডিজাইনের ও রঙের পোশাক পরে জনসমক্ষে হাজির হতে দেখা যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে এমন অদ্ভুত ফ্যাশনের আইকনে পরিণত হয়েছেন উরফি জাভেদ। তিনি নিয়মিত পত্রিকাগুলোর বিনোদন বিভাগে স্থান পাচ্ছেন। এমন পোশাক পরে আলোচনায় এসেছেন সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা, হলিউড অভিনেত্রী কেটি হোমস, জুলিয়া ফক্সের মতো তারকারাও। 

এই প্রবণতা থেকেই ফ্যাশনে সম্ভবত ‘শ্লাম্পি’ শব্দটি এসেছে। বাংলায় কাছাকাছি অনুবাদ হতে পারে ‘আলুথালু’! এর একটি দারুণ উদাহরণ হতে পারে এইচবিও টিভি সিরিজ ‘হোয়াইট লোটাস’–এর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পোর্শিয়া। দ্বিতীয় সিরিজের তুমুল বিশৃঙ্খলা যেন তাঁর গায়ে মাখামাখি করে আছে। একেক সময় শরীরজুড়ে লেপ্টে থাকা খণ্ড খণ্ড পোশাক যেন পোর্শিয়ার একেকটি মোড, তাঁর পরিপার্শ্বের প্রতিনিধি। তাঁর যেন নির্দিষ্ট কোনো চরিত্র নেই, একজন তরুণী, যে অসংখ্য মানসিক অবস্থার সমষ্টি! একটি আকনিক দৃশ্যে পোর্শিয়ার পরনে দেখা যায়—বেখাপ্পা বিকিনি টপ এবং স্ট্র্যাপলেস ব্রায়ের ওপর একটি ক্ষুদ্র কার্ডিগান। আপাত কপর্দকহীন, কিন্তু নিজেই সর্বেসর্বা—এই সময়ের তরুণ–তরুণীদের চাক্ষুষ প্রতিনিধি পোর্শিয়া। 

ফ্যাশনের এই ধরনের জগাখিচুড়ির কথা কিন্তু ২০২১ সালেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক ও ট্রেন্ডের ভাষ্যকার শান মোনাহান। সাবস্টেক প্ল্যাটফর্মে ‘ভাইব শিফট’ নামে একটি নিবন্ধে এসবের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। যেখানে বলেছিলেন, হঠাৎ করেই মানুষ বহু বছর আগের ফ্যাশনের পোশাক পরা শুরু করে। বর্তমানের এলোমেলো এই ফ্যাশন সে ভাইব শিফটের অংশ হতে পারে। মোনাহান বলেন, ‘আমরা নতুন এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছি।’ 

হুটহাট পুরোনো ফ্যাশন, পুরোনো গান, পুরোনো কৌতুক নতুন করে তোলপাড় তুলছে। স্পষ্টত কেউই ভেবেচিন্তে কিছু করছে না। কেউ একজন হাত ধরে শিখিয়ে দেবে সে অপেক্ষায় আর কেউ বসে থাকছে না। 

এই প্রবণতায় জ্বালানি সরবরাহ করছে সোশ্যাল মিডিয়া। বিশেষ করে টিকটকের মতো শর্ট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম। হাতের নাগালে ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার সুপরিকল্পিত অ্যালগরিদম সে অর্থে নতুন কিছু দিচ্ছে না। সবার হাতেই আছে বা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবচেতনেই চর্চা বা ব্যবহার করে যাচ্ছে এমন কোনো জিনিসের প্রতি মানুষের অন্তর্নিহিত পক্ষপাতিত্বকে উসকে দিচ্ছে এই অ্যালগরিদম। ফলে হুটহাট সমাজে অর্থহীন প্রবণতার জন্ম দিচ্ছে। 

খুব পরিপাটি না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের পোশাকের ছবি দেখলে মনে হয় এগুলো বিশেষ ফ্যাশন সচেতন কোনো গোষ্ঠীর পোশাক। তবে অর্থনীতি ও আবহাওয়ার কথা ভাবলে এ ধরনের সাজ শুধু ব্যয়বহুলই নয়, উদ্ভটও বটে। 

প্রচলিত সামাজিক রীতি বা প্রত্যাশাকে অস্বীকার করে এমন ফ্যাশন ইচ্ছাকৃত খামখেয়ালিপনাকেই নির্দেশ করে। 

এই পুরো প্রবণতাকে সুনিপুণভাবে এক শব্দে বর্ণনা করতে অক্সফোর্ডে যুক্ত হয়েছে নতুন শব্দবন্ধ—গবলিন মোড। এটিই নতুন প্রজন্মের নিত্যদিনের মানসিকতা। প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ও প্রত্যাশাকে সচেতনভাবে এককথায় প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা ভয়ানকভাবে বেড়েছে। সেই প্রভাব পোশাকে ও চলনে–বলনে স্পষ্ট। বিষয়টি শুনতে অস্বস্তিবোধ হলেও এটি সত্য। কিম কার্দাশিয়ানের কোমর, রাতাইকোওস্কির অ্যাবস অথবা ঐশ্বরিয়ার চোখের দিকে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হয়তো আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি! নতুন কিছু চাই!

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত