ইমরান খান
মীম কাঁদছে। এই পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ না থাকার বেদনায় তার এ কান্না। মাত্রই ২৬টি লাশের সারি থেকে মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ শনাক্তের দগদগে ক্ষত তৈরি হয়েছে নয় বছরের এ শিশুর বুকে। ব্যাগ আঁকড়ে ডুবতে ডুবতে নিজে বেঁচে গেলেও সর্বনাশা পদ্মায় তার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার এ বেদনা, অশ্রু সবাইকে স্পর্শ করেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা, প্রশ্ন খুঁজে পান না সাংবাদিকেরা।
দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে খুলনার তেরখাদায় যাওয়ার পথে ৩ মে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়িতে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় জীবনের এ মর্মান্তিক বাঁকে এসে দাঁড়াতে হয়েছে নয় বছরের মীমকে। কাঁদতে কাঁদতে মীমের শরীর শিথিল হয়ে আসে, কান্না বন্ধ হয়; আবার ফুঁপিয়ে শুরু হওয়া কান্না বিলাপ পর্যন্ত গিয়ে থামে। কান্না ছাড়া তার আর কী–বা করার আছে?
কান্না এমনই। কান্নার কাছে `আকবর বাদশা থেকেহরিপদ কেরানি' কারও ভেদ নেই। সত্যিই কি ভেদ নেই? মোঘল সম্রাট আকবর কি সত্যিই কাঁদতেন? সম্রাট আকবর তো ইতিহাসের পাতার আড়ালে লুকিয়েছেন। তাঁর কান্নার হদিস নেওয়া তাই কঠিনই বটে। মহারানি ভিক্টোরিয়ার যুগও গত। তবে আছেন একজন। মহারানি এলিজাবেথ। আচ্ছা ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ কি কাঁদেন?
এত দিন এই প্রশ্নের উত্তর অজানা ছিল। ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে রানির অশ্রুসিক্ত চোখ বিশ্বকে এই প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিল। রানির দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই ছবির ক্যাপশন লিখেছেন, ‘আজ কোনো প্রটোকল নেই, রানি কাঁদছেন।’
এই কান্না স্বামী হারানোর, সাত দশকের জীবনসঙ্গীর বিদায়ের। এ অশ্রু এক বিশ্বস্ত সঙ্গীর সাহচর্য হারানোর বেদনার। এ কান্না এমন মর্মবেদনার, যা থামিয়ে রাখতে ৭৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী কোনো সংখ্যাই নয়। এ যেন রানির ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিতে উৎপন্ন সব পানি চোখ থেকে উপচে পড়ার প্রতিজ্ঞার ফল।
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপ গত ৯ এপ্রিল মারা গেলেন, ১৭ এপ্রিল হলো তাঁর শেষকৃত্য। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সম্ভবত প্রথমবারের মতো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে কাঁদতে দেখল বিশ্ব। ফিলিপের সঙ্গে রানির বহু হাস্যোজ্জ্বল ছবির পাশে রানির এ অশ্রুসজল চোখ যে কারও মনে ধাক্কা দেয়। একইসঙ্গে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়—কান্না সর্বজনীন; সবাই কাঁদে।
অশ্রু কী?
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী—আবেগ, অসুস্থতা বা ব্যথার কারণে চোখ থেকে প্রবাহিত নোনতা তরলের ফোঁটাকে অশ্রু বলে। আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট বিজ্ঞানবর্তিকা বলছে—অশ্রু হচ্ছে পানি, লবণ, কিছু অ্যান্টিবডি ও কিছু অ্যান্টি–মাইক্রোবেয়াল এজেন্টের সংমিশ্রণ, যা মানুষের চোখের ঠিক পাশে থাকা অশ্রু গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়।
আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজি ওয়েবসাইটের ফ্যাক্টস অ্যাবাউট টিয়ারস বলছে, বেসল অশ্রু চোখের কর্নিয়াকে ভেজা ও সুরক্ষিত রাখে। চোখে ধোঁয়া, ধূলিকণা বা অন্যকিছু গেলে, তা ধুয়ে ফেলার জন্য উৎপন্ন হয় রিফ্লেক্স অশ্রু।
মানুষ, গরিলা ও হাতির শরীরে আবেগময় অশ্রু নামে আরেক ধরনের অশ্রু পাওয়া যায়। নানা ধরনের মানসিক উত্তেজনা প্রশমনে এ অশ্রু নিঃসৃত হয়। এ অশ্রুতে থাকা বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেস হরমোন ন্যাচারাল পেইন কিলার হিসেবে কাজ করে বলেও উল্লেখ করেছে বিজ্ঞানবর্তিকা।
বৈচিত্র্যময় কান্না
কান্নার ধরনে অনেক বৈচিত্র্য আছে। এর মধ্যে মায়া কান্না, চাপা কান্না, বিলাপ করে কান্না, মাতম করে কান্না অন্যতম। অনেকের সামান্য কান্নায় অশ্রুতে চিবুক ভিজে যায়। অনেকে জোরে শব্দ করে বিলাপ করলেও অশ্রুর দেখা মেলে না। কারও কান্নায় শব্দহীন অশ্রু ঝরে, কেউ আবার জনসম্মুখে না কেঁদে একাকী বালিশ ভেজায়।
কে কতবার কাঁদে, তা নিয়েও আছে গবেষণা। আলজেইমার্স রিসার্চ সেন্টারের বর্তমান পরিচালক উইলিয়াম ফ্রে ১৯৮০ সালে এ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। মার্কিন এই প্রাণরসায়নবিদ তাঁর গবেষণায় দেখান, নারীরা মাসে গড়ে ৫ দশমিক ৩ বার কাঁদে। অন্যদিকে পুরুষ কাঁদে মাসে ১ দশমিক ৩ বার। ২০১১ সালে সেইজ জার্নালসে প্রকাশিত এক গবেষণায়ও একই ফল উঠে এসেছে। গবেষণায় দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশের নাগরিকদের কান্নার হার বেশি বলেও তথ্য উঠে আসে।
মানুষ কেন কাঁদে?
মানুষ নানা কারণে কাঁদতে পারে। নানা কারণে চোখে অশ্রু আসতে পারে। শারীরিক ব্যথা, মানসিক দুঃখ, ক্রোধ বা ভয়ে অনেকে কাঁদেন। অনেকর সুখ প্রকাশের মাধ্যমও অশ্রু। বাংলা চলচ্চিত্রে নায়কের সাফল্যে তাঁর মায়ের উক্তি, ‘আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে’ বলে কেঁদে ফেলার দৃশ্যও কোনো বানোয়াট বিষয় নয়। বাস্তব জীবনেও এমন দৃশ্য দেখা যায়। ফল প্রকাশের দিন জিপিএ ৫ পেয়ে মাকে জড়িয়ে কান্নার দৃশ্যও উঠে আসছে পত্রিকার পাতায়। আমাদের নিজের জীবনেও এমন ঘটনা হয়তো অনুপস্থিত নয়।
এই যেমন মন ভাঙায় বেশ কয়েকবারই কেঁদেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তাহুরা তাবাসসুম (২৩)। কখনো খুশি, আবার কখনো হতাশা থেকে তাঁর অশ্রু ঝরেছে। তবে কান্না তাঁর মনের নেতিবাচকতা দূর করে মন ফ্রেশ করেছে; সুন্দর করে নতুন চিন্তা করতে সহায়তা করেছে।
আবার একাকীত্ব বা দুর্ভাবনাও হতে পারে কান্নার কারণ। নতুন চাকরির দ্বিতীয় মাসে করোনা আক্রান্ত হন নাবিউল বাপ্পি (২৮)। কিছুদিন আগে পিতৃবিয়োগ, অফিসে যেতে না পারা, অসুস্থতা, ঘর থেকে বের হতে না পারা মিলে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কান্না চলে আসে। কান্না শেষে হাত–মুখ ধুয়ে এলে নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয়েছে বলে তিনি জানান।
আবার অন্যের জন্য নয়, মেহেরুন নাহার মেঘলা (২৫) কাঁদেন একান্তই নিজের জন্য। এতে চাপ কমে, চোখ পরিষ্কার হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কান্না পেলে কাঁদাই উপকারী বলে মনে করেন এ তরুণী। আর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আসমা ইসলাম (২৪) কাঁদেন রাগ, অভিমান, দুঃসংবাদের জেরে। বললেন, `কান্না আমাকে মানসিক স্থিতিশীলতা দিয়েছে, ভারাক্রান্ত মনে স্বস্তি জুগিয়েছে, সহজে কষ্ট ভুলতে সহায়তা করেছে।’
মূলত মনের ভাব প্রকাশের জন্যই মানুষ কাঁদে। পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেক সময় অনিচ্ছায়ও কান্না চলে আসে। হেলথলাইন ডটকমে কান্নার ছয়টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে—
* অন্যের সহায়তা পেতে কান্না বেশ সহায়ক। ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়—কেঁদে সাহায্য চাওয়া লোকেদের সাহায্য পাওয়ার হার বেশি।
* রোগের যন্ত্রণা কমাতে কান্না সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, কান্নায় শরীরে এন্ডোরফিনস ও অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। এসব উপাদান মানসিক কষ্টের পাশাপাশি শারীরিক কষ্ট দূর করতে সহায়তা করে। দীর্ঘস্থায়ী ও সাময়িক রোগের যন্ত্রণায় কান্না সাময়িক স্বস্তি দেয়।
* সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা আছে। একজনকে কাঁদতে দেখলে অনেকে তার পাশে দাঁড়ায়; কান্নার কারণ জানতে চায়। এতে সমাজের মানুষের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
* কোনো অনুভূতি চরম আকার ধারণ করলে, তা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ কাঁদে। দুঃখ, অপরাধবোধ, উদ্বেগ, প্রেম, আনন্দ, কৃতজ্ঞতার মতো বহু আবেগ এমন চরম আকার ধারণ করতে পারে।
* মানুষ অনেক সময় অন্যের অনুভূতির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। একে সহানুভূতি, সমানুভূতি বলা যায়। এ ধারণার মূল কথা হলো অন্যের পরিস্থিতি দেখে বা ওই পরিস্থিতিতে নিজেকে চিন্তা করেও কান্না আসতে পারে। মৃতের বাড়িতে প্রতিবেশীর কান্না এর একটি উদাহরণ।
* দাবি আদায়ের জন্য অনেকে কাঁদেন। পরিবারের সদস্যদের অনেক দাবি সহজে পূরণ না হলে কেঁদে দাবি আদায়, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জনগণের কাছে কান্নাবিজড়িত আহ্বান, সৃষ্টিকর্তার কাছে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে অপরাধের ক্ষমা ও নতুন কিছু চাওয়া এর উদাহরণ। ‘না কাঁদলে মা–ও দুধ দেয় না’ তো প্রবাদই হয়ে গেছে।
কান্নাতন্ত্র
পুরুষতান্ত্রিক দেশে পুরুষদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়—কান্না পুরুষের জন্য নয়। ছেলেরা আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে ‘এটুকু ব্যাথায় পুরুষ মানুষের কী হয়’, বলে কান্না থামানোর রেওয়াজও বেশ প্রচলিত। ছোটবেলা থেকে এই ধারণা মনে গেঁথে যাওয়ায় পরবর্তী জীবনেও এর প্রভাব থাকে। হয়তো তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া কর্তাকেও কাঁদতে দেখা যায় না।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশের লোকেদের কান্নার প্রবণতা বেশি। এর পেছনেও আছে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। ধনী দেশের চেয়ে দরিদ্র দেশের নাগরিকেরা সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে বলে এমন হয়।
কান্না কি শেখানোর বিষয়?
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখানো হয়, প্রথাগতভাবে জাপানিদের কান্না নিষিদ্ধ। ছোটবেলা থেকে তাদের না কাঁদতে শেখানো হয়। এটি হয়তো শ্রেষ্ঠত্বের ধারণারই প্রতীক। কিন্তু দেশটির মনোবিদ ও কান্নার প্রশিক্ষক (ক্রায়িং থেরাপিস্ট) হিদেফুমি ইওশিদা মনে করেন, এটা ঠিক নয়। তাঁর মতে, না কাঁদতে পারাটা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কান্না মানুষকে চাপা যন্ত্রণা থেকে সান্ত্বনা দেয়, মন ভালো করে। মানুষের যত অনুভূতি আছে, তার মধ্যে কান্না আসল সত্তাকে বের করে আনে। তাই মানুষকে কান্না করা শেখাতে সেমিনার করছেন ইওশিদা। গত আট বছরে তাঁর প্রচেষ্টায় প্রায় ৫০ হাজার লোকের চোখে পানি এসেছে। মানুষকে কাঁদাতে তিনি সিনেমা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, চিঠি ও বই ব্যবহার করেন।
কান্না পেলে কাঁদুন
আবেগ ও ভালো থাকা নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন নেদারল্যান্ডসের টিলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিঞ্জারহয়েটস। তাঁর মতে, সাধারণভাবে অনেক মনোবিদই মনে করেন কান্না দমিয়ে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন, ‘বেশির ভাগ লোকই মনে করেন কান্না মনকে হালকা করে। তবে কারও কাছে তাঁর সর্বশেষ কান্নার কারণ জানতে চাইলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মন খারাপ হয়ে যায়।’
মীম কাঁদছে। এই পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ না থাকার বেদনায় তার এ কান্না। মাত্রই ২৬টি লাশের সারি থেকে মা-বাবা ও দুই বোনের লাশ শনাক্তের দগদগে ক্ষত তৈরি হয়েছে নয় বছরের এ শিশুর বুকে। ব্যাগ আঁকড়ে ডুবতে ডুবতে নিজে বেঁচে গেলেও সর্বনাশা পদ্মায় তার অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তার এ বেদনা, অশ্রু সবাইকে স্পর্শ করেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা, প্রশ্ন খুঁজে পান না সাংবাদিকেরা।
দাদার মৃত্যুর খবর পেয়ে খুলনার তেরখাদায় যাওয়ার পথে ৩ মে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়িতে স্পিডবোট দুর্ঘটনায় জীবনের এ মর্মান্তিক বাঁকে এসে দাঁড়াতে হয়েছে নয় বছরের মীমকে। কাঁদতে কাঁদতে মীমের শরীর শিথিল হয়ে আসে, কান্না বন্ধ হয়; আবার ফুঁপিয়ে শুরু হওয়া কান্না বিলাপ পর্যন্ত গিয়ে থামে। কান্না ছাড়া তার আর কী–বা করার আছে?
কান্না এমনই। কান্নার কাছে `আকবর বাদশা থেকেহরিপদ কেরানি' কারও ভেদ নেই। সত্যিই কি ভেদ নেই? মোঘল সম্রাট আকবর কি সত্যিই কাঁদতেন? সম্রাট আকবর তো ইতিহাসের পাতার আড়ালে লুকিয়েছেন। তাঁর কান্নার হদিস নেওয়া তাই কঠিনই বটে। মহারানি ভিক্টোরিয়ার যুগও গত। তবে আছেন একজন। মহারানি এলিজাবেথ। আচ্ছা ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ কি কাঁদেন?
এত দিন এই প্রশ্নের উত্তর অজানা ছিল। ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে রানির অশ্রুসিক্ত চোখ বিশ্বকে এই প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দিল। রানির দুচোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই ছবির ক্যাপশন লিখেছেন, ‘আজ কোনো প্রটোকল নেই, রানি কাঁদছেন।’
এই কান্না স্বামী হারানোর, সাত দশকের জীবনসঙ্গীর বিদায়ের। এ অশ্রু এক বিশ্বস্ত সঙ্গীর সাহচর্য হারানোর বেদনার। এ কান্না এমন মর্মবেদনার, যা থামিয়ে রাখতে ৭৩০ জন নিরাপত্তাকর্মী কোনো সংখ্যাই নয়। এ যেন রানির ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিতে উৎপন্ন সব পানি চোখ থেকে উপচে পড়ার প্রতিজ্ঞার ফল।
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপ গত ৯ এপ্রিল মারা গেলেন, ১৭ এপ্রিল হলো তাঁর শেষকৃত্য। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে সম্ভবত প্রথমবারের মতো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে কাঁদতে দেখল বিশ্ব। ফিলিপের সঙ্গে রানির বহু হাস্যোজ্জ্বল ছবির পাশে রানির এ অশ্রুসজল চোখ যে কারও মনে ধাক্কা দেয়। একইসঙ্গে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়—কান্না সর্বজনীন; সবাই কাঁদে।
অশ্রু কী?
অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী—আবেগ, অসুস্থতা বা ব্যথার কারণে চোখ থেকে প্রবাহিত নোনতা তরলের ফোঁটাকে অশ্রু বলে। আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট বিজ্ঞানবর্তিকা বলছে—অশ্রু হচ্ছে পানি, লবণ, কিছু অ্যান্টিবডি ও কিছু অ্যান্টি–মাইক্রোবেয়াল এজেন্টের সংমিশ্রণ, যা মানুষের চোখের ঠিক পাশে থাকা অশ্রু গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়।
আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজি ওয়েবসাইটের ফ্যাক্টস অ্যাবাউট টিয়ারস বলছে, বেসল অশ্রু চোখের কর্নিয়াকে ভেজা ও সুরক্ষিত রাখে। চোখে ধোঁয়া, ধূলিকণা বা অন্যকিছু গেলে, তা ধুয়ে ফেলার জন্য উৎপন্ন হয় রিফ্লেক্স অশ্রু।
মানুষ, গরিলা ও হাতির শরীরে আবেগময় অশ্রু নামে আরেক ধরনের অশ্রু পাওয়া যায়। নানা ধরনের মানসিক উত্তেজনা প্রশমনে এ অশ্রু নিঃসৃত হয়। এ অশ্রুতে থাকা বিভিন্ন ধরনের স্ট্রেস হরমোন ন্যাচারাল পেইন কিলার হিসেবে কাজ করে বলেও উল্লেখ করেছে বিজ্ঞানবর্তিকা।
বৈচিত্র্যময় কান্না
কান্নার ধরনে অনেক বৈচিত্র্য আছে। এর মধ্যে মায়া কান্না, চাপা কান্না, বিলাপ করে কান্না, মাতম করে কান্না অন্যতম। অনেকের সামান্য কান্নায় অশ্রুতে চিবুক ভিজে যায়। অনেকে জোরে শব্দ করে বিলাপ করলেও অশ্রুর দেখা মেলে না। কারও কান্নায় শব্দহীন অশ্রু ঝরে, কেউ আবার জনসম্মুখে না কেঁদে একাকী বালিশ ভেজায়।
কে কতবার কাঁদে, তা নিয়েও আছে গবেষণা। আলজেইমার্স রিসার্চ সেন্টারের বর্তমান পরিচালক উইলিয়াম ফ্রে ১৯৮০ সালে এ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। মার্কিন এই প্রাণরসায়নবিদ তাঁর গবেষণায় দেখান, নারীরা মাসে গড়ে ৫ দশমিক ৩ বার কাঁদে। অন্যদিকে পুরুষ কাঁদে মাসে ১ দশমিক ৩ বার। ২০১১ সালে সেইজ জার্নালসে প্রকাশিত এক গবেষণায়ও একই ফল উঠে এসেছে। গবেষণায় দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশের নাগরিকদের কান্নার হার বেশি বলেও তথ্য উঠে আসে।
মানুষ কেন কাঁদে?
মানুষ নানা কারণে কাঁদতে পারে। নানা কারণে চোখে অশ্রু আসতে পারে। শারীরিক ব্যথা, মানসিক দুঃখ, ক্রোধ বা ভয়ে অনেকে কাঁদেন। অনেকর সুখ প্রকাশের মাধ্যমও অশ্রু। বাংলা চলচ্চিত্রে নায়কের সাফল্যে তাঁর মায়ের উক্তি, ‘আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে’ বলে কেঁদে ফেলার দৃশ্যও কোনো বানোয়াট বিষয় নয়। বাস্তব জীবনেও এমন দৃশ্য দেখা যায়। ফল প্রকাশের দিন জিপিএ ৫ পেয়ে মাকে জড়িয়ে কান্নার দৃশ্যও উঠে আসছে পত্রিকার পাতায়। আমাদের নিজের জীবনেও এমন ঘটনা হয়তো অনুপস্থিত নয়।
এই যেমন মন ভাঙায় বেশ কয়েকবারই কেঁদেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তাহুরা তাবাসসুম (২৩)। কখনো খুশি, আবার কখনো হতাশা থেকে তাঁর অশ্রু ঝরেছে। তবে কান্না তাঁর মনের নেতিবাচকতা দূর করে মন ফ্রেশ করেছে; সুন্দর করে নতুন চিন্তা করতে সহায়তা করেছে।
আবার একাকীত্ব বা দুর্ভাবনাও হতে পারে কান্নার কারণ। নতুন চাকরির দ্বিতীয় মাসে করোনা আক্রান্ত হন নাবিউল বাপ্পি (২৮)। কিছুদিন আগে পিতৃবিয়োগ, অফিসে যেতে না পারা, অসুস্থতা, ঘর থেকে বের হতে না পারা মিলে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কান্না চলে আসে। কান্না শেষে হাত–মুখ ধুয়ে এলে নিজেকে ভারমুক্ত মনে হয়েছে বলে তিনি জানান।
আবার অন্যের জন্য নয়, মেহেরুন নাহার মেঘলা (২৫) কাঁদেন একান্তই নিজের জন্য। এতে চাপ কমে, চোখ পরিষ্কার হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কান্না পেলে কাঁদাই উপকারী বলে মনে করেন এ তরুণী। আর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আসমা ইসলাম (২৪) কাঁদেন রাগ, অভিমান, দুঃসংবাদের জেরে। বললেন, `কান্না আমাকে মানসিক স্থিতিশীলতা দিয়েছে, ভারাক্রান্ত মনে স্বস্তি জুগিয়েছে, সহজে কষ্ট ভুলতে সহায়তা করেছে।’
মূলত মনের ভাব প্রকাশের জন্যই মানুষ কাঁদে। পরিস্থিতি অনুযায়ী অনেক সময় অনিচ্ছায়ও কান্না চলে আসে। হেলথলাইন ডটকমে কান্নার ছয়টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে—
* অন্যের সহায়তা পেতে কান্না বেশ সহায়ক। ২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়—কেঁদে সাহায্য চাওয়া লোকেদের সাহায্য পাওয়ার হার বেশি।
* রোগের যন্ত্রণা কমাতে কান্না সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, কান্নায় শরীরে এন্ডোরফিনস ও অক্সিটোসিন নিঃসৃত হয়। এসব উপাদান মানসিক কষ্টের পাশাপাশি শারীরিক কষ্ট দূর করতে সহায়তা করে। দীর্ঘস্থায়ী ও সাময়িক রোগের যন্ত্রণায় কান্না সাময়িক স্বস্তি দেয়।
* সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা আছে। একজনকে কাঁদতে দেখলে অনেকে তার পাশে দাঁড়ায়; কান্নার কারণ জানতে চায়। এতে সমাজের মানুষের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
* কোনো অনুভূতি চরম আকার ধারণ করলে, তা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ কাঁদে। দুঃখ, অপরাধবোধ, উদ্বেগ, প্রেম, আনন্দ, কৃতজ্ঞতার মতো বহু আবেগ এমন চরম আকার ধারণ করতে পারে।
* মানুষ অনেক সময় অন্যের অনুভূতির সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। একে সহানুভূতি, সমানুভূতি বলা যায়। এ ধারণার মূল কথা হলো অন্যের পরিস্থিতি দেখে বা ওই পরিস্থিতিতে নিজেকে চিন্তা করেও কান্না আসতে পারে। মৃতের বাড়িতে প্রতিবেশীর কান্না এর একটি উদাহরণ।
* দাবি আদায়ের জন্য অনেকে কাঁদেন। পরিবারের সদস্যদের অনেক দাবি সহজে পূরণ না হলে কেঁদে দাবি আদায়, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জনগণের কাছে কান্নাবিজড়িত আহ্বান, সৃষ্টিকর্তার কাছে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে অপরাধের ক্ষমা ও নতুন কিছু চাওয়া এর উদাহরণ। ‘না কাঁদলে মা–ও দুধ দেয় না’ তো প্রবাদই হয়ে গেছে।
কান্নাতন্ত্র
পুরুষতান্ত্রিক দেশে পুরুষদের ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়—কান্না পুরুষের জন্য নয়। ছেলেরা আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে ‘এটুকু ব্যাথায় পুরুষ মানুষের কী হয়’, বলে কান্না থামানোর রেওয়াজও বেশ প্রচলিত। ছোটবেলা থেকে এই ধারণা মনে গেঁথে যাওয়ায় পরবর্তী জীবনেও এর প্রভাব থাকে। হয়তো তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া কর্তাকেও কাঁদতে দেখা যায় না।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, দরিদ্র দেশের তুলনায় ধনী দেশের লোকেদের কান্নার প্রবণতা বেশি। এর পেছনেও আছে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা। ধনী দেশের চেয়ে দরিদ্র দেশের নাগরিকেরা সহজেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে বলে এমন হয়।
কান্না কি শেখানোর বিষয়?
২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার এক ভিডিও প্রতিবেদনে দেখানো হয়, প্রথাগতভাবে জাপানিদের কান্না নিষিদ্ধ। ছোটবেলা থেকে তাদের না কাঁদতে শেখানো হয়। এটি হয়তো শ্রেষ্ঠত্বের ধারণারই প্রতীক। কিন্তু দেশটির মনোবিদ ও কান্নার প্রশিক্ষক (ক্রায়িং থেরাপিস্ট) হিদেফুমি ইওশিদা মনে করেন, এটা ঠিক নয়। তাঁর মতে, না কাঁদতে পারাটা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কান্না মানুষকে চাপা যন্ত্রণা থেকে সান্ত্বনা দেয়, মন ভালো করে। মানুষের যত অনুভূতি আছে, তার মধ্যে কান্না আসল সত্তাকে বের করে আনে। তাই মানুষকে কান্না করা শেখাতে সেমিনার করছেন ইওশিদা। গত আট বছরে তাঁর প্রচেষ্টায় প্রায় ৫০ হাজার লোকের চোখে পানি এসেছে। মানুষকে কাঁদাতে তিনি সিনেমা, প্রাকৃতিক দৃশ্য, চিঠি ও বই ব্যবহার করেন।
কান্না পেলে কাঁদুন
আবেগ ও ভালো থাকা নিয়ে গবেষণা করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন নেদারল্যান্ডসের টিলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিঞ্জারহয়েটস। তাঁর মতে, সাধারণভাবে অনেক মনোবিদই মনে করেন কান্না দমিয়ে রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন, ‘বেশির ভাগ লোকই মনে করেন কান্না মনকে হালকা করে। তবে কারও কাছে তাঁর সর্বশেষ কান্নার কারণ জানতে চাইলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মন খারাপ হয়ে যায়।’
বাঘ, সিংহ, হাতি, সাম্বার হরিণ, জলহস্তী, মায়া হরিণ, চিত্রা হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, ভালুক, নীলগাই, গয়াল, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণী অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরাপদে এই দৃশ্য দেখা যায় আমাদের দেশে। আর দেখতে হলে এক দিনের জন্য ঘুরে আসা যাবে গাজীপুর সাফারি পার্ক।
৯ ঘণ্টা আগেআধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেল ঝকমকে শহর সৌদি আরবের জেদ্দা। এ শহরে পুরোনো ইতিহাসের স্বাদ নিতে যেতে হবে আল-বালাদ। শত শত বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে শহরটি। সময়ের সঙ্গে আধুনিকায়নের ঢেউ এলেও এলাকাটি এখনো ধরে রেখেছে অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য।
৯ ঘণ্টা আগেঅনেক বছর পর অবশেষে বিদেশি পর্যটকদের জন্য সীমান্ত খুলতে যাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশটি বিদেশিদের জন্য সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দিয়েছিল। তবে উত্তর কোরিয়া কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা এখন পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
১০ ঘণ্টা আগেজেন-জির ভ্রমণের অভ্যাস কিছুটা ভিন্ন। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ট্রাভেল এজেন্সি ‘আগোডা’ তাদের একটি জরিপ প্রকাশ করে জেন-জির পাঁচটি ভ্রমণ বৈশিষ্ট্য জানিয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে