Ajker Patrika

গুগলে চাকরি পাওয়ার পেছনে

ড. কিশোয়ার শাফিন
আপডেট : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৪: ৫০
Thumbnail image

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী টেকজায়ান্ট কোম্পানি হলো গুগল। সম্প্রতি সেখানে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ড. কিশোয়ার শাফিন। গত মার্চে তিনি গুগলের যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার কার্যালয়ে যোগ দেন। যেভাবে এই পথচলা তা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন।

আমি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছি। কম্পিউটার সায়েন্স পড়ার আগ্রহ থেকে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ভর্তি হই। পরে এমআইএসটিতে লেকচারার হিসেবে যোগদান করি। আমি পড়াশোনা ও শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রোগ্রামিং ও গবেষণায় আগ্রহী ছিলাম। ২০১৬ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, শান্তা ক্রুজে বায়োমোলিকুলার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োইনফরমেটিকসে পিএইচডি করতে আসি। মূলত গবেষণার প্রতি আগ্রহ থেকেই গুগলের ইন্টারভিউয়ের পর আমাকে যখন রিসার্চ সায়েন্টিস্ট অথবা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের পজিশনে আবেদন করতে বলা হয়, আমি রিসার্চ সায়েন্টিস্ট নির্বাচন করি। 

যেভাবে গুগলে পথচলার শুরু 
আমার পিএইচডির মূল গবেষণার বিষয় ছিল ডিপ লার্নিংয়ের সাহায্যে জিনোম সিকোয়েন্সিং টেকনোলজির অ্যানালাইসিসের ওপর। গবেষণার বিষয়টি বেশ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় অনেকগুলো কোলাবরেশনের সুযোগ পাই। আমার একটি গবেষণাপত্র Nature Biotechnology, একটি গুগলের দলের সঙ্গে Nature Methods এবং আরও একটি New England Journal of Medicine-এ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া যে গবেষণা দলটি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি মানব জিনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স Science জার্নালের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশ করে, আমি সেই দলের সদস্য। এই বিষয়ের অর্জনগুলো TIME 100 most influencal people of 2022, নেচার "seven technologies to watch in 2022 ", গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে জায়গা করে নেয়। ২০২১ সালে গুগল ও NVIDIAতে দুটো ইন্টার্নশিপ করি এবং দুটো থেকেই ফুলটাইম অফার পাই। আমার গবেষণার বিষয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে গুগলের কাজে মিল থাকায় আমি গুগলে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিই। 

গুগলে রিসার্চ সায়েন্টিস্টের কাজ 
গুগল মূলত প্রতিষ্ঠিত এবং পরীক্ষিত গবেষকদের রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকে। যেকোনো দলেই রিসার্চ সায়েন্টিস্টদের গবেষণা এবং ডেটা অ্যানালাইসিস করার দক্ষতা দেখে নিয়োগ দেওয়া হয়।

তবে গুগলে অনেক ক্ষেত্রেই রিসার্চ সায়েন্টিস্ট ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের কাজে তেমন পার্থক্য নেই। আমাদের দলের আমি একমাত্র রিসার্চ সায়েন্টিস্ট। প্রতিদিন অন্য সবার মতোই ৬০-৭০ শতাংশ সময় কোড লিখতে, ২০-৩০ শতাংশ সময় কোড রিভিউ করতে চলে যায়। মূল পার্থক্যটা আসলে গবেষণার গতিপথ নির্ধারণ ও প্রকাশনায়। রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে দলের প্রজেক্টগুলোর প্রসার এবং নতুন গবেষণার গতিপথ নির্ধারণ করা আমার দায়িত্ব। 

ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা
গুগলের সঙ্গে আমার কাজের শুরু ইন্টার্নশিপের মাধ্যমে। ইন্টার্নশিপের শেষে আমি ফুলটাইম রিসার্চ সায়েন্টিস্ট পজিশনের জন্য আবেদন করি, যেখানে আমাকে দুই রাউন্ডে মোট ছয়টি ইন্টারভিউ দিতে হয়। 

প্রথম ধাপ
ইন্টারভিউ শুরু হয় একটি এক ঘণ্টার প্রেজেন্টেশন দিয়ে। যেখানে আপনার গবেষণা থেকে চার-পাঁচটা বিষয়ের একটি বেছে, সেটার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে টেকনিক্যালি শক্তিশালী টপিকগুলো বাছাই করলে ভালো হয়। প্রেজেন্টেশনের পর দুটো রিসার্চ এবং দুটো প্রোগ্রামিং ইন্টারভিউ হয়।

রিসার্চ ইন্টারভিউ
গবেষণার বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করা হয়, বিশেষ করে ডিপ লার্নিং এবং জিনোমিকসের নানা সমস্যা সমাধান নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। প্রতিটি রিসার্চ ইন্টারভিউয়েই ডিপ লার্নিং অথবা জিনোমিকসের বেসিক প্রশ্ন করা হয় যেন গবেষণার বিষয়ে দক্ষতা কতটা তা যাচাই করা যায়। 

প্রোগ্রামিং ইন্টারভিউ 
এখানে দুই-তিনটি প্রোগ্রামিংয়ের সমস্যা সমাধান করতে দেওয়া হয়। এই ইন্টারভিউয়ে সাধারণ প্রোগ্রামিং দক্ষতা, ডেটা স্ট্রাকচার, ডায়নামিক প্রোগ্রামিং ইত্যাদির পরীক্ষা নেওয়া হয়। তা ছাড়া সমাধান কীভাবে করা যায় এবং কোড টেস্টিং নিয়েও কিছু প্রশ্ন করা হয়। 

শেষ ধাপ
প্রথম চারটি ইন্টারভিউয়ের দুই সপ্তাহ পর একটি কোডিং ও একটি রিসার্চ ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়। এবারের রিসার্চ ইন্টারভিউটি বেশ অ্যাডভান্সড ছিল, ভবিষ্যতে গবেষণাকে কীভাবে উন্নত করা যায় তা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। কোডিং ইন্টারভিউয়ে এজ কেসেস ছিল, যেগুলো পুরোপুরি বের করতে হয়েছিল। মোট ছয়টি ইন্টারভিউ ও একটি প্রেজেন্টেশনের দুই সপ্তাহ পরে আমি ফুলটাইম অফার পাই। এরপর গুগলের জিনোমিকস দলের লিডের সঙ্গে কথা বলে আমার দায়িত্ব এবং পরিকল্পনার সঙ্গে দলের কতটা মিল আছে, সেটা জানার চেষ্টা করি এবং পাশাপাশি রিক্রুটারের সঙ্গে অফার নেগোশিয়েট করি। 

বাংলাদেশ থেকে সরাসরি নিয়োগ
যেহেতু বাংলাদেশ থেকে সরাসরি গুগলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অনেকেই প্রতিনিয়ত যোগদান করছেন, তাই নিজেকে গবেষক হিসেবে ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারা এটা অসম্ভব না। অনেক ক্ষেত্রে চাকরিবিষয়ক ওয়েবসাইট LinkedIn থেকে গুগলের রিক্রুটারদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে অ্যাপ্রোচ করলে উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গুগলের কোনো দলের কাজের সঙ্গে যদি আপনার কাজ ও যোগ্যতা পুরোপুরি মিলে যায়, তাহলে সেই দলের একজন মেম্বারকে অ্যাপ্রোচ করা যেতে পারে সরাসরি ই-মেইল বা LinkedIn থেকে। কিন্তু তার আগে অবশ্যই কাজের মিল খুঁজে বের করা উচিত। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জানার জন্য সব থেকে ভালো উপায় হলো গুগলের ওয়েবসাইট https://careers.google.com

যেসব দক্ষতা অর্জন জরুরি
গবেষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে কীভাবে গবেষণাপত্র লিখতে হয় এবং লিটারেচর রিভিউ করতে হয়, সেটা নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। টেকনিক্যাল স্কিল ডেভেলপ করার জন্য প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার পাশাপাশি একটি ভালো উপায় হলো বড় কোনো প্রজেক্টে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করা। পরিসংখ্যান, প্রোবাবিলিটির ওপর দক্ষতা থাকলে সব ক্ষেত্রেই সেটার সুফল পাবেন। সফট স্কিল যেমন কমিউনিকেশন, টিম প্লেয়ার, পারস্পরিক সম্মানবোধ ভালোভাবে পরিচর্যা করা উচিত। মনে রাখবেন, আপনি যেখানে কাজ করেন, সেখানে কেউ আপনার প্রতিযোগী নয়। বড় কোম্পানিগুলোতে এটাকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়।

আত্মবিশ্বাস রাখুন
যখন আপনি কোনো দায়িত্ব বা সুযোগ পাবেন, সেটার সদ্ব্যবহার এবং সুযোগটিকে সম্মান করতে হবে। আপনাকে কোনো দায়িত্ব দিলে মনে রাখবেন সদস্যরা আপনার ওপর নির্ভর করছেন। এ ক্ষেত্রে আপনি কোন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেটা বুঝিয়ে বলা এবং প্রয়োজনে সাহায্য চাইলে সবাই বিষয়টি নিয়ে অবগত থাকতে পারেন। বড় কোলাবরেশনে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা আপনাকে কাজ দিয়ে তার অগ্রগতি জানা কঠিন হলে আপনার ওপর নির্ভরশীলতা কমে যায়। কখনো যদি মনে হয় আপনার কোনো একটি বিষয়ে দুর্বলতা কাটানো প্রয়োজন তাহলে মনে রাখবেন কখনোই ‘অনেক দেরি’ হয়ে যায়নি। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রেখে চেষ্টা ও সঠিক গাইডলাইনের মাধ্যমে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

অনুলিখন: সাদিয়া আফরিন হীরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত